অর্ণব

যারা বিগ ব্যাং থিওরি নিয়ে রিসার্চ করছেন তারা বলেন আমাদের পৃথিবীর মত নাকি অসংখ্য পৃথিবী এই মহাবিশ্বে রয়েছে। এবং সেইসব পৃথিবীতেও আমাদেরই মত একটা মানুষ রয়েছে। এই পৃথিবীতে যা ঘটে সেই পৃথিবীতেও সেই একই ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু দু’টো পৃথিবীর দু’টো ঘটনার পরিনতি আলাদা হলেও হতে পারে।

নাহ বড্ড জটিল করে ফেলছি। এবার একটু সহজ করে বলা যাক। সবাই বলে জীবনের প্রথম প্রেম ভাঙার ব্যথা মানুষ ভুলতে পারে না। কথাটা হয়ত পুরোপুরি ঠিক নয়। মানুষ ভুলে হয়ত যায়, তবে সেই সময়ের স্মৃতিগুলো সুযোগ পেলেই উঁকি দিয়ে মনে করিয়ে যায় – আমরা আছি, আছি, আমরা আছি। এই কনটেক্সটেই জানিয়ে রাখি আজ রোদ্দুরের খুব মন খারাপ। দিনটা মেঘলা বলে নয়। সে তো বছরের প্রায় অনেকগুলো দিনই সূর্য মেঘের আড়ালে থাকে। আজকের ওর মনখারাপের কারণ হল আজ দোল। প্রত্যেক বছর এই দোলের দিন এলেই রোদ্দুরের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। অনেকগুলো পুরোনো অগোছালো স্মৃতি এসে ভীড় করে মনের জানলায়। আজকের দিনে ওর জীবনের প্রথম প্রেমটা ভেঙে গিয়েছিল। এই দিনটা ওর একদমই পছন্দ না।

সকাল থেকে ওর ফোনটা অনেকবার বেজেছে কিন্তু ওর যেন সেদিকে আজ তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। ছাদের ঘরে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দেখছে। ২ টো বছর কীভাবে সমস্ত কিছু পালটে দিতে পারে। গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ার তখন ওর। সবাই বলত রোদ্দুর আর আবীরার সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙবে না। কথাটা শুনতে খুব ভালো লাগত রোদ্দুরের। আবীরার ভালো লাগত কি? কি জানি ও নিজে তো কখনও বলেনি।

রোদ্দুর আর আবীরা একদম উলটো ধাঁচের মানুষ ছিল। যেমন আবীরা ভালোবাসত বাইরে বাইরে ঘুরতে, রেস্টুরেন্ট এক্সপ্লোর করতে। কিন্তু আবীর বড্ড ঘরকুনো। বই নিয়ে পড়ে থাকতে বা মোবাইলে গান শোনাতেই ওর আগ্রহ বেশী।

সেদিনও হোলির দিন ছিল। রোদ্দুর হোলির দিনে কখনও বাড়ি থেকে বেরোয় না। বন্ধুরা হোলি খেলার জন্য ডাকলে স্কিন অ্যালার্জির অজুহাত দিয়ে বাড়িতে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু আবীরা কখনও শোনেনা। স্কুল লাইফ থেকে যবে থেকে ওর সাথে প্রেম হয়েছে ও প্রত্যেক বছর হোলির দিন এসে ওকে রঙ মাখিয়ে গেছে বাড়িতে এসে। নীরার সাথে আসত বলে মা অত কিছু সন্দেহও করত না। নীরা ওর বাড়িতে আসছে সেই ৫ বছর বয়স থেকে। ওর বাবার এক বন্ধুর মেয়ে নীরা। আবীরা আর রোদ্দুরের ছিল এক স্কুল তারপর এক কলেজে। দু’জনেরই রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স।

যাই হোক, যেদিনের কথা বলছি, রোদ্দুর সেই হোলির দিনে কানে ইয়ার ফোন দিয়ে কি একটা হিন্দি গান শুনছিল। হঠাৎ ওর ছাদের ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখল আবীরা দাঁড়িয়ে আছে। ওর জামাকাপড়ে একটু আধটু রঙ লেগেছিল বটে। কিন্তু গায়ে মুখে খুব একটা রঙ নেই। খুব সামান্যই রঙ ওর ঘাড়ের কাছে।

রোদ্দুর বলল, “আয়! তোর কথাই ভাবছিলাম।”

আবীরা বলল, “আমার কথা? কেন?”

রোদ্দুর বলল, “কেন আবার? আজ হোলির দিন তো! তুই রং মাখাতে আসবি জানতাম তো.”

আবীরা একটু থেমে বলল, “কিন্তু আমি তো রঙ মাখাতে আসিনি?”

আবীরার গলাটা কি একটু অন্যরকম লাগছে!

রোদ্দুর যদিও ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব না দিয়ে বলল, “আয় ভেতরে আয়। নীরাকে নিয়ে এলি না আজ? অবশ্য এতদিন ধরে আসছিস আমার বাড়ি, মা বোধহয় সব বোঝে। ছাড় নীরাকে আনলেই ব্যাটা কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হয়ে যায়। ভালোই হয়েছে।”

আবীরা একটু জোরে নিঃশ্বাস নিল তারপর বলল, “রোদ্দুর… আমার… কিছু কথা আছে!”

রোদ্দুর বলল, “হ্যাঁ বল। কি হয়েছে?”

আবীরা কয়েক মুহুর্ত ভেবে বলেছিল, “আমি… আমি ভালো নেই রোদ্দুর!”

রোদ্দুর অবাক হয়ে বলেছিল, “ভালো নেই? মানে? বাড়িতে কিছু সমস্যা হচ্ছে? কাকু কাকিমার সাথে?”

আবীরা দু’দিকে ঘাড় নাড়ল। তারপর আবার একটু কিছুক্ষন ভাবল। তারপর বলল, “রোদ্দুর আমরা বড্ড আলাদা জানিস তো! তুই… আমি… আমরা ঠিক… একসাথে থাকার মত না! তাই আমার মনে হয়… আমাদের এবার… আর এগোনো… উচিত হবে না…”

রোদ্দুর কয়েক মুহুর্তে কিছু বলতে পারছিল না। এসব কী বলছে? এত দিন, এত বছর একসাথে থাকার পর আবীরা এই কারনে সব শেষ করতে চাইছে? যে ওরা আলাদা? ওরা যে আলাদা সেতো অনেক আগে থেকেই জানে রোদ্দুর। রোদ্দুর কেন? ওদের সব বন্ধুরা, শুভদ্বীপ, নীরা, তিতির, অত্রি সবাই জানে। তা সত্ত্বেও ওরা যেভাবে একসাথে থাকে সেটার জন্যই সবাই বলত ওদের কেউ কোনোদিন আলাদা করতে পারবে না! কিন্তু আজ হঠাৎ আবীরা এরকম কথা কেন বলতে শুরু করল?

কারণটা অবশ্য একটু পরেই বুঝতে পারল রোদ্দুর। আবীরার গলায় লাল রঙের যেটাকে ও হোলির রঙ ভাবছিল, সেটা আসলে অন্য কিছু একটা। এই দাগ রোদ্দুর চেনে। রোদ্দুর কেন আজকালকার ছেলে মেয়েরা সবাই এই দাগ চেনে। এটাকে বলে লাভ বাইটস। একবার আবীরার দেওয়া লাভ বাইটস রোদ্দুরের মা দেখতে আঁতকে উঠেছিল। ভেবেছিল কোনো পোকা কামড়েছে। তারপর অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রীম থেকে শুরু করে ব্যাথার মলম সব লাগিয়ে মায়ের শান্তি হয়েছিল।

কিন্তু এই একই দাগ আজ আবীরার গলায়। অথচ আবীরার সাথে রোদ্দুরের দেখা হচ্ছে আজ প্রায় ৬ দিন পর।  রোদ্দুর বুঝতে পারল ওর শরীরটা কেমন যেন করছে। গাটা খুব গোলাচ্ছে। ও কাঁপা কাঁপা বলল, “গলায় এটা… কীসের দাগ আবীরা?”

আবীরা শুধু বলল, “ভালো থাকিস রোদ্দুর। I am really sorry for everything.”

কথাটা বলেই ও বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন ঘর থেকে। তার ১ মিনিট পরেই রোদ্দুর শুনতে পেল ওদের বাড়ির সামনে একটা বাইক স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ। ওপর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখেছিল ওদের কলেজেরই একটা সিনিয়রের বাইকে বসে আবীরা চলে গেল। পরে ও জেনেছিল ছেলেটার নাম। সন্দীপন।

আজ ফোনটা এই নিয়ে প্রায় ৮ বার বাজল রোদ্দুরের। একবার আড়চোখে ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখল ও। নীরা ফোন করছে! উফফ! কেন জ্বালায় এই মেয়েটা। বিরক্ত হয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে দিল ও। তারপর আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

মাঝে মাঝে রোদ্দুরের ওপর মাথাটা বড্ড গরম হয় নীরার। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে ওকে দেখছে। এখনও একই রকম রয়ে গেল ছেলেটা। নিজের কথা ছাড়া আর কারুর কথা ভাবে না। নীরা সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছে রোদ্দুরকে, কিন্তু ও ফোন তোলেনি। নীরার বাড়ি থেকে রোদ্দুরের বাড়ি ওই হেঁটে ৫ মিনিট। নীরা ঘড়ির দিকে দেখল। তখন বাজে সকাল সাড়ে ১০ টা। একবার কি যাবে রোদ্দুরের বাড়ি? আজকে দোলের দিনটা ও ভেবেছিল একসাথে কাটাবে। কারন রোদ্দুর আজ বাড়ি থেকে বেরোবেনা। ওর রঙে আতঙ্ক রয়েছে।

আর তাছাড়া আজ ওর মনখারাপের দিন। কিন্তু এরকম হোলির দিন এলেই এরকম দুঃখবিলাসীতা নীরার আর ভালো লাগে না। হয়ে গেল তো দু’বছর। আর কতদিন চলবে এরকম। আজ দেখা হলে খুব বকবে ও রোদ্দুরকে। যদিও ও নিজেও জানে রোদ্দুরের কাছে গেলেই ওর এই রাগ গলে জল হয়ে যাবে। ওর ওপর কিছুতেই রাগ করে থাকতে পারে না নীরা। সেই ক্লাস ইলেভেন থেকে ওকে…

“কীরে? আবার রোদ্দুরের কথা ভাবছিস?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কথাটা বলেছে ওর বাবা। উনি সবটাই জানেন, সবটাই বোঝেন। কিন্তু বলেন না সব সময়। আজ বললেন!

ও চোখ পাকিয়ে বলল, “শোনো বাবা, তুমি এরকম কুল বাবা হওয়ার চেষ্টা কোরো না। আমার অস্বস্তি হয়। বাবা হবে রাগী রাগী। আমার বাকি বন্ধুদের বাবারা ওরকমই।”

ওর বাবা বললেন, “দ্যাখ তোর থেকে তো অন্তত তিরিশ বছর পৃথিবীটা বেশী দেখেছি। কাজেই আমার কথাগুলো একটু গুরুত্ব দিয়ে শোন। কাজে লাগবে। যাকে এত বছর ধরে পছন্দ করিস তাকে এবার বলে দে। আর অপেক্ষা করিস না।”

কথাটা অবশ্য ভুল বলেননি উনি, সেই ক্লাস ইলেভেন থেকে ওর ভালো লাগে রোদ্দুরকে। কিন্তু ও রোদ্দুরকে কিছু বলার আগেই রোদ্দুর প্রোপোজ করে বসল আবীরাকে। আবীরা ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল। ওর জন্য ক্লাসের প্রায় ৭-৮ জন ছেলে পাগল ছিল সেই সময়। কিন্তু আবীরা কাউকে পাত্তা দিত না। দিত শুধু রোদ্দুরকে। তারপর আর কী? দিনের পর দিন নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারুর হতে দেখল নীরা। তারপর ঠিক সাড়ে চার বছরের মাথায় সেই মানুষটাকে ভালোবাসার জন্য শেষ হতেও দেখল।

নীরার বাবা বলল, “যাই হোক, আমি তোকে কখনই জোর করিনি। আজও করব না। কিন্তু অপেক্ষা করিস না। এটুকুই বলব।”

নীরা একটু হেসে বলল, “বাবা!”

–      হ্যাঁ বল।

–      বাবারা এরকম হলে হয় না জানো তো! একটু অমরেশ পুরি টাইপ বাবা না হলে গল্প জমে না।

–      মানে? কার গল্প? কী গল্প?

–      কিছু না। তুমি বুঝবে না। যাও তুমি।

–      সে ঠিক আছে কিন্তু মাসি কে কী বলব?

–      কীসের কী বলবে?

–      মাসি জিজ্ঞেস করছিল মাস্টার্স তো কমপ্লিট তোর। শুধু রেজাল্ট বেরোনো বাকি। তুই কি কলকাতা যাবি? ওদের ওখানে একটা চাকরি আছে ভালো বলছিল।

–      ধুর! এখন ছাড়ো ওসব। পরে দেখা যাবে।

–      ঠিক আছে। তোর মাসি বলছিল আজ কলকাতা ফিরবে। তুই চাইলে…

–      উফফ বাবা! পরে… আমি রোদ্দুরের বাড়ি থেকে আসছি…

নীরা ভেবেছিল ওদের বাড়ির পেছনে মেহগিনি গাছের ছোট্ট জঙ্গলটা দিয়ে শর্টকাটে রোদ্দুরের বাড়ি চলে যাবে, কেউ দেখতে পাবে না। কিন্তু ওর বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দিল পাড়ার বাচ্চাগুলো। সকাল হতেই পিচকিরি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। নীরাকে দেখেই ৪-৫ টা পিচকিরি থেকে রঙিন জল এসে ওর বাসন্তী রঙা কূর্তিটা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

“কাকিমা রোদ্দুর কোথায় গো?”

রোদ্দুরের বাড়িতে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল নীরা। ওদের বাড়িতে ও ছোটোবেলা থেকেই আসছে। এখন আর অত ফরম্যালিটির বালাই নেই।

রোদ্দুরের মা বলল, “আর বলিস না। সকাল থেকে ছাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে! বেরোচ্ছেও না, কিছু খাচ্ছেও না। দ্যাখ তো তুই ডাকলে খোলে কিনা!”

ছাদের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল নীরা। “এই হনুমান, দরজা খোল”

ভেতর থেকে আওয়াজ এল, “তুই কেন এসেছিস? বাড়ি যা!”

নীরা বলল, “সকাল থেকে ফোন করছি, তুলছিস না কেন? তারপর আবার অফ করে দিলি ফোন! টেনশন হয়না নাকি?”

কোনো উত্তর নেই!

নীরা এবার জোরেই বলল, “খুলবি দরজাটা?”

কয়েক মুহুর্ত পরে খুলে গেল দরজাটা। রোদ্দুর বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “বল? কী হয়েছে?”

নীরা ঢুকে পড়ল ওর ঘরে। তারপর বলল, “তোকে তো আমি বলেছিলাম হোলির দিন আমি তোর সাথে কাটাবো!

রোদ্দুর বলল, “হ্যাঁ? তাতে কী? আমি তো বলিনি!”

নীরা বলল, “দু’বছর তো হয়ে গেল রোদ্দুর। এখনও কেন এরকম হচ্ছে তোর?”

–      কী হচ্ছে? আমার কিছু হচ্ছে না!

–      তোর মুখ-চোখ দেখে বুঝতে পারছি আমি রোদ্দুর। তুই… তুই এখনও ঠিক ভালো নেই…

–      আমি ঠিক আছি। তুই এত চাপ নিস না!

–      চাপ তো নিতেই হবে তাই না? তুই সকাল থেকে কিছু খাসনি। কিছু খাবি চল!

–      নাহ। খেতে ইচ্ছে করছে না।

–      ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে।

–      ভালো লাগছে না নীরা! তুই যা এখন।

নীরা এবার রোদ্দুরের হাতটা টেনে ধরল, বলল, “আগে তুই খাবি। তারপর আমি যাবো।”

এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল রোদ্দুর তারপর চেঁচিয়ে বলল, “শোন নীরা, তুই আমার গার্লফ্রেন্ড নোস। এরকম প্রেমিকার মত নাটকটা করিস না। আমার ভালো লাগছে না। তুই বাড়ি যা না। কখন থেকে যেতে বলছি তো তোকে।”

নীরা রোদ্দুরকে এভাবে কখনও দেখেনি। ও ভাবতে পারেনি রোদ্দুর ওকে এভাবে… ও বুঝতে পারছে ওর চোখে একটা ঝড় আসছে। আর এখানে থাকা যাবে না। ও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

“মাঝে মাঝে তোকে দেখে ভাবি যে ছেলেরা কতটা বোকা হয়?”

কথা বলেছেন রোদ্দুরের মা। উনি ছেলের চিৎকার শুনেই ছাদে এসেছেন। নীরা ততক্ষনে চলে গেছে

রোদ্দুর বলল, “মা এখন ভালো লাগছে না।”

ওর মা বলল, “নীরার ওপর চিৎকারটা কি না করলে চলছিল না?”

রোদ্দুর বলল, “মা, যেটা জানোনা সেটা নিয়ে প্লিজ কথা বোলো না।”

–      “কী? কী জানিনা আমি? তোর সাথে আবীরার সম্পর্কের কথা জানতাম না ভাবছিস? ও কেন প্রত্যেক বছর দোলের দিন নীরাকে সাথে নিয়েই তোকে রঙ মাখাতে আসত সেটা জানিনা ভাবছিস? নাকি নীরা যে এত বছর ধরে তোকে এত ভালোবাসে সেটা জানিনা?

“নীরা!!” রোদ্দুর যেন আকাশ থেকে পড়ল! “নীরা আমাকে… ভালোবাসে?”

ওর মা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “শোন একটা কথা বলি। আমরা একটা মানুষকে যতই ভালোবাসি না কেন… সেই মানুষটা যে আমাদের সাথে সারা জীবন থাকবেই এ কথা হলফ করে কারুর পক্ষে বলা সম্ভব নয়! তুই কি ভাবছিস তোর বাবাকে আমি ভালোবাসিনি? তাও কি থাকল মানুষটা? চলে গেল তো! আমাকে ছেড়ে, তোকে ছেড়ে….”

রোদ্দুর যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন ওর বাবা মারা যায়। ক্যানসারে। তারপর থেকে ও মায়ের কাছেই মানুষ।

রোদ্দুর বলল, “মা প্লিজ। এখন ভালো লাগছেনা শুনতে আমার। একটু একা থাকি আমি?”

ওর মা চলে গেল কোনো কথা না বলে। আর রোদ্দুর ভাবছিল নীরার কথা। নীরা তাহলে ওকে সত্যিই ভালোবাসে? কিন্তু তাহলে কোনোদিন বলেনি কেন? আবীরার সাথে সম্পর্কে ছিল বলে? কিন্তু তাহলে ওর প্রেমে এত সাহায্য করেছে কেন নীরা? যখন যা বলেছে সব শুনেছে। অথচ এক মুহুর্তের জন্য বুঝতে দেয় নি যে…

রোদ্দুর নিজের ফোনটা সুইচ অন করল। তারপর ফোন করল নীরাকে! রিং হয়ে গেল। কেউ ধরল না। আবার করল ও ফোন। ধরল না নীরা। এবার? এবার কী করবে? ধুর! শুধু শুধু নিজের রাগ, ফ্রাস্ট্রেশন টা নীরার ওপর ছুঁড়ে ফেলল ও। ঠিক করেনি এটা রোদ্দুর। একদম ঠিক করেনি।

একবার ছাদ থেকে নীচের দিকে তাকাল রোদ্দুর। বেলা অনেকটাই বেড়েছে। রাস্তায় লোকে ভর্তি। আর এসব ছোটো শহরে লোকজন রাস্তায় নেমে হোলি খেলে। রোদ্দুর জানে ও যদি বেরোয় তাহলে ভূত হয়ে নীরার বাড়ি যেতে হবে। কোনো উপায় নেই। অগত্যা ফোনই ভরসা। আবার ফোন করল ও নীরার নাম্বারে। ফোন সুইচড অফ! এই রে! রোদ্দুরও এক জিনিস করেছিল। নীরা কি তাহলে প্রতিশোধ নিচ্ছে? ভালোবাসলে কি এভাবে প্রতিশোধ নিতে হয় নাকি?

রোদ্দুর এবার কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে বের করল নীরার বাবার নাম্বার। নীরার মা নেই। বাবার কাছেই মানুষ হয়েছে ও। ওর বাবাকে দেখতে খুব গম্ভীর যদিও। তবে উনি বেশ ফ্রেন্ডলি। একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে ও সাহস করে ফোন করল নীরার বাবার নাম্বারে।

ও প্রান্ত থেকে আওয়াজ এল।

–      হ্যালো…

–      হ্যালো কাকু… আমি রোদ্দুর বলছি…

–      কে?… ও হ্যাঁ… বলো!

গলাটা একটু গম্ভীর কি?

–      কাকু, বলছিলাম যে নীরাকে কি একটু দেওয়া যাবে? ওকে আসলে ফোনে পাচ্ছি না।

কাকু গম্ভীরভাবে বললেন, “ও তো এখন একটু ব্যস্ত আছে। ওকে আমি বলে দেব। ও কলকাতা পৌঁছে তোমাকে ফোন করবে। কেমন?”

রোদ্দুর একটু অবাক হল। বলল, “কলকাতা পৌঁছে? মানে? ও কোথায় যাচ্ছে?”

–      ও তো ওর মাসির সাথে কলকাতা যাবে বলে রেডি হচ্ছে। ব্যাগ গুছোচ্ছে!

–      সেকি? কেন?

–      সেটা তো ও বলতে পারবে। আমায় বলল, এখানে আর ওর থাকার কোনো কারণ নেই।

রোদ্দুর কী বলবে বুঝতে পারছিল না। নীরা চলে যাচ্ছে? এই মানুষটা ওকে সামলেছিল ওর ব্রেক আপ এর পর। দিনের পর দিন রাতের পর রাত ফোন করে কেঁদেছে ও। নীরা সব সময় ওর পাশে ছিল। ওর সাথে ছিল। আর আজ… ওর জন্য এই মানুষটা চলে যাচ্ছে!

“হ্যালো! …” ওদিক থেকে আওয়াজ এল…

–      হ্যাঁ কাকু!

–      কিছু কি বলতে হবে নীরাকে?

–      না… আমি… ও কখন বেরোবে কাকু?

–      এই তো মিনিট ১০-১৫র মধ্যে।

১৫ মিনিট! মানে হাতে আর ১৫ মিনিট। কিন্তু কীই বা করবে ও এই ১৫ মিনিটে। যে মানুষটা ভেবেই নিয়েছে সে চলে যাবে, তাকে ১৫ মিনিটে কি আটকানো সম্ভব? ও কি একবার যাবে নীরার বাড়িতে? কিন্তু কিই বা বলবে গিয়ে? ও কি নীরাকে ভালোবাসে? ও তো জানেনা। ও শুধু জানে, নিজের সবচেয়ে দুর্বল মুহুর্ত গুলোতে ও নিজেকে সঁপে দেয় নীরার কাছে।

কাকু বোধহয় আওয়াজ না পেয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছে। রোদ্দুর একবার প্রমাদ গুনল। গত ৮ বছরে ও হোলির দিন বাড়ির বাইরে এক মুহুর্তের জন্য পা রাখেনি! আজ কী করবে ও? বাইরে বেরোলেই তো এদিক ওদিক থেকে রঙ ছিটকে আসবে ওর দিকে। আর এটাতেই ওর আতঙ্ক। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি করতে হবে সময় নেই।

এমন সময় হঠাৎই রোদ্দুরের ফোনটা বেজে উঠল এবং স্ক্রীনে এমন একটা নাম ফুটে উঠল যে নামটা ও ভাবেনি ও আর কখনও নিজের ফোনে দেখবে? আবীরা। আবীরা ফোন করছে। যে আবীরা আজ থেকে দু’বছর আগে দোলের দিনে ওর সাথে সব কিছু শেষ করে চলে গিয়েছিল। সেই আবীরা আজ ফোন করছে। ঘড়ির দিকে দেখল রোদ্দুর।

নীরা এখন একটা কথা খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছে। Life is not fair. জীবনটা সবার জন্য একরকম নয়। কিছু মানুষ আছে যারা সবটা পায় যদিও তারা সবটা Deserve করে না। আবার কিছু মানুষ যারা অনেকটা Deserve করে, তারা প্রায় কিছুই পায় না। এত বছর ধরে রোদ্দুরের এত খেয়াল রেখেছে ও। বিনিময়ে কিচ্ছু চায় নি ও। কেনই বা চাইবে? ভালোবাসাতে আবার বিনিময় প্রথা চলে নাকি? কিন্তু দুর্ব্যবহার? সেটা কি ও সত্যিই Deserve করে? এত দিন পর, এত বছর পর ওর প্রাপ্য কী এতটুকুই?

আজ বাড়ি ফিরে আবীরাকে ফোন করেছিল নীরা। ওকে জানিয়েছে রোদ্দুর ওকে ছাড়া ভালো নেই। ও যেন একটা ফোন করে রোদ্দুরকে! যদিও ও জানেনা আবীরা ফোন করবে কিনা। ও সত্যিই চায় আবীরা আর রোদ্দুরের সব ঠিক হয়ে যাক। তাতে অবশ্য ও ভালো থাকবে না কিন্তু রোদ্দুর তো ভালো থাকবে! ভালো থাকুক ওরা! সবাই ভালো থাকুক।

রোদ্দুর যদিও আজ ওকে দু’বার ফোন করেছে। কিন্তু ওর ইচ্ছে করছিল না কথা বলতে। তাই ও আবীরার সাথে কথা হওয়ার পরেই ফোনটা অফ করে দিয়েছে।

দরজায় কেউ একটা নক করল দু’বার। চোখ মুছে নিয়ে ও বলল, “হ্যাঁ বাবা এসো!”

ওর বাবা বলল, “তুই কি কিছু অর্ডার করেছিস? অনলাইনে?”

নীরা বলল, “অনলাইনে? কই না তো! কেন?”

ওর বাবা বলল, “দেখ তো নীচে একবার!”

এখানে একটা মজা আছে। যারা গল্পটা শুনছে, বা গল্পটা পড়ছে তারা কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে ওর বাবা কেন এ কথা বললেন! কিন্তু আমাদের গল্পের দুই প্রধান চরিত্র, তারা কিন্তু কিচ্ছু জানেনা। ভেবে দেখুন একজন ভাবছে আর একজন কলকাতা চলে যাচ্ছে। আর একজন ভাবছে তার জন্য অনলাইনে অর্ডার এসেছে। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না যে, যে মানুষটা গত ৮ বছরে হোলির দিনে বাড়ি থেকে বেরোয় নি, সে আজ রঙ মেখে ভূত হয়ে এসেছে নীরার মানভঞ্জন করতে! এটা যদি ভালোবাসা না হয় তাহলে ভালোবাসা কী আমার জানা নেই!

নীচে গিয়ে কী হল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাও বলি…

রোদ্দুরকে এত রঙিন আগে কখনও দেখেনি নীরা। জামাকাপড়ে রঙ ভর্তি। ও চমকে উঠেছিল। কিন্তু ওকে আরও চমকে দিয়ে রোদ্দুর হঠাৎ বলে উঠল, “প্লিজ যাস না তুই। আমার ভুল হয়ে গেছে বিশ্বাস কর! আর কখনও আমি তোর সাথে এভাবে কথা বলব না। প্রমিস।”

নীরার হতবাক ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। ও বুঝতে পারছে না ও রোদ্দুরের অসংলগ্ন কথাগুলোর ওপর ফোকাস করবে নাকি ও আজ দোলের দিন ওর বাড়ি এসেছে, রাস্তায় বেরিয়েছে সেটার ওপর ফোকাস করবে!

নীরা বলল, “তুই আজ? মানে বাড়ি থেকে বেরোলি? আর… আমি… আমি কোথায় যাবো? কেনই বা যাবো?”

রোদ্দুর বলল, “যাবি না! তাহলে কাকু যে বলল, তুই কলকাতা চলে যাচ্ছিস। সব কিছু নিয়ে!”

নীরা এবার চোখ পাকিয়ে ওপরের জানলার দিকে তাকাল! দেখল ওর বাবা মুচকি হাসছে ওপর থেকে। সত্যিই এই লোকটাকে আর অমরেশ পুরি বানানো হল না ওর।

নীরা বলল, “তোকে আবীরা ফোন করেনি?”

রোদ্দুর বলল, “হ্যাঁ করেছিল তো!। তুই কী করে জানলি?”

নীরা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “কী বলল? ও? সব ঠিক হল?”

রোদ্দুর বলল, “জানিনা!”

–      জানিনা মানে? কী বলল আবীরা? বল।

–      ওর ফোনটা ধরিনি রে।

–      সেকি? কেন?

–      কারন কাকু বলল তুই ১৫ মিনিটের মধ্যে বেরোবি! তাই ফোনটা কেটে দিয়ে আমি বেরিয়ে গেছি বাড়ি থেকে।

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই প্রাইওরিটি গুলো ঠিক করে উচিত। সবার আগে ঠিক করা উচিত যে আমার কাছে ঠিক কি গুরুত্বপূর্ণ! যেমনটা আজ রোদ্দুর ঠিক করল। শুরুতেই প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছিলাম। হয়ত এরকম কিছু পৃথিবী এখনও রয়েছে যেখানে রোদ্দুর বাড়ি থেকে না বেরিয়ে তার প্রথম প্রেম আবীরার ফোন ধরেছে। আর সেই পৃথিবীতে এই নীরা হয়ত চোখের জল ফেলতে ফেলতে সত্যিই কলকাতা চলে গিয়েছে। কিন্তু সেই গল্পগুলো আমরা মনে রাখি না! সেই গল্পগুলো ঠিক গল্প হয়ে ওঠে না। গল্প হয়ে ওঠে সেই ঘটনাগুলো যেখানে রোদ্দুর আর নীরার কথোপকথনের মাঝে পাড়ার পুচকে গুলো পিচকিরি দিয়ে হোলি হ্যা বলে ওদের আবার ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়। আর গল্প হয় সেই সব ঘটনাগুলো যেখানে এই অন্যরকম দোলের মাঝে সত্যিই একে অপরকে Deserve করা দু’টো মানুষ রঙে ভেজা-জামাকাপড়ে একে অপরের আর একটু কাছে চলে আসে নিজের অজান্তেই।

অন্যরকম দোল

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি