১
অনেকক্ষন থেকেই একটা টেনশন কাজ করছে মৈত্রেয়ীর মধ্যে। আজকের দিনটা ওর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ওর জন্য না ওর আর সায়নের জন্য বলা চলে। সায়ন আজ শেষ পর্যন্ত ওকে ওর বাড়িতে ডেকেছে। না না… উলটো পালটা ভাবার মত এখনও কিছু ঘটে নি। না মানে আগে ঘটেছে কিন্তু আজ ওই জন্য ডাকেনি। আজ সায়ন ওকে ডেকেছে ওর মা এর সাথে মৈত্রেয়ীর আলাপ করাবে বলে। সায়ন বলেছে আজকে যদি ওর মা এর ওকে ভালো লেগে যায় তাহলে আর মাসখানেক এর মধ্যেই ওদের বিয়ের ব্যাপারটাও ফাইনাল হয়ে যাবে।
“আর যদি ভালো না লাগে তাহলে” জিজ্ঞেস করেছিল মৈত্রেয়ীই
সায়ন একটু ভেবে বলেছিল, “আরে লাগবে রে। দেখ না। তোকে ভালো লাগবে না এরকম হবে না কখনই।”মৈত্রেয়ী বলেছিল, “যদি না ভালো লাগে তাহলে? বল না। কী হবে তাহলে?”
– সে দেখা যাবে। ভালো লাগিয়েই ছাড়বো আমি।
উত্তর টা একদমই পছন্দ হয় নি মৈত্রেয়ীর। ও ভেবেছিল সায়ন বলবে “পছন্দ না হলেও তোকেই বিয়ে করব আমি!”
সে হয়তো সায়ন এমনিই করবে। কিন্তু এই কথাটা শুনতে কোন মেয়ের খারাপ লাগে!
আজ ওর টেনশনে থাকার আর একটা কারনও আছে যদিও। আজ সকাল থেকে অনীকের সাথে কথা বলে নি মৈত্রেয়ী। কাল রাত্রে ওরকম একটা ঘটনার পর ও সত্যি বুঝতে পারছিল না যে কী বলবে! এ জিনিস টা অবশ্য সায়ন অনেকদিন আগেই সন্দেহ করেছিল। ও বলেছিল অনীকের ওকে ভালো লাগে। কিন্তু মৈত্রেয়ী পাত্তা দেয় নি। দেয় নি তার কারণ অনীক নিজে ওকে কখনও কিছু বলে নি। ওর সাথে ক্লাস 11 থেকে একসাথে পড়ছে অনীক। তারপর একসাথেই কেমিষ্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল বিদ্যাসাগর কলেজে। সেখানেই ওর আলাপ সায়নের সাথে।
“তুই বোস। আমি মা কে ডাকছি” সায়ন এর গলায় বাস্তবে ফিরে এল মৈত্রেয়ী।
মৈত্রেয়ী বলল, “হ্যাঁ বসছি।”
সায়ন চলে গেল দোতলায় মা কে ডাকতে। ওদের বাড়িটা বেশ বড়। এটা অবশ্য ও আগেই বুঝেছিল। বাইরে থেকেই কয়েকবার দেখেছিল সায়নদের এই প্রাসাদের মত বাড়িটাকে। সায়ন ওকে ভেতরে নিয়ে আসার কথা বলেনি কখনই। মৈত্রেয়ীর খারাপ লাগত কিন্তু ব্যাপারটা কে পাত্তা দেয়নি তখন। পরে একটা বন্ধুর কাছে শুনেছিল সায়নের মায়ের নাকি ওকে খুব একটা পছন্দ না। ওর মা এর মনে হয়েছিল ও ওদের স্ট্যান্ডার্ডের না। তবে সায়ন কখনও এই কথাটা বুঝতে দেয়নি ওকে। সায়ন ওকে সত্যিই ভালোবাসে সেটা ও জানে। তবে সায়ন খুব পসেসিভ। অনীক কে নিয়ে বহুবার ঝামেলা করেছে ও মৈত্রেয়ীর সাথে। ইন ফ্যাক্ট আজ যে ও বসে আছে মৈত্রেয়ীর বাড়িতে সেটাও ওই ঝামেলারই সাইড এফেক্ট।
“দেকি পা টা তুলুন দেকি”
কথাটা শুনেই অন্যমনস্কতা টা একটু কাটল মৈত্রেয়ীর। কথাটা বলেছে বাড়ির কাজের মাসি। পা’টা তুলে নিল ও। ধুর! এভাবে কতক্ষন বসে থাকতে হবে। সায়ন যে সেই গেছে এখনো নামলো না। আর এদিকে মৈত্রেয়ীর মাথাটা টেনশনে ভারী হয়ে যাচ্ছে। ফোনটা ব্যাগ থেকে বার করল মৈত্রেয়ী। নাহ মেসেজ আসে নি কোনো। ও আশা করেছিল আসবে। আজ ও ব্যাগেই ফোন রেখেছিল। কারন আজ ওকে কুর্তি আর লেগিংস পরতে হয়েছে। সায়নের হুকুম। আজ প্রথমবার ওর মা সাথে দেখা হবে। জিনস নাকি পরা চলবে না। অনীকের বাড়িতে তো কয়েকবার থ্রি কোয়ার্টার আর টিশার্ট পরে চলে গেছে। কই ওর মা তো কিছু বলে নি। অনীকের বাড়িতে একটা খুব ভালো গেমিং এর সেট আপ আছে। দেওয়ালে প্রোজেক্টরের পর্দা। আর তার সাথে কানেক্ট করা থাকে X BOX. দারুন লাগে বড় স্ক্রীনে গেম খেলতে। সুযোগ পেলেই ওর বাড়ি গিয়ে ফিফা খেলে মৈত্রেয়ী। ৩-৪ দিন আগেও গিয়েছিল। গেম খেলতে। অনীকের মা চিকেন পকোড়া বানিয়েছিল সেদিন ওদের জন্যে। হঠাৎই ফোন করেছিল সায়ন। একটা লাইভ গেমের মাঝে ছিল বলে ফোনটা ধরে নি। ১০ মিনিট পর কলব্যাক করেছিল মৈত্রেয়ী।
– হ্যাঁ রে বল
– কোথায় ছিলি
– এই তো ফিফা খেলছিলাম।
– ফোন ধরলি না কেন?
– আরে গেমের মাঝে ছিলাম তো তাই। এই বাল, আমার জন্য পকোড়া রাখবি। সব খেয়ে নিস না।
– তুই কি অনীকের বাড়িতে?
– হ্যাঁ রে। আর কোথায় গেম খেলব?
– কেন? তোর নিজের ল্যাপটপে?
– সেই? আমার ল্যাপটপে গেম? মাইক্রোসফট ওয়ার্ডই খোলে না ভালো করে।
– ঠিক আছে। তুই খুব ব্যস্ত বুঝতে পারছি। পরে কথা হবে।
এই কথাটা শুনেই মৈত্রেয়ী বুঝেছিল সায়নের রাগ হয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ও চাপা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “এই কী হয়েছে? রাগ করছিস কেন?”
সায়ন বলেছিল, “জানিনা। আমার রাগ হচ্ছে। তাই রাগ করছি।”
– এরকম করে না বাবু। কী করব বল? বোর হচ্ছিলাম বাড়িতে তাই গেম খেলতে এসেছিলাম। তোকে মেসেজও করেছি তো Whatsapp এ।
– আমার নেট টা কাজ করছে না। ঠিক আছে গেম খেল তুই। পরে কথা বলব।
– আরে শোন না। তোর বাড়িতে তো নিয়ে গেলি না তুই কখনও। আর এখানে মার ভালো বন্ধু বলতে তো অনীক। জানিস তো তুই। কেন রাগ করছিস?
– কবে আসতে চাস?
এই প্রশ্নটাতে একটু চমকে গিয়েছিল মৈত্রেয়ী। কবে আসতে চাস মানে? সত্যি?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “সিরিয়াসলি?”
সায়ন বলেছিল, “হ্যাঁ। দেখ এখন আমি চাকরি করছি। কাজেই আমাদের সম্পর্ক টা নিয়ে এগোতেই পারি আমরা।”
– কিন্তু তোর বাড়িতে? আমাকে মেনে নেবে?
– কেন নেবে না? নেক্সট উইক আয় আমার বাড়ি। মা এর সাথে আলাপ করিয়ে দেব। বাবা থাকবে না যদিও ওই সময়। দিল্লী যাবে। বাবার সাথে পরে আলাপ হবে। আগে মা এর সাথে হোক।
খুব আনন্দ হচ্ছিল মৈত্রেয়ীর সেদিন। যাক। শেষ পর্যন্ত ও যাচ্ছে সায়নের বাড়িতে। সেই আনন্দ যে এরকম একটা টেনশনে রূপান্তরিত হবে সেটা কি আর জানতো ও।
“অ্যাই! অ্যাই! কি ভাবছিস?” সায়নের গলায় সম্বিৎ ফিরল ওর। ধুর আজ কী যে হচ্ছে! শুধু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে ও।
“হ্যাঁ বল। কাকিমা কোথায়?” জিজ্ঞেস করল মৈত্রেয়ী
“ওই তো আসছে!” রাজ বলল।
কথাটা শুনে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল একজন ভদ্রমহিলা নামছেন। ইনিই তাহলে সায়নের মা। ও উঠে দাঁড়ালো ওনাকে দেখে। সামনে আসতেই প্রনাম করল ভদ্রমহিলাকে।
সায়নের মা ওকে বলল, “বোসো।”
বেশ গম্ভীর গলা তো। ভয়টা আর একটু বাড়ল মনে হয় মৈত্রেয়ীর।
“কী করো তুমি এখন?” জিজ্ঞেস করলেন সায়নের মা
মৈত্রেয়ী গলা ঝেড়ে বলল, “আমি তো এই MSC তে ভর্তি হয়েছি। ওটা হয়ে গেলে Phd করব ভাবছি”
সায়নের মা বললেন, “আরও পড়বে?”
– হ্যাঁ সেরকমই তো ইচ্ছে আছে!
মৈত্রেয়ী আস্তে আস্তে অনেকটা স্বাভাবিক হচ্ছে মনে হল।
“তোমার বাবা কী করেন?” সায়নের মা জিজ্ঞেস করল এবার।
– একটা বই দোকানে কাজ করেন।
– ব্যাস?
– ব্যাস মানে? বুঝলাম না।
– মানে আর কিছু করেন না?
– নাহ।
– আর তোমার মা?
– মা ওই পাড়ার বাচ্চাদের পড়ায় বাড়িতে।
মৈত্রেয়ী কথাটা বলতে বলতে সায়নের দিকে তাকালো। ওর এদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। ও তখন ফোনে কি একটা ভিডিও দেখছে।
সায়নের মা বললেন, “আচ্ছা একটা কথা বলো। যদি আমরা তোমাকে বিয়ের পর বলি আর পড়তে হবে না। তাহলে তুমি করবে?”
মৈত্রেয়ী আবার তাকাল সায়নের দিকে। সায়ন এবার ওর দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু কিছু বলছে না।
মৈত্রেয়ী বলল, “দেখুন Academics এ থাকার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। তাই আসলে Phd. টা করাটা এর জন্য খুব জরুরী।”
– না ধরো আমরা বললাম যে তোমার পড়ার খরচ আমরা দিতে পারবো না। সেক্ষেত্রে কী করবে তুমি?
– মৈত্রেয়ী বলল Phd. করতে গেলে এমনিতেও তো টাকা দিতে হবে না আমাকে। বরং JRF টা ক্র্যাক করতে পারলে আমিই টাকা পাবো Phd. এর জন্যে।
– বাবাহ! পুরো প্ল্যানিং হয়ে আছে তো! তা বিয়ের প্ল্যানিং কিছু হয়েছে নাকি?
– নাহ হয় নি।
– তা সায়নের যা যা দরকার দিতে পারবেন তোমার বাবা?
মৈত্রেয়ীর বলতে ইচ্ছে করছিল, “কেন ওর বাবা দিতে পারে না নাকি?”
কিন্তু চেপে গেল সেটা। অহেতুক বাজে ব্যবহার করে লাভ নেই। ও বলল, “মানে পণ নেবেন বলছেন?”
এই কথাটা শোনার পর কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন ভদ্রমহিলা। তারপর সায়ন কে বললেন, “রানুমাসি কে বল মিষ্টি দিতে। আর লুচিও ভাজতে বল। মেয়েটা অনেকক্ষন এসেছে।”
সায়ন বাধ্য ছেলের মত চলে গেল। সায়নের মা এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি রান্না করতে পারো?”
মৈত্রেয়ীর অনেকক্ষন থেকেই এই জেরার জন্য মাথা গরম হচ্ছিল। সায়নটাও কীরকম রে ভাই! নিজে কিচ্ছু বলছে না। এরকম হিটলার শাশুড়ির সাথে ঘর করতে হবে? বাপরে!
সায়নের মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “পারো? রান্না করতে?”
মৈত্রেয়ী মাথা নীচু করে উত্তর দিল, “না পারি না।”
একটা বাঁকা হাসি হাসলেন ভদ্রমহিলা। তারপর বললেন, “তাহলে বাড়ির রান্নাবান্না করবে কী করে?” মৈত্রেয়ী বলল, “কেন? তখন রানু মাসি থাকবে না?”
সায়ন রান্নাঘর থেকে এল তারপরেই। ওর মা ওকে বলল, “কীরে তুই বলিস নি তো ও রান্না জানেনা বলে?”
মৈত্রেয়ীর মাথাটা গরমই ছিল। সায়ন কিছু বলার আগেই ও বলল, “হ্যাঁ সায়ন। তুই বলিস নি তো তোর মা রান্না জানে কিন্তু রানু মাসি কে দিয়ে করায় বলে?”
কথাটা বলেই সোফা থেকে উঠে পড়ল মৈত্রেয়ী। তারপর এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সায়ন তখন ডাকছে ওকে” এই! কী হল? কোথায় যাচ্ছিস?”
ওর মা ওকে ধমক দিয়ে কিছু একটা বলল মনে হল। খুব কান্না পাচ্ছে মৈত্রেয়ীর! খুব! আজকের দিনটা এরকম ভাবে কাটবে ও সেটা একদমই ভাবেনি! ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল ও। নাহ। কোনো মেসেজ নেই।
২
পরমানুর মধ্যে তিনটে ছোটো ছোটো কনা আছে। প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন। এর মধ্যে প্রোটনে থাকে পজিটিভ চার্জ। আর ইলেকট্রনে থাকে নেগেটিভ চার্জ। আর নিউট্রন হল নিউট্রাল। কোনো চার্জ নেই ওর মধ্যে। কেমিস্ট্রি অনার্স পড়ে এইটুকু মোটামুটি অনীক রপ্ত করতে পেরেছে এতদিনে।
ক্লাস ইলেভেন থেকে একসাথে রয়েছে ও মৈত্রেয়ীর সাথে। বেশীরভাগ লোকজনই ভাবত ওরা কাপল। তাই কেউ খুব একটা লাইন মারার চেষ্টাও করে নি মৈত্রেয়ী কে। কিন্তু এই সায়ন ছেলেটা কবে যে হঠাৎ মেয়েটাকে পটিয়ে নিল সেটা ও বুঝতেও পারে নি।
অনীক বরাবর ভাবত ও হল ইলেকট্রন আর মৈত্রেয়ী হল প্রোটন। হ্যাঁ মৈত্রেয়ীর জন্য ওর নেগেটিভ চার্জ হতেও অসুবিধে নেই। কিন্তু যখন সায়ন ফিল্ডে এসেছিল তখন ও ভেবেছিল এই ছেলেটা নিউট্রন না হয়ে যায় না। প্রোটন আর ইলেকট্রন সবসময় একে অপরকে আকর্ষন করবে। আর নিউট্রন ব্যাটা বসে বসে দেখবে। কিন্তু কখন যে হতচ্ছাড়া সায়নটা ওর কাছ থেকে নেগেটিভ চার্জ নিয়ে নিয়েছে সেটা বুঝতেও পারে নি ও। তারপর ও হয়ে গেল নিউট্রন আর…
ধুর তখন থেকে প্রোটন নিউট্রন প্রোটন নিউট্রন কিসব ভাবছে। আর ভেবে কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে!
“কীরে তোর মন খারাপ?” জিজ্ঞেস করল ওর মা।
সকাল থেকে অনীক ওর ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। কাজেই ওর মা এর এটা জিজ্ঞেস করাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না।
“না না। মন খারাপ কেন হবে?” উত্তর দিল অনীক
ওর মা হেসে বলল, “গাজরের হালুয়া খাবি?”
ওর মন খারাপ থাকলেই ওর মা গাজরের হালুয়া করে। মা ভাবে এটা খেলেই ওর মন ভালো হয়ে যাবে। আর সেটা যে হয় সেটা অনীক নিজেও জানে। কীভাবে হয় কে জানে? একবার সেকেন্ড সেম এ খুব কম নাম্বার পেয়েছিল অনীক। স্টুডেন্ট হিসেবে ও খুব একটা ভালো কোনোদিনই নয়। কিন্তু তাও সেবারের নাম্বার টা যেন একটু বেশীই কমে গিয়েছিল ওর। দুপুরে ওয়েবসাইটে রেজাল্ট দেখার পর থেকে ফোন বন্ধ করে দিয়েছিল ও। ও জানে মৈত্রেয়ী ফোন করবে ওকে। সেই জন্যেই আরোই বন্ধ করেছিল। মৈত্রেয়ী ওকে না পেয়ে ওর মা এর ফোনে ফোন করেছিল। তাও ও ফোন ধরে নি। বলেছিল, “বলে দাও শরীর খারাপ!”
সেদিন হঠাৎ মা এর সাথে প্ল্যান করে মৈত্রেয়ী চলে এসেছিল ওর বাড়িতে। হঠাৎ করেই এক বাটি গাজরের হালুয়া নিয়ে ওর রুমে এসেছিল মৈত্রেয়ী। ও প্রথমটায় খুব অবাক হয়ে গেছিল। আরও অবাক হয়েছিল যখন শুনেছিল ওটা নাকি মৈত্রেয়ী নিজের হাতে করেছে। প্রথমটায় একদম বিশ্বাস করে নি। কিন্তু খাওয়ার পর চিনি কম লাগায় বুঝতে পেরেছে এটা মৈত্রেয়ীই করেছে। মা এর এই ভুল টা হয় না। মা জানে ও মিষ্টি বেশী খায়।
“কীরে খাবি না?” আবার জিজ্ঞেস করল ওর মা।
অনীক বলল, “আজ থাক মা। ভালো লাগছে না!”
ওর মা আর কিছু না বলে চলে গেল। আজ ওর সত্যিই ভালো লাগছে না। কেন যে কাল রাত্রে ওটা করতে গেল ও। কে জানে! ও জানে ওকে নিয়ে মৈত্রেয়ীর সাথে সায়নের ঝামেলা হয়। ও বুঝতে পারে। সায়ন বোঝে যে অনীকের মৈত্রেয়ী কে ভালো লাগে। কিন্তু মৈত্রেয়ী টা একটা গাড়ল। কিছুতেই বুঝতে পারে না ও সেটা। ক’দিন আগেই ওর বাড়িতে ফিফা খেলছিল মৈত্রেয়ী। হঠাৎই সায়নের ফোন আসে। তখন গেম খেলছিল বলে ফোন ধরতে পারে নি ও। কিন্তু তারপর ঘুরে ফোন করেছিল। আর কথা বলতে বলতে চলে গিয়েছিল পাশের ঘরে। তখনই অনীক বুঝেছিল ওদের আবার ঝামেলা হচ্ছে!
তবে ফোন রেখে আসার পর মৈত্রেয়ী যেন আনন্দে লাফাচ্ছিল।
“কী হয়েছে? এত মজা কীসের? জিজ্ঞেস করেছিল অনীক।
মৈত্রেয়ী বলেছিল, “সায়ন ওর বাড়িতে ডাকছে আমাকে! ওর মা এর সাথে আলাপ করাবে বলে”
“Wow! দারুন তো! Um… খুব ভালো ব্যাপার! কবে যাবি?” জিজ্ঞেস করেছিল অনীক।
– “পরের সপ্তাহেই হয়তো! দেখি!
পরের সপ্তাহ! মানে সময় খুব কম। একবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করা যাবে না। অনেক সাহস করে কাল রাত্রে মেসেজ করেছিল ও মৈত্রেয়ী কে।
– ব্যস্ত?
– ন্যাকা চৈতন্য? বল!
– একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
– একটা চড় মারব তোকে!
– মানে? কেন?
– এরকম ফরম্যালিটি কবে থেকে করতে শুরু করলি আমার সাথে?
– শোন না…
– হ্যাঁ বল।
– না মানে… আসলে…
– প্রেমে পড়েছিস নাকি কারুর? প্রোপোজ করতে পারছিস না?
মৈত্রেয়ীটা কীভাবে যে ওর মনের কথা বুঝে যায়! সেটা আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না অনীক।
অনীক লিখেছিল, “হ্যাঁ। কিছুটা ওরকমই!”
– এই? কে রে? আমাকে বল?
– ঋতুপর্ণা নাকি?
– কে ঋতুপর্ণা?
– আরে ওই তো আমাদের সাথেই পড়ত! খুব বড় ইয়ে… মানে…
– হ্যাট না না!
– হ্যাট!!
– ওহ ও নয়? Good for you! এমনিতেও ও খুব হর্নি শুনেছি। তুই ওকে Satisfy করতে পারতিসও না।
– বাল বকিস না। শোন আমার কথা।
– হ্যাঁ সরি। বল বল।
– Um… I… love you..
– I love you too রে। এবার বল মেয়েটা কে? সায়ন ফোন করছে তখন থেকে! ধরতে হবে এবার।
এই মেয়েটা জাস্ট যাতা! অপ্রয়োজনীয় জিনিস কত সহজে বুঝে যায়! আর আসল কথাই বুঝতে পারে না।
অনীক এবার লিখল, “না… I mean I love you… I have always loved you. আমি তোকে ভালোবাসি মৈত্রেয়ী”
মৈত্রেয়ী মেসেজটা সিন করে কিছুক্ষন কোনো রিপ্লাই দেয় নি। তার একটু পর বলল, “পরে কথা হবে অনীক।”
অনীক আর কিছু বলে নি। আর কিই বা বলবে। এটা যে ঘটবে সেটা ও ভেবেইছিল। কিন্তু ও ভেবেছিল কিছু একটা রিপ্লাই হয়তো করবে মৈত্রেয়ী। আজ তো বোধহয় সে এতক্ষনে সায়নের বাড়িতে চলেই গেছে। বিয়ের কথা কী পাকা হয়ে গেল? বিছানার পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে একবার দেখল ও। না কোনো মেসেজ নেই। পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়ল ও। এই মেয়ে আর ওকে মেসেজ করবে না।
একটু তন্দ্রা মত এসেছিল অনীকের। কিন্তু হঠাৎই ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠতেই আলোতে চোখটা কুঁচকে গেল ওর।
“উফফ! মা। লাইট বন্ধ করো। ভালো লাগছে না” একটু জোরেই বলে উঠল অনীক।
“এই বাল! উঠে বোস!”
গলাটা শুনেই তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে বসে পড়ল অনীক। মৈত্রেয়ী দাঁড়িয়ে আছে খাটের সামনে। হাতে গাজরের হালুয়া। এটা কী হল? এটা কীভাবে হল? এটা কেন হল? এটা কখন হল? অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে ভীড় করছে অনীকের মনে।
“তুই এখানে?” বলে উঠল অনীক।
“ফিফা খেলতে এলাম। মুড টা ভালো নেই!” মৈত্রেয়ী বলল
অনীক বলল, “কী হয়েছে?”
– আগে তোকে হারাই একটা ম্যাচ। তারপর বলব কী হয়েছে!
“ওহ Okay” বলেই গাজরের হালুয়ার বাটিটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল অনীক
“এটা তোর নয় ছাগল। তোর টা আনছে কাকিমা” বলে উঠল মৈত্রেয়ী
হাত সরিয়ে নিল অনীক। ওর পাশে বসল মৈত্রেয়ী। একটু পরেই মা ঘরে এল আর একটা বাটি নিয়ে। মা এর মুখ দেখে মনে হচ্ছে জোর করে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। অনীক কিছু বলল না। চুপচাপ বাটি টা নিয়ে নিল।
হালুয়ার বাটি থেকে প্রথম চামচ টা মুখে দিয়েই অনীক বুঝল মিষ্টি কম। অর্থাৎ এটা মৈত্রেয়ী করেছে। অনেকক্ষন আগে এসেছে তাহলে ও। একবার ভাবল বলবে ওকে। তারপর মনে হল থাক। মৈত্রেয়ী সবকটা রান্নাই দারুন করে। হালুয়ায় না হয় একটু খুঁত থাকল। এ আর এমন কী!
ও অবশ্য তখনও জানে না মৈত্রেয়ী সায়নের মা কে বলে এসেছে ও রান্না করতে পারে না!