ডিসেম্বরের সন্ধ্যে। ঠান্ডাটা বেশ ভালোই পড়েছে। শুধু স্লিভলেস একটা সোয়েটারেই হয়ে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম উপায় নেই। পথেই বাইক থামিয়ে ওপরে হুডি টা পরতেই হল। কলেজ থেকে বেরিয়েছি ৭ টায়। এখন ইউনিভার্সিটির মার্কস সাবমিট করতে হচ্ছে রোজ। সেই কারনেই বেরোতে দেরী হচ্ছে বেশ। সাধারনত কলেজ ৫ টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এখন প্রায় সাড়ে ৬ টা থেকে ৭ টা বাজছে রোজই।

আমার বাড়ি খড়গপুর। কলেজে পড়ানোর সূত্রে কলকাতায় থাকতে হয়। কিন্তু প্রত্যেক শনিবার হয় আমি বাড়ি ফিরি নাহয় আমার স্ত্রী কলকাতায় আসে। ও ওখানে একটা স্কুলে পড়ায় সেই কারনে একটানা একসাথে আমাদের সেভাবে থাকা হয় না।

সেদিনও শনিবার ছিল। কলেজ থেকে বেরিয়েই বাইক নিয়ে বাড়ির পথে এগোলাম। আগে ট্রেনেই যেতাম। কিন্তু ইদানীং রোজ দেরী হচ্ছে বলে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে ভরসা পাচ্ছি না। কলকাতার যানজট থেকে বেরিয়ে যখন ফাইনালি বোম্বে রোড এ পড়লাম তখন ৮ টা ১৫ বেজে গেছে। বোম্বে রোডে বাইক নিয়ে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে। বেশ ফ্রেশ লাগে। সিগন্যাল এর খুব একটা বালাই নেই। রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। আরামসে ৮০ অবধি স্পীড তোলা যায়।

আজকেও সেরকমই বোম্বে রোডে উঠেই স্পিডোমিটারের কাঁটা নিয়ে গেলাম ৭০ এ। ৮০ তে নিয়ে গেলাম না তার কারন হল ঠান্ডা। বড্ড হাওয়া দিচ্ছে। এই হাওয়াতে ঠান্ডা লাগলে আর দেখতে হবে না।

ধূলাগড় টোল ট্যাক্স টা পেরিয়েছে মিনিট ২০ হয়েছে। ঘড়ি বড়ছে ৯ টা ১০ তখন। রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ দেখলাম অনেকটা দূরে প্রচুর গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই রে! এখানে যদি জ্যাম এ আটকে যেতে হয় তাহলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ১১ টা পেরিয়ে যাবে। স্পীড তখন ৭৫ এর আশেপাশেই ছিল। কী করব ভাবছি। কারন জ্যামটা এখনও আমার থেকে ৭০০-৮০০ মিটার দূরে একটা ওভারব্রীজের ওপর। হঠাৎ খেয়াল হল একটু দূরেই ঠিক বাঁদিকে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। দেখে বুঝলাম এই রাস্তাটা গেছে ওভারব্রীজের ঠিক নীচ দিয়ে। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরেই মেইন রোডের সাথে আবার যুক্ত হয়ে যাবে। আর একটুও না ভেবে বাঁদিকের রাস্তায় ঢুকে গেলাম। রাস্তাটা অন্ধকার। হেডলাইটের আলোতেই যাওয়া যেত হয়ত। কিন্তু রাস্তায় ঢোকার পরেই যেটা ঘটল সেটার জন্য আমি একেবারে তৈরী ছিলাম না।

বাইকের স্পীড তখনও আমার ছিল ৭০। দিব্যি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ঐ সরু রাস্তার মাঝখানে কেউ একটা রয়্যাল এনফিল্ড এমনভাবে রেখেছে যে যাওয়ার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও যেটুকু আছে সেটা দিয়ে আমি বেরিয়ে যেতে পারব বুঝতে পেরেছিলাম। তাই স্পীড আমি কমালাম না। কিন্তু যেটা অন্ধকারের মধ্যে খেয়াল করিনি সেটা হল ওই রয়্যাল এনফিল্ডের ঠিক আগেই একটা বড় বাম্পার ছিল। সেটা খেয়াল করলাম একদম কাছে গিয়ে। তাড়াতাড়ি করে ব্রেক কষলাম। কিন্তু বাম্পারের ওপরে এবং আশে পাশে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল প্রচুর গোল গোল নুড়ি। ফলে যেটা আমার সাথে কখনও হয়নি হল সেটাই। বাইকের চাকা স্লিপ করে পড়লাম ঠিক ওখানেই। প্রচন্ড জোরে একটা আওয়াজ তার সাথে পায়ের ওপর বাইক টা পড়ায় যন্ত্রনায় একটা অস্ফূট আওয়াজ বেরোলো মুখ দিয়ে।

কয়েক মুহুর্ত বোধহয় ওভাবেই পড়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় আর একটা মানুষ নেই। কাজেই বাইক ধরে তুলে দেওয়ারও কেউ নেই। নিজেই উঠলাম কষ্ট করে। তারপর পায়ের যন্ত্রনা অগ্রাহ্য করে তুললাম বাইকটা। বাঁহাতের কনুইএর কাছটাও জ্বালা করছে। পায়েও বেশ কয়েকটা জায়গা কেটেছে বুঝতে পারছি।

এভাবে বাকি রাস্তা যেতে পারব কিনা ভাবছিলাম। হঠাৎ পেছনে তাকাতেই চোখে পড়ল, একটা ছোটো গুমটি মত চায়ের দোকান। একটা টিমটিমে বাল্ব জলছে তাতে। দোকানের মধ্যে বসে আছে একজন খুব বয়স্ক ভদ্রলোক। কেমন অদ্ভুতভাবে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাত পা ভীষন জ্বালা করছিল। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। গলা ঝেড়ে বললাম, “একটু জল হবে?”

বুড়ি কোনো উত্তর দিল না। চারপাশ টা যেন একটু বেশীই নিস্তব্ধ। শুনতে পায়নি নাকি?

দোকানের সামনে আর একটু এগিয়ে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম ভদ্রলোক কে, “একটু জল দিতে পারবেন?”

কথাটা বলার পরেই পায়ে কি যেন একটা ঠেকল। চমকে নীচে তাকিয়ে দেখি একটা জলের বালতি। আর একটা মগ রাখা আছে। কেন জানিনা গা টা একবার শিরশিরিয়ে উঠল। ঠান্ডা হাওয়াটা বড্ড বেড়েছে বুঝতে পারলাম। আর কথা না বলে মগে করে জল নিয়ে হাত পায়ে যেখানে কেটেছে সেই জায়গাগুলো ধুলাম। উফফ! জলটাও কনকনে ঠান্ডা যেন!

পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছতে মুছতে চায়ের দোকানের দিকে তাকাতেই দেখি দোকানে কেউ নেই! একি! এই তো ছিল বুড়ো  । ২ মিনিটের জন্য অন্যদিকে তাকিয়েছি এর মধ্যে কোথায় গেল? বাইরে তো বেরিয়ে আসেনি। আসলে দেখতে পেতাম।

একটু নীচু হয়ে গুমটির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম বুড়োকে। আর ভদ্রলোক এখন একা নেই। দোকানে আর একটা লোকও রয়েছে। সে তাকে চা দিচ্ছে দেখলাম। যা ঠান্ডা পড়েছে তাতে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। কিন্তু বুড়ো তো কোনো কথার উত্তরই দেয় না!

এবার আর একটু জোরেই বললাম, “আমায় এক কাপ চা দেবেন তো!”

আমি ঠিক করেই ছিলাম এবার সাড়া না দিলে এবার চেঁচিয়ে বলব। করলামও তাই। বুড়ো সাড়া দিল না দেখে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দোকানের মধ্যে ঢুকে বললাম, “কী হল? শুনতে পান না নাকি?”

কথাটা বলার পরেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। বুড়ো এবং দোকানের সেই লোকটি একসাথে আমার দিকে ফিরে তাকাল! কেমন অদ্ভুত সেই চাহনি। বেশীক্ষন সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। ঠিক তার পেছনেই একটা গররর আওয়াজ পেলাম। কুকুররা রেগে গেলে যেরকম আওয়াজ হয় ঠিক সেরকম। চোখ গেল সেদিকে। দেখলাম দু’টো সবুজ চোখ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গাটা কেমন যেন করে উঠল। বুঝতে পারলাম আমার উপস্থিতি এখানে একেবারেই কাম্য নয়। চা খেতে গিয়ে শেষে কুকুর লেলিয়ে দিলে বিপদের শেষ থাকবে না। এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম বাইকের দিকে।

বাইকের সামনে যেতেই পায়ের যন্ত্রনাটা আবার বুঝতে পারলাম। কিন্তু তখন অলরেডি অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। এভাবেই বাড়ি ফিরতে হবে বুঝতে পারলাম। বাইকে উঠে স্টার্ট দিলাম বাইক। কী মনে হল যাওয়ার আগে একবার দোকানের দিকে তাকালাম। তাকিয়েই গাটা আবার শিরশিরিয়ে উঠল। বুড়ো বসে আছে নিজের চেয়ারে। চোখ আমার দিকেই। সেই হাসি মুখ। আবছা আলোতেও সাদা দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম নিজের পথে।

বৃহস্পতিবার দুপুর গড়াতে ৩ টের পর বেরোলাম খড়গপুর থেকে বাইক নিয়ে। বেরোবার আগে দেখলাম বাইকের একটা দিকে দাগ হয়ে গিয়েছে! যেভাবে পড়লাম সেদিন, তাতে দাগ না হলেই আশ্চর্য হতাম। মুড টা একটু অফ হয়ে গেল। বাইকটার জন্য। সেদিন যে ঠিক কী ঘটল সেটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়।

বোম্বে রোড দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ কেন জানিনা মনে হল দিনের আলোয় সবটা দেখলে কী একটু পরিষ্কার হতে পারে?  ধূলাগড় এর একটু আগে এসে ইউটার্ণ নিয়ে বাইকটা ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর আস্তে আস্তে চালাতে লাগলাম বাইক। একটু পরেই সেই ওভারব্রীজ টা আসবে। আর তার ঠিক পাশেই ওই ছোট্টো রাস্তা।

একটু আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম। যাতে কোনোভাবে জায়গাটা না মিস করে যাই সে জন্যে। একটু যাওয়ার পরেই দূরে ওভারব্রীজটা দেখতে পেলাম। তার ঠিক একটু আগেই চোখে পড়ল রাস্তাটা। সেই রাস্তা দিয়ে আজ অনেক গাড়িই যাচ্ছে। আমিও বাইকটা নিয়ে গেলাম সেই রাস্তায়।

একটু দূর যাওয়ার পরেই বাম্পার টা চোখে পড়ল। বাইক স্লো করে দিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হল আজ বাম্পারের ওপর নুড়ি পাথর কিচ্ছু পড়ে নেই। সেদিন যে কী করে কী হল! বাম্পার টা পেরিয়েই বাইকটা থামালাম। আশ্চর্য! চা দোকান টা কোথায় গেল? যাহ বাবা! ৪ দিনে চা দোকান উঠে গেল নাকি?

বাইক থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। জায়গাটা মিস করলাম নাকি? একটা টোটো যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। আমাকে দেখে টোটো থেকেই বলল, “ক’দিন হল?”

পেছন ফিরে অবাক হয়ে বললাম, “মানে?”

টোটোওয়ালা বলল, “অ্যাকসিডেন্ট? ক’দিন হল?”

এই প্রশ্নটা শুনে আমি একটু চমকে গেলাম। এটা কী হল! অ্যাকসিডেন্টের কথা এ জানলো কীকরে? সেদিন রাত্রে দোকানে এই লোকটা ছিল নাকি?

বললাম, “আপনি জানলেন কীভাবে?”

টোটোওয়ালা তার টোটো নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, “এসব জায়গায় সময় নষ্ট করবেন না। বাড়ি যান!”

এ তো মহাঝামেলা! দিন দুপুরে লোকজন ফ্রীতে জ্ঞান দিয়ে চলে যাচ্ছে। অথচ আমার যেটা প্রয়োজন সেটাই পাচ্ছি না। যেখানে সেদিন দোকানটা ছিল সেখানটা এখন জলা। এগিয়ে গেলাম জলার ধারে। বার বার মনে হচ্ছে আমি কি জায়গাটা মিস করলাম?

হঠাৎ পেছনে একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। বাইকের আওয়াজ। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম একজন সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখে বললেন, “কি হয়েছে? কিছু খুঁজছেন নাকি?”

আমি বললাম, “এখানে একটা চায়ের দোকান…

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে উনি বললেন, “বুঝে গেছি! আবার একটা! উফফ!”

আমি বললাম, “মানে?”

উনি বললেন, “অ্যাকসিডেন্ট করেছেন তো?”

আমি বললাম, “আমি কোনো সেলেব্রিটি? সবাই কীভাবে জানতে পারছে যে আমি অ্যাকসিডেন্ট করেছি!”

–      কারন অ্যাকসিডেন্ট না করলে কেউ এই জায়গায় চা দোকান খুঁজতে আসে না!

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “ব্যাপারটা কী একটু বলবেন কাইন্ডলি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না!”

ভদ্রলোক নিজের হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “বলতেই পারি। হাতে সময় আছে। চলুন সামনের বটতলায় আর একটা চায়ের দোকান আছে!”  বাইকটা নিয়েই আসুন। বলছি সব।

বাইক নিয়ে একটু ভেতর দিকে যেখানে গেলাম, সেটা আর একটা চায়ের দোকান। পাশেই একটা বড় বটগাছ। একটা লো পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বলছে। আর গুটিকতক লোক চা দোকানে আর কিছু লোক বটতলায় বসে চা খাচ্ছে!

সেই ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “আপনি যে চায়ের দোকানটার কথা বলছেন, সেটা শশধরদার চায়ের দোকান। ওই তো বড় রাস্তার পাশেই যেখানে সরু রাস্তা শুরু হচ্ছে তার ঠিক পরেই গুমটির মত একটা দোকান। তবে গুমটির মত হলেও ওই দোকানটা বেশ অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। বোম্বে রোড দিয়ে গাড়ি গেলেই এখানে অনেকেই দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেয়ে যেতো। সেটা বোধহয় ভালো আদা দেওয়া চা আর শশধরদার ভালো ব্যবহারের কারনে। কিন্তু আপনি জানেন হয়তএই রাস্তায় রাত্রের দিকে খুব বেপরোয়া ভাবে লরিগুলো চলে! আর…”

আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, “বুঝে গেছি! তারপর চায়ের দোকানে লরি ধাক্কা মারল। আর শশধরদা মারা গিয়ে ভূত হল! এরকম কিছু?”

ভদ্রলোক এবার একটু বিরক্ত হলেন বুঝতে পারলাম। বললেন, “আপনি কি জানতে চান সবটা? নাহলে আমার দায় পড়েনি কিন্তু!”

বললাম, “সরি। কেমন একটা ক্লিশে ভূতের গল্পের মত লাগছে। তাই বললাম। বাদ দিন! বলুন!”

“তো যাই হোক। ওই চায়ের দোকান ছাড়া শশধরদার কেউ ছিল না। এক ভাই ছিল বটে। হলধর। তবে তার সাথে কোনো কারনে মুখ দেখাদেখি বন্ধ! তাই সে দোকানেই খেত। দোকানেই ঘুমোত। দোকানে চা, বিস্কুট, সিগারেট সবই পাওয়া যেত। আর একটা ব্যপার হল কুকুরদের বড় ভালোবাসত ও। পাড়ার অনেক কুকুরই ওর দোকানের সামনে ভীড় করত বিস্কুট পাওয়ার আশায়! আমাদের এ পাড়াতেও একটা কুকুর ছিল রাজা! সে সারাক্ষন ওর চা দোকানের বাইরে বসে থাকত! একদিন রাত্রে দোকান বন্ধ করার আগে সে বাইরে রাজাকে খেতে দিতে এসেছিল। সেই সময় গাড়িতে করে বালি নিয়ে যাচ্ছিল একটা লরি। যেকোনো কারনেই হোক রাস্তায় অল্প কিছুটা বালি পড়ে গিয়েছিল। আর সেদিনই দোকানে চা খেতে এসে একজন তাড়াহুড়োয় নিজের বাইকটাকে হাফ রাস্তা ঘিরে স্ট্যান্ড করেছিল। সে লোকটা দোকানের মধ্যে বসে চা খাচ্ছিল। একটা লরি বোম্বে রোড দিয়ে খুব স্পীডে আসছিল। পরে জানা যায় সে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল লরিতেই। সে হঠাৎ চোখ খুলে সামনে বাম্পার, আর গাড়ি দেখে খুব তাড়াতাড়ি ব্রেক কষে। কিন্তু বালি আর নুড়ি পাথর থাকায় চাকা কোনো কারনে স্কিড করে লরি গিয়ে ধাক্কা মারে শশধরদার চায়ের দোকানে! একসাথে তিনটে প্রান শেষ! শশধরদা, দোকানের ভেতরের লোকটা… আর রাজা! ড্রাইভার ওই অবস্থায় লরি ফেলে ছুট! তাকে আর পাওয়া যায় নি!”  

আমি বললাম, “মানে? এটাই? মানে আপনি বলছেন সেদিন আমি…

–      “ভূত দেখেছেন বললে বিশ্বাস করবেন না জানি। করার প্রয়োজনও নেই। আপনি দোকানটা খুঁজছিলেন তাই বললাম। মাঝে মাঝেই লোকজন শশধরদার চায়ের দোকানের সামনে ওভাবেই অ্যাকসিডেন্ট করে। ওই নুড়ি পাথরে স্কিড করে। কেউ কেউ তো বলে তারা নাকি রাতের বেলা ফেরার সময় মাঝে মাঝেই দেখে একটা লরি ওই দোকানের জায়গাটায় উলটে পড়ে আছে!”

আমি বললাম, “দেখুন আপনি এখানে বটতলায় ভালো চা খাওয়ালেন তার জন্য ধন্যবাদ! তবে গল্পটা নেহাতই গাঁজাখুরি মশাই! আমার… মানে ঠিক… বিশ্বাস হল না!”

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “এটাই সবাই বলে। দেখুন বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার! তবে আপনাকে বলব দয়া করে, আর ওই চায়ের দোকান খোঁজার চেষ্টা করবেন না! তাতে আপনারই ভালো!”

আমি বললাম, “বেশ আপনার কথা রাখার চেষ্টা করব! কিন্তু আমাকে বলুন, আপনি এত কথা জানলেন কীভাবে? মানে এত ডিটেইলিং সহ!”

ভদ্রলোক চা দোকানের মালিকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “এই তো! হলধরের কাছ থেকে শোনা! ইনি শশধরদার আপন ভাই! এই চায়ের দোকানটা এঁরই”

আমি দোকানের মালিকের দিকে তাকালাম। কেমন খ্যানখেনে গলায় হেসে সে বলল, “হে হে! নমস্কার সার!”

কেমন একটা যেন অস্বস্তি হতে লাগল! জানিনা কেন! ওই শশধরের সাথে হলধরের মুখশ্রীর অদ্ভুত একটা মিল। ভদ্রলোক কে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। 

এরপর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। প্রত্যেক বছর এই সময়টা খুব চাপ যায়। ডিসেম্বর এলেই ইউনিভার্সিটি মার্কস সাবমিট করতে হয় কলেজে বসে। তাই কলেজ থেকে বেরোতে বেরোতে হয়ে যায় ৭ টা। আজও তাই হল।

এরপরের কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। বাড়িতে থাকব বলে। আজ বাইক নিয়ে আমার বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তায় হঠাৎ কী মনে হল, শশধরের চায়ের দোকানটা আর একবার খুঁজলে কেমন হয়? সত্যি কথা বলতে কী সেদিনের সেই গল্প আমার একেবারেই বিশ্বাস হয় নি! কেমন যেন গাঁজাখুরি টাইপের। জোর করে ভূতের গল্প করার জন্য বানানো বলে মনে হল! তাই আজ ঠিক করলাম, দোকানটা খুঁজব!

বোম্বে রোডের সেই জায়গাটায় গিয়ে ওভারব্রীজ ধরলাম না আজ। নীচের রাস্তাটা নিলাম। নেওয়ার পরেই চোখে পড়ল দোকানটা। টিমটিমে আলো জ্বলছে! এই তো দোকানটা দেখা যাচ্ছে! লোকজন ফালতু ভূতের গল্প ছড়ায়। দোকানের কাছে গিয়ে বাইক থামিয়ে বাইক থেকে নেমেই দেখি, দোকানে কেউ একজন মাথা নীচু করে কিছু একটা করছে!

আমি সামনে গিয়ে গলা ঝেড়ে বললাম, “শশধরদা এক কাপ চা দেবেন?”

লোকটি মুখ তুললো। টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় তার মুখটা কেমন যেন রহস্যময় লাগল আমার! গা টা একটু ছমছম করে উঠল। হঠাৎ সে আমায় বলল, “আপনাকে এতবার বারন করার পরেও আপনি কথা রাখলেন না সার! আপনার তো দেখছি খুব সাহস!”

তারপরেই সে হাসতে লাগল!

আমি মুহুর্তের জন্য একটু থমকে গেলাম। তারপরেই পেছনে শুনলাম একটা লরির হর্নের আওয়াজ। পেছনে তাকালাম! আমি বাইকটা রেখেছিলাম দোকানের কাছেই, কিন্তু দেখলাম সেটা রাখা আছে রাস্তার মাঝখানে হাফ রাস্তা ঘিরে। এরপর যেটা ঘটল তার জন্য আমি একেবারেই তৈরী ছিলাম না। প্রচন্ড স্পিডে আসা লরিটা হঠাৎই যেন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ধেয়ে এল আমার দিকে। হেডলাইটের প্রচন্ড আলোতে আমার চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল! তখন পেছনে শুনতে পাচ্ছি শশধরের হাসি আর একটা কুকুরের গর্জন! আমি জ্ঞান হারালাম!

যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখলাম আমি শুয়ে আছি বটতলার সেই চায়ের দোকানে। হলধর চা করছিল। আমাকে বলল, “আপনাকে সেদিন দাদা অতবার মানা করল! তাও আপনি শুনলেন নে কো! ওই জাগায় যাবেন না সার! ও জাগা ভালো না!”

আমি উঠে গলা ঝেড়ে বললাম, “এক কাপ… গরম চা দেবে?”

হলধর ওর সাদা দাঁতগুলো বের করে অল্প হেসে আমাকে বলল, “চা খাবেন? নিশ্চয় দেবো সার! নিশ্চয় দেবো!”

দুজনের মুখশ্রীতে কি অদ্ভুত মিল! বিশেষ করে দাঁতগুলো!

গল্পের অডিও ভার্সন শুনুন এখানে – https://youtu.be/WIyajo5oTTw

শশধরের চায়ের দোকান

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি