কলেজে যখন পড়তাম, তখন বাড়ি থেকে কলকাতা যেতাম ট্রেনে। মাঝে মাঝে এমন কিছু কিছু স্টেশন পড়ত, যেগুলোতে লোকজন তেমন একটা নামত না কিংবা উঠতও না। কিন্তু তাও ট্রেন দাঁড়াতো। আমার খুব ইচ্ছে হত ওই স্টেশনে নেমে পড়তে। মনে হত এরকম একটা ফাঁকা স্টেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যায়! চলে যাওয়া ট্রেনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা যায়! তখন ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। এখন আছে।
আজ এরকমই একটা স্টেশনে বসে আছি আমি। কেউ নেই স্টেশনটায়। মাঝে মাঝে দু’একটা থ্রু ট্রেন যাচ্ছে। একটুও না থেমে। নভেম্বর মাস। খুব ঠান্ডা না হলেও বাতাস মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে যে শীতকাল আর বেশী বাকি নেই।
হঠাৎই নিজের ডান হাঁটুতে একটা নরম আঙুলের টোকা খেয়ে তাকিয়ে দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে, হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটির বয়স কোনোভাবেই ৪-৫ বছরের বেশী না। ছেলেটির পরনে ভালো পোষাক। ভালো বাড়ির ছেলে বোঝা যাচ্ছে! একটু আগেই ছেলেটাকে দেখেছি আমি। আমার পেছন পেছন লাইন পেরোচ্ছিল।
আমি বললাম, “কিছু বলবে?”
বাচ্চা ছেলেটি মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাঁদছো কেন?”
আমি হেসে বললাম, “আমি কেন কাঁদব?”
বাচ্চাটি বলল, “এই তো তোমার চোখ লাল!”
আমি বেশ মজা পেলাম। বললাম, “তোমাকে কে বলল, চোখ লাল হওয়ার মানে কাঁদা?”
– আমি জানি তো! আমার মা যখন কাঁদে, তখন মায়েরও চোখ লাল হয়!
– তোমার মা কেন কাঁদেন?
– বাবা মারে তো! তাই…
আমি এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। “তোমার বাবা তোমার মাকে মারেন?”
ছেলেটি এবার আমার পাশের ফাঁকা জায়গাতে বসে পড়ল। বলল, “হ্যাঁ, মারে তো! রোজ মারে!”
আমি বললাম, “তুমি কিছু বলো না কেন?”
বাচ্চাটি বলল, “আমি কী করে বলব। আমি তো ছোটো। আমাকেও তো মারে!”
কেন জানিনা চোয়ালটা শক্ত হচ্ছে। রাগ হচ্ছে খুব!
বললাম, “তোমার বাবা-মা কোথায়? তুমি একা কেন?”
বাচ্চাটি বলল, “বাবা দোকানে কি একটা কিনছে। আমাকে বলল স্টেশনে দাঁড়াতে!”
কি অদ্ভুত এই বাচ্চাটা। দিব্যি এসে অচেনা জায়গায়, নির্জন স্টেশনে, একজনের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমি এবার বললাম, “তোর নাম কীরে?”
ছেলেটি বলল, “সপ্তর্ষি! তোমার নাম কী?”
আমি বললাম, “আমার নাম সমুদ্র!”
সপ্তর্ষি বলল, “ধ্যাত! সমুদ্র আবার কারও নাম হয় নাকি?”
– কেন হয় না শুনি?
– সমুদ্রে তো বেড়াতে যায় সবাই। আমিও গেছি। দীঘা!
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না! সপ্তর্ষি এবার বলল, “তুমি তো বললে না!”
আমি বললাম, “কী?”
সপ্তর্ষি বলল, “এই যে তুমি কাঁদছিলে কেন? তোমার বাবাও কী তোমায় মেরেছে?”
আমি বললাম, “নাহ! আমার বাবা আমাকে মারেন না! আমাকে ভালোবাসেন খুব!”
সপ্তর্ষি অবাক হয়ে বলল, “ধুর তুমি মিথ্যে বলছ! বাবারা তো সবাইকেই মারে!”
তারপর আমি কিছু বলার আগেই, একটু দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই দেখো আমার বাবা!”
আমি তাকালাম সেদিকে! একজন মাঝবয়সী লোক লাইন ক্রস করছে। তার পাশেই একটা ছোটো জটলা হয়েছে। লোকটা হঠাৎ কি খেয়াল হতে এগিয়ে গেল সেদিকে! সপ্তর্ষি এবার চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল, “আমি যাই বাবার কাছে!”
আমি হঠাৎ কি মনে হত ওর হাতটা ধরে নিলাম। বললাম, “চকোলেট খাবি?”
সপ্তর্ষি এক সেকেন্ড ভেবে বলল, “হ্যাঁ। খাবো!”
বললাম, “চল তাহলে!”
তারপর ওর হাত ধরে হাঁটা দিলাম উল্টোদিকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামব নামব করছে। সপ্তর্ষির এখন ওদিকে না যাওয়াই ভালো। নিজের মৃতদেহ দেখতে এইটুকু বাচ্চার একদম ভালো লাগবে না। কষ্ট হবে। তাছাড়া ও এখনও জানেই না, কিছুক্ষন আগে আমার সাথে লাইন পেরোনোর সময় আমরা দু’জনেই ট্রেনের তলায় চলে গিয়েছি।
