ত্রিধা
অনেকদিন গতে বাঁধা প্রেমের গল্প লেখা হয়ে ওঠেনি। থ্রিলার, রহস্য, গোয়েন্দা নিয়েই মেতেছিলাম অনেকদিন ধরে। যখন প্রেম করতাম, তখন মাসে একটা অন্তত প্রেমের গল্প না লিখলে গার্লফ্রেন্ড বাংলার পাঁচের মত মুখ করে বসে থাকত! আর এখন তো আবদার করারও কেউ নেই আর…
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠল আমার। মা ফোন করছে। উফফ! আবার সেই এক জিনিস! ধুর!! ভালো লাগে না ছাই! বিরক্ত মুখেই ফোনটা ধরলাম।
“বলো!”
ওদিক থেকে মা বলল, “না! কী আর বলি! যাই বলব তুই রেগে যাবি?”
আমি বললাম, “সব কথায় তো আমি রেগে যাই না মা! যেটায় রেগে যাই সেটা কেন বলো!”
– ঠিক আছে। রেগে যাবি জানি তাও বলব। তোর মামা একটা মেয়ে দেখেছে। খুব ভা-
“আমি জানতে চাই না মা!”
চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “আমি তো তোমাকে বলেছি আমি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করব না! তাও দিনের পর দিন কেন এরকম করছ?”
মাও এবার চেঁচিয়ে উঠল, “কেন করবি না তুই? আমি আর তোর বাবা করেছি, তোর কাকু কাকিমা করেছে আরও কত মানুষ করেছে, সবাই কি খারাপ হয় নাকি?”
– আরে এতো আজব ব্যাপার! যে মানুষটাকে জানিনা চিনিনা! তাকে আমি গিয়ে বিয়ে করে নেব?
– তো তোকে এভাবে বিয়ে করতে কেউ বলছে নাকি? সময় নে। চেন। জান। সমস্যা কী?
– আমার অনেক সমস্যা। আমি বিয়ে করব না। আর তুমি আমায় ফোন করবে না।
প্রচন্ড চিৎকার করে শেষ কথাটা বলে আমি ফোন রেখে দিলাম। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছিল আমার। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলা খাঁকরানির আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, শর্মিষ্ঠা দি দাঁড়িয়ে রয়েছে পেছনে। শর্মিষ্ঠা দি আমার রিপোর্টিং ম্যানেজার!
উনি বললেন, “পার্সোনাল কথা বলার থাকলে গেমস্ রুমে গিয়ে ফোন ধর। বা লিফট এর কাছে গিয়ে কথা বলো। এভাবে চিৎকার করে সবাইকে জানানোর কি খুব দরকার যে তোমার সাথে তোমার বাড়ির লোকের সমস্যা চলছে!”
আমি কিছু বললাম না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ২ টো বাজে! টিফিন টা আর জলের বোতল টা বের করে এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির দিকে।
২
এবার একটু শান্ত লাগছে। ব্যাকগ্রাউন্ডটা সেরে নিই। আমি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে আমার চাকরি। কোম্পানীর এই অফিসটা কলকাতার শেক্সপিয়র সরনীতে। একটা বড় ১৮ তলা বিল্ডিং এর সিক্সথ ফ্লোরে আমাদের অফিস। শুরুতে প্রেমের গল্প নিয়ে যে ইন্ট্রো টা শুরু করেছিলাম তার কারন লেখাটা আমার প্যাশন। যদিও লিখে আমি এখনও অবধি খুব সুবিধে করতে পারিনি। কয়েকটা লিটল ম্যাগ ইত্যাদি জায়গায় লেখা বেরোয় আর আমার ফেসবুক পেজ এবং ব্লগ এই দু’টো জায়গাতে লিখি আমি। এইটুকুই। আমার ৩০ বছর বয়স। অর্থাৎ বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের বিয়ের বয়স যাকে বলে। কাজেই বাড়িতে কি হচ্ছে সেটা আশা করি ওপরের পরিচ্ছেদ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে সবার কাছে।
১৮ তলা অফিসের একদম ওপরের ছাদ থেকে পুরো কলকাতা দেখা যায়। এই জায়গাটা আমার বড্ড শান্তির জায়গা। এই টিফিনের এক ঘন্টা আমি প্রত্যেকদিন একা একা চলে আসি এই ছাদে। তারপর ঝাদের একদম ধার থেকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি। মাঝে মাঝে নীচের দিকে তাকালে মাথাটা ঘুরে ওঠে! জানি একবার পড়ে গেলে সব শেষ! তাও এই থ্রিলটা বড্ড ভালো লাগে। এখনও অবধি এই জায়গাটা কীভাবে মানুষের অগোচরে রয়ে গেছে কে জানে! আজ ঠান্ডাটা বেশ রয়েছে। আমার ব্যাটম্যান হুডিটা পরে নিলাম মাথায়। আজ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। সামনের দিকে তাকিয়ে শুধু মনে হচ্ছে শান্তি শুধু এখানেই। সারাটা দিন সারাটা রাত যদি এখানে বসে থাকতে পারতাম তাহলে কি ভালো হত তাই না? কত দিন ঠিক করে কিছু লেখার টাইম পাইনি। রোজ এই অফিস আর বাড়ি করতে করতে জীবনটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে!
হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। একটি মেয়ে হাতে টিফিন নিয়ে ছাদে এসেছে। ব্যাস শুরু হল! এবার আস্তে আস্তে লোক বাড়বে! দিব্যি ছিলাম এতদিন! ধুর! মেয়েটা বসল বেশ খানিকটা দূরে আমার মত একইভাবে পা ঝুলিয়ে! কপিক্যাট কোথাকার!
আমি ব্লুটুথ ইয়ার ফোন টা কানে দিয়ে গান চালালাম একটা। তারপর খুললাম টিন্ডার অ্যাপ টা। লোকজন ভাবছে… কী? টিন্ডার! আমি জানি ব্যাপারটা খুব বোকা বোকা কিন্তু আমি টিন্ডারে সময় পেলেই সোলমেট খুঁজতে থাকি। আমার এক্স শালা ব্রেক আপ এর এক সপ্তাহের মধ্যে সোলমেট পেয়ে গেল! আর আমি ২ বছর পরেও পেলাম না।
মিনিট খানেক পরেই গান চলা সত্ত্বেও পেটের মধ্যে খরগোশ দৌড়োনোর আওয়াজ টা স্পষ্ট পেলাম। বুঝতে পারলাম মায়ের ওপর হওয়া রাগটা খাবারের ওপর দেখিয়ে লাভ নেই। যদিও খাবারটা বানিয়ে দিয়েছে মা নিজে। টিফিন বক্সটা খুলে দেখলাম পরোটা আর আলুর দম। নাহ আর লোভ সংবরন করতে পারলাম না।
৩
আমি মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে গেলে আমার মুখে পেনটা চলে যায়! সাধারনত কোনো গল্প নিয়ে ভাবার সময়েই এরকমটা হয় আমার। আজও সেরকম একটা সময়ে শর্মিষ্ঠা দি এসে বলে গেল “ইউনিয়ন অ্যালায়েড প্রাইভেট লিমিটেড” এর ফাইলটা রেডি করো। কাল প্রেজেন্টেশন আছে!” বসের হুকুম! অগত্যা গল্পস্বল্প ছেড়ে শুরু করলাম ইউনিয়ন অ্যালায়েডের কাজ। ঘন্টা তিনেক পর সব ফাইল রেডি করার পর একটু অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করে দেখলাম যে গল্পটার কথা ভাবছিলাম সেটা আর মনে পড়ছে না! ধুর ছাই!
কাল বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে একটা কথাও বলিনি। সোজা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলাম। শুধু রাত্রে খাবার দেওয়ার সময় একবার ডেকেছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার নিয়ে এসে আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে
দিয়েছিলাম। বাবা এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। মা কিছু বলতে গেলে বলে, “তোমাদের মা ছেলের ব্যাপার! তোমরা মেটাও! আমি এর মধ্যে নেই!”
অপেক্ষা করছিলাম ২ টো বাজার জন্য। ২ টো বাজতেই টিফিনটা নিয়ে বেরোতে যাবো অমনি সঞ্জয় এসে বলে গেল, “এই অমিত, শর্মিষ্ঠা দি তোমাকে ডাকছে ওর ঘরে!”
অসাধারন! আর ডাকার টাইম পেল না? গেলাম ওঁর ঘরে।
“শর্মিষ্ঠাদি আসছি!”
কম্পিউটারে কিছু একটা করছিলেন উনি। না তাকিয়েই বললেন, “হ্যাঁ এসো!”
ঢুকলাম ওঁর ঘরে। বসলাম সামনের একটা চেয়ারে!
উনি বললেন, “বাড়ির ঝামেলা মিটেছে?”
আমি বললাম, “না! এখন মিটবে বলে মনে হয় না!”
শর্মিষ্ঠা দি বললেন, “তা সেই ঝামেলার প্রভাব কাজে পড়লে তো সমস্যা!”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কাজে পড়েছে নাকি?”
শর্মিষ্ঠা দি ওর কম্পিউটারের মনিটর টা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন, “১৭ই ডিসেম্বর ওদের দেড় লাখ টাকার একটা ট্র্যানজাকশন হয়েছে! তোমার ফাইলে ওটার কোনো মেনশনই নেই!”
এই রে! এটা মিস করে গেছি তাহলে আমি… আমার কাছে যে এক্সেল শিট টা আছে তাতে তো এটা দেখলাম না আমি!
আমি বললাম, “শর্মিষ্ঠাদি, আমি এটা আসলে… বোধহয়… খেয়াল করিনি…
শর্মিষ্ঠাদি মনিটর টা নিজের দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “দেখো অমিত, আজ আমি খেয়াল করলাম বলে ঝামেলাটা এড়ানো গেল। যদি না খেয়াল করতাম তাহলে তোমার খেয়াল না করার মাশুল দিতে হত আমাদের কোম্পানীকে। বুঝতে পারছ তো?”
সত্যিই আমার কিছু বলার নেই। ভুল টা আমারই ছিল।
শর্মিষ্ঠাদি বললেন, “যাই হোক। খেয়াল রেখো এরকম যেন আর না হয়! যাও এখন!”
ব্যাপারটা হালকার ওপর দিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু খুব অপমানিত লাগছিল নিজেকে। ধুর! এসব কাজ করতে আর ভালো লাগে না ছাই!
৪
টিফিন নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখলাম আর এক বিপত্তি। কালকের সেই মেয়েটি আজ চলে এসেছে আমার আগেই। শুধু তাই নয়, ওর এত বড় সাহস যে আমার বসার জায়গাতে দিব্যি আমার মত করে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে! কড়া করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, পরক্ষনেই মনে হল অফিসটা তো আর আমার বাবার নয়! যাক গে যাক! কাল ও যেখানে বসেছিল আমি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বসতে যেতেই হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠল, “আরে আরে!! বসবেন না ওখানে!”
মানে টা কী? কেন বসব না? বয়ফ্রেন্ডের জন্য জায়গা রাখছে নাকি? তাও এত দূরে?
বললাম, “মানে? কেন বসব না?”
মেয়েটা বলল, “পায়রা পটি করেছে ওদিকটায়। সেই জন্যেই আমি এদিকটায় বসেছি। আপনার কালো প্যান্ট টা কিন্তু যাবে ওদিকে বসলে!”
ওহ! এই জন্যে! কিন্তু তাহলে বসব কোনদিকে? এই দু’টো দিকেরই ভিউ সব থেকে ভালো! বাকি দু’টো দিকে বড় বড় কয়েকটা বিল্ডিং রয়েছে! ধুর! এই মেয়েটা এসেই ঝামেলা বাড়াল! দিব্যি ছিলাম আমি একা! আমি ইতস্তত করছি দেখে মেয়েটি এবার বলল, “আপনি চাইলে এদিকে বসতে পারেন। আমি ধাক্কা মেরে ফেলে দেব না। চাপ নেই!”
হাসতে হত? এটা জোক ছিল! বেশী পাকা! কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে বসলাম মেয়েটার সাইডে। পা ঝুলিয়ে। খাওয়ার সময় কেউ পাশে বসে দেখলে খুব অস্বস্তি লাগে! তাই চুপচাপ বসে রইলাম আমি কিছুক্ষন।
মেয়েটি এবার বলল, “আপনি কি বরাবরই এরকম কম কথা বলেন?”
আমি থতমত খেয়ে বললাম, “হ্যাঁ? কই না তো!”
মেয়েটি হেসে বলল, “আপনাকে আমি বসতে বললাম এদিকটায় কোথায় একটা থ্যাঙ্কিউ বলবেন তা না! মুখ গোমড়া করে বসে আছেন!”
আমি বললাম, “ওহ আচ্ছা। সরি… থ্যাঙ্কস।”
মেয়েটি বলল, “বাপরে আপনি তো পুরো রোবট মনে হচ্ছে।”
আমি বললাম, “কী? মানে?”
মেয়েটি বলল, “কিছু না! আমি যাই! আমারই ভুল হয়েছে গায়ে পড়ে আলাপ করা!”
কথাটা বলেই আর কিছু আমাকে বলতে না দিয়ে মেয়েটা উঠে চলে গেল। কি অদ্ভুত মেয়ে ভাই! আমি আর সময় নষ্ট না করে মায়ের দেওয়া টিফিনটার সদব্যবহার করতে শুরু করলাম। লুচি, আলুভাজা, মিষ্টি! যাক এতক্ষনে আমার মুডটা একটু ভালো হল!
(চলবে)