১
শেষ ক্লাসের ঘন্টা পড়েছে বেশ খানিকক্ষন আগেই। কিন্তু বাইরে তখনও কিছু ছেলে মেয়ের জটলা। সে জিজ্ঞেস করল – কী ব্যাপার?
একজন বলল, “না স্যার! কিছু না!”
একটু আগেই ক্লাস করছিল এরা সবাই। জিজ্ঞেস করছিল সারা দেশে ঘটে চলা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এনআরসি কী? সিএএ কী? কেন দরকার? কেন দরকার নেই ইত্যাদি ইত্যাদি!
হঠাৎ ক্লাসের ঘন্টা বাজার পর সে খুব দূরের কেউ হয়ে গেল কী?
অবশ্য সব কিছু নিয়েই সে একটু বেশী ভাবে!
ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
২
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট খুলে যায় সকাল ৭ টারও আগে। সে যখন কলেজে ঢুকছে তখন দেখল বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের ফাঁকা মাঠে আজ ৫০-৬০ জন ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কীসব প্ল্যাকার্ড!
অত পাত্তা না দিয়ে ক্লাসে চলে গেল সে। ছাত্ররা বসে আছে।
ক্লাসের ছাত্রদের সবার মুখই কেমন যেন থমথমে!
কী হয়েছে রে?” জিজ্ঞেস করল সে আবার।
একজন বলল, “স্যার আমাদের ফিস!”
কী হয়েছে ফিস এর?” জিজ্ঞেস করল সে আবার
উত্তর এল, “স্যার আমাদের ফিস মাসে ৭৫ টাকা থেকে হঠাৎ করে ৩৭৭৫ করে দেওয়া হয়েছে! তাই কিছু ছেলে মাঠে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে!”
এত টাকা একসাথে বাড়ল? অদ্ভুত তো!
স্টাফ রুমে টিচারদের আলোচনায় সে শুনল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিস বাড়েনি বহুকাল। প্রায় ১৮ বছর পর বাড়ল ফিস। সেই জন্যেই নাকি এত ঝামেলা।
একজন টিচার তো বলেই বসলেন, সবকটাকে ধরে চাবকাতে হয়। এত বছর পর বেড়েছে তাতেও এদের সমস্যা!
কিন্তু এত বছর এরা পড়েনি তো! তার মাশুল এরা দেবে কেন?
৩
পরের দিন সে এসে দেখল মাঠের ভীড় টা বেড়েছে! ১০০র একটু বেশী হয়েছে সংখ্যাটা। ভীড়ের দিকে তাকিয়ে একটা চেনা মুখ তার চোখে পড়ল মনে হল।
ক্লাসে গিয়ে দেখতে পেল একজন কম। অয়ন আজ আসে নি। ও গিয়েছে মাঠে।
“কেন যায় এসব ঝামেলায় জড়াতে!” সে জিজ্ঞেস করল
একজন ছাত্র বলল, “আরে দাঁড়ান না স্যার। দু’দিনের ব্যাপার! কয়েকদিন পর দেখবেন সবাই আবার ক্লাসে আসছে।”
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর সময় দেখা গেল ছাত্ররা ঘিরে রেখেছে ভিসির ঘর। ঘেরাও করেছে। বাড়ানো ফিস না কমালে রুম থেকে বেরোতে দেবে না।
সে আর অপেক্ষা করেনি। তবে রাত্রে Whatsapp এ জানতে পেরেছিল খুব ঝামেলা হয়েছে। বেরোতে না পেরে ভিসি পুলিশ ডেকেছিলেন। পুলিশ মারধোর করে ঘেরাও তুলেছে। সেই ভিডিওগুলোই সার্কুলেট হচ্ছে এর ওর Whatsapp এ।
৫
পরের দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে অবাক হল সে। মাঠে সেদিন কাতারে কাতারে ছাত্র! স্লোগান দিচ্ছে। ভিসির পদত্যাগ পত্র চাইছে।
সে খুব অবাক হল দেখে! যে ছেলেটি বলেছিল অয়ন দু’দিন পরেই ক্লাসে আসবে সে আজ বিক্ষোভকারীদের দলে গিয়ে ভীড়েছে!
স্টাফরুমে অন্যান্য টিচার রা ছাত্রদের বাপ বাপান্ত করছে। ভিসির কোনো হেলদোল নেই শুনল সে। কোনোভাবেই বাড়িয়ে দেওয়া ফিস সে কমাবে না।
তিনতলার বারান্দা থেকে দেখছিল ও ছাত্রদের।
৩৭
ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। তাও কলেজের সেই মাঠের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলেগুলো। আজ প্রায় এক মাসেরও বেশী হয়ে গেল।
ক্লাস হচ্ছে না। সব ক্লাসে একজন দু’জনের বেশী ছাত্র নেই। সব ছাত্ররা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে।
ভিসির একটুও নড়চড় নেই। ফিস উনি কমাবেন না।
তিনি পুলিশ প্রোটেকশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। পুলিশ প্রোটেকশন নিয়ে বেরোচ্ছেন।
স্টাফরুমে গুজব শোনা গেল কাল নাকি মাঠ থেকে ইট পাটকেল ছোঁড়া হয়েছে বিল্ডিং লক্ষ্য করে। কয়েকটা কাঁচ ভেঙেছে।
সেই নিয়ে প্রচুর মানুষের উদ্বেগ! কিন্তু কয়েকদিন আগেই যে ছাত্র-ছাত্রীদের গায়ে পুলিশ দিয়ে হাত তোলা হল সেটা সবাই সাধারন ঘটনা হিসেবেই নিয়েছে।
৩৮
ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে সে দেখল ছেলেমেয়ে গুলো কে। ক্লান্তি নেই। দিন নেই রাত নেই। সারাক্ষন বসে আছে ওই মাঠে।
স্কুলের ঘন্টা পড়ার আগে অবধি সে ওদের নিজেদের লোক ছিল। এখন তো আর ক্লাসও নেই, ঘন্টাও নেই। এখন সে শুধুই বাইরের লোক।
স্টাফরুমে গুজব শুনল সে, আজ ভিসির রুম অভিযান করবে ওরা। ভিসিও পুলিশ কে বলে রেখেছে. ওর রুমের দিকে এলেই যেন টিয়ার গ্যাস, গুলি ছোঁড়া হয়!
গুলি? ছাত্রদের বিক্ষোভে গুলি?
শোনা গেল অনেক ওপর মহলের নির্দেশ! কেউ যেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে না পারে সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে। সেই কারনেই এই নির্দেশ!
৩৯
কাল ওরা আসেনি। সারা রাত দাঁড়িয়েছিল মাঠে। এই ঠান্ডায়।
তিনতলার বারান্দা থেকে সে দেখল আজ ভীড়টা এগোচ্ছে। স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের দিকে।
দ্রুত পায়ে সে নেমে গেল নীচে!
পুলিশ বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। পেছনে ভিসি। তার পেছনে শিক্ষকরা।
ছাত্ররা আসছে।
ওদের থামতে বলছে পুলিশ।
কিন্তু ওরা আজ থামবে না। আজ ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ভীড়টা আরও কাছে এলো। স্লোগানের আওয়াজ আরো স্পষ্ট হল। আবারও থামতে বলা হল ওদের।
তাও কাছে এল ওরা। গেটের প্রায় কাছে যখন চলে এসেছে ওরা, তখনই… গুলির আওয়াজ।
কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল ভীড় টা।
তারপর এগোতে লাগল আবার।
আবার চলল গুলি। ছোঁড়া হল টিয়ার গ্যাস!
একটা রক্তও মাটিতে পড়ল না।
সে হাসল। ওরা ছাত্র। ওরা বিপ্লব! ওরা আদর্শ! আদর্শ কে মেরে ফেলা যায় নাকি?
কখনই যায় না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একটা বড় রাষ্ট্রের মত। শাসক আসবে শাসক যাবে। থেকে যাবে ছাত্ররা। আর থেকে যাবে আদর্শগুলো।
ইনকিলাব…
পরের লাইনটা শোনা গেল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে!