সময়টা মার্চ মাস হলেও গরম টা কিন্তু বেশ পড়ে গেছে অলরেডি। আচ্ছা বেশ! সত্যিই কথা দিয়েই শুরু করি বরং। গরম খুব না পড়লেও আমার গরম লাগে বেশী। অন্তত আর পাঁচজনের থেকে বেশী তো বটেই। সেই কারনেই অফিস থেকে ফিরে স্নান টা একেবারে মাস্ট। সেটা ডিসেম্বরের শীত হোক বা জুন মাসের গরম। আই ডোন্ট কেয়ার!

মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু কারনে মন খারাপ লাগে আমার। আবার মাঝে মাঝে মন খারাপের কারনটা ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু কিছু একটা নিয়ে মনের মধ্যে যেন দুঃখ টা গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। কাব্যি করে লাভ নেই। আসল কথায় আসা যাক। আমার পেন ড্রাইভ টা হারিয়ে গেছে। ১৬ জিবি পেনড্রাইভ। স্যান ডিস্ক এর। লাল কালো দেখতে। খুব কমন! সবার কাছেই আজকাল থাকে ওটা। তবে মন খারাপ শুধু ১৬ জিবি জায়গার জন্য নয়। ওই ১৬ জিবি জায়গা জুড়ে একজনের ইয়ে ছিল। ভিডিও ছিল, ছবি ছিল। ওগুলোর ব্যাকআপও নেওয়া নেই। সেটার জন্যেই আরও মন টা কেমন যেন খারাপ।

স্নান করে যখন বাথরুম থেকে বেরোলাম তখন রাত সাড়ে ১০ টা বাজে। স্নান করলে আমার মুড টা সাধারনত একটু ভালো থাকে। কী একটা হিন্দি গান গুনগুন করছিলাম। ডাইনিং টেবিলে ফোনটার কাছে যেতে দেখলাম নোটিফিকেশনের লাইট টা ব্লিংক করছে। তোয়ালে টা বারান্দায় মিলে দিয়ে একটা টিশার্ট পরে ফোনটা হাতে নিলাম। ২ টো মিসড কল আর ২ টো Whatsapp Message. মিসড কল একটা মায়ের আর একটা আমার ইয়ের… ক্রাশের… মায়ের মিসড কল টা দেখলেই মুড টা অফ হয়ে যায় আমার। শুধু বলে বাড়ি যেতে। কী করে বোঝাবো সাংবাদিকের চাকরিতে মা-বাবা বাড়ি-ঘর সব ভুলে যেতে হয়। দিনরাত খালি কাজ আর কাজ। তবে সেই কাজ যে আমার ভালো লাগে না তা নয়। প্রচন্ড ভালো লাগে। সেই কারনেই অন্য অফার পাওয়া সত্ত্বেও এই চাকরিটা আমি ছাড়িনি।

যাই হোক ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক হল এবার বর্তমানে ফিরে আসি। রাত সাড়ে দশটার সময় ক্রাশের মিসড কল দেখতে কার না ভালো লাগে। সাথে সাথে কলব্যাক করলাম ওকে। কিন্তু ফোনটা ধরল না। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। ফোনের কাছে নেই হয়তো। কে জানে। ফোন টা কান থেকে নামিয়ে দেখলাম দু’টো মেসেজ। প্রথমের টা দেবুর। ও জিজ্ঞেস করছে কলকাতায় ভালো স্ট্রিপ ক্লাব আছে কিনা! উফফ! এই ছেলেটা জাস্ট যাতা লেভেলের নোংরা। না মানে এমনি ছেলে ভালো। দারুন ফটো তোলে। আমার সাথে ওর সম্পর্কও খুব ভালো। ক্রাশের ফটো, ভিডিওগুলো ওরই তোলা। কিন্তু সব সময় খালি স্ট্রিপ ক্লাব, পানু এসব ছাড়া কোনো কথা নেই।

সেকেন্ড মেসেজ টা ইন্দ্রাক্ষীর মানে আমার ক্রাশের। ও লিখেছে, “তোর পেনড্রাইভ টা পেয়েছি। কাল দিয়ে দেবো”

কোনটা বেশী আনন্দের সেটা ভাবছিলাম। ইন্দ্রাক্ষীর আমার পেনড্রাইভ পাওয়া নাকি ওর আমাকে ফোন করাটা। যাক দিনের শেষ টা বেশ সুন্দর ভাবেই হল। পরক্ষনেই একটা খেয়াল পড়তে আঁতকে উঠলাম আমি। পেন ড্রাইভের মধ্যে ইন্দ্রাক্ষীর ফটো ভর্তি। ও যদি এটা দেখে তাহলে তো…

এই সেরেছে। সাথে সাথে আবার ফোন করলাম ওকে। কিছু একটা বলে পেনড্রাইভ টা দেখা থেকে আটকাতে হবে। একটু পরেই ও প্রান্ত থেকে জানান দিল সুইচড অফ!

কী হল কেস টা? এখনও ১১ টা বাজেনি! আর ফোন সুইচড অফ! আমাদের এমনিই সারা রাত ফোন অন রাখতে হয়। আর তাছাড়া ইন্দ্রাক্ষীর তো আজ নাইট শিফট! ওকে সারা রাত এমনিই অফিসে থাকতে হবে। তাহলে সুইচড অফ কেন?

পরের দিন অফিসে ঢুকলাম ৯ টায়। আমাদের এডিটর আফসার ভাই বললেন ডেস্কে অনেকগুলো নিউজ আছে। যেগুলো খুব তাড়াতাড়ি রিরাইট করতে হবে। তারপর কিছু এজেন্সি কপিও ছিল মেইল এ। ওগুলোও ট্র্যানস্লেট করতে হত। তড়িঘড়ি কাজে বসে যাওয়ায় মাথা থেকে ইন্দ্রাক্ষীর কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল।

দেবু ঢুকল এক ঘন্টা পর। আমার কিউবিকলের সামনে এসে দাঁড়াল হাসি মুখ করে। আমি বললাম, “কীরে স্ট্রিপ ক্লাব পেলি?”

দেবু এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “গুপ্তধন পেয়েছি মামা! গুপ্তধন!”

আমি বললাম, “তাই? এত ভালো?”

দেবু হেসে বলল, “তুই চল! কেন ভালো বলছি বুঝতে পারবি!”

আমি বললাম, “তুই তো জানিস! আমি ওই রসে বঞ্ছিত! কেন আমাকে বলিস!”

–       “মানে দাঁড়ায়না বলছিস?”

–       Shut up দেবু!

দেবু হাসল আবার। বলল, “কাজ কর। পরে ফটো দেখাবো। অনেক ফটো তুলেছি!”

ও হ্যাঁ বলা হয় নি বোধহয়। দেবু আমাদের ফটোজার্নালিস্ট! সাংবাদিকতার ভাষায় যাকে বলে চিত্রসাংবাদিক।

শেষ কথাটা বলে দেবু চলে গেল আফসার ভাইয়ের ঘরে! আফসার ভাই আমাদের এডিটর আগেই বললাম। অফিসে যখন জয়েন করি তখন থেকেই দেখে আসছি সবাই এনাকে আফসার ভাই বলে। তাই আমিও মেজরিটি কে ফলো করতে শুরু করলাম। বড্ড ভালো মানুষ উনি! এত বড় একটা পোস্ট হোল্ড করছেন। কিন্তু কোন অহংকার নেই। আমাদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন।

আর একজন আছেন আমাদের অফিসে সৃঞ্জয় দা। উনি অ্যাসোসিয়েট এডিটর। উনি আবার ঠিক এর উলটো। সব সময় কেমন যেঁ খিটখিট করে কথা বলেন। কিছু জিজ্ঞেস করলে খেপে যান। সেই জন্যে আমাদের সবার যেকোনো সমস্যা হলেই আমরা আফসার ভাই এর কাছেই যাই।

আজকেও ইন্দ্রাক্ষীর নাইট শিফট! কাজেই ওর অফিস ঢুকতে ঢুকতে প্রায় ৭ টা বাজবে। আসলে ঢোকার টাইম একটু পরেই। কিন্তু ও চলে আসে একটু আগেই। আর আমিও অপেক্ষা করি। ও অফিস ঢোকে আর আমি বেরোই। মাঝে মাঝে অফিসের ক্যান্টিনে বসে কফি খাই একসাথে। তারপর আমি বেরিয়ে যাই।

আজ সকাল থেকেও ওকে কয়েকবার চেষ্টা করলাম ফোনে। কিন্তু ওর ফোন অফ! ফোনটা কি গেলো নাকি? মাঝে মাঝে একটু আধটু ভয় লাগছে এটা ভেবে যে আমার পেনড্রাইভে ওর এত ফটো দেখে রাগ করে নি তো? পরক্ষনেই মনে হচ্ছে তার জন্য ফোন অফ কেন করবে?

আমাদের অফিসে রাজু বলে একটি ছেলে রয়েছে। এমনি ফাইফরমাশ খাটে। ফাইল টাইল এদিক ওদিক নিয়ে যায়। চা এনে দেয় ক্যান্টিন থেকে। ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম আমি দুপুরে কাল রাতে ওর ডিউটি ছিল কিনা।

রাজু বলল, “হ্যাঁ দাদা। ছিল তো! আর তাছাড়া আমি তো বাড়ি যাই না। এখানেই শুয়ে পড়ি রাত্রে।”

আমি বললাম, “ইন্দ্রাক্ষী এসেছিল কাল?”

রাজু বলল, “হ্যাঁ দাদা। এসেছিল। তবে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল!”

–       তাড়াতাড়ি মানে? ক’টায়?

–       ওই তো সাড়ে দশটা মত হবে।

–       সাড়ে দশটা? অত তাড়াতাড়ি?

–       হ্যাঁ দাদা। তাই তো দেখলাম। আমি ভাবলাম শরীর খারাপ ছিল হয়ত!

–       ওহ।

–       আর দাদা তোমার পেনড্রাইভ টা পাওয়া গেছে জানো তো!

–       হ্যাঁ। ইন্দ্রাক্ষী বলল কাল

–       আমাকে জিজ্ঞেস করছিল তোমার পেনড্রাইভ টা 8 GB না 16 GB।

–       ও তো জানত। 16 GB আমার টা।

–       কি জানি। আমাকে তো জিজ্ঞেস করল।

–       আমি বললাম ঠিক আছে। যা তুই।

রাজু আর কিছু বলল না। চলে গেল নিজের কাজে। আমার পেনড্রাইভ হারিয়েছে সেটা গোটা অফিসে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমি নিজেই এত হল্লা করেছিলাম সেদিন যে…

“এই বুদ্ধু…

চেনা গলার ডাকে পেছনে ফিরলাম আমি। এই নামে আমাকে একজনই ডাকে। দেবু।

“কী হয়েছে? বল…” বললাম আমি।

দেবু বলল, “পার্ক স্ট্রীট যাচ্ছি। যাবি নাকি?”

আমি বললাম, “তুই কি ভুলে যাচ্ছিস আমি ফটোজার্নালিস্ট নই। জুনিয়র সাব এডিটর!”

দেবু হেসে বলল, “একদম ভুলে যাই নি। তুই নিজের কাজ না করে অন্যের খোঁজ নিচ্ছিলি তাই ভাবলাম তুই ভুলে গেছিস হয়ত!”

আমি বললাম, “আরে দ্যাখ না! ইন্দ্রাক্ষীর ফোন কাল থেকে অফ! অফিস থেকেও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল শুনলাম।”

দেবু বলল, “দ্যাখ হয়তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটাচ্ছে!”

আমি বললাম, “ওর বয়ফ্রেন্ড নেই! ও সিঙ্গল!”

–       থাকলেও যে তোকে বলবে তুই সেটাই বা ধরে নিচ্ছিস কেন?

–       ধুর! তুই যা তো! আমাকে জ্বালাস না।

–       ওকে সোমবুদ্ধ বাবু!

দেবু হাসতে হাসতে চলে গেল। বড্ড বাজে বকে ছেলেটা।

অফিসে প্রায় ৮ টা অবধি অপেক্ষা করলাম ইন্দ্রাক্ষীর জন্য! কিন্তু ও এল না। আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লাম ওর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের অফিস টা ক্যামাক স্ট্রীটে। আর ওর বাড়ি বালিগঞ্জে। ক্যাব বুক করে নিলাম একটা। ইন্দ্রাক্ষীর ফোন টা এখনও অফ!

ওর বাড়িতে পৌঁছোলাম প্রায় আধঘন্টা পর। বালিগঞ্জের একটা চারতলা ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়ায় থাকে ইন্দ্রাক্ষী। ওর বাড়ি এখানে না। ওর বাড়ি আলিপুরদুয়ারে। দোতলায় উঠে বেল বাজালাম ওর ফ্ল্যাটে। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম কোনো সাড়া নেই! আবার বাজালাম বেল। ৩ বার ধাক্কাও দিলাম দরজায়! তাও কোনো সাড়া নেই।

এবার আমার একটু টেনশন হচ্ছিল। এই ফ্ল্যাটে আগে আমি বার কয়েক এসেছি। ওপরের ফ্লোরে মালিক দীপক বাবু থাকেন। ওকে ডাকলাম এবার। দীপকবাবুর বয়স প্রায় ৫৫ মত। বললেন “কী ব্যাপার!”

ওঁকে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বললাম সবটা। জিজ্ঞেস করলাম ওর কাছে এক্সট্রা চাবি আছে কিনা। কারন এটা গোদরেজের ইয়েল লক। যেকোনো একদিকে চাবি থাকলেই খোলা যাবে। উনি বললেন আছে। তারপর চাবি নিয়ে নেমে এলেন আমার সাথে।

উনি প্রথমে দু’একবার ডাকলেন ইন্দ্রাক্ষীকে। কিন্তু সাড়া না পেয়ে চাবি বের করলেন।

আমার কেন জানিনা বুকের ভেতর টা কেমন একটা করছিল। দরজাটা খুলতেই সেটা যেন থেমে গেল। সমস্ত কিছুই যেন থেমে গেল মুহুর্তের জন্য। ফ্ল্যাটের মধ্যে মাটিতে পড়ে রয়েছে ইন্দ্রাক্ষীর শরীর! পরনে অফিসের পোশাক। শরীর টা জাস্ট শোয়ানো রয়েছে মাটিতে। যেন মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে।

আমি সিঁড়িতে বসে আছি। মাথায় হাত দিয়ে। জাস্ট বুঝতে পারছি না এটা কী হল? কীভাবে হল? ইন্দ্রাক্ষীর মৃতদেহ টা যেমন ছিল তেমনই আছে। পুলিশ আসছে জানালো দীপক বাবু।

একটু আগে ইন্দ্রাক্ষীকে ওই অবস্থায় দেখে আমি সাথে সাথে দৌড়ে যাচ্ছিলাম সেদিকে। দীপক বাবু আমায় আটকালেন।  বললেন, “আগে পুলিশ আসুক। তার আগে কিচ্ছুতে হাত দেবেন না!”

কথাটা বলে উনি ওপরে গেলেন ফোন আনতে। আমি আর থাকতে পারলাম না। দৌড়ে গেলাম মৃতদেহের দিকে। গলায় হাত দিয়ে দেখলাম। নাহ! নাড়ি নেই। নিশ্বাস পড়ছে না। শরীরটা স্তব্ধ। সমস্ত কিছু থেমে গেছে। কিন্তু শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই ওর। ঘরের মধ্যে একটা অন্যরকম রুম ফ্রেশনারের গন্ধ! হঠাৎ গা টা যেন গুলিয়ে উঠল। উঠে মুখ চেপে চলে গেলাম বাথরুমে।

কয়েক মিনিট পর চোখে মুখে জল দিয়ে যখন বেরোলাম তখনও গাটা গুলোচ্ছে। বসে পড়লাম আমি ইন্দ্রাক্ষীর মৃতদেহের পাশে। ওর… ওর বাড়িতে তো জানাতে হবে সবটা। কিন্তু ওর বাড়ির নাম্বার তো আমি জানিনা। ওর ফোনে কী থাকতে পারে? এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর ফোনটা রয়েছে কিনা দেখছিলাম। চোখ গেল ফ্রীজের তলায়। দেখতে পেলাম ফোন টা।

ফোনটা বের করতে গিয়েও থমকে গেলাম। এটা কী ঠিক হবে? মিডিয়াতে কাজ করি আমি। এই ফোনটা এখন ইভিডেন্স। পুলিশ আসার আগে এই জিনিসে হাত দেওয়ার মত ভুল বোধহয় করা উচিত হবে না। নিজেকে বোঝালাম এরপর যা যা হতে চলেছে তার জন্য তৈরী হতে হবে। পুলিশ নিশ্চয় আমাকে জেরা করবে। আশ্চর্যের ব্যাপার ইন্দ্রাক্ষীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই! কিচ্ছু নেই।

ফোনটায় হাত দিলাম না। কিন্তু তক্ষুনি আমার চোখ গেল আর একটা জিনিসের দিকে। ফোনের একটু পাশেই পড়ে রয়েছে সেটা। আমার পেনড্রাইভ। লাল কালো স্যানডিস্ক!

“একী? আপনাকে বারণ করলাম বডির কাছে যেতে!” দীপকবাবুর গলা শোনা গেল এবার।

তাই তো! উনি বারন করেছিলেন বটে। এক সেকেন্ড! উনি ব্যাপারটা এত সহজ ভাবে নিচ্ছেন কীভাবে? ওঁর ফ্ল্যাটে একটা খুন হয়ে গিয়েছে আর উনি কেমন ঠান্ডা মাথায় পুলিশ ডাকলেন, উত্তেজিত হলেন না একটুও। ব্যাপারটা কেমন একটা অদ্ভুত না?

ওঁর অলক্ষ্যে পেন ড্রাইভ টা কুড়িয়ে নিলাম আমি। তারপর উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “আসলে মানে… দেখতে চাইছিলাম নাড়ি রয়েছে কিনা!”

দীপক বাবু বললেন, “কী দেখলেন? আছে?”

বললাম, “না!”

আর কিছু ভালো লাগছিল না! দীপক বাবু কে বললাম আমি কী বাড়ি যেতে পারি? আমার শরীর টা ভালো লাগছে না! গা গুলোচ্ছে!

ভদ্রলোক বললেন, “আপনার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে যান! পুলিশ চাইলে দিতে হবে!”

আমার কার্ড টা দিয়ে দিলাম ওঁকে। তারপর বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। খুব বমি পাচ্ছে!

ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষন হল। বেশ অনেকগুলো ফোন এল। আবার কেটে গেল! একটা ফোনও ধরতে ইচ্ছে করল না। এর মধ্যে অফিসের ফোনের সংখ্যাই বেশী! দেবুও ফোন করল বার কয়েক। আমি ধরিনি! সবাই হয়তো খবরটা পেয়েছে এর মধ্যে! ওরা জানে ইন্দ্রাক্ষীর সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক আমার ছিল।

হ্যাঁ আমার কষ্ট হচ্ছে! তার চেয়েও বেশী অদ্ভুত সব প্রশ্ন ঘুরছে মাথার মধ্যে! ফোনটা আবার বাজছে। দেবু ফোন করছে। তুলব না তুলব না করেও শেষ মুহুর্তে তুললাম ফোন টা।

–       বল

–       ঠিক আছিস?

–       হুম। কিছু বলবি?

–       কীভাবে হয়েছে কিছু জানতে পারলি?

–       নাহ। গিয়ে দেখলাম জাস্ট বডি টা…

–       কোনো Unusual কিছু পাস নি?

–       নাহ।

–       হুম। ফোন করতে পারতিস। আমি কাছেই ছিলাম। চলে আসতাম।

–       নারে ঠিক আছে।

–       শোন…

–       কী?

–       কাল অফিস আয়। কাল পুলিশ আসবে হয়ত! আফসার ভাই বলল। ওরা তোর সাথে কথা বলতে চাইবে। তুই না এলে সন্দেহ টা…

–       মানে? আমি খুন…

–       শান্ত হ সোম! তুই জানিস আমি কী বলতে চেয়েছি! ওরা কথা বলবে। তোর থাকাটা জরুরী। আমরা সবাই থাকব।

–       হুম।

–       ঠিক আছে। কাল দেখা হচ্ছে।

ফোন রেখে দিলাম আমি।

বাড়ি ফিরে পকেট থেকে সব জিনিস বের করে কম্পিউটের টেবিলে রেখেছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল আমার সেই পেনড্রাইভ টা। একটু কী আলাদা আমারটার চেয়ে? একটু নতুন বলে মনে হচ্ছে যেন!

শরীর টা আজ আর দিচ্ছিল না। কেন জানিনা। আর ভাবতে ইচ্ছে করল না। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

নিজের কিউবিকলেই বসেছিলাম তখন। ৩ জন সাদা পোষাকের পুলিশ এসে আফসার ভাই এর ঘরে গেল। সৃঞ্জয় দা এর পর আমার কিউবিকলের সামনে এসে বলল, “আমাদের নিউজপেপারের একটা রেপুটেশন আছে জানো তো?

ঘাড় তুলে বললাম, “জানি!”

সৃঞ্জয় দা বলল, “এই কান্ডটা ঘটানোর আগে একবারও ভাবলে না?”

–       মানে? কী ঘটালাম আমি?

–       কী দরকার ছিল ওর বাড়ি যাওয়ার?

–       কী বলছেন? না গেলে তো জানাও যেত না সব টা!

–       যেত না যেত না! তোমার কী তাতে?

–       মানে? ও আমার…

–       হ্যাঁ কে? ও তোমার কে? গার্লফ্রেন্ড নাকি? যত ঢং!

মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠেছিল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। এই সময় রাজু এসে বলল, “সোম দা আপনাকে আফসার ভাই ডাকছেন!”

কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলাম এডিটরের রুমে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে যেতে যেতেই দেখলাম ৩ জন পুলিশ রয়েছে ঘরের ভেতর। ২ জন বসে। একজন দাঁড়িয়ে।

আফসার দা আমায় দেখে বললেন, “এসো সোম। বোসো!”

তারপর পুলিশদের দিকে ফিরে বললেন, “আমি কি বেরিয়ে যাবো?”

একজন অফিসার বললেন, “না না। আপনি থাকুন! অসুবিধে নেই!”

আমি বসলাম একটা চেয়ারে। পুলিশ অফিসারটি আমার দিকে ফিরে বললেন, “আপনার নাম সোমবুদ্ধ রায়?”

বললাম, “হ্যাঁ।”

পুলিশ অফিসার টি তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “ইন্দ্রাক্ষী মজুমদারের সাথে আপনার সম্পর্ক কীরকম ছিল?”

আমি বললাম, “ভালোই ছিল!”

–       শুধু ভালো?

–       হ্যাঁ। মানে ভালো। বাড়াবাড়ি রকমের কিছু ছিল না।

–       মানে গার্লফ্রেন্ড ছিলেন না উনি আপনার। তাই তো?

–       না। ছিলেন না।

–       ওঁর কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল?

–       না। ছিল না।

–       কী করে জানলেন?

–       ও আমায় বলেছিল!

–       আপনি সেটা বিশ্বাস করেছিলেন?

–       কেন করব না?

–       না মানে হতে পারে আপনাকেও লাইনে রাখবে বলে…

বুঝতে পারলাম মাথাটা গরম হল কথাটা শুনে। তাও ঠান্ডা গলায় বললাম, “না! ওরকম ব্যাপার নেই!”

“লাস্ট কথা তো আপনার সাথেই হয়েছিল ওঁর?” জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ অফিসার টি

–       হ্যাঁ বোধহয়। টেক্সট করেছিল একটা।

–       কখন?

–       পরশু রাত্রে! সাড়ে দশটা নাগাদ!

–       ফোন করেন নি?

–       করেছিল। আমি বাথরুমে ছিলাম ধরতে পারিনি।

–       কী লিখেছিলেন টেক্সটে?

–       লিখেছিল যে আমার পেনড্রাইভটা পেয়েছে! যেটা হারিয়ে গিয়েছিল।

–       পেন ড্রাইভ?

–       হ্যাঁ আমার একটা পেনড্রাইভ হারিয়ে গিয়েছিল অফিসে!  ওটাই ও খুঁজে পেয়েছে বলে জানিয়েছিল!

–       ওহ! আচ্ছা। কী ছিল সেই পেনড্রাইভে!

এই জায়গায় সত্যি বলা যাবে না। কারন তাতে সমস্ত সন্দেহ পড়বে আমার ওপরেই। ওর ফটো ছিল বললেই যাতা ব্যাপার হবে!

বললাম, “অফিসের কিছু ডকুমেন্টস, অফিস পার্টির কিছু ফটো এসবই ছিল!”

অফিসার কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, “আপনি কাল ওর বাড়ি গিয়েছিলেন কেন?”

বললাম, “আগেরদিন রাত্রে আমায় ফোন করেছিল। তারপর থেকে ফোন অফ ছিল! বুঝতে পারছিলাম না কিছু হয়েছে কিনা! সেই জন্যেই গিয়েছিলাম। ঠিক আছে কিনা দেখতে!”

–       আগেও তো গিয়েছেন শুনলাম ওখানে! ফ্ল্যাট মালিক বললেন।

–       হ্যাঁ গিয়েছি কয়েকবার।

–       রাত্রে থেকেছেন?

–       What?

–       রাত্রে কখনও থেকেছেন ফ্ল্যাটে?

–       আপনি কী বলতে চাইছেন একটু বলবেন প্লিজ!

–       আপনি তো মিডিয়াতে চাকরি করেন! আপনাকে বলে দিতে হবে আমি কী বলতে চাইছি! সহজ একটা প্রশ্ন করলাম। রাত্রে ওর বাড়িতে থেকেছেন কখনও?

–       না থাকিনি!

–       বেশ!

আফসার ভাই এতক্ষন কিছু বলছিলেন না। এবার বললেন, “দেখুন অফিসার! সোমবুদ্ধ আমাদের এখানে প্রায় ২ বছর হল কাজ করছে। ওকে আমরা সবাই খুব ভালো করে চিনি! ইন্দ্রাক্ষীকেও চিনতাম। কাজেই ওকে বোধহয় এভাবে…

“দেখুন একটা কথা বলি…” অফিসারটি এবার বললেন, “আজকাল আমরা কেউ কাউকে চিনি না বুঝলেন তো! কোন মানুষ যে ঝোঁকের বশে কখন কী করে ফেলবে তা কেউ বলতে পারে না! আমাদের পেশার সাথে যুক্ত থাকলে বুঝতেন!”

অফিসারের কথা শেষ হওয়ার পরেই ঘরে ঢুকে এল দেবু! তারপর আফসার ভাই কে বলল, “আফসার ভাই, আমাকে কি কেউ জেরা টেরা করবে? নাহলে আমি বেরোবো এবার!”

পুলিশ অফিসারটি এবার ওর দিকে ফিরে বললেন, “আপনি কে?”

দেবু বলল, “আমি দেবু! ফটোগ্রাফার!”

–       আপনি ভিকটিম কে চিনতেন?

–       হ্যাঁ চিনতাম তো!

–       তাহলে আপনাদের সবার সাথেই কথা বলব! বাইরে অপেক্ষা করুন!

–       ওকে!

দেবু চলে গেল বাইরে। অন্য পুলিশ অফিসার টি এবার আমাকে বললেন, “এই সময় কলকাতার বাইরে যাবেন না! আমরা দরকার হলে ডাকব!”

ঘাড় নাড়লাম আমি। তারপর চেয়ার থেকে উঠে বাইরে যাচ্ছিলাম। তখন আর একজন পুলিশ অফিসার বললেন, “আর শুনুন!”

–       হ্যাঁ বলুন।

–       ওই পেনড্রাইভ টা কি ফেরৎ পেয়েছেন?

–       কোনটা?

–       যেটা হারিয়েছিল।

–       ওহ না। পাই নি। তার আগেই তো…

–       হুম। ঠিক আছে যান!

আমি আফসার ভাই এর দিকে তাকালাম। আফসার ভাই চোখের ইশারাতে আমাকে বলল বাইরে গিইয়ে বসতে। আমি বেরোনোর পরেই দেখলাম সৃঞ্জয় দা চলে গেল আফসার ভাই এর ঘরের ভেতর!

“কী বলল তোকে?”

প্রশ্নটা করেছে দেবু। আমি আবার কিউবিকলে মাথা নীচু করে বসেছিলাম। ও কখন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।

মাথা তুলে বললাম, “বাদ দে ওসব। তুই হঠাৎ মাঝে ঢুকতে গেলি কেন?”

দেবু বলল, “আরে আমাকে বেরোতে হত তো! সেই জন্যেই!”

–       কোথায়?

–       পার্ক সার্কাস যেতে হবে। অ্যান্টি সিএএ মুভমেন্টের ওখানে কিছু ঝামেলা হচ্ছে!

–       কী হয়েছে?

–       কী হয়েছে জানিনা।  শুধু শুনলাম ঝামেলা হচ্ছে। সামনেই ইলেকশন জানিস তো! এখন ঝামেলাগুলো না হলেই ভালো!

–       হুম।

–       ঠিক আছিস তুই?

–       হ্যাঁ।

–       এই পেন ড্রাইভ নিয়ে কী বলছিলো?

–       তোকে কে বলল?

–       আমি বেরোনোর সময় শুনলাম মনে হল।

–       আরে আমার পেনড্রাইভ টা হারিয়েছিল না? ওটাই খুঁজে পেয়েছিল ইন্দ্রাক্ষী। সেটা আমি পেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করল!

–       ধুর! একটা মানুষ মারা গেছে আর এরা পেন ড্রাইভ নিয়ে পড়েছে!

–       হুম।

রাজু এসে এরপর জানালো দেবুর ডাক পড়েছে! দেবু বলে গেলো, “Wish Me Luck!”

আমি ম্লান হাসলাম। অফিসে ভালো লাগছিল না আর। ফোন বের করে আফসার ভাই কে একটা টেক্সট করলাম, “আমি কি বেরিয়ে যেতে পারি?”

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিপ্লাই এল, “না! আর একটু বোসো। কথা আছে!”

দেবু এল তার আর একটু পরেই। জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলল?”

দেবু বলল, “ওই তো রেগুলার! যা করে আর কী! কীভাবে চিনি! তোর সাথে কিছু ছিল কিনা। কে খুন করতে পারে কোনো সন্দেহ রয়েছে কিনা। এই আর কি!”

আমি বললাম, “আমাকে তো শেষ প্রশ্ন টা করল না!”

দেবু বলল, “জানিনা। আমাকে তো করল… আচ্ছা শোন… আমি বেরোই। পার্ক সার্কাসের ঝামেলাটা বাড়ছে শুনলাম!”

আমি বললাম, “হ্যাঁ যা!”

দেবু চলে গেল। আমার ডেস্কে কম্পিউটার স্ক্রীনে আমাদের পত্রিকার ফেসবুক পেজ টা খোলা ছিল। নিউজ ফিডে এ যেতেই চোখে পড়ল একটা স্পনসর্ড পোস্ট। মানে ফেসবুককে টাকা দিয়ে যে পোস্টগুলো করা হয়। আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছোনোর জন্য!

পোস্ট টা এরকম – “শাহিনবাগের বন্দুকবাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাড়া করা”

খুব ভয়ংকর অভিযোগ তাতে কোন সন্দেহ নেই। ক’দিন আগেই এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। শাহিনবাগে অ্যান্টি সিএএ মুভমেন্টের ওখানে একজন বন্দুকবাজ কে পাওয়া গিয়েছিল। এদিক ওদিক এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছিল সে। পুলিশ পরে ধরে নিয়ে যায় কিন্তু ওকে কে পাঠিয়েছিল সেসব কিছুই জানা যায় নি।

পোস্ট টা ভালো করে পড়লাম আমি। উপযুক্ত তথ্য প্রমান সহ সবটা সাজানো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তার মধ্যে কোথায় কী ডিল হয়েছে। কীভাবে টাকা নিয়েছে! এসবও আছে। আর তার সাথে একটা ফোনে রেকর্ড করা ভিডিও রয়েছে! কী পেজ এটা? আমাদের নিউজপেপার এটা ফলো করে কেন?

পেজ টার নাম – ‘অপরাজিত – The Unvanquished’। পেজটায় লাইকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখের কাছাকাছি। হঠাৎ চোখ গেল একটা লেখার দিকে। ইন্দ্রাক্ষী মজুমদার অ্যান্ড ইলেভেন আদার ফ্রেন্ডস লাইক দিস।

ইন্দ্রাক্ষী! উৎসাহ টা কেমন যেন কমে গেল আবার। চোখের সামনে ওর মুখটা ভেসে উঠল আবার! বন্ধ করে দিলাম ফেসবুক টা।

এর কয়েক মিনিট পরেই আফসার দা ডাকলো আমায়। রাজু জানালো।

গিয়ে দেখলাম পুলিশ রা কেউ নেই।

আফসার ভাই বললেন, “বোসো!”

বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “ওরা চলে গেছে?”

আফসার ভাই বললেন, “নাহ। পাশের একটা ঘরে একজন একজন করে ডাকছে। সৃঞ্জয় দা আছেন ওখানে!”

–       ওহ আচ্ছা!

আফসার ভাই বললেন, “সোম… আমার মনে হয়… তোমার কয়েকদিন ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে!”

আমি বললাম, “তাড়িয়ে দিচ্ছো?”

আফসার ভাই বললেন, “একদম না। কিন্তু তোমার যা মনের অবস্থা তাতে আমার মনে হল তুমি কিছুদিন একা থাকতে প্রেফার করবে!”

আমি বললাম, “কতদিন?”

–       এক সপ্তাহ!

–       আজ বুধবার। পরের বুধবার তুমি নাহয় জয়েন কোরো আবার!

–       বেশ! তাই হবে। আজ কি তাহলে বেরিয়ে যাবো?

–       হ্যাঁ। সেটাই বোধহয় ভালো হবে।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে উঠে এলাম। বেরোনোর সময়। চঞ্চলের সাথে দেখা হল। চঞ্চল স্পোর্টসে রয়েছে।

জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবে?”

বলল নেট টা গেছে অফিসের। সৃঞ্জয় দা ব্যস্ত। তাই আফসার দা কে জানাতে যাচ্ছে।

আমি আর কিছু বললাম না। নিজের কিউবিকলে গিয়ে ব্যাগ টা গোছানোর সময়েই চোখে পড়ল সেই পেনড্রাইভ টা। অফিসে বের করা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম। তারপর কী মনে হতে সাহস করে বের করে ফেললাম। তারপর আমার কম্পিউটারে ইনসার্ট করলাম।

কিছুই আসছে না। কয়েক মুহুর্ত দেখলাম! তারপর পেনড্রাইভ টা খুলতে গেলেই বলছে – Error! No Internet!

আমি আর চেষ্টা করলাম না। কম্পিউটার থেকে খুলে পকেটে রেখে দিলাম। তারপর ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছিলাম অফিস থেকে। হঠাৎই অফিসের টিভিতে দেখলাম তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে কেন্দ্রে। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে! ওই শাহিনবাগ কান্ড নিয়েই হয়েছে বুঝতে পারলাম।

আমি আর দাঁড়ালাম না। বেরিয়ে গেলাম অফিস থেকে!

পেনড্রাইভ টা যে আমার নয় সেটা আমি অফিসেই বুঝেছিলাম। কারন এই পেনড্রাইভ টা ৮ জিবি। আমারটা ছিল ১৬ জিবি। সুতরাং এটা অন্য কারুর একটা পেনড্রাইভ! কিন্তু কার সেটা জানিনা। বাড়ি ফিরে কী চুপচাপ শুয়ে ছিলাম কিছুক্ষন। কিছু ভালো লাগছিল না। কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝেই চোখের সামনে ইন্দ্রাক্ষীর হাসি টা ফুটে উঠছে।

উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। অনেক হল। এবার অন্য কাজে মন দিতে হবে। ল্যাপটপ টা অন করে কানেক্ট করলাম নেট টা। তারপর ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভ টা বের করলাম। কী এমন পেনড্রাইভ যে ইন্টারনেট ছাড়া চলে না?

তারপর ল্যাপটপে ইনসার্ট করলাম পেনড্রাইভ টা।

কয়েক সেকেন্ড কিছু নেই। হঠাৎ করে আমার ল্যাপটপের স্ক্রীন টা পুরো নীল হয়ে গেল। মাউস পয়েন্টার টা নাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু দেখাচ্ছেই না।

এই রে! হচ্ছে টা কী?

তারপর স্ক্রীনে লেখা ফুটে উঠল – Connected to Database. Loading… Please Wait

কী অদ্ভুত পেনড্রাইভ! গেম নাকি? কয়েক মুহুর্ত পরেই স্ক্রীনে ফুটে উঠল একটা ম্যাপ! সাথে দেখা গেল মাউস পয়েন্টার টাও।

কী হচ্ছে এটা? ভালো করে দেখে বুঝলাম ম্যাপ টা কলকাতা শহরের। পুরো স্ক্রীন জুড়ে কলকাতার ম্যাপ। আর ম্যাপের মধ্যে লাল ফন্টে বোল্ড করে কিছু জায়গা ক্রস দিয়ে মার্ক করা আছে! তার মধ্যে গার্ডেন রিচ, রাজাবাজার এবং পার্ক সার্কাস সবার আগে চোখে পড়ল।

হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠল। সৃঞ্জয় দা ফোন করছে। অফিস থেকে।

ধুর! এখন কে ফোন ধরবে! একটা অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার মোডে চলে গেছি মনে হচ্ছে! এই ম্যাপ টা কী? কেন কি উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছি না। নীচে একটা জায়গায় লেখা আছে NEXT.

মাউস পয়েন্টার দিয়ে সেই নেক্সটে ক্লিক করলাম।

তারপরেও উইন্ডোতে যেতেই সবটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। যে ভয়টা এতক্ষন পাচ্ছিলাম কিন্তু পাত্তা দিচ্ছিলাম না সেটাই চোখের সামনে ভেসে উঠল। এটা একটা বম্ব ব্লাস্ট এর প্ল্যান। কলকাতার ৫ টা জনবহুল জায়গায় প্রথম ফেজের অ্যাটাকের কথা লেখা রয়েছে এই পাতায়। আমি প্রথম ফেজ বললাম কারন ওই উইন্ডোতে ঠিক এটাই লেখা রয়েছে  First Phase. তার মানে এটা ছাড়াও আরো Phase আসতে চলেছে?

গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে আমার। এবার কী করব? পুলিশের কাছে যাবো? নাকি পরের উইন্ডোতে যাবো? এখানেও নীচে লেখা আছে নেক্সট! আগের পাতায় লাল ক্রস দিয়ে মার্ক করা জায়গা গুলো তাহলে ওগুলোই। এই কারনেই কি ইন্দ্রাক্ষী কে… আমি আর ভাবতে পারলাম না। পেন ড্রাইভ টা খুলে নিলাম ল্যাপটপ থেকে। এটা মার্ডার ইভিডেন্স। একবার কি অফিসে যাবো? এই ব্যাপারটা কি সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন? পরক্ষনেই মনে হল এটা যদি ইন্দ্রাক্ষী অফিসে পেয়ে থাকে তাহলে অফিসেরও কেউ না কেউ এর সাথে জড়িত। সুতরাং এটা অফিসে নিয়ে গিয়ে ওদেরই কিছু সুবিধে করে দেবো না তো আমি? না না। সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এক্ষুনি থানায় যেতে হবে আমাকে। আমরা কেউ আর সেফ নই। কেউ না।

ফোনটা বাজছে আমার! সৃঞ্জয় দা আবার ফোন করছে। আমি কেটে দিলাম ফোন টা। থানায় বসে আছি আমি এখন! পুলিশ অফিসারটি ফোনে কারও সাথে কথা বলছেন। আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়িতেই এসেছি। এই থানার আন্ডারেই পড়ছে ইন্দ্রাক্ষীর কেস টা। সকালে যে অফিসার ছিলেন তাকে দেখতে পেলাম না। ঘড়ির দিকে দেখছিলাম আমি বারবার। ৭ টা বাজে।

মিনিটখানেক পর অফিসার ফোন রেখে এসে সামনে বসলেন।

বললেন, “বলুন। কী দরকার আপনার?”

গলা খাঁকরে বললাম, “আপনাদের আর একজন অফিসার আছেন। একটা কেসের ব্যাপারে আমাদের মিডিয়া হাউসে গিয়েছিলেন। ওঁকে কী একটু পাওয়া যাবে?”

অফিসারটি বললেন, “কী নাম আপনাদের মিডিয়া হাউসের?”

বললাম, “নাগরিক।”

অফিসার বললেন, “ওহ। আচ্ছা। আপনি কি ওই পত্রিকা থেকেই আসছেন?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। তবে এই মুহুর্তে আমি পত্রিকার পক্ষ থেকে আসিনি। আমাদের পত্রিকার একজন ডেস্ক রিপোর্টারের হঠাৎ খুন হয়ে গিয়েছে সেই ব্যাপারেই আসলে একটু কথা ছিল। ওই অফিসার কে কি পাওয়া যাবে এখন?”

অফিসার বললেন, “না। পাওয়া যাবে না। উনি একটু বেরিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে প্রচন্ড ঝামেলা হচ্ছে গড়িয়াহাটের দিকে। দেরী হবে ওঁর ফিরতে কী ব্যাপার আপনি আমাকে বলুন!”

আমি তখন সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা শুরু থেকে ওকে বললাম।

উনি সমস্ত কিছু শুনে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, “তার মানে বলছেন কলকাতায় জঙ্গী হামলা হচ্ছে? ২রা এপ্রিল?”

আমি বললাম, “ব্যাপার টা কি খুব মজার কিছু?”

অফিসার একইরকম ভাবে হাসি মুখেই বললেন, “না মানে… ভালো। প্লট ভালো। গল্প বলেনও খুব ভালো! কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না!”

–       কী?

–       আপনি নাগরিকের মত একটা পত্রিকায় কাজ করেন। আর এরকম একটা খবর নিজের পত্রিকায় না ছেপে থানায় এসেছেন সবটা জানাতে!

–       এসেছি তার কারন আমি জানিনা অফিসে কাকে ভরসা করব! সেই জন্যেই বাধ্য হয়ে!

–       বুঝলাম। দেখি কী পেনড্রাইভ আছে দেখি।

কথাটা বলে উনি পেছনে ফিরে হাঁক দিলেন, “এই জয়কৃষ্ণ, ল্যাপটপ টা দিয়ে যাও!”

একটু পর একজন কনস্টেবল এসে একটা ল্যাপটপ এনে রেখে গেল টেবিলে। আমি ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভ বের করতে করতে বললাম, “ইন্টারনেট আছে?”

অফিসার বললেন, “আছে। কেন? ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড বলা যাবে না!”

বললাম, “আমাকে বলতে হবে না। কিন্তু ল্যাপটপে নেট না থাকলে কিছুই দেখতে পাবেন না!”

অফিসার বললেন, “নাহ। ল্যাপটপে নেট আছে।”

আমি আর কিছু বললাম না। পেনড্রাইভ টা ওঁর হাতে দিলাম। উনি ল্যাপটপে সেটা ইনসার্ট করলেন। মিনিট খানেক পর দেখলাম ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ল্যাপটপ টা ওর দিকে ঘোরানো। আমি বুঝতে পারছিলাম না উনি কী দেখছেন। তবে আন্দাজ করতে পারছিলাম। এখন ওই ম্যাপটা দেখতে পেয়েছেন উনি! সেটা দেখেই চোখ বড় হয়ে গেছে ওঁর।

আমি বললাম, “নেক্সট এ ক্লিক করুন।”

উনি কিছু বললেন। ল্যাপটপেই কিছু একটা করতে লাগলেন।

কিছুক্ষন পর ল্যাপটপের লিড টা নামিয়ে উনি আমায় বললেন, “এটার কোনো কপি আছে আপনার কাছে?”

আমি বললাম, “নাহ। তবে আমার লাগবে না। ওটা আপনি রাখতে পারেন! ওটা ইভিডেন্স। আমার কাছে থাকা ঠিকও নয়!”

অফিসার নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “বেশ। অনেক ধন্যবাদ। আপনি ভাবতে পারবেন না আপনি নিজের অজান্তেই দেশের কত বড় উপকার করলেন।”

আমি হ্যান্ডশেক করলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম থানা থেকে। একটু হালকা লাগছে আমার।

গেট থেকে বেরোনোর সময়েই আমার হঠাৎ মনে হল অফিসারের নাম্বার টা নিয়ে রাখলে ভালো হত। তাহলে কেসটা সম্পর্কে আপডেট পাওয়া যেত। ফিরে গেলাম ভেতরে। আমি বেরোতেই আবার অফিসার ফোন কানে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নিজের চেয়ারের কাছে। আমাকে দেখেন নি।

আমি ডাকতে যাবো হঠাৎ ওঁকে বলতে শুনলাম, “হ্যালো… বালিগঞ্জ স্যার! বলছিলাম যে পেনড্রাইভ টা পেয়ে গেছি স্যার!”

এক মিনিট! পেন ড্রাইভটা মানে? এটার ব্যাপারে আগে থেকে জানতেন নাকি উনি? পরক্ষনেই আবার অফিসার কে বলতে শুনলাম, “না স্যার! আর কোনো কপি করা হয় নি। চাপ নেবেন না সব প্ল্যানমাফিকই হবে!”

হাত থেকে পড়ে গেল ফোন টা! সাথে সাথে অফিসারের চোখ গেল আমার দিকে।

উনি ফোনে বললেন, “এক মিনিট স্যার! একটু বাদে করছি!”

আমি আর দাঁড়ালাম না। ফোন টা মাটি থেকে কুড়িয়ে পেছন ফিরে হাঁটা দিলাম। এটা কী? কত বড় প্ল্যান? থানা অবধি এর সাথে Involved. পেছন থেকে অফিসারের গলা শুনলাম, “Excuse Me! দাঁড়ান আপনি। কোথায় যাচ্ছেন… হ্যালো!”

আর হ্যালো! আমি তখন পায়ের গতি বাড়িয়ে প্রায় দৌড়োচ্ছি! থানার পাশেই একটা গলি ছিল সেটা দিয়ে কোথায় যায় আমি জানিনা। তবু দৌড়োলাম সেই অন্ধকার গলি ধরেই। কী করব এবার আমি? কাকে ফোন করব? আর কেই বা বিশ্বাস করবে আমার কথা? সবথেকে বড় প্রমানটাই তো আমার হাতের বাইরে চলে গেল!

ক্যাবটা বুক করেছিলাম দৌড়োতে দৌড়োতেই। ক্যাব এ উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমার মাথা ঘুরছিল। আমি কার কাছে যাব? আফসার ভাই কে কী জানাবো সব টা? কিন্তু উনি কি বিশ্বাস করবেন আমার কথা? আসল জিনিসটাই তো আমি…

ফোনটা হাতেই ছিল কন্ট্যাক্ট লিস্ট টা স্ক্রল করছিলাম আমি। তখনই ঢুকল দেবুর ফোন টা।

একটু অপেক্ষা করে ফোনটা ধরলাম আমি।

–       হ্যা…হ্যালো!

–       মামা… কী খবর?

–       ক-কেন?

–       তুমি কি এখনও দুঃখ পাচ্ছো মামা?

–       কিছু বলবি তুই?

–       বলব বলেই তো ফোন করেছি! একটা দারুন স্ট্রিপ ক্লাবের খোঁজ পেয়েছি। চল না! হেব্বি মজা হবে। তোরও একটু সুবিধে হবে মুভ অন করতে।

উফফ! এই ছেলেটার টাইমিংগুলো খুব খারাপ! আমি মরছি আমার জ্বালায় আর একে স্ট্রিপ ক্লাবে পেয়েছে!

বললাম, “নারে। Now is not the time!”

কথাটা শুনেই দেবুর গলাটা হঠাৎ চেঞ্জ হয়ে গেল। ও বলল, “কী হয়েছে রে? কোথায় তুই?”

আমি একটু ইতস্তত করছিলাম। দেবু নিজেই বলল, “কিছু হয়েছে কী? ঠিক আছিস তুই?”

আমি আর চেপে রাখতে পারলাম না। যে কথাগুলো কাউকে একটা বলার জন্য মনটা কেমন একটা করছিল সেই কথাগুলো গড়গড় করে বলে দিলাম দেবু কে। একদম শুরু থেকে। কীভাবে পেনড্রাইভ পেলাম। কীভাবে সেই ম্যাপ পেলাম। কলকাতায় হামলার প্ল্যান! থানার ওই অফিসারের কথা! সমস্ত কিছু।

দেবু সব শুনে বলল, “তুই এখন কোথায়?”

আমি বললাম, “জানিনা। ক্যাবে আছি। বাড়ি ফিরছি!”

দেবু বলল, “তুই আয়। আমি আসছি! কিছু একটা ভাবতে হবে। ওদের তোর বাড়ি খুঁজে পেতে বেশী দেরী হবে না!”

–       মানে? ওরা আমার বাড়িতে আসবে নাকি?

–       কোনো লুজ এন্ডস ওরা এই সময় রাখবে না! ওই অফিসারের যদি মনে হয় তুই কথাগুলো শুনে ফেলেছিস তাহলে ওরা আসবেই।

–       আচ্ছা আমরা অন্য কোন থানায় যেতে পারি না?

–       রিস্ক হয়ে যাবে। সেই রিস্ক টা কি নেওয়া ঠিক হবে? তার ওপর তোর হাতে কোনো প্রমান নেই!

–       তাহলে আমরা করব টা কী?

–       দেখছি। আমি তোর বাড়ি ঢুকব মিনিট দশেকের মধ্যে। বাইকে আছি আমি। তুই আয়।

–       আমারও ওরকমই লাগবে।

–       ওকে। বাই। দেখা হচ্ছে।

ব্যাপারটা নিয়ে একা একা বড্ড ভাবছিলাম। Two Heads are better than one. আর আমি ভাববো না। দেবু আসুক তারপর একসাথে ভাবা যাবে। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। সৃঞ্জয় দাকে এবার কলব্যাক করব কিনা ভাবলাম। পরক্ষনেই মনে হল আবার ভদ্রলোক মেজাজ টা খিঁচড়ে দেবে। তার চেয়ে থাক বরং। এমনিতেও আমি ছুটিতে আছে। আফসার দা ফোন করলে না হয় দেখা যাবে!

১০

ক্যাবের টাকা মিটিয়ে যখন বাড়ির কাছে যখন নামলাম তখন ৯ টা বাজে প্রায়। গেটের কাছে দেখলাম দেবু দাঁড়িয়ে আছে মোটর সাইকেল নিয়ে। কাঁধে চিরপরিচিত ক্যামেরার ব্যাগটা তো আছেই। আমায় দেখে হাসল ও।

আমি বললাম, “কখন এসেছিস?”

বলল, “এই তো ২ মিনিটও হয় নি।

আমি বললাম, “এই কী হবে বলতো? আমার খুব ভয় লাগছে!”

দেবু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “উহু। বাড়ি ঢোক আগে। এখানে না!”

আমি আর কিছু বললাম না। নীচের গ্যারেজে ও ওর বাইকটা রাখল।

আমরা ফ্ল্যাটে ঢোকার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কফি খাবি?”

দেবু সোফায় বসতে বসতে বলল, “হ্যাঁ ভাই। Please! খাওয়া। একটু কফির খুব প্রয়োজন!”

আমি ব্যাগ রেখে রান্নাঘরে চলে গেলাম কফি বানাতে!

দেবু ডাইনিং থেকে বলল, “এই যেটা বললি এটা হওয়ার কথা ২রা এপ্রিল! তাই তো?”

বললাম,  “হ্যাঁ। প্রথম অ্যাটাক টা!”

দেবু ক্যামেরার ব্যাগ টা খুলতে খুলতে বলল “হুম! যাক বাবা ভালো হয়েছে আর কাউকে বলিস নি। কারা কারা এটার সাথে যুক্ত সেটা আগে জানতে হবে!”

ঘটনাটা ঘটল এর পরেই। আমার রান্নাঘরের দরজার পাশেই রয়েছে ফ্রীজটা। ফ্রীজ থেকে দুধের কার্টন টা বের করছিলাম। হঠাৎই আড়চোখে পাশে তাকাতেই আমার পুরো শরীর টা কেঁপে উঠল যেন। গা হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করল সাথে সাথে। আমি দেখলাম দেবু নিজের ক্যামেরার ব্যাগ থেকে বের করল একটা রিভলবার। তারপর সেটা রাখল সোফাতে। ওর পাশে।

তার মানে… তার মানে দেবুও? Shit! কি যাচ্ছেতাই ভুল করলাম আমি। কেন? কেন ভরসা করলাম। আমি বুঝলাম আমার হাতে সময় নেই বেশী। যা করার এক্ষুনি করতে হবে।

খুব শান্তভাবে দুধটা রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ঢাললাম দুধের বাটিতে। তারপর দেবু কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, “এই যাহ!”

দেবু বলল, “কী হল?”

বললাম, “চিনি একদম শেষ! দাঁড়া নিয়ে আসি!”

দেবু কিছু বুঝতে পেরেছিল কিনা জানিনা। ও বলল, “আরে আমার চিনি না হলেও চলবে!”

আমি বললাম, “আমার চলবে না! দাঁড়া। এই তো নিচেই দোকান!”

কথাটা বলেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে আমি দরজার দিকে এগোলাম।

দেবু বলল, “আরে মানিব্যাগ নিয়েছিস?”

আর মানিব্যাগ! আমি উত্তর দিলাম না। জুতোটা গলিয়ে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে! সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই আমি দৌড়োচ্ছি! প্রচন্ড জোরে! কোথায় যাচ্ছি জানিনা। কলকাতার অলি গলি পেরিয়ে আমি হেঁটে চলেছি। কত বড় এই প্ল্যান টা? আর কারা এটার সাথে রয়েছে? পুরো নাগরিক পত্রিকাই কি এটার সাথে যুক্ত? আফসার দা? চঞ্চল? এরাও?

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সবে বড় রাস্তায় উঠেছি। হঠাৎই একটা গাড়ি এসে থামল আমার সামনে। Maruti Suzuki Swift Dezire! কাঁচ সব তোলা। সাইডের কাঁচ নামিয়ে ড্রাইভারের সীট থেকে একজন চেনা গলায় আমায় বলল, “উঠে পড়ো!”

আমি আর একটুও সময় নষ্ট না করে উঠে পড়লাম গাড়িতে!

গাড়ি চলতে শুরু করল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আমার মনে হল যে মানুষটার পাশে আমি বসে আছি, আমার কখনও মনে হয় নি আমার চরম বিপদের মুহুর্তে এই মানুষটা আসবে আমাকে বাঁচাতে।

আমি কিছু বলার আগেই সৃঞ্জয় দা বলল, “কখন থেকে ফোন করছি! ফোনটা তো ধরবে!”

আমি বললাম, “আমি আসলে… বুঝতে পারিনি যে…

তারপর একটু থেমে বললাম, “এক সেকেন্ড! আপনি আমায় পেলেন কীভাবে?”

সৃঞ্জয় দা বলল, “ফোন ট্র্যাক করে। তোমার অফিসের কম্পিউটারে তোমার পাসওয়ার্ডগুলো সেভ আছে দেখলাম। ওখান থেকে গুগল এর জিপিএস দিয়ে… Anyway সেসব ছাড়ো। প্ল্যান টা কোথায়?”

আমি বললাম, “আপনি জানেন?”

সৃঞ্জয় দা বলল, “নাগরিক পত্রিকায় জানি শুধু আমিই। কিন্তু কারা কার কতটা Involved সেটা জানিনা। সেটার জন্যে ওই পেনড্রাইভ টা লাগত!”

আপনি কীভাবে জানলেন, “ওই পেনড্রাইভের ব্যাপারে?”

–       ইন্দ্রাক্ষী ফোন করেছিল কাউকে একটা! এটা জানাতে। কে সেটা আমি জানিনা এখনও। তখনই জানতে পারলাম।

–       মানে? বুঝলাম না। ইন্দ্রাক্ষী কাউকে ফোন করেছিল আপনি জানলেন কীভাবে?

–       দেখো অফিসের সবার ফোন আমি ট্যাপ করে রেখেছি। কারন কে কে এই প্ল্যানটার সাথে জড়িত সেটা জানার আর কোন উপায় ছিল না!

ফোন ট্যাপ! সবার! মানে আমারও। প্রাইভেসি বলে কি কিছু নেই মানুষের। আমি আর কিছু বললাম না। ধুর! যা ইচ্ছে হোক! আমি শুধু একটু শান্তি চাই।

একটু পর জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? থানায়?”

সৃঞ্জয় দা বলল, “থানায়? তুমি কি পাগল? অলরেডি থানায় গিয়ে তো দেখেই নিলে কী হল! কাউকে ভরসা করা যাবে না এখন! কাউকে না!”

সৃঞ্জয় দা এই কথাটা বলার সাথে সাথে আমার মাথাটা যেন হঠাৎ ঘুরে গেল। গাড়ি তখন স্পিড বাড়িয়েছে। আমি সমস্ত ব্যাপার দেবু কে জানিয়েছি থানা থেকে বেরিয়ে! যদি ধরেই নি সৃঞ্জয় দা ফোন ট্যাপ করার জন্য আমার সমস্ত কথা জানতে পেরেছে! তাহলে তো তারপর সৃঞ্জয়দার আমাকে ফোন করার কথা। কিন্তু সৃঞ্জয় দা তো আমাকে ফোন করছে যখন আমি পেনড্রাইভ টা কম্পিউটারে লাগিয়েছিলাম ঠিক তার পর থেকে।

যেই মুহুর্তে স্ক্রীনে দেখিয়েছে Connected to Database! তার ঠিক পরেই ফোনটা এসেছে সৃঞ্জয় দার। তার মানে Database! মানে… আর পারছি না। আমি আর ভাবতে পারছি না। এবার মুক্তি চাই আমি। একটার পর একটা কী ঘটছে আমার সাথে? পৃথিবীতে কি আর কাউকেই ভরসা করতে পারবো না আমি? পুরো কলকাতাই কি যুক্ত এই হামলার সাথে!

গাড়ি কোথায় যাচ্ছে আমি জানিনা। দু’পাশে ফাঁকা মাঠ। সম্ভবত বাইপাস এটা। মাঝে মাঝে কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ছে! চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ব কিনা ভাবছি! হঠাৎ সৃঞ্জয় দা বলল, “অত ভেবো না! আর বেশীক্ষন নয়।”

কথাটা বলার পরেই খেয়াল করলাম সৃঞ্জয় দার একটা হাত স্টিয়ারিং এ। আর একটা হাতে একটা রিভলবার আমার দিকে তাক করা। আমি বললাম, “ইন্দ্রাক্ষীকেও কী এই রিভলবার দিয়ে…”

সৃঞ্জয় দা বলল, “একদম না। ওরটা এক্সপেরিমেন্টাল ছিল। তোমারটাও তাই হবে। রিভলবার টা জাস্ট এখন যাতে বাড়াবাড়ি না করো সেটার জন্য!”

আমি বললাম, “এক্সপেরিমেন্টাল?”

সৃঞ্জয় দা বলল, “ তার মানে তুমি পেনড্রাইভ টা ভালো করে দেখোনি?”

আমি কিছু বললাম না। সৃঞ্জয় দা হাসল। বলল, “যাক! তাহলে তো ভালোই হল! হলিউড সিনেমার হলে তোমাকে সব খুলেই বলতাম! কারন আর বেশিক্ষন তো নেই তোমার হাতে… কাজেই…”

হলিউড সিনেমা কিনা জানিনা। কিন্তু এরপর যেটা ঘটল সেটাকে টলিউড সিনেমার সাথে তুলনা করা যেতেই পারে। আমি চেষ্টা করছি গুছিয়ে লেখার।

হঠাৎই একটা বাইক প্রচন্ড স্পিডে এসে আমাদের গাড়ির সামনে রাস্তা ঘিরে দাঁড়াল। সৃঞ্জয় দা ব্যাপারটায় এতটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল যে ব্রেক কষতেও ভুলে গিয়েছিল। তারপরেই খেয়াল হতেই স্টিয়ারিং টা ঘুরিয়ে দিল ডানদিকে। হাতের রিভলবার টা তখন পায়ের সামনে পড়ে গিয়েছে। আমি আর দেরী না করে চলন্ত গাড়ি থেকেই গাড়ির দরজা খুলেই লাফ দিলাম। গাড়িটা তখন রাস্তার ধারে মাঠে নেমে গেছে।

সামনের কালো হেলমেট পরা আরোহী এবার বাইকে স্টার্ট দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “উঠে পড়। আমাদের যেতে হবে!”

গলাটা আমার চেনা। একটু আগে বাড়িতে ওকে রেখেই পালিয়ে এসেছিলাম আমি। তখন ইতস্তত করছি দেখে দেবু বলল, “কলকাতায় জঙ্গী হামলা আটকাতে চাস কি?”

বললাম, “হ্যাঁ!”

দেবু বলল, “তাহলে বাইকে ওঠ বুদ্ধু! বেশী সময় নেই হাতে!”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাইকে উঠে বসলাম। বাইক স্টার্ট দিল দেবু। বললাম, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

দেবু একটা নিশ্বাস নিল জোরে। তারপর বলল, “দেখতে পাবি! এখনও অনেক কিছু জানা বাকি তোর!”

কে এই দেবু? মানে অফিসে জয়েন করা থাকা এই ছেলেটার পুরো নাম আজ অবধি জানতে পারিনি। প্রয়োজনও হয় নি। সবাই দেবু বলে তাই আমিও বলি। আজ খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর পরিচয়!

বললাম, “তুই দেবুই তো?”

দেবু হাসল। বলল, “কেন? সন্দেহ হয়?”

বললাম, “না মানে এখন আর কাউকেই ঠিক চিনিনা মনে হয়!”

গাড়ির পিকআপ বাড়িয়ে দেবু বলল, “ঠিকই মনে হয়। কখনও এতটা অহংকারী হয়ে যাস না যখন মনে হবে একটা মানুষকে তুই খুব ভালো করে চিনে গিয়েছিস! ঠিক তখনই দেখবি সেই মানুষটা তোকে অবাক করে এমন কিছু করবে যেটা তুই ভাবতেও পারবি না!”

আমি আবারও থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছি বল না।”

দেবু বলল, “আর একটাও কথা না! বাকি কথা অফিসে পৌঁছে!”

–       অফিস মানে? কীসের অফিস?

–       জানতে পারবে সোম বাবু। অপেক্ষা কর।

আমি হেঁয়ালিতে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা তোর পুরো নামটা তো বল? সেটাও তো আমি জানিনা ছাই!”

দেবু বাইক চালাতে চালাতেই উত্তর দিল, “আমার নাম অরন্য! অরন্য দেব!”

হ্যাঁ চলমান অশরীরিই বটে। রাত্রে বেলা এই বাইপাসের ধারে অন্ধকার ভেদ করে যেভাবে যাচ্ছি তাতে মনে ওর নাম টা সার্থক বলেই মনে হচ্ছে! কিন্তু কোথায় যাচ্ছি? কোন অফিস? হাতে আর মাত্র ৭ দিন। তার মধ্যে কলকাতায় জঙ্গী হামলা আটকানো সম্ভব হবে তো? ওই কয়েকটা এলাকাকেই কেন মার্ক করা ছিল ম্যাপে? কারা রয়েছে এটার পেছনে? এরকম একাধিক প্রশ্ন একটার পর একটা মাথার মধ্যে ঘুরছিল।

বাইক এসে থামল একটা পুরোনো ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে! বাইক থেকে নেমে দু’জনে এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে। তারপর একটা জং ধরা লিফটে করে উঠে গেলাম তিনতলায়! এখনও বুঝতে পারছি না কোথায় এলাম? কিসের অফিস এটা? এই ছেলেটাও আবার ওই দলের কেউ না তো!

তিনতলায় উঠে একটা ঘরের চাবি খুলে যেখানে ঢুকলাম সেটাকে আর যাই হোক, অফিস বলা চলে না। ঘরের মধ্যে তিনটে ল্যাপটপ রয়েছে। তিনটেই চলছে। ২ টো ল্যাপটপে কিছু একটা সার্চ হচ্ছে। আর একটায় খোলা আছে একটা ফেসবুক পেজ। অরন্য দরজা বন্ধ করল।

আমি একটু কাছে গিয়ে দেখলাম এই ফেসবুক পেজ টা আমি আগে দেখেছি। অফিসেই দেখেছি। বিভিন্ন স্টিং অপারেশন, গোপন খবর প্রমান সহ প্রকাশ করে এরা! এদের একটা খবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন নাড়িয়ে দিয়েছিল।

অরন্যর দিকে ফিরে বললাম, “এটা কীসের অফিস? কাদের অফিস?”

অরন্য বলল, “অপরাজিত – The Unvanquished!”

(ফিরবে)

তিলোত্তমা ঘূর্নাবর্তে – প্রথম পর্ব

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


One thought on “তিলোত্তমা ঘূর্নাবর্তে – প্রথম পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি