আজ সন্ধ্যেটা বেশ সুন্দর। বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে। আর মাঝে মাঝেই মেঘ ডেকে জানান দিয়ে যাচ্ছে এ বৃষ্টি এখন থামবার নয়! লোডশেডিং হয়ে গেছে একটু আগেই। একটা বড় মোমবাতির আলোয় ক্লাবের ভেতর টা কিছুটা আর বাইরে টা আলোকিত হয়েছে। যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্লাবে এসেছিলাম তখন আকাশ পরিষ্কারই ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল না যে আজ বৃষ্টি হতে পারে। ক্লাবে আজ তেমন কেউ আসে নি। প্রানেশ্বর আমাদের ক্লাবের ঠিক বাইরের দুয়ার টাতেই একটা চায়ের দোকান খুলেছে। রোজ সন্ধ্যেবেলা ও এখানে বসে। আমাদের ক্লাবের সদস্যরা তো চা খায়ই। আরও অনেকেই এই মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর দোকানে চা খেয়ে যায়! আজ ও ও দেখলাম আস্তে আস্তে সব গুছোচ্ছে!

আমি ওকে বললাম, “কীরে? তুই চলে যাবি নাকি?”

প্রানেশ্বর বলল, “কী করব অমিত দা! কেউ তো মনে হয় না আজ আর আসবে! শুধু শুধু বসে থেকে কী করব!”

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম! হঠাৎ দেখলাম এই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ২ টো ছায়ামূর্তি ছাতা মাথায় দিয়ে দৌড়ে এসে ক্লাবের শেড এর তলায় আশ্রয় নিল! ছাতা বন্ধ করার পর দেখি সুমন আর দীপেন্দু! অবাক হয়ে বললাম, “কীরে? এই বৃষ্টির মধ্যে এলি? আমি ভাবলাম আজ আর আসবি না!”

দীপেন্দু ছাতাটা ক্লাবের দুয়ারে মেলতে মেলতে বলল, “আরে ধুর! রাস্তায় বেরোনোর পর দেখি বৃষ্টি! আবার এ ফিরে যাবে!”

সুমন বলল, “সেম সেম! মাঝ রাস্তায় এসে গেছি, তারপরেই বৃষ্টি। ভাগ্যিস ছাতা ছিল!… ইয়ে প্রানেশ্বর দা চার কাপ চা করো না!”

প্রানেশ্বর দা অবাক হয়ে বলল, “চার কাপ?”

সুমন বলল, “হ্যাঁ ওই অভিপ্রেত আসবে বলল তো!”

অভিপ্রেত ক্লাবের পাশেই থাকে। ওর সাথে আমাদের আলাপ হয়েছে গত বছর ডিসেম্বর মাসে। ও এলেই ভূতের গল্পে একদম আসর জমিয়ে দিতে পারে! তবে ওর একটা বিশেষত্ব আছে। বেশী লোক থাকলে ও খুব একটা নিজের গল্প বলে না! আজ এই বৃষ্টিতে আর কেউ আসে নি! মনেও হয় না আর কেউ  আসবে বলে! কাজেই আজ অভিপ্রেত এর কাছ থেকে ভালো গল্প শোনা যেতে পারে এই আশায় মনে মনে বেশ প্রফুল্ল হলুম! এদিকে দীপেন্দুর মুখ ভার হয়ে গেল! প্রত্যেকটা গ্রুপেই এরকম একজন থাকে যে ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে থাকে! দীপেন্দু হল সেরকম! অভিপ্রেত আসবে শুনে দীপেন্দু বলল, “আরে এই মালটা আবার আজ আসবে? তার মানে আবার ভূতের গল্প করবে!”

সুমন বলল, “ধুর! ভূত ভূত কিছু না! ওসব গাঁজা!”

আমি বললাম, “সে ভূত হোক বা না হোক, বেশ একটা রোমাঞ্চ হয় কিন্তু!”

সুমন বলল, “সে হয়! কিন্তু মাঝে মাঝে এত ঢপ দেয়! নেওয়া যায় না!”

“কে ঢপ দেয়?”

কথাটা বলেছে অভিপ্রেত, ক্লাবের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে! হাতে ছাতা না দেখে আমি বললাম, “কী গো? তোমার ছাতা কই?”

অভিপ্রেত বলল, “ধুস! ছাতা কীসের জন্য লাগবে! বৃষ্টির জল আমার গায়ে লাগে না!”

সুমন বলল, “ফালতু ঢপ দিও না। থাকো তো ক্লাবের পাশেই এই বাড়িতে! তোমার আবার ছাতার দরকার কেন হবে? এইটুকু আসবে!”

অভিপ্রেত হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “মুড খারাপ নাকি? এরকম খিটখিট করছ কেন?”

সুমন বলল, “কই খিটখিট করলাম! এমনিই বলছি আর কী!”

আমি বললাম, “আজ একটা গল্প হোক না! অনেকদিন তো হয় নি!”

দীপেন্দু সাথে সাথে বলল, “আবার ভূতের গল্প?”

অভিপ্রেত বলল, “না না! আজ ভূতের গল্প না! আজ আমার ফ্যামিলি তে ঘটা একটা ঘটনা বলব!”

“যাক! তাও ভালো!” দীপেন্দু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো!

প্রানেশ্বর দা এই সময় চা দিয়ে গেল চার কাপ! গরম চায়ে চুমুক দিয়ে অভিপ্রেত বলল, “ভূতের গল্প না! তবে আজ বলব ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষার গল্প!”

দীপেন্দু আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল! সুমন ওকে থামিয়ে বলল, “তোমার ফ্যামিলির গল্প আবার ভ্যাম্পায়ারের গল্প!! ২ টো কী করে একসাথে সম্ভব? তোমার ফ্যামিলি কি ট্র্যানসিলভ্যানিয়াতে থাকত নাকি!!”

অভিপ্রেত বলল, “সেটা তো না শুনলে জানা যাবে না ভায়া! শুনতে চাইলে শোনাতে পারি!”

আমি বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ! একদম শুনতে চাই! তুমি শুরু করো!”

বাইরে বৃষ্টির জোর আরও বাড়ল। খুব কাছেই কোথায় একটা যেন বাজ পড়ল। অভিপ্রেত আবার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল…

আমমাদের পরিবারটা চিরকালই খুব অদ্ভুত! আমার ঠাকুরদা ছিলেন বাঙালী আবার আমার ঠাকুমা ছিলেন একজন ব্রিটিশ! ঠাকুমার দিকের অবশ্য কেউই ছিল না! একটা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। শুনেছিলাম যখন তিনি এ দেশে আসেন তখন তার ২১ বছর বয়স। আর আমার দাদু যখন ঠাকুমা কে বিয়ে করেন তখন তার (দাদুর) বয়স ২৭। সে অবশ্য অনেক বছর আগের কথা। স্বাধীনতার অনেক আগে।

তবে এখন যে ঘটনাটার কথা বলছি। সেটা ২০১৮ সালের কথা। জানি না কেউ বিশ্বাস করবে কিনা! এখন যখন পুরোনো কথা মনে পড়ে, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না! জানি না কেউ বিশ্বাস করবে কিনা! এখন যখন পুরোনো কথা মনে পড়ে, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না! তখন আমার বয়স ২৯। মানে যে বয়সে বিয়ে না করলে মা প্রায় পাগলের মত হয়ে যায়, সেই বয়স! কোনোরকমে ঠেকিয়ে রেখেছি কাজের দোহাই দিয়ে। আর তখন আমার ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে বেশ কাজের চাপ চলছে। আর আমি আমার কাজের সূত্রে থাকি কলকাতায়। মাও আমার সাথেই থাকে। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি আর মা সবে একটু গুছিয়ে উঠেছি সবটা। এর মাঝে একটা উটকো ঝামেলা উদয় হল।

মুর্শিদাবাদের যে প্রত্যন্ত গ্রামে আমার দেশের বাড়ি, সেখানে বহুদিন হল কেউ থাকে না! শুধু যোহান থাকে। সেও ঠাকুমার সাথেই এসেছিল এদেশে। খুব কম বয়সে! ওর আসল নাম অন্য কিছু একটা ছিল। কিন্তু দাদু ওকে ওই নামেই ডাকত। আমাদের বাড়িতেই রয়ে যায়। তো সেই দোতলা বাড়ি ভেঙে একটা স্কুল হওয়ার কথা অনেকদিনেরইই। বছর ২০ আগে বাবা কলকাতায় একটা বাড়ি কিনে উইল করে গ্রামের বাড়িটা একটা মিশনারী ট্রাস্ট কে দিয়ে গেছে। ঠাকুমার নাকি সেরকমই ইচ্ছে ছিল। এবার টেলিগ্রাম এল সেই বাড়ি ভাঙা হবে ২ দিন পর থেকে। বলা হল আমরা যেন তাড়াতাড়ি বাকি যা জিনিসপত্র আছে সেগুলো নিয়ে চলে আসি! অগত্যা ছুটি নিতেই হল।

গাড়ি নিয়ে যখন রায়দীঘিতে পৌঁছোলাম, তখন প্রায় বিকেল। মাও এসেছে আমার সাথে। আমি বলেছিলাম দরকার নেই, মা বললো, “তুই একা পারবি না! অনেক জিনিস আছে। তার মধ্যে যেগুলো কাজে লাগবে সেগুলো নিতে হবে!”

আমি আর আপত্তি করিনি! মা থাকলে সত্যিই সব কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়!

পৌঁছোনোর পরেই যোহান  বেরিয়ে এল! ওকে এর আগে মা অনেকবার নিয়ে যেতে চেয়েছে কলকাতায়! ও কিছুতেই যাবে না! ওর এই অজ পাড়াগাঁই পছন্দ! যোহান আমাদের দেখে খুব খুশি হল বোঝাই গেল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকলাম!

মা বলল, “কি যোহান! এতদিন ধরে তো ঠেকিয়ে রাখলে! এবার তো যেতেই হবে কলকাতা! উপায় তো নেই!”

যোহান হেসে বলল, “আমার বডি হয়ত চলে যাবে! কিন্তু মাইন্ড তো যাবে না মেমসাব!”

যোহানের কথাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত লাগে শুনতে! আমরা সবাই যোহানকে নাম ধরে ডাকি। আর যোহান মাকে ডাকে মেমসাব বলে আর আমাকে বলে ‘ছোটোসায়েব’! ওর বয়স এখন অনেক। বোধহয় ৭৫ এর আশেপাশে! অনেক ছোটোবেলায় এসেছে বলেই বাংলাটা মোটামুটি বলতে পারে ও। তবে মাঝে মাঝেই শব্দ খুঁজতে আটকে যায়! একটু ভাঙা ভাঙা বাংলা এই আর কি!

মা হাসল! পুরো সন্ধ্যেবেলাটা কোন জিনিসটা নেবো আর কোন জিনিসটা নেবো না সেটা বাছতে বাছতেই কেটে গেল! যোহানের রান্নার হাত খুব ভালো। বললেই বলে এটা নাকি ওর বাবার থেকে পাওয়া। ওর বাবা রোমানিয়ার একটা সরাইখানা তে রান্না করত! শুনলেই কেন জানিনা ওখানকার গল্প শুনতে ইচ্ছে করত। সরাইখানা বিষয়টা এখন উঠেই গেছে প্রায়। এখন তো এখানে সেখানে বড় বড় হোটেল গজিয়ে উঠছে। আর আজকাল এত সহজে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়, যে সরাইখানার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

রাত্রে যখন শুতে এলাম তখন বাজে সাড়ে ১০ টা। গ্রামের দিকে ৯ টা বাজলেই যেন মনে হয় অনেক বেজে গেছে! সব কীরকম নিস্তব্ধ হয়ে যায়! দাদুর এই ঘরটার সাথে একটা বারান্দাও আছে। সেখানে দাঁড়ালাম কিছুক্ষন! বেশ সুন্দর একটা হাওয়া দিচ্ছে! নভেম্বর মাস। শীত পড়বে পড়বে একটা ভাব আছে যদিও। কিন্তু এখনও জাঁকিয়ে পড়তে পারেনি! এমন সময় পেছনে একটা পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালাম।

যোহান দাঁড়িয়ে।

আমি বললাম, “বলো যোহান! কী ব্যাপার?”

যোহান বলল, “ছোটোসায়েব ওখানে দাঁড়াবেন না! ঘরের ভেতর চলে আসুন!”

আমি বললাম, “বারান্দায় দাঁড়াবো না! কেন?

যোহান একটু ইতস্তত করে বলল,  “সাপ-টাপ থাকতে পারে! আসলে রুমস তো সব খালি পড়ে আছে বহুদিন ধরে!”

আমি হেসে বললাম, “ধুর! এই ভর সন্ধ্যেবেলা দোতলা বাড়িতে সাপ কোত্থেকে আসবে! কিছু হবে না!”

যোহান বলল, “শুধু সাপ না ছোটোসায়েব!”

– তাহলে?

– খুব বাদুড় হয়েছে রিসেন্টলি! ঘরের মধ্যে যদি ঢুকে যায় সারা রাত ঘুমোতে পারবেন না!”

– বাদুড়??

– হ্যাঁ! হঠাৎ করেই দেখছি বাদুড় খুব বেড়ে গেছে! আপনি… বারান্দার দরজা টা বন্ধ করে দিন ছোটোসায়েব!

কী করি! অগত্যা! বন্ধ করতে হল দরজা! রাত্রেবেলা ঘরের মধ্যে বাদুড় কে চায়! যাই হোক, বারান্দার দরজা বন্ধ করছি দেখে যোহান আর কিছু না বলে চলে গেল!

আমি শুয়ে পড়লাম! শুয়ে শুয়ে বাইরে টা দেখছিলাম। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। রায়দীঘির সব রাস্তায় এখন স্ট্রিট লাইট পৌঁছোয় নি! বাইরের সুন্দর হাওয়াটা মাঝে মাঝেই ঘরের মধ্যে আসছিল! এর মধ্যে কখন যে ঘুম ধরে গেছে বুঝতে পারিনি! ঘুম টা ভাঙল অনেক রাত্রে! লোডশেডিং হয়ে গেছে। পাখা বন্ধ! হাওয়াটাও তেমন দিচ্ছে না! পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি হঠাৎ দেখলাম বিছানার ঠিক সামনে কেউ যেন একটা দাঁড়িয়ে! বুকটা কেঁপে উঠেছিল মুহুর্তের জন্যে! সাথে সাথে চমকে বিছানায় সোজা হয়ে বসে দেখি… সামনে কেউ নেই… শুধু জানলার পাশের বড় গাছ আর চাঁদের আলোর সংমিশ্রনে যে অবয়ব তৈরী হয়েছিল, সেটা দেখেই মনে হচ্ছিল কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে! কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম!

সকালে উঠেই তাড়াতাড়ি বেরোনোর কথা ছিল। আমাকে ফিরতে হবে। অফিস আছে। এদিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি আরেক বিপত্তি। মা ক্রমাগত ফোনটা নিয়ে কাকে যেন ফোন করে যাচ্ছে।  আমি চোখ ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করলাম,  “কি হয়েছে?  কাকে ফোন করছ?”

মা বললো,  “দেখ না!  সকাল থেকে ল!”

বিজয় আমাদের ড্রাইভার। আমাদের বললে ভুল হবে। কলকাতার একটা সেন্টার থেকে ড্রাইভার ভাড়া করে আমি নিয়ে এসেছি।  ওর নামই বিজয়। ও কাল রাত্রে নিজের ঘরেই শুয়ে ছিল।  কিন্তু সকালে উঠে গেল কোথায়।

আমি মাকে বললাম, “দাঁড়াও চিন্তা করোনা! নিশ্চয়ই কাছেপিঠে কোথাও আছে!  আমি ব্রাশ করে একবার বেরোচ্ছি.. দেখছি!”

মা কিছু বলল না।  রান্নাঘরে চলে গেল।  আমি ব্রাশ করে বেরোতে যাচ্ছি হঠাৎ জোহান বলল, “আমি কাল ওকে বারণ করেছিলাম বাইরে যেতে!”

ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “কাকে বারণ করেছিলে?”

– বিজয়কে।  বলেছিলাম যেন গেটের বাইরে না বেরোয় রাত্রে। ও বারবার বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল সিগারেট খেতে!

– সে যদি একটু সিগারেট খেতে বাইরে যায়, তাতে সমস্যা কী?

– ওই যে বললাম..  বাদুড়.. বাদুড়ের প্রকোপ খুব বেড়েছে এখানে!

আমি বললাম, “ধুর!  রাখো তো তোমার বাদুড়! আমি দেখি বিজয় কোথায় গেল”

কথাটা বলেই আমি নেমে এলাম ওপর থেকে। বাইরে বেরোতে যাব এমন সময় একটা আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালাম।  ফোন বাজছে। নিচের ঘরে ঢুকে দেখি বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটার উপর একটা ফোন বেজে চলেছে! স্ক্রিনে দেখতে পেলাম মায়ের নাম্বার।  অর্থাৎ এটা বিজয়ের ফোন। মা উপর থেকে ওকে বারবার ফোন করছে কিন্তু একবারও পাচ্ছে না তার কারণ ও নিজের ফোনটা রেখেই কোথাও একটা বেরিয়েছে!

বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছি, বিজয়কে খুঁজছি হঠাৎ পেছন থেকে “আরে অভি না?” শুনে ফিরে তাকালাম।  দেখলাম  পাশের বাড়ির এক কাকিমা  দাঁড়িয়ে! রেশমার মা! রেশমা আমার ছোটবেলার খেলার বন্ধু। প্রাইমারি স্কুলেও বোধহয় একসাথেই পড়েছি দুজনে!

আমি নমস্কার করে বললাম, “কেমন আছেন কাকিমা?”

কাকিমা বলল,  “ভালো আছি বাবা!  তুই কবে এলি?  মা কেমন আছে? ”

বললাম,  “মা ভালো আছে গো। আমরা কাল এসেছি। রেশমা কেমন আছে?”

– ভালো আছে রে! তবে এখন তো ওর ওই বাড়ি থেকে কাজ! রাত্রের শিফট! খুব খাটনি যাচ্ছে বেচারির! দেখলেই মনে হয় যেন শুকিয়ে যাচ্ছে!

– ওহ! ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করতে বল। আচ্ছা দাঁড়াও আমি ফোন করবো ওকে!

– হ্যাঁ করিস। তবে এখন করিস না। ও শিফট শেষ করে সবে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছে।

– হ্যাঁ সে ঠিক আছে। আমি এখন যাই বুঝলে আমাদের ড্রাইভার টা সকালে কোথায় যে গেল ওকে খুঁজতেই বেরিয়েছি!

কাকিমা চলে গেলেন। আমি এগোলাম বিজয় কে খুঁজতে! একটু পরেই বিজয়ের দেখা মিলল! আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা চার্চ আছে। তার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে গোরস্থান এর দিকে। এখানে আগে শুনেছি অনেক মিশনারী রা থাকত! সেই রাস্তা দিয়েই ঘাড়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে বিজয়।

আমি ওকে দেখে বললাম, “কীগো? কোথায় গিয়েছিলে সকাল সকাল?”

বিজয় বলল, “আমি… মনে করতে পারছি না। কাল একবার সিগারেট খেতে বাইরে এসেছিলাম। ওই সামনের মোড়ে একটা চা দোকান দেখেছিলাম। ওখানেই। তারপর আর কিছু খেয়াল নেই! ঘুম ভাঙতে দেখি ওই দিকে একটা বটগাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

পরক্ষনেই আমার চোখ গেল ওর হাতের দিকে। ওর হাতটা এখনও ঘাড়ে! আমি বললাম, “ঘাড়ে কী হল?”

বিজয় বলল, “খুব ব্যাথা! সকাল থেকেই! বুঝতে পারছি না!”

– দেখি হাত সরাও তো!

বিজয় হাত সরাতে দেখলাম একটা ওর ঘাড়ে লাল দুটো দাগ। রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে আছে জায়গাটায়! বললাম, “গাছের তলায় ঘুমিয়েছো! কিছু বোধহয় কামড়েছে! লাল হয়ে আছে পুরো!”

“তাই হবে” বিজয়ের কথায় যেন ক্লান্তি স্পষ্ট!

বাড়ির দিকে হাঁটছি হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি বিজয় অনেকটা পেছনে! আমি বললাম, “কী হল?”

বিজয় হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আপনি এগোন। আসছি আমি। দুর্বল লাগছে শরীর টা!”

আমি বাড়ি পৌঁছোলাম। বিজয় এল আরও মিনিট খানেক পরে। ওপরে গিয়ে ব্যাগ গুছোচ্ছি! হঠাৎ যোহান এসে মাকে বলল, “বিজয়ের বোধহয় শরীর খারাপ! কিছু একটা হয়েছে!”

মা বলল, “এই রে! সে কী? আমরা ফিরব কী করে?”

আমি আর মা নেমে গেলাম বিজয় এর ঘরে। দেখলাম বিজয় শুয়ে আছে ঘরে! বললাম, “কী হল? শরীর খারাপ লাগছে?”

বিজয় কোনোমতে মাথা তুলে বলল, “বড্ড দুর্বল লাগছে শরীর টা। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে! আজ… যদি না যাওয়া হয়… তাহলে…”

মায়ের দিকে তাকালাম। বুঝতে পারলাম বিজয় কী বলতে চাইছে! আমরা আর কিছু না বলে ওপরে এলাম। মা বলল, “কী করবি?”

আমি বললাম, “কী করব আর? অফিসে ফোন করি! এভাবে তো আর যাওয়া যাবে না! রাস্তায় কিছু বিপদ হলে?”

মা বলল, “ভালোই হল! রেশমার মা এসেছিল। তুইও একবার দেখা করে নিস ওর সাথে! কতদিন পর এলাম বল!”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “হুম”

সন্ধ্যে বেলা রেশমার বাড়ি গেলাম। কাকিমা খুব খুশি হলেন। বললেন, যা যা ওপরে যা। ও ওর ঘরেই আছে। আমি চা আর নারকেল নাড়ু দিচ্ছি! গেলাম সে ঘরে। রেশমা দেখলাম ল্যাপটপে কী একটা করছিল! আমাকে দেখে হেসে বলল, “আরে! অভি!! আয় আয়!”

আমি রেশমাকে দেখে চমকে গেলাম! কি সুন্দর গোলগাল চেহারা ছিল ওর! আজ দেখছি ও যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখের তলায় কালি! আমি বললাম, “একি রে! তোর কী অবস্থা?”

রেশমা বলল, “খুব রোগা হয়ে গেছি না রে?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ রে! ভীষন চোখে লাগছে সেটা! খাওয়া দাওয়া করছিস না নাকি?”

–       না রে। করছি তো! তবে রুটিন টা এখন এমন ঘেঁটে আছে! তাই জন্যেই হয়ত…

–       হ্যাঁ। শুনলাম তোর নাকি নাইট শিফট…

–       হ্যাঁ। সে এক যা তা কাজ রে। রোজই কাজ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি, বুঝতেই পারি না!

–       এই কী করিস রে তুই?

–       ঐ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর গ্রাফিক ডিজাইনার আমি।

–       মাল্টিন্যাশন্যাল? মানে ইন্ডিয়ান কোম্পানী না?

–       না না! জার্মানী!

আমি হেসে বললাম, “তাহলে তো তুমি মালদার পার্টি ভায়া! ডলারে কামাস তো!”

রেশমা বলল, “ধুস পাগল! ওরম না!”

আমি বসলাম ওর পাশে। বললাম, “কিন্তু একটা কথা বল… গ্রাফিক ডিজাইনিং এ রাত্রে কেন কাজ করতে হয়!”

ও বলল, “আরে ক্লায়েন্ট রা সব তো বিদেশে। ওরা রাত্রেই অনলাইন হয়! মানে ওদের ওখানে দিন!”

–       আর তোকে কোনো অফিস যেতে হয় না?

–       নাহ রে। সব কাজ বাড়ি থেকে। তবে অফিসের একটা ব্র্যাঞ্চ এখানে ওরা খুলেছে এই মাস খানেক হল। ইনফ্যাক্ট আমাদের বস পিটার আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন! অফিসের কাজেই…

–       বিদেশী বস? বাবাহ!

–       আরে হ্যাঁ। তুই আবার কেন বলছিস, তোর বাড়িতে তো বিদেশী কেয়ারটেকার!

–       তাও ঠিক!

রেশমা কথা বলছিল। আমি ঘরের মধ্যে হেঁটে ওর বারান্দায় গেলাম। ওর এই বারান্দাটা দারুন সুন্দর! বারান্দার সাথেই লেগে আছে একটা বড় গাছের ডাল! আমার মনে আছে ছোটোবেলায় একবার ওর কোনো একটা ছেলে এই গাছের ডাল বেয়ে সন্ধ্যেবেলা ওর ঘরে এসে ওকে প্রোপোজ করেছিল। ও তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেছিল বাপরে! তারপর সেই ছেলেটার বাবা-মা কে ডাকা হয়! সবার সামনে বেশ চড় থাপ্পড় খায় সে! যাতা অবস্থা একেবারে!

রেশমা বলল, “তারপর? মা বলছিল তোদের নাকি আজ চলে যাওয়ার কথা ছিল?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। ড্রাইভারের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হল দেখ না!”

–       কী হল হঠাৎ?

–       জানি না! কিছু পোকায় কামড়েছে! গলায় দেখলাম দাগ!

“কী?” রেশমার গলায় ভয় এবং বিস্ময় দু’টোই!

আমি বললাম, “কী হল?”

রেশমা বলল, “গলায় দাগ? সত্যি?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। কেন?”

–       কীরকম দাগ?

–       কীরকম দাগ সেটা কী করে বলি বল তো! ছবি তো তুলিনি!

রেশমা হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে এসে নিজের ঘাড় টা আমার দিকে এগিয়ে বলল, “দেখ তো? এরকম দাগ?”

আমি চমকে গেলাম! ঠিক যেরকম দাগ, বিজয় এর গলা তে দেখেছিলাম, ঠিক সেরকম দাগ! আমি বললাম, “এ…এটা কীসের দাগ? তোকেও কামড়েছে?”

রেশমা বলল, “হুম! কীসের যে দাগ সেটাই বুঝতে পারছি না জানিস! কয়েক সপ্তাহ আগেই হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি গলায় প্রচন্ড ব্যাথা! তারপর দেখি এরকম দাগ! খুব দুর্বল লাগছিল জানিস!”

আমি বললাম, “বারান্দার এই দরজাটা খুলে রেখেছিলি নাকি?”

রেশমা বলল, “হ্যাঁ ওটা তো খোলাই থাকে। ভালো হাওয়া আসে!”

–       তাহলে তোর এই দরজা দিয়েই কোনো পোকা এসেছে। আর মনে হয় এই পোকাই বিজয় কেও কামড়ছে!”

রেশমা একটু ভেবে বলল, “তাই হবে হয়ত!”

সেদিন রেশমার সাথে অনেকক্ষন ছিলাম। কিন্তু জানিনা বারান্দায় দাঁড়ানোর পর থেকেই একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আড়াল থেকে আমাদের দেখছে! কেন এরকম মনে হচ্ছিল সেটা বলতে পারবো না! কিন্তু কিছুতেই এই অনুভূতিটা সরিয়ে ফেলতে পারছিলাম না! ওর বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম, তখন প্রায় ৯ টা বেজে গেছে! আসার সময় পেছন ফিরে দেখলাম রেশমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। পরমুহুর্তেই ওদের বাড়ির পাশের ওই গাছটার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, একটা বড় বাদুড় গাছ থেকে উলটো হয়ে ঝুলছে! চমকে গেলাম বাদুড়টার আকৃতি দেখে! এত বড় বাদুড় আমি আগে কখনও দেখেছি কী? আবার বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখলাম রেশমা নেই! ঘরের মধ্যে চলে গেছে!

ভ্যাম্পায়ার এন্ড কোং – প্রথম পর্ব

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি