সেদিন একটু ভয়েই ভয়েই পরীক্ষা দিতে ঢুকেছিল নুসরত। পরীক্ষা নিয়ে ওর যত না ভয় তার থেকেও বেশী ভয় ছিল অন্য বিষয়টা নিয়ে। আচ্ছা ওর ক্লাসের বন্ধুরা কি ওর দিকে একটু অন্যভাবে তাকাচ্ছে আজ? নাহ! আজ ও এসব ভাববে না। খারাপ যা কিছু ঘটার তা ঘটে গিয়েছে। আজ ও মন দিয়ে পরীক্ষা দেবে।

১৯ বছরের নুসরত জাহান রফি বাংলাদেশের ঢাকা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে ফেনি নামে একটি গ্রামের বাসিন্দা। ছোটোবেলা থেকেই ওখানকারই একটি মাদ্রাসাতে পড়ে ও। দিন কয়েক আগে একটা ঘটনা ঘটে যেটা নুসরতের জীবন কে পালটে দেয় অনেকটাই। মার্চ মাসের শেষের দিক তখন। হঠাৎই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজ-উদ-দৌল্লা  ওকে ডেকে বলেন আজ ক্লাসের পর একবার আমার অফিসে আসবে। এটা শুনে নুসরত একটু অবাক হয়। স্কুলের কিছু গুরুতর নিয়মকানুন ভঙ্গ না করলে তো প্রধান শিক্ষকের রুমে যেতে হয় না। তাহলে কি নিজের অজান্তেই কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে ও?

ক্লাসের পর ও হাজির হয় প্রিন্সিপাল ঘরে। প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌল্লা ওঁর অফিসের দরজাটা বন্ধ করে দিতে বলেন। এবার আরও একটু অবাক হয় নুসরত। আদেশমত দরজা বন্ধ করে ও গিয়ে বসে প্রিন্সিপাল এর সামনে চেয়ারে। তারপর যেটা ঘটে সেটার জন্য একেবারেই তৈরী ছিল না নুসরত। ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় একাধিকবার ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্পর্শ করেন সোনাগাজি ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌল্লা। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই স্কুলের অনেকেই দেখেন নুসরত কে প্রধান শিক্ষকের ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে চলে আসতে।

ঘটনাটা এখানেই হয়তো শেষ হয়ে যেত। কারন বাংলাদেশে যৌন নির্যাতন এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা খুব কঠিন। অনেকে মেয়ে এবং তার পরিবার এসব ঘটনা সর্বসমক্ষে আনতে চান না। কারন অনেকেই ভাবেন এটা জানাজানি হলে আশেপাশের লোকজনের সামনে শুধু সম্মানহানিই হবে না, তাদের কে প্রতিনিয়ত অপমান সহ্য করতেও হতে পারে।

কিন্তু নুসরত জাহান রফি ছিল আলাদা। সে শুধু এর বিরুদ্ধে গর্জেই ওঠেনি। সে নিজে তার পরিবারের সাথে সেদিনই থানায় গিয়েছিল সমস্ত ঘটনা জানাতে। কিন্তু সেখানেও আর এক বিপত্তি ঘটে। থানার অফিসার-ইন-চার্জ নিজের ফোনে নুসরতের বয়ান রেকর্ড করতে থাকে। যে ভিডিওটি পরে কেউ একটা ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করে দেয়। নুসরত বার বার কথা বলার সময় মুখ ঢেকে নিচ্ছিল নিজের। কারন পুলিশের কাছে গিয়ে নিজের ওপর হওয়া যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলা এক জিনিস। কিন্তু সেই ঘটনা ক্যামেরার সামনে বলা? অতটাও সাহসী ছিল না হয়তো নুসরত। কিংবা হয়তো ও চায় নি এটা নিয়ে মিডিয়ায় বাড়াবাড়ি রকমের কিছু ঘটুক।

যদিও পুলিশ অফিসারটি এই ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয় নি একেবারেই। উনি বার বার নুসরত কে বলছিলেন মুখ থেকে হাত সরাতে। যাই হোক এই ঘটনার পরই ওই প্রধান শিক্ষক কে গ্রেফতার করা হয়। হাসি ফোটে নুসরতের মুখে। কিন্তু সেই হাসিও স্থায়ী হয় নি বেশীদিন। বাংলাদেশের রাস্তায় হঠাৎই মিছিল, বিক্ষোভ ইত্যাদি শুরু হয়। ওই প্রিন্সিপাল এর মুক্তির দাবি তে। ওই মাদ্রাসারই দু’জন ছাত্র স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদতে এই আন্দোলন শুরু করেন।

নুসরত কেই দোষ দিতে থাকেন সবাই। নুসরতের পরিবার এবার ভয় পেতে থাকেন নুসরতের নিরাপত্তা নিয়ে। নুসরত অবশ্য এতে দমে যায় নি। ওই ঘটনা ঘটার ১১ দিন পর ও আজ স্কুলে এসেছে পরীক্ষা দিতে। যদিও স্কুলে ঢোকার সময় একটু সমস্যা হয়। ওর দাদা হাসান কে আজ স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। গেটের বাইরেই আটকে দেওয়া হয়েছে। তবে আপাতত পরীক্ষাগুলোতেই কনসেন্ট্রেট করবে নুসরত আর ওসব ভাববে না।

পরীক্ষার পরই হঠাৎই ওর কাছে দৌড়ে দৌড়ে আসে মনি। কামরুন নাহার মনি ওর ক্লাসমেট। মনি জানায় যে ওরই এক বন্ধুকে স্কুলের ছাদে মারধোর করা হচ্ছে। ও একা যেতে সাহস পাচ্ছে না। নুসরত কে মনি অনুরোধ করে ওর সাথে যেতে। নুসরত রাজি হয়।

ছাদে গিয়ে নুসরত দেখে সেখানে অলরেডি ৪ জন রয়েছে। বোরখা পরে। বিপদ বুঝে পেছন ফিরে যেতে গিয়ে ও দেখে মনি দাঁড়িয়ে আছে ছাদের দরজা আটকে। তারপর বোরখাধারী পাঁচজন ঘিরে ধরে নুসরত কে। এবং ওকে বলে প্রিন্সিপাল এর ওপর করা অভিযোগ তুলে নিতে। নুসরত চোয়াল শক্ত করে বলে, “না!” ও কেস তুলবে না।

এরপরেই কয়েকজন নুসরত কে শক্ত করে ধরে। আর একজন ওর গায়ে ঢালতে থাকে কেরোসিন। নুসরত প্রাণপণ চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারে না। তারপরেই ওদের একজন ওর গায়ে ছুঁড়ে দেয় দেশলাই। জ্বলতে থাকে নুসরতের সারা শরীর। ওই পাঁচজন চেয়েছিল এটা যেন আত্মহত্যা বলে মনে হয়।

কিন্তু ওদের সেই প্ল্যান বানচাল হয়ে যায়। কারন ওরা ছাদ থেকে চলে যাওয়ার পর ধোঁয়া দেখে বেশ কয়েকজন দৌড়ে আসেন ছাদে। নুসরতের দাদা ওকে নিয়ে যায় স্থানীয় হাসপাতালে।  হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় শরীরের ৮০ শতাংশ সম্পূর্ণই পুড়ে গিয়েছে আগুনে। সঙ্গে সঙ্গে ওকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে।

ওখানে যাওয়ার সময়েই নুসরত বুঝতে পারে ও আর বেশীক্ষন নাও বাঁচতে পারে। তারপরেই নিজের দাদার ফোনে নিজের বয়ান রেকর্ড করে সে। সে জানায় ওর সাথে কী কী ঘটেছে। ওখানে যারা ছিল তাদের দু’জন কে ও চিনে ফেলেছিল সে কথাও জানায় ও বয়ানে। এবং সবশেষে জানায় ও যদি বেঁচে থাকে তাহলে ও নিজের শেষ নিঃশ্বাস অবধি এই কেস লড়বে। ওই স্যারের অপরাধের শাস্তি ও দিয়েই ছাড়বে।

কিন্তুটা জীবনটা তো রূপকথা নয়। ১০ই এপ্রিল ১৯ বছরের এই সাহসী নুসরত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। শেষ হয়ে যায় তার অপরাধীদের শাস্তি দেখে যাওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু যুদ্ধটা থেমে যায় নি। একটা ১৯ বছরের বাচ্চা মেয়ে চলে গেল সে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিল বলে। কিন্তু যেতে যেতে একটা বিপ্লব শুরু হয়ে করে দিয়ে গেল। মানুষকে ভাবিয়ে দিয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে শুয়ে যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে দাদার মোবাইলে শেষ বয়ান রেকর্ড করল নুসরত। যাতে ওর অপরাধীরা শাস্তি পায়। যাতে এরপর এই ধরনের ঘৃন্য অপরাধ করার আগে মানুষ একবার নুসরাত জাহান রফির কথা ভাবে। এত অল্প বয়সেই কত কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল মেয়েটা।

আমি ভয় করব না, ভয় করব না।
দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না।

অপরাজিতা

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি