অনেকক্ষন থেকেই ভাবছে অভিষিক্তা কথাটা বলবে। এবার বলেই ফেলল।
“একটু আস্তে চালাবি প্লিজ!”
“ওহ সরি” সুদীপ্ত বলল, “আমার আসল জোরে চালানো অভ্যেস!”
অভিষিক্তা বলল, “আরে না না ঠিক আছে। আসলে ও খুব জোরে চালায় না তো! আমার আসলে অভ্যেস নেই এসবের।
সুদীপ্ত বলল, “বুঝলাম”
সুদীপ্ত বাইক থামালো একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে। রেস্টুরেন্টের নামটা দেখে ম্লান হাসল অভিষিক্তা! The Sizzler. এটায় যে কতবার এসেছে অভ্রর সাথে। ইন ফ্যাক্ট একজন ওয়েটার ওদের খুব ভালো ভাবেই চেনে। দেখলেই চিনতে পারবে ওকে আজ। সেইখানেই কিনা নিয়ে এল সুদীপ্ত!
বাইক থেকে নেমে ভেতরে গেল ওরা। মাঝের একটা টেবিলে বসল। টেবিলটা চারজনের টেবিল। ওরা পাশের একটাতে ব্যাগ রাখল। টেবিলে বসার পর একজন ওয়েটার মেনু কার্ড দিয়ে গেল ওদের! সেই চেনা ওয়েটারটাকে দেখতে পাচ্ছে না অভিষিক্তা! কোথায় গেল কে জানে?
অভিষিক্তা বলল, “আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি!”
সুদীপ্ত ঘাড় নাড়ল। ও মেনু দেখতে লাগল এক মনে।
অভিষিক্তা ফেরার পর সুদীপ্ত বলল, “এই এবার যদি না বলিস তোর কী হয়েছে তাহলে কথাই বলব না তোর সাথে!”
অভিষিক্তা বলল, “আরে বাদ দে না। আজ তোর জন্মদিন। সেটাই বরং এঞ্জয় কর আজ”
– দ্যাখ তুই এরকম মনমরা হয়ে থাকলে কিছুই এঞ্জয় করা যাবে না।
– সেই জন্যেই বললাম খুলে বল সব। ভালো লাগবে। কী হয়েছে? অভ্রনীলের সাথে কিছু?
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল অভিষিক্তা।
“কী হয়েছে শুনি?” সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।
অভিষিক্তা বলল, “আসলে অফিস টা নিয়ে খুব চাপ হচ্ছে!”
সুদীপ্ত বলল, “কী চাপ?”
– মানে ওরা নাকি আমায় বেশী খাটিয়ে কম টাকা দিচ্ছে। আমার এই কাজটা করা উচিত না। ইত্যাদি ইত্যাদি!
– ওর নিশ্চয় নিজের একটা পার্স্পেকটিভ রয়েছে। তাই বলছে। তুই উড়িয়ে দিচ্ছিস কেন ওর কথা?
এমন সময় একজন ওয়েটার এল ওদের কাছে। অর্ডার নিতে। সুদীপ্ত তাকে বলল দু’মিনিট পরে আসতে।
তারপর অভিষিক্তাকে বলল, “কী খাবি বল? অর্ডার টা দিয়ে দিই? তারপর কথা বলছি।”
অভিষিক্তা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “যা হোক অর্ডার কর! আমার চাপ নেই!”
এখনও কল ব্যাক করল না অভ্র। কী করছে কী ও? ঠিক আছে তো সব?
সুদীপ্ত এর মধ্যে ওয়েটার কে ডেকে চিকেন চাউমিন আর মাঞ্চুরিয়ান চিকেন অর্ডার করে দিল!
তারপর বলল, “হ্যাঁ বল। কী বলছিলি?”
অভিষিক্তা বলল, ” আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু ও খুব ডমিনেটিং রে। নিজের কথা ছাড়া অন্য কারও কথা শুনবে না।”
সুদীপ্ত বলল, “দেখ একটা সম্পর্কে কাউকে না কাউকে ডমিনেটিং হতে হয়! ভালো কথা বলছি শোন! ঠিক করে নে সব!”
– নারে! আর কিচ্ছু ঠিক হওয়ার নেই. যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে!
– তাহলে পাঁচ মিনিট ছাড়া ছাড়া নিজের ফোন দেখা বন্ধ কর। যদি ধরেই নিস ঠিক হবে না কখনও তাহলে নিজের মনের ভেতর আশা রাখিস না।
সত্যিই তো! ঠিকই বলেছে সুদীপ্ত! কী হবে আশা রেখে? অভ্র তো ফোন করবে বলে মনেও হয় না। ফোন করল ও। কিন্তু কলব্যাক করল না। ঠিক আছে তো ও!
এর মধ্যে খাবার দিয়ে গেছে ওয়েটার! খাবারটা সবে শুরু করতে যাবে!
হঠাৎ সুদীপ্ত বলল, “আমার এবার একটা কথা বলার আছে!”
অভিষিক্তা বলল, “কী কথা?”
সুদীপ্ত বলল, “আমি জানিনা কথাটা তুই কীভাবে নিবি! মানে আমি এখনও কাউকে বলিনি এই কথাটা!”
অভিষিক্তা বলল, “মানে? কী কথা? কী হয়েছে?”
সুদীপ্ত বলল, “প্রথমে একটা কথা বলি! তারপর আসল কথাটা বলছি!।”
– এত সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে, বল তো কী হয়েছে?
– আজ… মানে আমার জন্মদিন নয়। আমি আজ তোকে এখানে আনার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম।
“মানে? তুই আমাকে মিথ্যে বলে এখানে নিয়ে এলি?” অভিষিক্তার গলায় রাগ!
সুদীপ্ত বলল, “তার কারন আছে। আমি তোকে একটা কথা বলতে চাই যেটা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। কিন্তু আর চেপে রাখতে পারছি না!”
অভিষিক্তার আজকাল মাথাটা খুব তাড়াতাড়িই গরম হয়। কেন কে জানে? আজও তাই হল।
অভিষিক্তা উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে! বলল, “বলতে হবে না তোকে কোনো কথা। আমি শুনতে চাই না। তোর কাছ থেকে এটা একদম এক্সপেক্টেড না! আমি আসছি!”
সুদীপ্ত ওর হাতটা ধরে ফেলল। বলল, “তুই আমার কথাটা শুনে যা। মাথা গরম করিস না!”
অভিষিক্তা বলল, “হাতটা ছাড়!”
– তুই আমার কথাটা শোন!
– তুই কি হাত ছাড়বি নাকি আমি সিন ক্রিয়েট করব?
সুদীপ্ত বলল, “তুই ভুল বুঝছিস… আমি…
অভিষিক্তা এবার একটু জোরেই বলল, “হাতটা ছাড় সুদীপ্ত!”
সুদীপ্ত হাতটা ছেড়ে দিল। তারপর বলল, “I am gay!”
এবার অভিষিক্তার চমকে যাওয়ার পালা! “What?” অবাক হয়ে বলল ও।
সুদীপ্ত বলল, “I am gay!”
অভিষিক্তা অবাক হল খুব। ও বুঝতে পারছে না এই তথ্য টা নিয়ে ও কী করবে? এটা এমন কী কথা! এত লুকোচুরিই বা কী আছে?”
অভিষিক্তা বলল, “হ্যাঁ তো। It’s totally normal! তার জন্যে এরকম রেস্টুরেন্টে এসে আমাকে খাইয়ে দাইয়ে বলতে হবে কেন?”
সুদীপ্ত বলল, “তুই আগে বোস। নাহলে আমি বলব না!”
অভিষিক্তা শান্ত হয়ে বসল চেয়ারে! তারপর বলল, “হ্যাঁ বল!”
সুদীপ্ত বলল, “আমি তোর মেসেজ দেখেছিলাম!”
“মানে? কী মেসেজ?” আবার অবাক হল অভিষিক্তা!
– আমাকে নিয়ে যে মেসেজ! অফিসে তোর ফোনটা টেবিলের ওপর ছিল। অভ্র মেসেজ করেছিল। আমাকে নিয়ে। ওর ধারনা আমি তোকে লাইন মারছি ইত্যাদি ইত্যাদি!
– বলিসনি কেন আমাকে?
– কী বলব? টেবিলের ওপর ছিল। আমি দেখলাম। তার কয়েকদিন পর দেখলাম তোদের ঝামেলা। তাই ভাবলাম আমার জন্য কিছু হল কিনা। সেই কারনেই আমি চাইছিলাম সবটা পরিষ্কার করে দিতে।
– I am really sorry. ও আসলে বড্ড insecure.
– না না। ঠিক আছে। তোর মত মানুষকে পেলে insecure হওয়াই স্বাভাবিক। যাই হোক আমার খুব দোষী মনে হচ্ছিল নিজেকে। তাই আমি একটা বাজে কাজ করেছি!
– আরও বাজে কাজ করেছিস? কী করেছিস রে?
সুদীপ্ত একটা জোরে নিঃশ্বাস নিল। তারপর বলল, “তুই যখন ওয়াশরুমে গিয়েছিলি তখন আমি অভ্রনীল কে ফোন করেছিলাম তোর ফোন থেকে! ওকে বলেছি তোর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে!”
“What the fuck?” অভিষিক্তা চেঁচিয়ে উঠল এবার, “এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি করলি তুই! কেন করলি তুই এটা? আমি তোকে বলেছিলাম করতে? আমার সমস্যা না হয় আমিই মেটাতাম!”
সুদীপ্ত বলল, “যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। তুই শান্ত হ। ও আসছে!”
অভিষিক্তা বলল, “কী বলল ও শুনে?”
প্রথমে তো কিছু বলেই নি! কিছু আওয়াজ পেলাম না কিছুক্ষন! তারপর কে একজন ফোন ধরল। আমি তাকে বলল এই রেস্টুরেন্টের সামনে আসতে!
অভিষিক্তা বলল, “কে একজন মানে? কে? ওর বোন?”
সুদীপ্ত বলল, “হতে পারে!”
অভিষিক্তা বলল, “কিন্তু ওর বোনের তো বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল!”
সুদীপ্ত বলল, “আমি জানি না। আমি সবটা এক্সপ্লেন করব। তারপর বাকি তোরা বুঝবি।”
অভিষিক্তা বলল, “তাও! এটা ঠিক করলি না তুই! আমাকে না জানিয়ে আমার ফোন থেকে…”
– এবার থেকে ফোন লক করে রাখ। তাহলে আর পারব না করতে।
– বাল তুই একটা।
– জানি। শোন… প্লিজ আমার কথা কাউকে বলিস না। আমি আমার মা বাবাকেই এখনও বলতে পারিনি। আর ওরা আমার জন্যে মেয়ে খুঁজছে!
– আচ্ছা বেশ। বলব না কাউকে।
সুদীপ্ত এবার তাকাল রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। তারপর একজন ওয়েটার কে ডেকে বাইরের দিকে ইঙ্গিত করে কী একটা বলল আস্তে করে। ওয়েটার চলে গেল দরজার দিকে।
সুদীপ্ত বলল, “এসে গেছেন তোমার উনি। দেখো কী বলেন! কথা বলো। মিটিয়ে নাও। আর ঝামেলা বাড়িও না!”
কথা বলতে বলতেই অভিষিক্তার চোখ গেলো রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। এক জোড়া অবাক চোখ ওকে দেখছে। এই চোখদুটো ওর খুব চেনা। ও উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। এক পা দু’পা করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে অভ্রনীল। ওর অভ্র। চোখে তার অবাক ভাব একটুও কমছে না।
হঠাৎই অভিষিক্তার চোখ গেল অভ্রর পেছনে। আর একটা চেনা মুখ ও দেখতে পেল। সৃজিতা। ও এখানে কী করছে? ওর পরনে একটা টিশার্ট আর একটা ট্র্যাক প্যান্ট। আর গায়ে পাতলা চাদর! এরকম পোষাক লোকে বাড়িতে পরে থাকে! ও অভ্রর সাথে? তার মানে কী অভ্রর বাড়িতে ছিল ও?
একসাথে প্রচুর প্রশ্ন মাথার মধ্যে ভীড় করতে শুরু করল অভিষিক্তার! জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল ও। একবার সুদীপ্তর দিকে তাকালো সে। তারপর ঝড়ের বেগে অভ্রকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল ও।
(চলবে)