ছোটোবেলা থেকেই একটা অদ্ভুত চোখের সমস্যায় ভুগছে দ্বৈপায়ন। ও কোনো রঙ দেখতে পায় না। পৃথিবীর সমস্ত কিছুই ও সাদা কালো দেখে। অথচ আইরনি হল ওর জন্ম হয়েছে দোলের দিন। সেই জন্যেই ওর ঠাকুমা ওর নাম রেখেছিল দ্বৈপায়ন। দ্বৈপায়ন ব্যাস নাকি কৃষ্ণের আর এক নাম। যাই হোক, ওর পরিবারের খুব একটা অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকায় খুব বেশী ডাক্তার দেখানোর সুযোগও ওর হয় নি। পাড়ার নিতাই ডাক্তার বলেছিল, এটাকে কালার ব্লাইন্ডনেস বলে এবং এ জিনিস কখনও ঠিক হওয়ার নয়। দ্বৈপায়ন এবং ওর বাবা-মা, বোন সবাই এই ডাক্তারের কথাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সবটা পালটে গেল যখন রোহিনী ওর জীবনে এল।

কলেজে প্রথম আলাপের দিন মেয়েটি দ্বৈপায়নের বেঞ্চের কাছে এসে বলেছিল, “সরে যা ওদিকে। বসব”

দ্বৈপায়ন একাই বসেছিল। তাই কথা না বাড়িয়ে ও সরে গিয়েছিল। মেয়েটি একটু পর নিজেই বলেছিল, “আমার নাম রোহিনী!”

দ্বৈপায়ন বলেছিল, “আমি দ্বৈপায়ন!”

– ও মা! তাই? কৃষ্ণের ১০৮ নামের এক নাম দ্বৈপায়ন জানিস?
– জানি। আমার ঠাকুমা রেখেছিল নাম। দোলের দিন আমার জন্ম হয়েছিল বলে।
– বুঝলাম। তা রোহিনী মানে জানিস তো?
– না! কী?
– পরে বলব। আগে বল তুই কালো চশমা পরে আছিস কেন ক্লাসের মধ্যে!
– আমি.. আমি আসলে কোনো রঙ দেখতে পাই না। খুব আলোর মধ্যে আমাকে তাই সানগ্লাস পরে থাকতে হয়।

রোহিনী ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবল। তারপর বলল, “কোনো রঙ দেখতে পাস না?”
– নাহ!
– কালার ব্লাইন্ডনেস তো এরকম হয় না। স্পেসিফিক কিছু রঙ মানুষ আলাদা করতে পারে না জানি। কিন্তু… ডাক্তার দেখিয়েছিস?
– হ্যাঁ ছোটোবেলায় দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছিল এ ঠিক হওয়ার নয়।
– তা আবার হয় নাকি। আবার দেখাবি। আমি যাবো সাথে।

দ্বৈপায়ন হেসেছিল। ও জানে রোহিনী বেশীদিন ওর সাথে থাকবেও না। কালার ব্লাইন্ড ছেলের সাথে কোন মেয়েই বা থাকতে চাইবে। আজ ওর মায়া হয়েছে তাই এসে বসেছে পাশে। তাই বলে রোজ রোজ! অসম্ভব!


কিন্তু অদ্ভুতভাবে রোহিনী থেকে গেল। ওর আর রোহিনীর মধ্যে একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরী হল। মাঝে মাঝে অবশ্য দ্বৈপায়ন বিশ্বাস করতে পারত না যে রোহিনী ওর জীবনে আছে। একবার জিজ্ঞেসও করেছিল রোহিনীকে।

দ্বৈপায়নঃ একটা কথা বলবি?
রোহিনীঃ কী?
– তুই কেন আছিস আমার সাথে?
– মানে? বুঝলাম না!
– মানে আমি তো.. ডিফারেন্টলি এবল্ড একটা মানুষ।
– না, একদমই না। তবে তুই যদি আর একবার এই কথাটা বলিস, আমার হাতে মার খেয়ে তুই সত্যিই এবার ওটা হয়ে যাবি।
– তুই বুঝতে পারছিস না রোহিনী, আমি… আমি…
– শোন, আমি আমি করিস না। এত কনফিডেন্সের অভাব কেন তোর? তুই পড়াশুনোতে ভালো। আমাদের ব্যাচের টপার তুই। তুই এত হীনমন্যতায় কেন ভুগিস?
– কারণ আমি যে বর্ণান্ধ!
– ধুর পাগল! তুই তো তাও দেখতে পাস! কত মানুষ তো দেখতেই পায় না। আর তাছাড়া শোন, আমি আমার জামাইবাবুর সাথে কথা বলেছি। উনি একজন চোখের ডাক্তারকে রেফার করেছেন আমরা যাব তার কাছে!
– কিন্তু ওনার ফিস কত! বাবাকে আগে থেকে বলতে হবে.. নাহলে..
– সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।

আর কথা বাড়ায়নি দ্বৈপায়ন! কয়েকদিন পরেই যাওয়া হল সেই ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ভালো করে সব দেখার পর বললেন দ্বৈপায়নের এই কন্ডিশনটার নাম অ্যাক্রোমাটপ্সিয়া বা মোনোক্রোমাসি। এই কালার ব্লাইন্ডনেসটা খুব রেয়ার। প্রত্যেক ৩৩০০০ মানুষে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়। উনি একটা চোখের ড্রপ দিলেন। বললেন, ৩ মাস ব্যবহার করতে। আর মাঝে মাঝেই বিভিন্ন রঙ দেখে আলাদা করার চেষ্টা করতে বললেন।


সেদিন ছিল দোল। দ্বৈপায়ন অপেক্ষা করছিল রোহিনীর জন্যে! তিথি অনুযায়ী দেখলে আজ দ্বৈপায়নের জন্মদিন। তাই রোহিনী বলেছিল আজ ওরা একসাথে বেরোবে। প্রথমে আঁতকে উঠেছিল দ্বৈপায়ন।

– তুই কি পাগল? দোলের দিন আমরা বেরোবো?
– হ্যাঁ তো! কি হবে তাতে!
– রাস্তায় লোকে রঙ দেবে তো গায়ে!
– তোর আর চাপ কী? তুই তো দেখবি জল দিচ্ছে গায়ে? স্নান করে নিবি সকাল সকাল!
– কিন্তু আমরা যাবোটা কোথায়?
– কোথাও না। আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব! রঙ মাখব। তোকে রঙ চেনাবো!

দ্বৈপায়ন জানে রোহিনী পাগল। আর এই পাগলের সাথে ও তর্ক করতে পারবে না। ও যখন বলেছে ওইদিন বেরোবে, ও বেরোবেই।

সেই কারণেই আজ ও অপেক্ষা করছে রোহিনীর জন্য। কিন্তু রোহিনী এখনও আসছে না কেন! ১০ টায় আসবে বলেছিল। ইনফ্যাক্ট বাড়ি থেকে বেরিয়েও জানিয়েছে ওকে। এখন বাজে পৌনে ১১ টা। ফোনটা এল একটু পরেই..
– হ্যালো… দ্বৈপায়ন রায় বলছেন…
– হ্যাঁ বলছি। কে বলছেন?
– আপনি একটু কাইন্ডলি নর্থ পয়েন্ট নার্সিংহোমে আসতে পারবেন!
– ক-কেন বলুন তো!
– আসলে একজন পেশেন্ট এখানে রয়েছেন। ওনার মাইনর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কেউ না এলে ওকে আমরা রিলিজ করতে পারব না। উনি বললেন আপনাকে ফোন করতে।
– কী নাম?
– রোহিনী সেনগুপ্ত।
– রোহিনী!! রোহিনীর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?
– আরে এত টেনশন করার কিছু নেই। খুব সামান্যই লেগেছে। আপনি চলে আসুন। এলেই আমরা রিলিজ করে দেব!
– হ্যাঁ। আমি এখুনি আসছি!

যখন নর্থ পয়েন্টে পৌঁছোলো ও, তখন বাজে ১২ টা বাজতে ১০। ওর গোটা জামা ভিজে গিয়েছে রঙ এ। রাস্তায় লোকজন প্রচুর রঙ দিয়েছে। তবে রোহিনী ভুল কিছু বলেনি। ওর কাছে তো রঙ আর জলের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। সবই তো সাদা কালো। ভেতরে ঢুকেই রিসেপশনে গিয়ে ও উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করল, “রোহিনী! রোহিনী সেনগুপ্ত কত নাম্বার রুমে আছেন!”

রিসেপশনিস্ট একটা ছেলেকে ডেকে বললেন ওকে ১১ নম্বর ঘরে নিয়ে যেতে। ও গেল ছেলেটির পেছন পেছন। ১১ নম্বর ঘরে ওকে বসতে বলে ছেলেটি চলে গেল। সেই ঘরে শুধু একটাই বিছানা। আর কেউ নেই ঘরে। ও বুঝতে পারল ওর টেনশনটা বাড়ছে। নিজের হার্টবিটের আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছে ও।

একটু পরেই দরজার সামনে একটা আওয়াজ শুনে সামনে তাকিয়ে ও দেখতে পেল রোহিনীকে। রোহিনীর মুখে হাসি। ও বলল, “কী কেষ্টঠাকুর টেনশন করছিলে নাকি?”

রোহিনী মাঝে মাঝেই ওকে এইনামে ডাকে। দ্বৈপায়ন বলল, ” কী হয়েছে তোর? পায়ে লেগেছে? কোন পায়ে? কীভাবে হল!”

রোহিনী কাছে এগিয় এসে হেসে বলল, “দাঁড়া দাঁড়া! উফফ! পুরো ঘেমে গেছিস তুই! তারপর ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে দ্বৈপায়নের কপাল মুখ, চোখ সব মুছিয়ে দিল। হঠাৎই দ্বৈপায়নের মনে হল ওর যেন খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ও ঢলে পড়ল ঘুমে। রোহিনী খুব সাবধানে ধরে নিল ওর মাথাটা।


জ্ঞান ফেরার পর এই দ্বৈপায়ন বুঝতে পারল ওর মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। তবে ওর চোখের সামনেটা অন্ধকার! কয়েক মুহুর্ত পর ওর মনে পড়ল ও নার্সিং হোম এ রয়েছে! ও বিছানায় ছটপট করতেই কেউ একটা ওর হাতটা ধরে নিল। এই স্পর্শটা ওর চেনা। রোহিনী।

দ্বৈপায়ন বলল, “রোহিনী… আমি কোথায়?”

রোহিনীঃ তুই নার্সিং হোমেই আছিস। দাঁড়া ডাক্তারকে ডাকি।
তারপরেই রোহিনীর ডাক শুনেই ঘরে ২-৩ জনের পায়ের শব্দ পেল দ্বৈপায়ন।
ও বলল, “আমার কী হয়েছে? আমার কি শরীর খারাপ? আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
রোহিনীঃ সব জানতে পারবি। আর একটু অপেক্ষা কর।
ডাক্তার কাউকে একটা বললেন, ঘরের আলোটা কমিয়ে দাও। শুরুতেই এতটা আলো নিতে পারবে না!”

তারপর আস্তে আস্তে দ্বৈপায়নের চোখের ব্যান্ডেজটা খোলা হল। দ্বৈপায়ন বুঝল ওর চোখেও অসম্ভব ব্যাথা।

এর পরের ঘটনাটা বড্ড প্রেডিক্টেবল। দ্বৈপায়ন জীবনে প্রথমবারের জন্য দেখতে পেল পৃথিবীর রঙ। শুরুতেই ওর চোখ গিয়েছিল রোহিনীর দিকে। রোহিনী ওকে বলেছিল এই কূর্তির রঙটাকে আকাশী রঙ বলে। যদিও আজ দোলের দিন আকাশী রঙ এর ওপর, লাল, সবুজ, বেগুনী রঙ এর ছোপ পড়েছে। সব রংই ওকে সেদিন চিনিয়েছিল রোহিনী!

কিন্তু যেটা খুব একটা প্রেডিক্টেবল নয় সেটা হল কীভাবে সবটা সম্ভব হল! রোহিনীর ছোটবেলাটেই বোন ম্যারো ট্র‍্যান্সপ্ল্যান্ট হয়েছিল। তারপর লিউকোসাইটোসিস এর কারনে কেমো নিতে হয় ওকে। এবং তার জন্যই ওর শরীরে ডেভেলপ করে অন্য একটা রোগ। পালমোনারি ফাইব্রোসিস। ও জানে ওর হাতে আর মাত্র বছর দু’য়েক। তাই ও চেয়েছিল ওর চোখদু’টো পাক দ্বৈপায়ন।
দ্বৈপায়নের সাদা কালো চোখদুটো দিয়ে দু’বছর দিব্যি চালিয়ে নেবে রোহিনী। সেই জন্যেই আজকের দিনটা। আজ ওর জন্মদিন। জন্মদিনের এর থেকে ভালো উপহার কি হতে পারে তা ওর জানা নেই। আর তাছাড়া আর দোল বলে কথা।

রোহিনী বলল, “এই যে কেষ্টঠাকুর”
দ্বৈপায়নঃ হ্যাঁ বল?
– রোহিনী নামের অর্থ জানতে চেয়েছিলে না?
– হ্যাঁ চেয়েছিলাম তো! বল না।
– রাধার আর এক নাম রোহিনী!
– সত্যি নাকি!
– হ্যাঁ রে পাগল! সত্যি!

রোহিণী

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


One thought on “রোহিণী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি