আজ সকাল থেকেই বাড়িতে সাজো সাজো রব! খুব সকালে উঠে স্নান করেছেন পার্থবাবু! যদিও সকালে ওঠাটা ওঁর কাছে নতুন কিছু না। এই ৫১ বছর বয়সেও উনি রোজ সাড়ে পাঁচটায় ওঠেন। তবে অন্যদিনের থেকে আজকের দিনটা তো একটু আলাদা!

আজ সকালে উঠেই ভালো করে স্নান করলেন উনি! তারপর কাল রাত্রে ইস্ত্রি করা হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামাটা বের করে রাখলেন বিছানার ওপর। ঘড়ির দিকে তাকালেন একবার। ৭ টা বাজে সবে। বিকেল ৪ টে বাজতে এখনও অনেক দেরী! রনি এখনও ওঠেনি। আজকালকার ছেলেরা কবেই বা সকালে উঠেছে।

সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ শেখাটা খুব কঠিন কাজ নয়। পুরো ব্যাপারটা ভালো করে রপ্ত করতে ৭ দিন লেগেছিল পার্থবাবুর। ২৬ বছর বয়সে নিজের প্রেমিকার জন্যেই শিখেছিলেন। হ্যাঁ, যেটা ভাবছেন সেটাই। ওর প্রেমিকা এবং পরবর্তীকালে যিনি ওঁর স্ত্রী হন, তিনি কথা বলতে পারতেন না। শুনতে পেতেন কিন্তু বলতে পারতেন না। সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে কথা বলতেন। সেটা বোঝার জন্যেই সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ শিখেছিলেন পার্থবাবু! কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে সংসার করাটা শিখতে পারেন নি বলে…

“কী গো? এত তাড়াতাড়ি কেন উঠেছো?”

রনি চোখ ঘষতে ঘষতে বলল।

পার্থবাবু বললেন, “আজ আসলে… মানে ওই.. জানিসই তো!”

রনি হেসে বলল, “ওহ হ্যাঁ। তোমার নূতন ক্রাশ কে প্রোপোজ করবে আজকে, তাই না?”

পার্থবাবু লজ্জায় মাথা নীচু করলেন। ইসস! আজকালকার ছেলেদের মুখে কীসব ভাষা! ক্রাশ আবার কী? ভালো লেগেছে ওঁর একজন কে। তাকে প্রোপোজ করতে চান। অনেকবার ভেবেছেন এই বয়সে কী আর এসব মানায়! ছেলেকে বলেওছেন সে কথা!

ছেলে বলে, “ধুর! প্রেমের আবার বয়স হয় নাকি?”

“হয় না?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন পার্থবাবু

রনি বলে, “নাহ। একদম হয় না! তোমার ভালো লেগেছে, তুমি জানাতে চাও, জানাবে! এত কিছু কেন ভাবছো?”

পার্থবাবু অবাক হন আরও। রনির বয়সে ওর এই কনিফিডেন্ট ছিল কী? একটু হয়ত ছিল। সেই জন্যেই জনসমক্ষে ভালোলাগার মানুষকে বলেছিলেন, “সাঁঝ, তোমায় বড্ড ভালোবাসি বিশ্বাস করো!” কথাটা শুনে কি অদ্ভুতভাবে হেসেছিল মেয়েটা। তারপর আঙুলের সাহায্যে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে বলেছিল সেও ওঁকে ভালোবাসে।

রনি বলল, “চা খাবে? বানাবো?”

কেমন অদ্ভুতভাবে পুরো সংসারের দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে রনি। এই সামান্য কাজটুকু যদি উনি পারতেন তাহলেই হয়ত সংসারটা টিকে যেত ওঁর। বাড়ির সমস্ত কাজ করত সাঁঝবাতি একা। কোনো অভিযোগ করত না। দিনের পর দিন। আনাজ কাটা, রান্না করা, জামাকাপড় কাচা, হিসেবপত্র দেখা হেন কোন কাজ নেই যেটা ও করত না। আর পার্থবাবু রোজ সকালে অফিসে যেতেন, আর রাত্রে ফিরে ঘুমিয়ে পড়তেন। কেমন যেন রোবটের মত হয়ে গিয়েছিলেন উনি। ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছিলেন।

সাঁঝবাতি সবটা দেখেও ১৮ বছর ধরে কিছু বলে নি। এর মাঝে রনি বড় হয়েছে তখন আরও দায়িত্ব বেড়েছে। তা সত্ত্বেও সে কোনো অনুযোগ করেনি। কিন্তু ওদের বিবাহবার্ষিকীর দিন…

“এই নাও! চা নাও!” রনির কথায় চিন্তার তার কাটল পার্থবাবুর।

উনি বললেন, “আমি বানাতাম তো!”

রনি হেসে বলল, “হ্যাঁ, ক্রাশ কে ইম্প্রেস করার জন্য সব শিখেছো আমি জানি। কিন্তু আজকের চা টা না হয় আমি বানাই। ক্রাশ হ্যাঁ বললে না হয় আমাকে বিরিয়ানি খাইও। মনে আছে তো কীভাবে বানাতে হয়!”

পার্থবাবু চায়ের কাপ টা নিতে নিতে বললেন, “হ্যাঁ মনে আছে! তুই তো শেখালি!”

রনি পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। বলল, “তারপর বলো, তা কী বলবে কিছু ভেবেছো?”

পার্থবাবু বললেন, “যেটা সত্যি সেটা। আমি ওকে ভালোবাসি সেটা!”

রনি বলল, “ব্যাস এইটুকু? এতে ইম্প্রেস হবে তো?”

পার্থবাবু বললেন, “এর থেকে বেশী আর কিই বা বলব!”

রনি একটু ভাবলো। তারপর বলল, “মাকে যখন প্রোপোজ করেছিলে তখন কীভাবে করেছিলে?”

পার্থবাবু বলল, “ধুর! তখন তো কম বয়স! সিনেমার নায়কদের মত এক হাঁটু গেড়ে বসে, গোলাপ ফুল দিয়েছিলাম!”

–       ধুর! বয়সের কী আছে। এখনও ওভাবেই করো!

–       কিন্তু আমার হাঁটুতে ব্যাথা তো!

–       হাঁটুর ব্যাথাকে ক্রাশকে পাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দিও না বাবা। ভালো কথা বলছি!

কথাটা বলে রনি উঠে চলে গেল অন্য ঘরে! পার্থবাবু এবার পড়লেন দোটানায়! হাঁটুর ব্যাথাটাকে ইগনোর করা ঠিক হবে? আর তাছাড়া একটা বুড়ো লোক রাস্তার ওপর ওভাবে বসে কাউকে গোলাপফুল দিচ্ছে দেখলে লোকজন কী ভাববে?

ধুর! সে এখনও অনেক দেরী। পরে দেখা যাবে! হাতে সময় আছে। আপাতত ঘরটা বরং একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার।

সাদা পাজামার সাথে হলুদ পাঞ্জাবীটা পরার পর আয়নার সামনে নিজেকে দেখলেন একবার পার্থবাবু! ড্রেসিংটেবিল থেকে চিরুনীটা নিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে চুল আঁচড়াতে গিয়ে খেয়াল হল যে’কটা আছে তার জন্য চিরুনীর ব্যবহার করা আর মশা মারতে কামান দাগা সমান। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এতগুলো বছর পরে এসে কেন এও পাগলামি করছেন?

তখনই রনির কথাটা মাথার মধ্যে বাজছে। “ভালোবাসার আবার বয়স হয় নাকি?”

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে রনি একবার ওর ঘরে এসেছিল। মুচকি হেসে বলে গেল, “যাও বাবা, জি লো আপনি জিন্দেগী!”

ছেলেটা বড্ড পেকেছে। আর মা না থাকায় শাসন টাও সেভাবে পায়নি লাস্ট ক’টা বছর। সত্যি শেষের ৭ বছর যে কি অদ্ভুতভাবে কাটল সেটা ভাবলেই কেমন একটা অবাক লাগে ওঁর! সবটা শেষ হয়েছিল ওর দোষেই। দিনের পর দিন বাড়ির সমস্ত কিছু সামলে যখন সাঁঝবাতি যখন ক্লান্ত, সেরকম একটা দিনেই অনেক রাত্রে অফিস থেকে গলা ভর্তি মদ খেয়ে ফিরেছিলেন পার্থবাবু! মদ টা ওর কখনই ঠিক সহ্য হয় না, কিন্তু সেদিন অনেকক্ষন থেকেই শরীরটা আর টানতে পারছিল না।   সাঁঝবাতি দরজা খোলার পরেই গোটা ঘরময় বমি করতে করতে বাথরুমের দিকে চলে যান পার্থবাবু! বাথরুম থেকে বেরোনোর পরেও সাঁঝবাতি একটা কথা বলে নি। ও তখন ভেজা কাপড় দিয়ে ঘর মোছার চেষ্টা করছিল।

পার্থবাবুও লজ্জায় কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে যান শুতে। ঘুমটা যখন ভাঙে তখন ভোর! বিছানায় ওর পাশে সাঁঝবাতি কে না পেয়ে উনি অবাক হন একটু। চশমাটা পরে যখন বাইরে গিয়ে দেখেন বাইরের দরজায় খিল দেওয়া নেই। দরজাটা খোলা।

রনি বা তার মা কেউ বাড়িতে নেই। একটু পরেই টেবিলের ওপর একটা চিঠি পান পার্থবাবু। হাতের লেখাটা ওর চেনা। সাঁঝবাতির হাতের লেখা। সে লিখেছে সে আর থাকতে চায় না পার্থবাবুর সাথে। এরকম মানুষের সাথে নাকি কখনই সংসার করা যায় না। ভুল জীবনের স্বপ্ন দেখে ভালোবেসেছিল ঠিকই। কিন্তু সারাজীবন কাটাতে সে পারবে না। রনি কে নিয়েই চলে গিয়েছিল সে। পার্থবাবু অনেকবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। সে আসেনি। তবে অনেক অনুরোধের পর সপ্তাহে ২ দিন রনিকে ওর কাছে পাঠানো হয়। আজও সেরকম একটা দিন।

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পার্থবাবু অনেকটা ভাবলেন! তারপর ঠিক করলেন ভালোবাসার মানুষকে ইম্প্রেস করতে হাঁটুকে অল্প কষ্ট দেওয়া যেতেই পারে। কাছের একটা দোকান থেকে একটা গোলাপফুল কিনলেন উনি! তারপর এগিয়ে গেলেন সেই স্কুলটার দিকে।

গত ৭ বছরে অনেক কিছু ঘটেছে। যেটা ঘটল সেটাকে অ্যাকসেপ্ট করে এগিয়ে যেতেই ওঁর লাগল প্রায় ২ বছর। ২ বছর উনি বুঝলেন যে যাবার সে গেছে, সে আর ফিরবে না! ওঁকে এখন এই বুড়ো বয়সে মুভ অন করতে হবে। সেসব করতে গিয়েই আস্তে আস্তে শিখলেন সংসারের কাজ। রান্নাটা ভালো করে শেখালো ওর ছেলে রনি। মায়ের কাছে প্রত্যেক সপ্তাহে নতুন নতুন রান্না শেখে আর বাবাকে এসে তা শেখায়! এই করতে করতে কাটল আরও ৩ বছর। তারপরেই তাকে দেখলেন ওর বাড়ির কাছের ওই স্কুলটাতে। তাকে মানে… ক্রাশকে। রোজ ১১ টার সময় স্কুলে পড়াতে আসেন এবং ৪ টের সময় বাড়ি ফিরে যান। রোজ দূর থেকে দেখেছেন মানুষটাকে। কাছে যেতে সাহস হয় নি কখনও।

রনি কে বলেছিলেন উনি এর ব্যাপারে। রনিই প্রথম মাথায় ঢোকালো প্রোপোজ করার কথা!

প্রথমে পার্থবাবু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর রনির অকাট্য যুক্তির কাছে হার স্বীকার করেন। শেষ ২ বছর তো শুধু সাহস যোগাড় করতে করতেই চলে গেল। আর সাহস পেলেই তো হবে না। দিনক্ষন দেখে তবে না প্রোপোজ করতে হবে! আর হ্যাঁ বলুক বা না, দিনক্ষন দেখে তবে না প্রোপোজ করতে হবে। যদি ও হ্যাঁ বলে তাহলে আজকের দিনটা সারাজীবন মনে রাখতে হবে তো?

ঘড়ির দিকে একবার দেখলেন পার্থবাবু। ৪ টে বাজতে পাঁচ। এবার বড্ড ভয় লাগছে ওঁর! এই বুড়ো বয়সে রিজেকশন নিতে পারবেন তো? কিংবা যদি চড় মেরে দেয়? তাহলে? এই স্কুলের বাচ্চারা দ্যাখে যদি?

হঠাৎ ফোনে মেসেজ ঢুকল রনির। ফোন বের করে দেখলেন, তাতে লেখা – All the best Baba.

নাহ! এতদূর এসে পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ উনি নন। যা হবে দেখা যাবে। স্কুলের গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন উনি। তবে গেট থেকে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালেন। যাতে স্কুলের ভেতর থেকে ওকে দেখতে না পাওয়া যায়!

৪ টের ঘন্টা বাজল ঢং ঢং করে। কিছু বাচ্চাকে তাদের বাবা মা নিতে এসেছে। খুব বেশী ছেলে মেয়ে অবশ্য পড়ে না এই স্কুলে। পার্থবাবু একটু এগিয়ে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন ভেতরের দিকে। স্টাফরুম থেকে বেরোলো। ওই তো! ওই তো সে! গাঢ় নীল রঙ এর একটা শাড়ি পরেছে ও আজ।

পার্থবাবু আবার সরে এলেন পাশে! বুকের ভেতর মনে হচ্ছে হাতুড়ি পড়ছে। কী হবে কে জানে! গোলাপ টা হাতে নিয়ে উনি তৈরী! সে স্কুল থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের ঘুরেই সামনে দেখল রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পার্থবাবু!

ও আসতেই পার্থবাবু এক হাঁটুতে ভর দিয়ে প্রোপোজ করার ভঙ্গীতে বসলেন। তারপর গোলাপটা ওর দিকে এগিয়ে দিলেন।

সেও খুব অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে পার্থবাবুর দিকে। এবং পার্থবাবু এটাও জানেন আরও অনেক জোড়া চোখ ওকে দেখছে। ওঁর জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে।

তাও সাহসে ভর করে উনি বললেন, “সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ শিখেছিলাম মাত্র ৭ দিনে শুধু তোমার সাথে কথা বলব বলে। কিন্তু সংসার করতে জানতাম না আমি একটুও। এখনও যে পুরো শিখেছি সে কথা হলফ করে বলতে পারব না। কিন্তু এই ৭ বছর ধরে এটুকু বুঝেছি তুমি সাথে থাকলে সেটাও শিখে নেব। তুমি এই স্পেশাল স্কুলে জয়েন করার পর থেকে রোজ তোমায় দেখছি গত ২ বছর ধরে। সাহস করে কাছে আসতে পারিনি। আজ পেরেছি। আমি জানিনা তুমি এখনও…”

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন পার্থবাবু। সাঁঝবাতির চোখে জল। ও হাতটা বাড়িয়ে পার্থবাবুর হাত থেকে গোলাপটা নিল। তারপর চোখে জল নিয়েই অদ্ভুতভাবে হাসল মেয়েটা। এই হাসিটা পার্থবাবুর বড্ড চেনা।

পার্থবাবু বললেন, “সাঁঝ, তোমায় বড্ড ভালোবাসি বিশ্বাস করো!”

সাঁঝ আঙুলের সাহায্যে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে বলল, সেও ওকে ভালোবাসে। ঠিক ২৫ বছর আগের মত।

তারপর রাগী রাগী চোখে পার্থবাবুর হাঁটুর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল ওঁর দিকে। এই হাতটাই তো উনি ধরে থাকতে চেয়েছিলেন সারাজীবন। আমরা সবাই যেমন চাই একটা শক্ত হাত আমাদের ধরে থাকুক!

রূপকথার গল্প

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি