ডিসেম্বর, ২০১৯
১
ডিসেম্বরের সন্ধ্যে। ঠান্ডাটা বেশ ভালোই পড়েছে। শুধু স্লিভলেস একটা সোয়েটারেই হয়ে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম উপায় নেই। পথেই বাইক থামিয়ে ওপরে হুডি টা পরতেই হল। কলেজ থেকে বেরিয়েছি ৭ টায়। এখন ইউনিভার্সিটির মার্কস সাবমিট করতে হচ্ছে রোজ। সেই কারনেই বেরোতে দেরী হচ্ছে বেশ। সাধারনত কলেজ ৫ টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এখন প্রায় সাড়ে ৬ টা থেকে ৭ টা বাজছে রোজই।
আমার বাড়ি খড়গপুর। কলেজে পড়ানোর সূত্রে কলকাতায় থাকতে হয়। কিন্তু প্রত্যেক শনিবার হয় আমি বাড়ি ফিরি নাহয় আমার স্ত্রী কলকাতায় আসে। ও ওখানে একটা স্কুলে পড়ায় সেই কারনে একটানা একসাথে আমাদের সেভাবে থাকা হয় না।
সেদিনও শনিবার ছিল। কলেজ থেকে বেরিয়েই বাইক নিয়ে বাড়ির পথে এগোলাম। আগে ট্রেনেই যেতাম। কিন্তু ইদানীং রোজ দেরী হচ্ছে বলে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে ভরসা পাচ্ছি না। কলকাতার যানজট থেকে বেরিয়ে যখন ফাইনালি বোম্বে রোড এ পড়লাম তখন ৮ টা ১৫ বেজে গেছে। বোম্বে রোডে বাইক নিয়ে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে। বেশ ফ্রেশ লাগে। সিগন্যাল এর খুব একটা বালাই নেই। রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। আরামসে ৮০ অবধি স্পীড তোলা যায়।
আজকেও সেরকমই বোম্বে রোডে উঠেই স্পিডোমিটারের কাঁটা নিয়ে গেলাম ৭০ এ। ৮০ তে নিয়ে গেলাম না তার কারন হল ঠান্ডা। বড্ড হাওয়া দিচ্ছে। এই হাওয়াতে ঠান্ডা লাগলে আর দেখতে হবে না।
ধূলাগড় টোল ট্যাক্স টা পেরিয়েছে মিনিট ২০ হয়েছে। ঘড়ি বড়ছে ৯ টা ১০ তখন। রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ দেখলাম অনেকটা দূরে প্রচুর গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই রে! এখানে যদি জ্যাম এ আটকে যেতে হয় তাহলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ১১ টা পেরিয়ে যাবে। স্পীড তখন ৭৫ এর আশেপাশেই ছিল। কী করব ভাবছি। কারন জ্যামটা এখনও আমার থেকে ৭০০-৮০০ মিটার দূরে একটা ওভারব্রীজের ওপর। হঠাৎ খেয়াল হল একটু দূরেই ঠিক বাঁদিকে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। দেখে বুঝলাম এই রাস্তাটা গেছে ওভারব্রীজের ঠিক নীচ দিয়ে। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরেই মেইন রোডের সাথে আবার যুক্ত হয়ে যাবে। আর একটুও না ভেবে বাঁদিকের রাস্তায় ঢুকে গেলাম। রাস্তাটা অন্ধকার। হেডলাইটের আলোতেই যাওয়া যেত হয়ত। কিন্তু রাস্তায় ঢোকার পরেই যেটা ঘটল সেটার জন্য আমি একেবারে তৈরী ছিলাম না।
বাইকের স্পীড তখনও আমার ছিল ৭০। দিব্যি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ঐ সরু রাস্তার মাঝখানে কেউ একটা রয়্যাল এনফিল্ড এমনভাবে রেখেছে যে যাওয়ার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও যেটুকু আছে সেটা দিয়ে আমি বেরিয়ে যেতে পারব বুঝতে পেরেছিলাম। তাই স্পীড আমি কমালাম না। কিন্তু যেটা অন্ধকারের মধ্যে খেয়াল করিনি সেটা হল ওই রয়্যাল এনফিল্ডের ঠিক আগেই একটা বড় বাম্পার ছিল। সেটা খেয়াল করলাম একদম কাছে গিয়ে। তাড়াতাড়ি করে ব্রেক কষলাম। কিন্তু বাম্পারের ওপরে এবং আশে পাশে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল প্রচুর গোল গোল নুড়ি। ফলে যেটা আমার সাথে কখনও হয়নি হল সেটাই। বাইকের চাকা স্লিপ করে পড়লাম ঠিক ওখানেই। প্রচন্ড জোরে একটা আওয়াজ তার সাথে পায়ের ওপর বাইক টা পড়ায় যন্ত্রনায় একটা অস্ফূট আওয়াজ বেরোলো মুখ দিয়ে।
কয়েক মুহুর্ত বোধহয় ওভাবেই পড়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় আর একটা মানুষ নেই। কাজেই বাইক ধরে তুলে দেওয়ারও কেউ নেই। নিজেই উঠলাম কষ্ট করে। তারপর পায়ের যন্ত্রনা অগ্রাহ্য করে তুললাম বাইকটা। বাঁহাতের কনুইএর কাছটাও জ্বালা করছে। পায়েও বেশ কয়েকটা জায়গা কেটেছে বুঝতে পারছি।
এভাবে বাকি রাস্তা যেতে পারব কিনা ভাবছিলাম। হঠাৎ পেছনে তাকাতেই চোখে পড়ল, একটা ছোটো গুমটি মত চায়ের দোকান। একটা টিমটিমে বাল্ব জলছে তাতে। দোকানের মধ্যে বসে আছে একজন খুব বয়স্ক মহিলা। কেমন অদ্ভুতভাবে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাত পা ভীষন জ্বালা করছিল। গলা ঝেড়ে বললাম, “একটু জল হবে?”
বুড়ি কোনো উত্তর দিল না। চারপাশ টা যেন একটু বেশীই নিস্তব্ধ। শুনতে পায়নি নাকি?
দোকানের সামনে আর একটু এগিয়ে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম মহিলাকে, “একটু জল দিতে পারবেন?”
কথাটা বলার পরেই পায়ে কি যেন একটা ঠেকল। চমকে নীচে তাকিয়ে দেখি একটা জলের বালতি। আর একটা মগ রাখা আছে। কেন জানিনা গা টা একবার শিরশিরিয়ে উঠল। ঠান্ডা হাওয়াটা বড্ড বেড়েছে বুঝতে পারলাম। আর কথা না বলে মগে করে জল নিয়ে হাত পায়ে যেখানে কেটেছে সেই জায়গাগুলো ধুলাম। উফফ! জলটাও কনকনে ঠান্ডা যেন!
পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছতে মুছতে চায়ের দোকানের দিকে তাকাতেই দেখি দোকানে কেউ নেই! একি! এই তো ছিল বুড়ি। ২ মিনিটের জন্য অন্যদিকে তাকিয়েছি এর মধ্যে কোথায় গেল? বাইরে তো বেরিয়ে আসেনি। আসলে দেখতে পেতাম।
একটু নীচু হয়ে গুমটির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম মহিলা কে। আর মহিলা এখন একা নেই। দোকানে আর একটা লোকও রয়েছে। বুড়ি তাকে চা দিচ্ছে দেখলাম। যা ঠান্ডা পড়েছে তাতে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। কিন্তু বুড়ি তো কোনো কথার উত্তরই দেয় না!
এবার আর একটু জোরেই বললাম, “আমায় এক কাপ চা দেবেন তো!”
আমি ঠিক করেই ছিলাম এবার সাড়া না দিলে এবার চেঁচিয়ে বলব। করলামও তাই। বুড়ি সাড়া দিল না দেখে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দোকানের মধ্যে ঢুকে বললাম, “কী হল? শুনতে পান না নাকি?”
কথাটা বলার পরেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। বুড়ি এবং দোকানের সেই লোকটি একসাথে আমার দিকে ফিরে তাকাল! কেমন অদ্ভুত সেই চাহনি। ঠিক তার পেছনেই একটা গররর আওয়াজ পেলাম। কুকুররা রেগে গেলে যেরকম আওয়াজ হয় ঠিক সেরকম। চোখ গেল সেদিকে। দেখলাম দু’টো সবুজ চোখ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গাটা কেমন যেন করে উঠল। বুঝতে পারলাম আমার উপস্থিতি এখানে একেবারেই কাম্য নয়। চা খেতে গিয়ে শেষে কুকুর লেলিয়ে দিলে বিপদের শেষ থাকবে না। এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম বাইকের দিকে।
বাইকের সামনে যেতেই পায়ের যন্ত্রনাটা আবার বুঝতে পারলাম। কিন্তু তখন অলরেডি অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। এভাবেই বাড়ি ফিরতে হবে বুঝতে পারলাম। বাইকে উঠে স্টার্ট দিলাম বাইক। কী মনে হল যাওয়ার আগে একবার দোকানের দিকে তাকালাম। তাকিয়েই গাটা আবার শিরশিরিয়ে উঠল। বুড়ি বসে আছে নিজের চেয়ারে। চোখ আমার দিকেই। সেই হাসি মুখ। আবছা আলোতেও সাদা দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।
মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম নিজের পথে।
২
বলাবাহুল্য সেবার বাড়ি গিয়ে সোমবার আমার ফেরা হয় নি। তিস্তা মানে আমার স্ত্রী ফিরতে দেয় নি। পরের দিন সকালেই জোর করে এক্স-রে করাতে নিয়ে গিয়েছিল। যখন দেখল ইন্টার্ন্যাল ফ্র্যাকচার নেই কোনো তখনও ও শান্ত হল না।
বাড়ি ফিরে প্রচন্ড রেগে গিয়ে তিস্তা বলল, “আর কতবার তোমায় বলব সাবধানে চালাতে?”
আমি বলতে যাচ্ছিলাম আর কতবার মানে? কবে বললে সাবধানে চালাতে?
তারপরেই মনে পড়ল, মেসেজে তো বলে – সাবধানে আসবে! সেটার কথাই বলছে হয়ত।
বললাম, “আচ্ছা বাবা ঠিক আছে! আর হবে না! এবার সাবধানেই চালাব!”
“শেষবারও তাই বলেছিলে!” কথাটা বলেই আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তিস্তা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
এ তো আচ্ছা ঝামেলা! তিস্তা এমন ভাব করছে যেন এরকম অ্যাকসিডেন্ট আমি আগেও ঘটিয়েছি।
বুঝতে পারলাম কলেজ ছুটি নিতেই হবে। বৌয়ের রাগ না ভাঙিয়ে যাওয়া চলবে না। কারন আমাদের তো আর চাইলেই দেখা হওয়ার উপায় নেই। কাজেই সব ঠিক করেই যেতে হবে। পায়ের ব্যাথাটা রয়েছে বেশ। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই গেলাম বেডরুমে। দেখলাম তিস্তা বিছানায় একটা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে চুপচাপ।
ওর পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর একটু অপেক্ষা করে ও কিছু বলছে না দেখে নিজেই বললাম, “আর কখনও হবে না বিশ্বাস করো। খুব সাবধানে চালাবো এবার!”
তিস্তা আমার দিকে তাকালো আবার। তারপর বলল, “ঠিক তো? কথা দিচ্ছ? আর হবেনা তো?”
আমি বললাম, “না, আর হবে না!”
তারপর একটু থেমে বললাম, “আর আমি ভাবছি আর তিনদিন রেস্ট নিয়ে তারপরেই একেবারে ফিরব বুঝলে! সেটা শরীরের জন্যও ভালোই হবে!”
তিস্তার মুখে এতক্ষনে হাসি ফুটল। ও বলল, “কী করে তেল মারতে হয় সেটা তোমার থেকে শেখা উচিত বুঝলে তো?”
আমি বললাম, “শেখাই তো কলেজে। ছেলেগুলোকে শেখাই কীভাবে ভালো বয়ফ্রেন্ড হতে হয়। কীভাবে ভালো হাসব্যান্ড হতে হয়!”
তিস্তা হাসল। বলল, “সেই রে শয়তান! আজ দুপুরে চিকেন অর্ডার করব। এখানে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে। খুব ভালো খাবার। ওরা ডেলিভারি দিচ্ছে।”
বললাম, “যো আপকি মর্জি জাঁহাপনা!”
৩
বৃহস্পতিবার দুপুর গড়াতে ৩ টের পর বেরোলাম খড়গপুর থেকে বাইক নিয়ে। বেরোবার আগে দেখলাম বাইকের একটা দিকে দাগ হয়ে গিয়েছে! যেভাবে পড়লাম সেদিন, তাতে দাগ না হলেই আশ্চর্য হতাম। মুড টা একটু অফ হয়ে গেল। বাইকটার জন্য। সেদিন যে ঠিক কী ঘটল সেটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়।
বোম্বে রোড দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ কেন জানিনা মনে হল দিনের আলোয় সবটা দেখলে কী একটু পরিষ্কার হতে পারে? ধূলাগড় এর একটু আগে এসে ইউটার্ণ নিয়ে বাইকটা ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর আস্তে আস্তে চালাতে লাগলাম বাইক। একটু পরেই সেই ওভারব্রীজ টা আসবে। আর তার ঠিক পাশেই ওই ছোট্টো রাস্তা।
একটু আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম। যাতে কোনোভাবে জায়গাটা না মিস করে যাই সে জন্যে। একটু যাওয়ার পরেই দূরে ওভারব্রীজটা দেখতে পেলাম। তার ঠিক একটু আগেই চোখে পড়ল রাস্তাটা। সেই রাস্তা দিয়ে আজ অনেক গাড়িই যাচ্ছে। আমিও বাইকটা নিয়ে গেলাম সেই রাস্তায়।
একটু দূর যাওয়ার পরেই বাম্পার টা চোখে পড়ল। বাইক স্লো করে দিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হল আজ বাম্পারের ওপর নুড়ি পাথর কিচ্ছু পড়ে নেই। সেদিন যে কী করে কী হল! বাম্পার টা পেরিয়েই বাইকটা থামালাম। আশ্চর্য! চা দোকান টা কোথায় গেল? যাহ বাবা! ৪ দিনে চা দোকান উঠে গেল নাকি?
বাইক থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। জায়গাটা মিস করলাম নাকি? একটা টোটো যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। আমাকে দেখে টোটো থেকেই বলল, “ক’দিন হল?”
পেছন ফিরে অবাক হয়ে বললাম, “মানে?”
টোটোওয়ালা বলল, “অ্যাকসিডেন্ট? ক’দিন হল?”
এই প্রশ্নটা শুনে আমি একটু চমকে গেলাম। এটা কী হল! অ্যাকসিডেন্টের কথা এ জানলো কীকরে? সেদিন রাত্রে দোকানে এই লোকটা ছিল নাকি?
বললাম, “আপনি জানলেন কীভাবে?”
টোটোওয়ালা তার টোটো নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, “এসব জায়গায় সময় নষ্ট করবেন না। বাড়ি যান!”
এ তো মহাঝামেলা! দিন দুপুরে লোকজন ফ্রীতে জ্ঞান দিয়ে চলে যাচ্ছে। অথচ আমার যেটা প্রয়োজন সেটাই পাচ্ছি না। যেখানে সেদিন দোকানটা ছিল সেখানটা এখন জলা। এগিয়ে গেলাম জলার ধারে। বার বার মনে হচ্ছে আমি কি জায়গাটা মিস করলাম?
হঠাৎ পেছনে একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। এই আওয়াজটা আমি চিনি। শুধু আমি না। প্রচুর মানুষ এই আওয়াজটা চেনে। রয়্যাল এনফিল্ডের আওয়াজ। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম একজন সাদা পোষাকের ট্রাফিক সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে।
আমাকে দেখে বললেন, “কি হয়েছে? কিছু খুঁজছেন নাকি?”
আমি বললাম, “এখানে একটা চায়ের দোকান…
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে উনি বললেন, “বুঝে গেছি! আবার একটা! উফফ!”
আমি বললাম, “মানে?”
উনি বললেন, “অ্যাকসিডেন্ট করেছেন তো?”
আমি বললাম, “আমি কোনো সেলেব্রিটি? সবাই কীভাবে জানতে পারছে যে আমি অ্যাকসিডেন্ট করেছি!”
– কারন অ্যাকসিডেন্ট না করলে কেউ এই জায়গায় চা দোকান খুঁজতে আসে না!
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “ব্যাপারটা কী একটু বলবেন কাইন্ডলি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না!”
সার্জেন্টটি নিজের হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “বলতেই পারি। কিন্তু আপনি এমনিও মনে রাখতে পারবেন না!”
– মানে?
– আসুন! সামনে একটা ভালো চা দোকান আছে। বাইকটা নিয়েই আসুন। বলছি সব।
৪
“প্রশান্ত চৌধুরী নামে একজন লোক এই এলাকার এমএলএ ছিল। সে আর তার অ্যালসেসিয়ান ‘রাজা’ গোটা এলাকা টহল দিয়ে বেড়াত। লোকটি এমনিতে খুব খারাপ লোক ছিল! এলাকার লোকজন বড্ড ভয় করত ওকে। ওর নামে ইনফ্যাক্ট তিনটে মার্ডার কেসও ছিল। একটা ক্ষেত্রেও বডি পাওয়া যায়নি বলে একটা কেসও টেকেনি। কিন্তু সবাই জানত কে রয়েছে এর পেছনে। কিন্তু রাজাকে সে বড্ড ভালোবাসত! আপনি যে চায়ের দোকানের কথা বলছেন সেখানে সত্যিই একটা চায়ের দোকান ছিল। বছর খানেক আগে…”
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, “তারপর কী চায়ের দোকান ভেঙে দিল প্রশান্ত চৌধুরী। আর তারপর বুড়ি ভূত হয়ে গেল?”
সার্জেন্ট ভদ্রলোক এবার একটু বিরক্ত হলেন বুঝতে পারলাম। বললেন, “আপনি কি জানতে চান সবটা? নাহলে আমার দায় পড়েনি কিন্তু!”
বললাম, “সরি। কেমন একটা ক্লিশে ভূতের গল্পের মত লাগছে। তাই বললাম। যাই হোক বলুন!”
“তো যাই হোক। ওই চায়ের দোকানের বুড়ির কেউ ছিল না। বুড়ি দোকানেই খেত। দোকানেই ঘুমোত। আর একটা ব্যাপার বলা দরকার সেটা হল বুড়ি কে কেউ কখনও কথা বলতে দেখেনি। সবাই জানত বুড়ি ছিল বোবা। তবে পরিষ্কার শুনতে পেত সবই। যে যা চাইত চা, বিস্কুট, সিগারেট দিত। প্রশান্ত চৌধুরীও ওখানে বসেই চা খেত। সাথে থাকত তার অ্যালসেসিয়ান কুকুর। একদিন গাড়িতে করে বালি নিয়ে যাচ্ছিল একটা লরি। যেকোনো কারনেই হোক রাস্তায় অল্প কিছুটা বালি পড়ে গিয়েছিল। সেদিনই সুশান্ত চৌধুরী তাড়াহুড়োয় নিজের বাইকটাকে হাফ রাস্তা ঘিরে স্ট্যান্ড করেছিল। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে সে চা খাচ্ছিল। একটা বাইক বোম্বে রোড দিয়ে খুব স্পীডে আসছিল। সে হঠাৎ সামনে বাম্পার, আর গাড়ি দেখে খুব তাড়াতাড়ি ব্রেক কষে। কিন্তু বালি আর নুড়ি পাথর থাকায় চাকা স্লিপ করে বাইক শুদ্ধু পড়ে যায়। ঠিক তখনই বুড়ি খিলখিল করে হেসে ওঠে! আর বলতে থাকে, আবার আবার আবার! প্রশান্ত চৌধুরী একটু অবাক হয়ে তাকায় সেদিকে। আগেই বললাম লোকটা এমনিতে খুব খারাপ একটা লোক ছিল। ওর নিজেরও এই ব্যাপারটাতে বেশ মজা লাগে।”
“তারপর থেকে এই ছিল ওদের কাজ। রোজ সন্ধ্যে হলেই প্রশান্ত চৌধুরী বাইক রাখত ঠিক ওইভাবে। ওর এক চ্যালা ছিল – বাবলু। সে বালি নুড়ি পাথর ছড়িয়ে দিত বাম্পারের ওপরে। যারাই খুব স্পিডে বাইক চালাত তারাই পড়ত ওভাবে বাইক নিয়ে। সেটা দেখে বুড়ি হাসত। আর এটা দেখেই প্রশান্ত চৌধুরী অদ্ভুত আনন্দ পেত ভেতরে ভেতরে। ও এমএলএ ওর ওপরে কারুর কিছু বলার নেই!”
“এর পর একদিন একটা বাড়াবাড়ি হল। একজন লোকাল থানার অফিসার বাড়ি ফিরছিলেন সন্ধ্যেবেলা। ওঁর বাড়ি উলুবেড়িয়াতে। উনিও একইভাবে বাইক নিয়ে পড়লেন চাকা স্লিপ করে। পুলিশের ইউনিফর্মে একজন পড়ে গেল দেখে অন্য কেউ হলে হয়ত ভয় পেত। কিন্তু বুড়ি সেই একইভাবে হাসছিল আর প্রশান্ত চৌধুরী দোকানের ভেতর থেকেই মজা দেখছিল।”
“অফিসারটি দোকানের কাছে এসে জল চাইছিলেন। দেখলেন জল রাখা আছে বাইরেই। উনি জিজ্ঞেস করলেন বাইকটা কার!
প্রশান্ত চৌধুরী বললেন, “আমার”
অফিসার দোকানের ভেতর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। দোকানে তখন ছিল প্রশান্ত চৌধুরী, তার কুকুর রাজা আর ঐ বুড়ি।
তারপর অফিসার বললেন, “এভাবে বাইক রেখেছেন কেন?”
প্রশান্ত চৌধুরী বলল, “এই যে তুই পড়ে গেলি। ওটা দেখতে বেশ মজা লাগল! তাই…”
প্রথমেই তুই! ওঁর মাথাটা হঠাৎ গরম হল। অফিসারের একটা সমস্যা ছিল। অ্যালকোহল প্রবলেম। আর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মানসিক ভাবে একেবারেই স্টেবল ছিলেন না। মাথা গরম হয়ে গেলে উনি আর মানুষ থাকতেন না। এর জন্যে বহুবার ওকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে হয়েছে। সেদিনও উনি মদের নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন।
উনি চেঁচিয়ে বললেন, “মানে? ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?”
প্রশান্ত চৌধুরী বললেন, “এই গলা নামিয়ে কথা বল। আমাকে চিনিস না তুই। তোর ঐ গলা আমি এখানে দাঁড়িয়ে নামিয়ে দিতে পারি। যা ভাগ এখান থেকে শূয়রের বাচ্চা!”
অফিসার আর থাকতে পারলেন না। নিজের সার্ভিস রিভলবার বার করলেন তারপর তিনটে গুলি করলেন পরপর। প্রথমটা দুটো প্রশান্ত চৌধুরীকে। পরের টা বুড়িকে লক্ষ্য করে। কিন্তু কোনো কারনে বুড়ির দিকে ছোঁড়া গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এবং সেটা গিয়ে লাগে গ্যাসের সিলিন্ডারে। সাথে সাথে বিরাট আওয়াজ করে সব শেষ। একসাথে চারটে প্রান জাস্ট শেষ!”
আমি বললাম, “মানে? এটাই? মানে আপনি বলছেন সেদিন আমি…
সার্জেন্ট ভদ্রলোক বললেন, “ভূত দেখেছেন বললে বিশ্বাস করবেন না জানি। করার প্রয়োজনও নেই। এমনিও আপনি এসব মনে রাখতে পারবেন না!”
আমি বললাম, “দেখুন গল্পটা এতটাই গাঁজাখুরি যে আমি চাইলেও ভুলতে পারব না।”
সার্জেন্ট হেসে বললেন, “এটাই সবাই বলে। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের ওই বিশেষ একটা দিনের ঠিক রাত ১২ টার পর আপনার আর এই ঘটনার কোন স্মৃতি মনে থাকবে না! এটাই হয় সবার সাথে। সবাই জানে এটা। সেই জন্যে ডিসেম্বর মাস পড়লে বোম্বে রোডে হাজার জ্যাম থাকলেও কেউ ঐ শর্টকার্ট টা নেয় না! সেদিন যখন আপনি পড়েছেন রাস্তায় তখন কোনো গাড়ি দেখেছিলেন কী ওখানে?”
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। তিস্তা বলেছিল, “শেষবারও বলেছিলে সাবধানে চালাবে!”
তার মানে কী আমার অলরেডি আর একবার এই অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে? এটা কী তাহলে সেকেন্ড টাইম? আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। তবে ওঁর কথাটাও খুব বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ৭ টা বাজতে যায়। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এবার যেতে হবে।
এরপর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। বোম্বে রোড দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় খুব আস্তে আস্তে চালাই আমি। আর রাত হয়ে গেলে ঐ রাস্তা একদম নিই না।
ডিসেম্বর, ২০২০
৫
উফফ! বড্ড হাওয়া দিচ্ছে আজ। মাফলারটা যেন কেন নিতে ভুলে গেলাম কে জানে। হেলমেট আছে কিন্তু তাও কানে বড্ড হাওয়া লাগছে। ধুর! এখন ঠান্ডা লাগানোটা একদম ঠিক হবে না। তার ওপর এখন ঠান্ডা লাগলেই লোকজন যেভাবে কোভিড বলে দাগিয়ে দিচ্ছে সেটাও বেশ সমস্যাজনক।
প্রত্যেক বছর এই সময়টা খুব চাপ যায়। ডিসেম্বর এলেই ইউনিভার্সিটি মার্কস সাবমিট করতে হয় কলেজে বসে। তাই কলেজ থেকে বেরোতে বেরোতে হয়ে যায় ৭ টা। আজও তাই হল।
এরপরের কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। বাড়িতে থাকব বলে। আজ বাইক নিয়ে আমার বাড়ি ফিরছিলাম। ওহ এখানে বলে রাখা ভালো, আমার বাড়ি খড়গপুর। কলকাতা থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার। মাঝে মাঝে ট্রেনেই ফিরি। কিন্তু এখন এই কোভিড সিচুয়েশনের জন্য ট্রেন নিতে ভয় লাগছে। সেই কারনেই বাইকেই ফিরছি আজ।
বোম্বে রোডে বাইক চালানোর আলাদা মজা আছে। নিশ্চিন্তে স্পীড ৮০র ওপর তোলা যায়। ফাঁকা রাস্তা। সবাই নিজের নিজের স্পেসে গাড়ি চালায়। ব্যাপারটা ঘটল ধূলাগড় পেরোনোর মিনিট ২০ পরে।
দেখলাম একটু দূরে বড্ড জ্যাম শুরু হয়েছে। প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পর পর। এই রে! এখানে যদি একবার জ্যামে আটকে পড়ি তাহলে আর দেখতে হবে না। ফিরতে ১১ টা তো বাজবেই। আর তিস্তা না খেয়ে বসে থাকবে। আর তাছাড়া এই সময়টা ওর সময়ে খাওয়াটা জরুরী। She is Pregnant.
কী করব কী করব ভাবছি। হঠাৎ চোখে পড়ল বম্বে রোডের ঠিক পাশেই ছোটো একটা রাস্তা। একটু অন্ধকার। কিন্তু হেডলাইটের আলোয় দিব্যি যাওয়া যাবে। ছোটো গাড়ি যাওয়ার জন্যেই এই রাস্তাগুলো করা। আর ভাবলাম না। বাঁদিকের সেই রাস্তায় বাইক নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
একটু যাওয়ার পরেই একটা দেখলাম, কোনো এক আনাড়ি লোক রাস্তার অর্ধেকটা ঘিরে রেখেছে নিজের রয়্যাল এনফিল্ড বাইক দিয়ে। আমি স্পীড কমাইনি কারন পাশে বেশ খানিকটা রাস্তা ফাঁকাই ছিল। কিন্তু অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। তারপরেই হঠাৎ সামনে বাম্পার দেখে ব্রেক কষলাম খুব জোরে। কিন্তু বাম্পারের চারপাশে নুড়িপাথর ভর্তি থাকায় সামলাতে পারলাম না। চাকা স্লিপ করে পড়লাম। সাথে সাথে প্রচন্ড যন্ত্রনায় একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরোলো মুখ দিয়ে। মনে হল আগেকার কোনো ব্যাথার ওপর যেন আজকের ব্যাথা লাগল।
কয়েক মুহুর্ত পরেই নিজেই উঠে দাঁড়ালাম। কারন রাস্তায় লোকের চিহ্নমাত্র নেই। বাইকটা তুললাম কোনো রকমে। পায়ে খুব লাগছে। হঠাৎ কী মনে হতে পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলাম। পেছনে ছোটো গুমটি মত একটা চায়ের দোকান। একটু আগে খেয়াল করিনি এটা।
দেখলাম দোকানে বসে আছে একজন বয়স্ক মহিলা। সে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাত পা অসহ্য জ্বালা করছে। একটু জলের আশায় আমি এগিয়ে গেলাম সেই চা দোকানের দিকে…
অনেক দিন বাদে এলাম। বেশ লাগলো।❤️❤️❤️