১১
ফোনটা অনেকক্ষন থেকেই বাজছে টেবিলে। ভাইব্রেটিং মোড এ আছে। সন্তু ফোন করে চলেছে আমি ধরছি না! কেমন একটা অদ্ভুত ফিলিং কাজ করছে মনের ভেতর! কষ্ট হচ্ছেনা জানেন! মনে হচ্ছে ঠিক কী হল ব্যাপার টা! একজন ভুল নাম্বার দিল আমাকে? নাকি আমি ভুল সেভ করলাম? বার বার কেন জানিনা মনে হচ্ছে দ্বিতীয়টাই সত্যি! যদিও সেটা জানার উপায় নেই ২ টোর আগে!
বার বার ঘড়ি দেখছিলাম! এখন ১ টা ১৫ বাজে। কখন যে ২ টো বাজবে! আবার ফোনটা ভাইব্রেট করছে! এবার ধরলাম। বললাম, “কী হয়েছে?”
সন্তু বলল, “কখন থেকে ফোন করছি! কোথায় ছিলি?”
বললাম, “এখানেই! বল!”
– তাহলে ধরিসনি কেন?
– ইচ্ছে করছিল না!
– অমিত এগুলো কেন করছিস?
– তোর কী কিছু বলার আছে?
– শোন না… এভাবে ব্যবহার কি না করলেই নয়!
– না নয়! আর কিছু?
সন্তু একটু থেমে বলল, “অমিত একটা কথা বলি! লাস্ট! এটা বলেই আমি ফোনটা রেখে দেবো!”
– উফফ! বল!
সন্তু বলল, “তোকে আমরা সবাই ভালোবাসি অমিত। আমি, কাকিমা, কাকু। সবাই। জানি এগুলো তোকে মনে করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সবারই একটা লিমিট আছে অমিত! তুই দিনের পর দিন অকারনে মিসবিহেভ করে যাবি, তারপর যদি এক্সপেক্ট করিস, তাও সবাই তোর খোঁজ নেবে! তোকে ভালোবাসবে! তাহলে খুব ভুল করবি! এরকম করিস না!”
ফালতু জ্ঞান শুনতে ইচ্ছে করছিল না! বললাম, “এটাই? আর কিছু বলবি?”
সন্তু ফোনটা কেটে দিল! আমিও আর কিছু বললাম না। আমার মাথায় এখন অন্য টেনশন! এসবের পেছনে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছিল না! আজ যেন সময় আস্তে আস্তে চলছে! ২ টো বাজার সাথে সাথে আমি হাতে টিফিন নিয়ে পা চালালাম! ১৮ তলার ওপর ছাদে উঠে দেখলাম ত্রিধা তখনও আসেনি! নিজের জায়গায় গিয়ে বসলাম।
২ টো ৫! ২ টো ১০! ২ টো ১৫! আজ এত দেরী হচ্ছে কেন! এর আগে একদিনই বোধহয় দেরী হয়েছিল ত্রিধার! কিন্তু… কেন জানিনা মাথার মধ্যে ভুলভাল চিন্তা আসছিল! সত্যিই ইচ্ছে করে ভুল ভাল নাম্বার দেয় নি তো! কিন্তু কেন? আমি কি সত্যিই খুব ডেসপারেট হয়ে নাম্বার চেয়েছি! ওর কি আমার সান্নিধ্য ভালো লাগছিল না! ২ টো ৩০ যখন বাজল, তখনও মনে হচ্ছিল ত্রিধা আসবে। ৩ টে বাজতে ৫ মিনিট বাকি যখন, তখন বুঝলাম ও আর আজ আসবে না!
এবার একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করাই ভালো! কারন এর পরের ঘটনা গুলো ডিটেইলে মনে করতে আমার ইচ্ছে করছে না! মঙ্গলবার গেলাম। ত্রিধা এল না! বুধবারও না! বৃহস্পতিবার আমি আর থাকতে না পেরে একটা বাজে কাজ করলাম। ত্রিধা বলেছিল ১৫ তলায় ওর অফিস! যদিও অফিসের কি নাম বলেছিল আমার মনে নেই। কিছু একটা ল ফার্ম! একবার মনে হল ওখানে গিয়ে খোঁজ নিই।
যেমন ভাবা তেমন কাজ! লিফট এ গিয়ে চলে গেলাম 15th Floor এ। লিফট থেকে বেরিয়েই দেখলাম কী একটা অফিস! বাইরে সাইন বোর্ড নেই। ভেতরে প্রচুর প্যাক করা জিনিসপত্র। সামনে চেয়ারে একটা লোক বসে ঢুলছে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে গেলাম। বললাম, “শুনছেন?”
লোকটি ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। তারপর আমাকে দেখে চোখ ঘষতে ঘষতে বলল, “বলুন!”
আমি বললাম, “এটা কি একটা ল ফার্ম?”
লোকটি বলল, “আপনি কাকে খুঁজছেন?”
আমি বললাম, “ত্রিধা বলে একজন। বলেছিল এখানে কাজ করে!”
লোকটি বলল, “ত্রিধা! না ঐ নামে এখানে কেউ কাজ করে না!”
আমি বললাম, “আপনি ঠিক জানেন? ও এটাই বলেছিল কিন্তু! কি একটা নাম বলল ওর ফার্ম এর! কিন্তু 15th floor এ এটা কনফার্ম!”
লোকটি বলল, “দেখুন 15th floor এ এই একটাই অফিস! তবে এটা ল ফার্ম না! এখান থেকে অনলাইনে পাইকারি জিনিসপত্র ডেলিভারির কাজ হয়! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে!”
ভুল হচ্ছে! সিরিয়াসলি! ভুল হচ্ছে! ভুল অফিস! ভুল ফোন নাম্বার! এত ভুল করব আমি? হঠাৎই মনে পড়ল ল ফার্ম টার নাম! ত্রিধাই বলেছিল, J and B Legal! সাথে সাথে ফোন বের করে সার্চ করলাম গুগলে! গুগল যেটা দেখালো তাতে অবাক হলাম আরও। এই নামে ভারতবর্ষে কোনো ল ফার্ম নেই। যেটা আছে সেটা কানাডা তে। আর তার কোনো ব্র্যাঞ্চ ভারত কেন? পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই নেই!
আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না! কিচ্ছু না! এটা ঠিক কী হল? কেন হল? একজন মহিলা রোজ দুপুরে এসে আমার সাথে গল্প করল এতদিন ধরে। এত কথা বলল! তারপর… সব মিথ্যে! সব ভুল!
বুকের ভেতরে যেন হাতুড়ি পড়ছিল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ওই অফিস থেকে বের করে লিফট এর দিকে যেতে যেতে সন্তু কে ফোন করলাম। ফোনে অপারেটর শোনালো ব্যস্ত। যাহ বাবা! আরও ২ বার করলাম। আবারও বলল ব্যস্ত। Whatsapp খুলে মেসেজ করতে গিয়ে দেখলাম, ডিপির জায়গাটা সাদা! ওর ডিপি দেখা যাচ্ছে না! আমাকে… ব্লক করেছে?
১২
স্নিগ্ধা চলে যাওয়ার পর মানসিক ভাবে আমি যে জায়গায় চলে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ফিরে আসতে আমাকে কম লড়াই করতেই হয় নি! অনেকে ভাবতেই পারে যে পৃথিবীর সবার জীবনেই এই ঘটনা ঘটে। এবং আমি কিন্তু এক মুহুর্তের জন্য এটা দাবি করছি না যে আমার কষ্টের থেকে বড় কষ্ট কারুর কখনও হতে পারে না! কিন্তু খুব খুব কষ্ট হয়েছিল। আসলে ৯ বছরের সম্পর্কও যে ভেঙে যেতে পারে এটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। সেই জায়গাটাতেই আমি খুব ধাক্কা খেয়েছিলাম। এতটাই ধাক্কা খেয়েছিলাম যে সেটা নিজের ক্ষতি করছিল। শেষে আমায় একজন কাউন্সেলরের শরনাপন্ন হতে হয়। তবে একটা কথাও সত্যি শেষের দিকে সম্পর্কটাকে বড্ড টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়ে নিয়েছিলাম। অকারনে খারাপ ব্যবহার করতাম। ফোন অফ করে দিতাম রাগ হলেই। কাজেই দোষএর ঝুড়ি টা ওর দিকে ঠেলে দিয়ে লাভ নেই। সে যাই হোক, এখন এত কিছু মাথায় ঘোরার কারন একটাই। সেটা হল ত্রিধা। আমি কেন জানিনা মানসিক ভাবে খুব অশান্ত হয়ে গেলাম আবারও। স্নিগ্ধা যাওয়ার পর যেটা ঘটেছিল আবার সেটাই রিপিট হতে শুরু করল।
“খাবি কিছু?”
প্রশ্নটা করেছে মা! আজ শুক্রবার যদিও। আজ ছুটি নিয়েছি। মেডিকেল লিভ! তবে জানলা দরজা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি!
মাকে বললাম, “না খিদে পাচ্ছে না!”
মা, “ঠিক আছে!” বলে চলে গেল!
মা আজকাল আর আমায় জোর করে না কিছুতে। আগে মনে হচ্ছিল এটাই হয়ত আমি চাই। যে আমায় যেন কেউ কোনো কিছুতে জোর না করে। আমার যা ইচ্ছে আমি করব! এটাই হয়ত আমি চাই! এখন কেন জানি না খারাপ লাগছে। একা লাগছে বড্ড! সন্তুটাও আমাকে ব্লক করে দিল। ধুর! ওই একটা বন্ধু সব সময় আমার পাশে থেকেছে। আর এখন…
নিজের অজান্তেই কখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে দেখিনি! কিন্তু অন্য একজন খেয়াল করেছে। সেটা বুঝতে পারলাম হঠাৎই। দেখলাম কখন যে মা পাশে এসে বসেছে বুঝতেও পারিনি।
আমি বললাম, “আমার খিদে পায়নি মা!” বুঝতে পারলাম গলা ভেঙে যাচ্ছে! কান্না পাচ্ছে খুব!
মা কিছু না বলে শুধু নিজের হাতটা আমার কপালে রাখল! আমি আর শান্ত থাকতে পারলাম না। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললাম! বার বার মাথার মধ্যে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই কথাটা হয়ত আমার মত হাজার হাজার মানুষ রোজ প্রতি মুহুর্তে ভাবে! “আমার সাথেই কেন এরকম হয়? কেন?”
কিছুক্ষন পর যখন একটু শান্ত হলাম, মা নিজের ফোন টা আমার হাতে দিয়ে বলল, “ফোন কর!”
আমি বললাম, “কাকে?”
মা চেয়ার থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল, “তুই জানিস কাকে!”
আমি বিছানায় উঠে বসলাম! মায়েরা সব বোঝে, সব জানে!
ডায়াল করলাম মায়ের ফোনটা নিয়ে। ২ বার রিং হওয়ার পরেই ও প্রান্ত থেকে বলল, “কাকিমা তুমি যাই বলো, আমি ওকে আনব্লক করব না! বড্ড খারাপ ব্যবহার করেছে ও আমার সাথে!”
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “সন্তু, একবার আসবি! আমি… আমি ঠিক থাকতে পারছি না রে!”
১৩
ভেবেছিলাম সুন্দর একটা প্রেমের গল্প হবে। কিন্তু সব ঘেঁটে যাচ্ছে! স্নিগ্ধা চলে গেল! ত্রিধা এসেও চলে গেল! থুড়ি আসার আগেই চলে গেল! আমার জীবন টা কেমন যেন হয়ে গেছে! না রয়েছে থ্রিল, না রয়েছে রোমান্স!
ধুর বাল! ভালো লাগে না!
“ঠিক আছিস?” জিজ্ঞেস করল সন্তু। আমার ফোনের ১ ঘন্টার মধ্যেই ও চলে এসেছে! ছেলেটা আমাকে বড্ড ভালোবাসে!
পরক্ষনেই ভাবলাম সবাই আমাকে এত ভালোবাসে! তাহলে আমি কেন এরকম ভাবে কষ্ট পাচ্ছি!
“কীরে?” আবার বলল সন্তু!
আমি বললাম, “হ্যাঁ ভাই! একটু আগে অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল রে। বলে বোঝাতে পারব না!”
– সে তো আমি ব্লক করেছিলাম বলে। জানি! ওরম হয়েই থাকে!
– ফালতু কথা খালি। নিজেকে অত ইম্পরট্যান্স দিস না তো! আমার ত্রিধার কথা মনে পড়ছিল। তাই মন খারাপ লাগছিল।
সন্তু চেয়ার থেকে উঠে বলল, “আমি তাহলে চলে যাই?”
আমি এবার রাগী চোখে তাকালাম ওর দিকে। বললাম, “কেন ব্ল্যাকমেইল করছিস। মা বিরিয়ানি আনতে বলল বাবাকে তুই এলি বলে। না খেয়ে চলে যাবি!”
সন্তু কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বলল, “ঠিক আছে। কাকিমার জন্য আর একটু বসেই যাই নাহলে!”
আমি বললাম, “পৌলমী কেমন আছে?”
সন্তু বলল, “ভালো রে! খুবই ভালো!”
– বিয়ে কবে করছিস?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– আরেহ মা খালি আমার বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিচ্ছে! তাই ভাবলাম এক ছেলের বিয়ে হলে একটু থামবে হয়ত।
সন্তু গদগদ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে কথাটা বললি! মন ভালো হয়ে গেল! Thank you! Thank you!”
আমি হেসে বললাম, “তাহলে বল কবে করছিস?”
সন্তু কয়েক মুহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “অমিত… আমি জানি তুই সবটা নরম্যাল করার চেষ্টা করছিস! এবং তোর জায়গায় দাঁড়িয়ে তুই হয়ত ঠিক! কিন্তু নিজের থেকে পালিয়ে বেড়াস না! তুই এতটা ভেঙে পড়ছিস কেন আবার! কি এমন হল?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আমি… আমি জানি না রে। এই মেয়েটা আমার কেউ নয় অথচ অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে! কী বলতো, কষ্ট টা কিন্তু মেয়েটার সাথে প্রেম করতে চাই বলে হচ্ছে না! মেয়েটা ভূল নাম্বার দিল বলে হচ্ছে! মানে… এতটাই খারাপ আমি! মানে ভূল নাম্বার দিয়ে কাটাতে হল ভাই!”
সন্তু বলল, “সব বুঝলাম, কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখ। মেয়েটা প্রথম দিন থেকেই তোকে মিথ্যে বলেছিল। একটাও সত্যি কথা বলেনি! তুই বুঝতেও পারিস নি! সেটা ভাব! নিজেকে ব্লেম করিস না। হয়ত মেয়েটাই প্রব্লেমেটিক ছিল!”
কথাটা খুব ভুল বলেনি সন্তু। মেয়েটা তো শুরু থেকেই আমার প্রতি ডিসঅনেস্ট ছিল। এটা তো মিথ্যে না! ধুর! কি যে করি। ভেতর টা বড্ড তোলপাড় হচ্ছে! মানুষ চেনা কি এতটাই কঠিন?
(চলবে)