১৪

“তারপর?”

আমি বসে আছি সল্টলেকের একটা ফ্ল্যাটে। শেষ কয়েকদিনে আমার আবার পুরোনো ট্রমাগুলো ফেরত এসেছে। তাই মা আর সন্তু দুজনেই সাজেস্ট করল আর একবার কাউন্সেলিং এর জন্য! উনি সন্তুর একজন আত্মীয় হন। আগেরবার ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে খুব শান্তি পেয়েছিলাম। সবটা গুছিয়ে বলার পর প্রশ্নটা করেছেন কাউন্সেলর – গার্গী। গার্গী রায়চৌধুরী।

বললাম, “তারপর আর কী? পুরোনো ট্রমাগুলো ফেরত এল! আবার!”

গার্গী বলল, “কিন্তু কেন?”

আমি বললাম, “কেন মানে?”

–      মানে… কেন ফেরত এল বলে তোমার মনে হয়?

–      জানিনা। বোধহয় মনে হল, আমার সেলফ ওয়ার্থ বলে কিছু নেই। কেউ আমার সাথে থাকতে চায় না! আমাকে মিথ্যে বলে!

–      আমি যতদূর জানি… As per my knowledge স্নিগ্ধা… রাইট? স্নিগ্ধা ছাড়া আর কোনো ব্রেক আপ তোমা হয় নি! তাই তো?

–      না… হয় নি!

–      আর এই মেয়েটি… মানে ত্রিধা এটা তো ঠিক ব্রেক আপ বলা যায় না!

–      নাহ। কিন্তু মিথ্যে তো বলল! স্নিগ্ধাও বলেছিল। এও বলল!

–      আচ্ছা ঠিক আছে। যদি তাও হয়… তাহলেও… এই ২ জন তোমার সেলফ ওয়ার্থ ঠিক করে দেবে? এদের কে এতটা ইমপরট্যান্স দিও না।

–      হুম। আমি জানি তুমি ঠিক বলছ! কিন্তু মন তো এত যুক্তিসম্মত ভাবে চলে না। সেই জন্যেই আর কি…

এরপরেই গার্গী অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, Do you have this Tridha’s Number?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু ওটা তো সুইচ অফ!”

–      হ্যাঁ জানি সুইচ অফ! কিন্তু আমি একবার ট্রাই করি?

আমি বললাম, “হ্যাঁ, সে করতেই পারো। আমি নাম্বার টা পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমাকে!”

কথাটা বলেই আমি Whatsapp খুলে নাম্বার টা পাঠিয়ে দিলাম গার্গী কে। গার্গী ফোন টা নিয়ে একঝলক দেখে নিল কিছু একটা। তারপর বলল, “এখন কেমন ফিল করছ?”

আমি বললাম, “ঐ একইরকম। দেখো সব সময় যে খুব খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে তা না! মাঝে মাঝে ভেতরে অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে তখনই পুরোনো ট্রমাগুলো ঘুরে ফিরে আসছে!”

গার্গী বলল, “আচ্ছা এই ত্রিধার সাথে কারুর আলাপ করিয়েছো? কোনো বন্ধু বা কলিগ এর সাথে?”

আমি বললাম, “সেই সুযোগই হল কোথায়? কিছু হওয়ার আগেই তো…!”

–       না। সেটা তো তুমি বললে… কিন্তু অফিসের কোনো কলিগ, কারুর সাথে কোনো আলাপ বা দেখা হয় নি ত্রিধার?

–      উহু! হয় নি।

–      ওকে!

বলে ডায়রি তে কিছু একটা লিখলো গার্গী! এত সাইকো থ্রিলার ওয়েব সিরিজ দেখেছি, কেন জানিনা অনুমান করতে পারছিলাম যে গার্গী কী ভাবছে। আমি বললাম, “তুমি কি এরকম কিছু ভাবছো যে ত্রিধা আসলে এক্সিস্টই করে না! ও কাল্পনিক!”

গার্গী বলল, “এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর সময় হয় নি। তবে কোনো সম্ভাবনাই আমি বাদ দিচ্ছি না এই মুহুর্তে!

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। বললাম, “তাহলে তো আর এই বিষয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই! তুমি যদি আমাকে পাগলই ভাবো… তাহলে…

“না না না! ভুল করছ!” আমাকে থামালো গার্গী, “তোমায় পাগল আমি ভাবিনি। আমরা কেউই পাগল নই। আসলে কি জানো তো অনেক সময় এরম হয় যখন আমাদের খুব একা লাগে, বা চারপাশ থেকে প্রচুর চাপ আসতে থাকে আমাদের ওপর… তখন আমরা কমফর্ট খুঁজতে থাকি নিজের মধ্যেই। সেই জায়গা থেকে অনেক সময় অনেক চরিত্র জন্ম নেয় যারা আমাদের সেই শান্তিটুকু দিতে পারে! আমি এই পসিবিলিটি টাকেই উড়িয়ে দিতে চাইছি না এক্ষুনি!”

গার্গীর কথায় যুক্তি রয়েছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আমার আর এক মুহুর্তও ওখানে থাকতে ইচ্ছে করছিল না! তখনই বেরিয়ে গেলাম ওখান থেকে।

১৫

“অমিত সব ঠিক আছে তো?”

কথাটা জিজ্ঞেস করেছে শর্মিষ্ঠা দি। সময় সব কিছু ঠিক করে দেয় এটা আমিও মানি। দেখলাম যত সময় পেরোচ্ছে ভেতরের যন্ত্রনাগুলো আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে! আমি অফিস জয়েন করেছি ২ দিন পরেই। কাজেও মন বসছে দেখলাম। আজ কাজ করতে করতে হঠাৎই পেছন থেকে শর্মিষ্ঠা দির গলার আওয়াজ পেয়ে একটু অবাক হলাম। সাধারনত কাউকে ডাকতে হলে শর্মিষ্ঠা দি কাউকে একটা পাঠায়। আজ নিজেই এসেছে।

পেছন ফিরে বললাম, “হ্যাঁ। সব ঠিক আছে!”

শর্মিষ্ঠা দি বলল, “ওকে। গুড। তুমি ১০ মিনিট পরে একবার আমার ঘরে এসো। দরকার আছে!”

আমি বললাম, “ঠিক আছে!”

আজ আবার কী হল? এক্সেল শীট এ কিছু ভুল করেছি নাকি? যাই হোক, গেলাম ১০ মিনিট পর।

ঢোকার সময় বলেই ঢুকলাম, “আসছি…”

শর্মিষ্ঠা দি কম্পিউটারে কিছু একটা করছিল। আমাকে দেখে বলল, “হ্যাঁ। অমিত এসো!… বোসো!”

বসলাম।

–      বলুন।

–      বাড়ির কি অবস্থা? সমস্যা মিটেছে?

–      হ্যাঁ। ঠিক আছে এখন।

–      বেশ। নিজের কেরিয়ার নিয়ে কী ভাবছো?

–      কেরিয়ার নিয়ে… মানে… এই তো এখানে আছি… চলছে একরকম

–      ব্যাস! এভাবেই চলে যাবে?

আমি প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম শর্মিষ্ঠা দির দিকে।

শর্মিষ্ঠা দি বলল, “ব্যাঙ্গালোর যাবে?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “হঠাৎ ব্যাঙ্গালোর?”

শর্মিষ্ঠা দি বলল, “হুম। ব্যাঙ্গালোর। ওখানকার অফিসে এফিশিয়েন্ট লোক লাগবে। স্যালারি কলকাতার ডাবল! তুমি কি যাবে? তাহলে আমি রেকমেন্ড করব তোমার নাম!”

আমি বললাম, “এক্ষুনি জানাতে হবে? মানে বাড়িতে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হত!”

শর্মিষ্ঠা দি বলল, “ঠিক আছে। সময় নাও। ২ ঘন্টা পর জানাও! ফোন করে নাও বাড়িতে! কিন্তু আজকেই ফাইনাল করতে হবে!”

২ ঘন্টা! এরকম একটা সিদ্ধান্তের জন্য ২ ঘন্টা এনাফ? ফোনে এসব কথা বলা সম্ভব! আমি জানি আমি সব কথা মুখ ফুটে বলতে পারি না! আজকেও তাই হল। বললাম, “ঠিক আছে। আমি জানাচ্ছি!”

উঠে পড়লাম চেয়ার থেকে। বেরোবার আগে শর্মিষ্ঠা দি বলল, “তোমার ডিসিশনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে অমিত। এই সুযোগটা ছেড়ো না!”

অনেক কিছু নির্ভর করবে? কী নির্ভর করবে? চাকরি চলে যাবে? ধুর! এই চাকরিটা যদি ছাড়তে পারতাম! মাঝে মাঝে বড্ড দুর্বল মনে হয় নিজেকে। ঘড়িতে দেখলাম ২ টো ৫ বাজে। টিফিন নিয়ে চলে গেলাম ছাদে!

১৬

যখনই ২ টোর সময় ছাদে যাই, তখনই মনে হয় দেখব ত্রিধা বসে আছে হয়ত! কিংবা মাঝে মাঝে মনে হয় আমি গিয়ে বসার পরে হয়ত ত্রিধা আসবে। কিন্তু কখনই তা হয় না! And somehow I am okay with it. যত দিন যাচ্ছে একটা ধারনাই মনের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে যে ত্রিধা আসলেই আমার কল্পনাপ্রসূত! বাস্তবে ওর কোনো অস্তিত্বই নেই!

আজ আবার বড্ড ডিস্টার্বড লাগছিল। ভালো লাগছিল না! মাঝে মাঝে জীবন এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় সেখান থেকে বেরোনো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমি কি ব্যাঙ্গালোর চলে যাবো? আর আমার লেখা? সেই স্বপ্ন? ছেড়ে দেবো! কী হবে লিখে? কত টাকা উপার্জন সম্ভব? ব্যাঙ্গালোর গেলে কলকাতার ডাবল মাইনে পাবো!

খুব সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে আজ ছাদে। রোদও তেমন নেই। টিফিন বক্স টা মাটিতে রেখে কার্নিশের যেখানে পা ঝুলিয়ে বসি, সেদিকে মানে ছাদের একদম কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর আকাশের দিকে তাকালাম। শরীর টা বড্ড হালকা লাগছে আজ। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল যেগুলো কে চেপে বসতে দিচ্ছিলাম না। কারন আমি জানি সেগুলো যদি চেপে বসে তাহলে আমি শেষ… এখানেই সবটা শেষ হয়ে যাবে!

এমন সময় হঠাৎ, “আরে আরে কী করছেন! পাগল নাকি?”

শুনে চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি ত্রিধা দাঁড়িয়ে! আমি কার্নিশ এর ধারে দাঁড়িয়ে আছি দেখে চিৎকার করে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ড আমি ভীষন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এটা কী হল? মানে এতদিন পর হঠাৎ করে আবার… মানে কেন?

আমি থ হয়ে গেছি দেখে ত্রিধা আবার বলল, “আপনি অবাক পরে হবেন! আগে নামুন ওখান থেকে! নামুন তো!”

আমি নামলাম। আমি বললাম, “আপনি… আপনি…

ত্রিধা বলল, “আপনি আপনি কী? সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন কেন? আবার প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছেন নাকি?”

আমি কার্নিশ থেকে নেমে পড়লাম, ততক্ষনে একটু সামলেছি নিজেকে। বললাম, “আপনি আমায় ভুল নাম্বার দিলেন, মিথ্যে বললেন… তার বেলা?”

ত্রিধা বলল, “তার জন্য আপনি সুইসাইড করবেন? Are you mad?”

আমি বললাম, “আমি সুইসাইড করতে যাইনি!”

–      না না! আপনি তো সুইসাইড করতে যান নি! আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন! জানি!

–      এই এই! আমি সুইসাইড করলে আপনার কী? মিথ্যেবাদী মেয়ে একটা! একটাও সত্যি কথা বলেন নি আপনি আমাকে। সব মিথ্যে বলেছেন। সব!

ত্রিধা কিছু বলল না। এগিয়ে এসে বসল সেই চিরপরিচিত জায়গায়! তারপর আমাকে বলল, “বসুন! একটু কথা বলি!”

আমি বসলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। শুধু ভাবছিলাম ও কি আদৌ আসল নাকি নকল? ও কি সত্যিই আমার কল্পনা!

ত্রিধা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “হ্যাঁ!”

আমি বললাম, “হ্যাঁ মানে?”

ত্রিধা বলল, “হ্যাঁ মানে আপনার মনে এই মুহুর্তে যে প্রশ্নটা ঘুরছে এটা তার উত্তর!”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে… আপনি…”

ত্রিধা বলল, “নিজের সাথে আর লুকোচুরি খেলবেন না! আপনি বুঝতেই পারছেন আমি কী বলছি। আমাকে সৃষ্টি করেছেন আপনি! নিজের কথা শেয়ার করেছেন আপনি! আপনার যে যে সময়ে আমাকে প্রয়োজন হয়েছে সেই সেই সময়ে আমি এসেছি! যেমন আজ!”

–      “আজ?”

–      হ্যাঁ আজ! কী করবেন ভাবলেন? ব্যাঙ্গালোর যাবেন?

আরে ধুর নিকুচি করেছে ব্যাঙ্গালোর! আমি এদিকে ভাবছি এরকমও হয়! একটা চরিত্র আমি তৈরী করে নিলাম নিজের ট্রমার সাথে লড়াই করার জন্য!

ত্রিধা বলল, “হ্যাঁ। নিলেন! যেদিন থেকে আপনার বাড়ির ঝামেলা মিটেছে সেদিন আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল। আমি আর আসিনি! আজ আবার আমার প্রয়োজন হয়েছে তাই এসেছি!”

আমি বললাম, “কিন্তু আপনি আমাকে নাম্বার দিলেন! আমি সেভ করলাম! আমার ফোনেই তো আছে আপনার নাম্বার!”

ত্রিধা বলল, “নাম্বারটা ভালো করে দেখুন তো একবার!”

আমি ফোন বের করে ত্রিধার নাম্বার টা বের করলাম! নাম্বারটা ভালো করে পড়তেই চমকে উঠলাম। এটা স্নিগ্ধার নাম্বার। আমি বার বার ফোন করতাম বলে ও নাম্বার চেঞ্জ করেছিল। তারপর আমি নাম্বার টা উড়িয়ে দিই! সেই নাম্বার আবার ত্রিধার নামে… আমার ফোনে…

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আর ভাবতে পারছি না। সব মিথ্যে। সব কিছু! আমার সাথেই কেন? কেন আমার সাথেই হয় এরকম?

ত্রিধা বলল, “আপনার হাতে সময় কিন্তু কমে আসছে! শর্মিষ্ঠা দি কে আজ জানাতে হবে তো? কী করবেন?”

মাথা নীচু করে বললাম, “জানি না! নিয়ে নেবো হয়ত অফার টা!”

–      আর আপনার লেখা?

–      কী?

–      আপনার লেখা… লেখার কী হবে?

–      ধুর! ছাড়ুন তো! বাল এর লেখা! লিখে কেউ কিছু করতে পেরেছে আজ অবধি!

–      হ্যাঁ, পেরেছে তো… সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়… আরও অনেক নাম আছে। বলব?

–      ধুস! ওদের বাবার অনেক টাকা! আমার বাবার নেই! সংসার টা আমাকেই দেখতে হবে!

ত্রিধা বলল, “আপনাকে আমি আগেও বলেছি, কোনো কিছুই একদিনে হবে না। লেগে থাকতে হবে! যেকোনো একটা জিনিসের ওপর ফোকাস করুন না! অবশ্যই ফল পাবেন। শুনুন সাফল্যের কোনো শর্ট কাট হয় না। লড়ে যেতে হবে আপনাকেই। নিজের যোগ্যতায় সবটা কেড়ে নিতে হবে!”

আমি একটু থেমে বললাম, “ভাবতে অবাক লাগছে, এই কথাগুলো আমি নিজেই নিজেকে বলছি!”

ত্রিধা বলল, “সে আপনি যা ভাববেন! যেভাবে ভাববেন। তাই বলে প্রত্যেকটা কথা মিথ্যে হয়ে তো যাবে না! ভেবে দেখুন। আপনি কর্পোরেট এর চাকর হবেন না শিল্পী হবেন? সবটাই আপনার ওপর! আর কাছের মানুষদের ওপর একটু ভরসা রাখুন। আপনি আপনার স্বপ্ন পূরন করতে চাইলে তারা নিশ্চয় আপনাকে সাপোর্ট করবেন!”

“হুম” বললাম আমি।

ত্রিধা উঠে পড়ল। বলল, “আমি যাই! আমার কাজ আপাতত শেষ!”

আমি বললাম, “আর দেখা হবে না?”

ত্রিধা বলল, “হয়ত হবে, হয়ত হবে না! সবটাই আপনার হাতে! আপনার যদি মনে হয় আমাকে প্রয়োজন আছে। তাহলে কাল আবার এই একই সময় আমাকে পাবেন!”

কথাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে ত্রিধার। এত স্পষ্ট কথা, এত সামনে থেকে একটা মানুষকে দেখছি অথচ সেই মানুষটা নাকি রক্তমাংসেরই নয়! সে নাকি আমার কল্পনা!

ত্রিধা বলল, “বিশ্বাস না হলে নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে পারেন!”

আমি বললাম, “চিমটি কাটলে কি আপনি চলে যাবেন?”

ত্রিধা হেসে বলল, “আমি এমনিই চলে যাবো। চিমটি কাটলে সাথে সাথেই চলে যাবো হয়ত!”

–      না। তাহলে এমনিই যান! আপনার চলে যাওয়া দেখি বরং!

–      বেশ!

কথাটা বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ত্রিধা! যাওয়ার আগে বলে গেল, “আর বিয়েটা এবার করে নিন! বয়স তো হল!”

আমি বললাম, “কাকে করব? মেয়ে চাই তো! আপনি তো কাল্পনিক বলে চলে যাচ্ছেন!”

ত্রিধা বলল, “আপনার মামা মেয়ে দেখেছে না? আপনার জন্যে! দেখুন না পছন্দ হয় কিনা!”

চমকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, আমার মামা মেয়ে দেখেছে ও জানল কীভাবে? পরক্ষনেই মনে হল! আমি যখন জানি তখন ও জানবেনা কেন? সবটাই তো আমার মাথায়!

ত্রিধা চলে গেল। আমিও এগোলাম সিঁড়ির দিকে।

১৭

লিফটের কাছে গিয়ে দেখি আর এক উপদ্রব! পুরো বিল্ডিং এ লোডশেডিং। জেনারেটরও বোধহয় চলছে না! এবার আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে! ধুর বাল!

মুড টা আবার বিগড়ে গেল! অগত্যা নামলাম সিঁড়ি দিয়ে! 15th Floor এ নেমে দেখি আর এক কান্ড! সব জিনিস বের করা হচ্ছে! ভেতরে প্রচুর লোক কাজ করছে! সেদিনের সেই লোকটাকে দেখে বললাম, “এখানে আবার কী হচ্ছে দাদা?”

লোকটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, “ল ফার্ম হবে ল ফার্ম! খেয়েদেয়ে কাজ নেই লোকের! এখানে হবে ল ফার্ম!”

খুব অদ্ভুত কো-ইনসিডেন্স তাতে সন্দেহ নেই! নেমে গেলাম অফিসে! শর্মিষ্ঠা দির ঘরে গিয়ে দেখলাম ও নেই। ধুর! একেবারেই সেরে নিতাম! সেটা আর হল না! নিজের কিউবিকলে চলে গেলাম! কী মনে হতে একটু পর মাকে ফোন করলাম, “শোনো না!”

মা বলল, “বল না!”

বলছিলাম যে, “মামা কাকে একটা দেখেছে বলছিলে না! আমার জন্যে!”

মা খুব উৎসাহের সাথেই বলল, “হ্যাঁ। দেখেছে তো! কেন?”

আমি বললাম, “কথা বলে দেখো তাহলে তোমরা। কেমন কী!”

মা বলল, “দেখ আমি তো কথা বলিনি! তবে…

–      তবে?

–      না কিছু না। দাঁড়া দেখছি আমি। ফোন করছি মামাকে।

–      না না। তবে কী? কী সমস্যা? বলো!

–      আরে কিছু না!

–      তুমি যদি না বলো আমি কিন্তু সব ক্যানসেল করে দেবো আবার!

মা এবার একটু ভয়ে ভয়ে বলল, “আসলে… সন্তু… কথা বলেছে মেয়েটার সাথে। ও বলছিল নাকি খুব ভালো মেয়ে!”

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “সন্তু?”

মা বলল, “হ্যাঁ! সন্তু! তুই কিন্তু বলিস না বাবা আমি বলেছি বলে! তাহলে আমার ওপর রাগ করবে!”

এতে রাগ করার কী আছে বুঝলাম না! কিন্তু কিছু না বলে রেখে দিলাম ফোন! খটকাটা মনের ভেতর রয়েই গেলো!

অফিস থেকে বেরোবার মিনিট ১৫ আগে মা আবার ফোন করল। বলল, “ব্যাস্ত?”

আমি বললাম, “না না। বলো!”

মা বলল, “কথা বললাম দাদার সাথে! তুই কি কথা বলবি?”

–      কার সাথে? মামার সাথে?

–      না না। মেয়েটার সাথে! বলবি?

–      ওহ! হ্যাঁ ঠিক আছে। সে নাম্বারটা পাঠিয়ে রাখো! অসুবিধে নেই! আমি ফোন করে নেবো!

–      হ্যাঁ আমি পাঠিয়ে দিয়েছি Whatsapp এ।

মা ফোন টা রেখেই দিচ্ছিল। হঠাৎ কী মনে হতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মা?”

–      হ্যাঁ বল?

–      কী করে মেয়েটা?

মা বলল, “শুনছি তো ল-ইয়ার বোধহয়! বাকি জানিনা!”

What? ল-ইয়ার? সিরিয়াসলি? জীবনে এত কোনইন্সিডেন্স সম্ভব? ১৫ তলায় ল ফার্ম তারপর যার সাথে বিয়ে হবে! সে নাকি ল-ইয়ার! এটাও কি আমার মাথার মধ্যেই হচ্ছে!

ফোন টা কেটে দিলাম। সাথে সাথে ফোন করলাম মায়ের পাঠানো নাম্বারে।

রিং হচ্ছে! বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে! বোঝাতে পারবো না ঠিক! অদ্ভুত একটা অনুভূতি!

চারবার রিং হওয়ার পর ও প্রান্ত থেকে ফোনটা ধরা হল।

একটি মেয়ে বলল, “হ্যালো!”

আমি বললাম, “আমি… আমি অমিত বলছি… আমার মামা আপনার নাম্বার…

আমার কথা শেষ করার আগেই ও প্রান্তের মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ, জানি। বলুন!”

গলাটা কি একইরকম কি? বুকের ভেতর হাতুড়ি চলছে! জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে আমার।

ওদিক থেকে আবার বলা হল, “গলাটা চেনেন কিনা দেখছেন?”

What the…. এসব কি আবার আমি নিজে নিজে ভাবছি! নিজে নিজে কল্পনা করছি?

আমি বললাম, “আপনি… আপনি কি…”

মেয়েটি হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমি ত্রিধা বলছি! বলুন!”

মানে? এটা? এটা কী হল? হঠাৎই মায়ের কথাটা মনে পড়ল! সন্তু! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যে আমার লাইফের সমস্ত খুঁটি নাটি জানে সে আগে কথা বলেছিল ত্রিধার সাথে! তাহলে সবটা… সবটাই কি…

 

শেষটুকু

–      “নার্ভাস?”

–      একটু!

–      চাপ নিও না। আমি আছি তো!

–      আসলে প্রথম বই তো! সেই কারনেই!

–      চিন্তা কোরো না। ভালো হবে! হতেই হবে!

–      আর না হলে?

–      নাহলে পাবলিশার এর নামে কেস করব! বৌ ল-ইয়ার থাকার এই এক সুবিধে তুমি পাবে!

–      পাগল!

–      I know! নাহলে ওভাবে বিয়ে করার জন্য নাটক করতাম নাকি?

–      এসব বাস্তবে হয় না জানো তো! রূপকথায় হয়!

–      জানি তো! আজকের দিনটাও রূপকথার মতই হবে। দেখো না!

কথাটা বলে, আমার হাতটা শক্ত করে ধরল ত্রিধা! 

(শেষ)

ত্রিধা – পঞ্চম পর্ব

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি