ওদের বাড়িটা আর রাজুদার বাড়িটা এমনভাবে লাগোয়া যে কোনো একটি বাড়িতে জোরে কথা বললে বা টিভি চললে আর একটা বাড়িতে খুব ভালোভাবেই শোনা যায়। রাজুদার ২ বছরের বাচ্চা রুকুকে একটু আগে বউদি ABCD পড়াচ্ছিল। ও পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিল বউদি বলছে A for কি হয় রুকু? রুকু সাথে সাথে উত্তর দিল Aeroplane.. তারপর আবার প্রশ্ন ধেয়ে এল রুকুর দিকে B For?  এবারও ঠিক বলল রুকু – Bird। কিন্তু H for Hut এর পরে I তে এসে রুকু বার বার আটকে যাচ্ছে।
বৌদির গলা পেল আবার ও। “ I – N – D – I – A” কি হয়? এত সোজা একটা জিনিস বলতে পারছ না?” রুকু কি বলল সেটা আর শোনা গেল না। যদিও সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় ও।বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল এই বসন্তকালে আবার মেঘ করেছে। পৃথিবীর আবহাওয়ার ভারসাম্যটা শেষ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তবে সত্যি কথা বলতে কি এসব নিয়ে ও খুব একটা ভাবে না। আর ওর ধারনা কোনো মানুষই তেমন একটা ভাবেনা। ওর আপাতত ভাবনার বিষয়বস্তুটা…
“কিরে দাদা, তোদের রিহারশ্যাল কমপ্লিট?”
চিন্তার তার কাটল ওর। প্রশ্নটা করেছে ওর বোন অরিত্রী। আসলে চিন্তাটা ওর আজকের ওই নাটক নিয়েই।
“না রে। এই তো বেরোবো এবার। তুই আসবি তো সন্ধ্যে তে?” জিজ্ঞেস করল অর্চন।
“হ্যাঁ আসব। আর সৃঞ্জয়ও বলল যাবে।”
সৃঞ্জয়কে অর্চন চেনে। ওর বোনের বয়ফ্রেন্ড। খুব ভাল ছেলে। ওর নিজের এসব ব্যাপারে একেবারেই নাক উঁচু নেই। আর থাকবেই বা কি করে। ওর লড়াই যেটা নিয়ে সে লড়াই লড়তে গেলে এত সামান্য ব্যাপারে আপত্তি করলে হয় না। ওদের বাবা মা বেঁচে থাকলেও আপত্তি করতেন বলে মনে হয় না।
“বাহ!ভালো তো। নিয়ে আসিস ওকে।”
“৭ টায় তো?”
“হ্যাঁ রে। রবীন্দ্র সদনে। ৭ টা থেকে। আমি বেরোলাম। যাই দেখি কতদূর এগোল রিহারশ্যাল।”

“ঠিক আছে রে। নাটকের শেষে দেখা হচ্ছে গ্রীনরুমে” দরজাটা বন্ধ করার আগে বলল অরিত্রী।

স্কুলের গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল শুভদ্বীপ। টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা বেজে গিয়েছে ৫ মিনিট হল। আস্তে আস্তে সবাই ক্লাসে আসছে। ও জানে স্যার আসতে অনেক দেরী এখনও। তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকে দেখছিল। ঝামেলা হচ্ছে আজও। ক্লাস ইলেভেনের এই ছেলেটা অদ্ভুত বলে সবাই সব সময় ওর পেছনে লাগে। অদ্ভুত মানে চুল বড় বড়, মেয়েদের মত একটা সাইড ব্যাগ নিয়ে স্কুলে আসে। আর কথাও বলে কেমন যেন করে। ওদের স্কুলের দারোয়ান বিশুদা আর ইলেভেনের আরও কয়েকজন ছেলে মিলে রোজ ঝামেলা করে এই ছেলেটার সাথে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
“কিরে ক্লাসে যাবি না? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” – জিজ্ঞেস করল সুনেত্র।
ও স্কুলের গেটের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল – “দেখ আজকেও জালাচ্ছে ওই ছেলেটাকে ওরা।”
সুনেত্র ওদিকে তাকিয়ে বলল, “তোর তাতে কি? ছাড় না। ওই হিঁচড়ে গুলোকে ওরকম করাই ভালো।”
কথাটা একদম ভাল লাগেনি শুভদ্বীপের। ও উত্তর দিল না কোনো। হিঁচড়ে কিনা ও জানে না। তবে কোনো মানুষের সাথেই এরকম হওয়া ঠিক বলে ওর মনে হয় না। রোজ রোজ অকারন ঝামেলা কতদিন সহ্য করতে পারে একজন?
“কিরে চল না ক্লাসে।” সুনেত্র এবার অধৈর্য গলায় বলল।
“তুই যা। আমি পরে যাচ্ছি।” বলে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেল শুভদ্বীপ। ও আজ দেখতে রোজ কি হয় গেটের সামনে।

নিচে গিয়ে গেট থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ও। সব কথাই কানে আসছিল ছেলেগুলোর। একজন বলল – “ভাই শুধু ওই মালটাকেই আরাম দিলে হবে? আমাদেরও একদিন একটু সুযোগ দে তোকে সেবা করার?”
এরপর আর একটা ছেলে পানের পিক ফেলে বিচ্ছিরিভাবে হাসতে হাসতে বলল, “ভাই… বা বোন যাই হোস না কেন তুই। আগে আমি। তারপর বাকিদের ভাগ দিস।”
ছেলেটা কিছু উত্তর না দিয়ে স্কুলের মধ্যে ঢুকতে গেলেই বাধা দিচ্ছে বিশু দা। বলছে, “ঘন্টা পড়ার পর কারুর ঢোকার নিয়ম নাই। এই কেলাসটা শেষ হোক তারপর…”

শুভদ্বীপের খুব ইচ্ছে করছিল এগিয়ে গিয়ে ছেলেগুলোকে আচ্ছা করে কেল… সরি… মারতে। কিন্তু ও পড়ে ক্লাস সেভেনে আর ওরা ক্লাস ইলেভেনে। ও একা কিই বা করবে। মাঝে মাঝে এই ছেলেটার সাথে আর একটা ছেলে থাকে। ও লক্ষ্য করেছে সেদিন গুলো এই ছেলেটাকে কিছু বলা হয় না। কিন্তু যখনই ও একা থাকে…

“এই তোর কোন ক্লাস রে? বেল পড়ে যাওয়ার পরে ক্লাসের বাইরে কেন?” হঠাৎ একটা বাজখাঁই গলার আওয়াজে চমকে উঠে পেছনে তাকাল ও।
প্রশ্নটা করেছেন ওদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার অভিজিৎ বাবু। খুব রাগী। শুভদ্বীপ মাথা নিচু করে একটু আমতা আমতা করে বলল – “সরি স্যার। বাথরুমে গিয়েছিলাম। ক্লাসে যাচ্ছি।”
অভিজিৎ বাবু কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। কারন তখন ওঁর চোখ পড়েছে গেটের বাইরের ঝামেলার দিকে। গেটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে ওর দিকে ফিরে বললেন, “ঠিক আছে যা ক্লাসে যা।”

বাধ্য ছেলের মত ও পেছন ফিরে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা ওঠার পর ও শুনতে পেল অভিজিৎ বাবুর গলা – “এই কি হচ্ছে এখানে? কোন ক্লাস তোদের?”

ভারতবাসী সমকামিতা বিষয়টা চিরকালই নাক উঁচু করে দেখে। ও বহুবার লক্ষ্য করেছে ‘gay’ শব্দটা শুনলে এই হোমোফোব গুলো ঘেন্না নিয়ে তাকায়। সুপ্রীম কোর্ট সমকামিতার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে প্রায় এক বছর হতে চলল। তবে তার বহু আগে থেকেই এই লড়াই টা চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওরা মানে মূলত ওর দাদাই। বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পেন থেকে শুরু করে সমকামিতার সমর্থনে থিয়েটার অবধি করছে। যদিও খুব বড় কোনো সাফল্য দেখেনি কেউই। কিন্তু অরিত্রীর বিশ্বাস ওর দাদা একদিন খুব বড় একটা মূল্য পাবে ওর এই লড়াই এর। ও জানে ওর দাদা কেন এই লড়াই টা তে এসেছে। স্কুলের সেই ঘটনাটার সাক্ষী ওরা অনেকেই।
“এই চল। দাদার সাথে দেখা করবি তো?” – সৃঞ্জয়ের কথায় সম্বিৎ ফিরল অরিত্রীর। অর্চন দের নাটক শেষ হয়ে গেছে বেশ খানিক্ষন হল। এই নাটক টা আসলে ওর বহুবার দেখা। তাই শেষ দিকে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল কি একটা যেন ভাবতে ভাবতে।

“হ্যাঁ চল্‌ যাই।” – চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল অরিত্রী।

রবীন্দ্র সদন আজ প্রায় হাউসফুল বলা চলে। দাদার কাছে শুনেছে আজ কোনো একটা কাগজের সাংবাদিক নাটকটা দেখতে আসবেন। নাটক শেষ। তাই ভীড় আস্তে আস্তে হালকা হচ্ছে। ভীড় ঠেলে গ্রীনরুমের দরজা ঠেলে যখন ওরা ঢুকল ভেতরে তখন মেক আপ তুলতে ব্যস্ত সবাই। অর্চন ওদের দেখে হাসি মুখে এগিয়ে এল।
“কেমন লাগল তোদের?” জিজ্ঞেস করল অর্চন।
অরিত্রী জানে সৃঞ্জয় আজ প্রথম দেখল এই নাটকটা। তাই প্রশ্নটা করা হয়েছে মূলত ওর জন্যেই।
সৃঞ্জয় সাথেই সাথেই উত্তর দিল – “খুব ভাল লেগেছে দাদা। অসাধারন কিছু অভিনয় আর তার সাথে জমাটি স্ক্রিপ্ট। সব মিলিয়ে অনবদ্য।”
“থ্যাঙ্ক ইউ। খুব ভাল লাগল শুনে।” – বলল অর্চন।
ঠিক এই সময় দলের একজন প্রবীন মহিলা হঠাৎ এসে অরিত্রীর গালটা টিপে দিয়ে বলল – “কিরে মা? কেমন আছিস?”
একে চেনে অরিত্রী। নম্রতা কাকিমা। ওকে খুব ভালবাসে। ছোটোবেলা থেকেই ওদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ বলেই জানে একে।
“আমি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?” -ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতে করতে বলল অরিত্রী।
“আমারও বেশ ভালই চলে যাচ্ছে রে।” বলল নম্রতা কাকিমা,(তারপর সৃঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে) “তা এই কি তোর তিনি?”
এবার উত্তর দিল অর্চন, “হ্যাঁ কাকিমা। এর কথাই বলেছিলাম আপনাকে। ওই সৃঞ্জয়।”
সৃঞ্জয় প্রনাম করল এবার। মাথায় হাত ছুঁইয়ে কাকিমা বললেন, “বাহ! বেশ ভাল মানিয়েছে তো তোদের দু’জনকে। এবার তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেল।”

‘বিয়ে’ শব্দটা যখনই ,মাথায় ঢোকে অরিত্রীর তখনই কেমন যেন একটা অদ্ভূত অনূভূতি হয়। ও যে ঠিক কি চায় মাঝে মাঝে ও বুঝতে পারে না। সৃঞ্জয় খুব ভাল ছেলে ও সেটা জানে। ওকে বন্ধু হিসেবেও খুব ভালবাসে ও। কিন্তু যখনই ও শারীরিক ভাবে কাছে আসতে চেয়েছে অরিত্রী বাধা দিয়েছে। কারন ও কখনোই ব্যাপারটা খুব একটা অনুভব করেনি। বরং যখন ও স্নিগ্ধার সাথে থাকে…
“ঠিক আছে মা! আজ তাহলে আসি। ভাল থাকিস তোরা।” – কাকিমার এই কথায় আবার বাস্তবে ফিরে এল ও। ওর যে ঠিক কি হয়েছে বুঝতে পারে না ও। মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে ওর। এটা আগে হত না ওর সাথে। ইদানীং হচ্ছে।
“এই শোন। তোরা যা। আমার একটু দেরি হবে। আমি সব গুছিয়ে আসছি। আর সৃঞ্জয় আজ আমাদের বাড়িতে খেয়ে যেও। আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি।” অর্চন একটা কাপড় দিয়ে মেক আপ তুলতে তুলতে বলল।

রবীন্দ্র সদন থেকে বেরিয়ে যখন ওরা মেট্রোয় ঢুকছে তখন একটা টেক্সট এল অরিত্রীর ফোনে। স্নিগ্ধা মেসেজ করেছে – ‘hi J’। শরীর দিয়ে একটা ঠান্ডা অথচ স্নিগ্ধ স্রোত বয়ে গেল কি? রিপ্লাই করতে পারল না ও। কারন স্টেশনের ভেতরে ঢুকতেই নেটওয়ার্কটা চলে গেল ফোনের। আধঘন্টার আগে আর রিপ্লাই করতে পারবে না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল অরিত্রীর।

  একটা পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর ক্লাসে পরের পিরিয়ডের স্যার আসতে দেরী করে অন্তত ১০ মিনিট। মাঝে মাঝে সময়টা বাড়ে বই কমে না। কাজেই এই সময়টা ক্লাসের সমস্ত ছেলেই বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ওদের স্কুলের ক্যাম্পাসটা বেশ বড়। স্কুলের মধ্যেই একটা ছোটোখাটো মাঠ রয়েছে। মাঠ পেরিয়ে অন্যদিকে ওদের স্কুলের লাইব্রেরী। ও শুনেছে এই লাইব্রেরীটাই আগে ওদের স্কুল ছিল। এখন এত বড় ক্যাম্পাস জুড়ে স্কুল হওয়ার পর পুরোনো বিল্ডিং টা কে লাইব্রেরী বানানো হয়েছে। বিজ্ঞানের ক্লাসটা শেষ হওয়ার পর ক্লাসের বাইরে এসে অন্যদিনের মত বারান্দায় দাঁড়াল শুভদ্বীপ। বেরিয়েই দেখতে পেল নীচে কয়েকজন দৌড়াদৌড়ি করে ওদের পুরোনো স্কুল বিল্ডিং এর দিকে যাচ্ছে। বারান্দা থেকে একটু বাঁ দিকে সরে গিয়ে পুরোনো বিল্ডিং এর দিকে দেখার চেষ্টা করল ও। কিন্তু একটা জটলা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে গেল ও ওই জটলার দিকে। কাছে গিয়ে দেখল অনেকে রয়েছে ওদের স্কুলের। ছোটদের সামনে যেতে দিচ্ছেন না স্যার রা। ওর বন্ধু সুনেত্র ওর অনেক আগে থেকেই এখানে আছে। ও এগিয়ে গিয়ে সুনেত্র কে জিজ্ঞেস করল – “কি হয়েছে রে” সুনেত্র বলল, “আরে ওই হিজড়ে টাইপের ছেলেটা যাকে সেদিন তুই দেখালি না ও সুইসাইড করেছে। হাত কেটে।”
সুইসাইড কথাটা শুনে আঁতকে উঠল শুভদ্বীপ। “কেন? সুইসাইড কেন করল?” জিজ্ঞেস করল ও।

“আরে যেটা শুনলাম সেটা হল  আজ নাকি ওই ছেলেটা অন্য একটা ছেলের সাথে গল্প করছিল প্রেয়ার হওয়ার আগে। এই পুরোনো বিল্ডিং এর একটা ঘরে। তারপর ক্লাস টুয়েল্‌ভের কতগুলো ছেলে ঢুকে ওকে উলটো পালটা ভয় দেখিয়ে জোর করে ‘ব্লো জব’ দেওয়া করিয়েছে।”
“ব্লো জব?” ভুরুটা কুঁচকে গেল শুভদ্বীপের, “এটা মানে কি?”
“কি রে তুই?” খুব বিরক্ত হয়ে বলল সুনেত্র, “ব্লো জব মানে জানিস না?”
শুভদ্বীপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সুনেত্র পেছনে তাকিয়ে ওকে থামাল। সাদা পোষাকের লোক এসেছে ৩ জন স্ট্রেচার নিয়ে। সাথে অভিজিৎ বাবু। জটলার একটা দিক অল্প ফাঁকা হল। এবার দেখতে পেল ছেলেটাকে শুভদ্বীপ। ওই ছেলেটার মাথা কোলে নিয়ে বসে আর একটা ছেলে কেঁদে যাচ্ছে। একে আগে দেখেছে ও। ওই শুয়ে থাকা ছেলেটার সাথে। অভিজিৎবাবু আসার পরেও কোলে শোওয়ানো ছেলেটা কে ছাড়ল না আর একজন।
শেষটায় স্যার একটু জোর করেই বললেন, “অর্চন, ছাড়ো ওকে। ওকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া জরুরী।”
শুভদ্বীপ দেখেছিল অর্চন বলে ছেলেটা আর বাধা দেয়নি। হাত আলগা করে দেয় নিজের। আর ওই ছেলেটাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে চলে যায় ওই লোকগুলো।

নাহ। তারপর আর কোনোদিন ওই ছেলেটাকে স্কুলে দেখেনি। অর্চনকে দেখেছে কয়েকবার একা একা লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তে। তবে ওর কখনোই কথা বলার সাহস হয়নি।

সকাল থেকেই অনেক গুলো টেক্সট পাচ্ছিল অর্চন। কনগ্র্যাটস পাঠাচ্ছিল অনেকে। কিন্তু মানেটা বুঝতে পারেনি। আর ও এসএমএস ব্যালান্স ভরে না কখনোই। আর কার জন্যেই বা ভরবে?
ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি লেট হয়ে গিয়েছিল ওর। উঠে দেখল বোন খাবার বানিয়ে রেখে কলেজ চলে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ওর অফিসের টাইম হয়ে গেছে। এমনিতেই থিয়েটার করে বলে প্রচুর অফিস বন্ধ হয় ওর। তার ওপর এরকম লেট করলে কৌশিকদা ক্ষেপে যাবে। কোনোরকমে খেয়েই অফিস বেরোলো ও।

যখন অফিসে ঢুকল। তখন প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। নিজের ডেস্কে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হল। রাজু এসে বলে গেল “তোমায় কৌশিকদা একবার ডাকছে”
আজ ভাগ্যে ঝাড় আছে ভেবে নিয়েই কৌশিকদার ঘরের দিকে এগোলো ও। কৌশিকদা ওদের TCS এর কলকাতার ইনচার্জ। মানুষটা এমনি খুব ভাল। কিন্তু রেগে গেলে বেশ চাপের হয়ে যায়।

দুরু দুরু বুকে যখন নক করল কৌশিকদার ঘরে তখন কৌশিকদা কারুর সাথে একটা ফোনে কথা বলছিল। ওকে দেখেই বলল “আরে আসুন স্যার। বসুন”
ও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেয়েছিল প্রথমে। হঠাৎ এভাবে কথা বলার কারন কি? আস্তে আস্তে গিয়ে বসল চেয়ারে। কৌশিকদা ফোন রাখার পর ও নিজেই বলতে শুরু করল, “আসলে কৌশিকদা আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু… আসলে কাল ওই শো থেকে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই আজ অফিস ঢুকতে লেট…
“আরে ধুর! ওসব বলতে কে ডেকেছে তোকে। খাওয়াবি কবে?” জিজ্ঞেস করল কৌশিকদা।
“মানে? কিসের… জন্য…? একটু আমতা আমতা করে বলল অর্চন।
“সে কি ভাই? টাইমস অব ইন্ডিয়া তে তোমার নাটকের রিভিউ বেরোলো আর তুমি আমাদের খাওয়াবে না তা কি করে হয়?”
– “মানে? কি বলছ কি তুমি? দেখো মজা কোরো না এসব নিয়ে”।
– “তুই কি পেপার পড়াও ছেড়ে দিচ্ছিস আজকাল? এই দ্যাখ” সামনে রাখা ক্যালকাটা টাইমস টা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল কৌশিকদা।
ক্যালকাটা টাইমস এর প্রথম পাতার নিচের দিকে দেখতে পেল ও রিভিউটা। শুভদ্বীপ রায় বলে একজন লিখেছে খবরটা। এই ভদ্রলোকেরই বোধহয় আসার কথা ছিল ওই দিন নাটক দেখতে। এসেছেন কিনা জানতে পারেননি।
অফিসে না থাকলে অর্চনের চোখে হয়ত জল চলে আসত আজ। ওর আজকের সাফল্যটা খুব বড় একটা সাফল্য। বহুদিন থেকে লড়াই করছে ও এটার জন্য। যেটা হারিয়েছে সেটা আর ফিরে পাবেনা ও নিজেও সেটা জানে। কিন্তু তার জন্য যে লড়াইটা করছে ও সেটা বৃথা যায়নি এটা ভেবেই ওর খুব ভাল লাগছে।
“কি রে? কি ভাবছিস? বল খাওয়াবি কবে?” জিজ্ঞেস করল কৌশিকদা
বাস্তবে ফিরে আসতে গিয়েও পারল না অর্চন। বুঝতে পারল ওর চোখটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। পকেট হাতড়ে রুমাল খুঁজতে গিয়ে দেখল আজ তাড়াহুড়ো তে ফেলে এসেছে ও রুমালটা।

*******

যখন বাড়ি ফিরল তখন বাজে সাড়ে সাতটা। আজ অফিসের সবাইকে খাওয়াতে হয়েছে। বাড়িতেও ও বিরিয়ানি এনেছে আজ আমিনিয়া থেকে। বাড়ি ঢুকে দেখল ঘর অন্ধকার করে বসে রয়েছে বোন।
“কিরে এভাবে ভুতের মত বসে আছিস কেন?” দরজার খিলটা আটকাতে আটকাতে জিজ্ঞেস করল অর্চন।
“এমনি রে। অন্ধকারটাই ভাল লাগছে”
“ঝগড়া করেছিস নাকি সৃঞ্জয়ের সাথে?”
কোনো উত্তর এল না বোনের দিক থেকে।
আবার অর্চন নিজেই বলল – “বল কি হয়েছে?”
অরিত্রী বলল, “we broke up রে”
লাইট জালিয়ে অফিসের ফরম্যাল শার্টটা খুলতে খুলতে অর্চন বলল, “ওহ। তোদের আবার মনোমালিন্য হয়েছে? দাড়া বকে দিচ্ছি সৃঞ্জয় কে? ফোন করছি।”
“ও কিছু করেনি রে। সমস্যা আমার। আমি শেষ করেছি সব” অর্চন ফোন বের করে ফোন করতে যেতেই অরিত্রী বলে উঠল।
“আরে আজকের দিনে এসব করিস না” টেবিল থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে কাছে গিয়ে বলল, “এই দেখ মাটন বিরিয়ানি আনলাম আজ তোর জন্যে। আর ফিরনিও আছে”
চেয়ার থেকে মুখ তুলে এরপর অরিত্রী বলল, “দাদা আমি লেসবিয়ান”
ভূমিকম্প হলেও পৃথিবীটা এভাবে নড়ে বলে অর্চনের জানা ছিল না। এক মুহুর্তের একটু অন্ধকার লাগল চোখের সামনেটা। হাত থেকে বিরিয়ানির প্যাকেটটা পড়ে গেল মেঝেতে। অরিত্রী একটু হতবাক হয়ে গিয়েছিল দাদার এই অবস্থা দেখে। ওর বোধহয় খেয়াল ছিল না নিউটন বলে গেছেন, “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে” যদি ওর নিজের সমকামিতার কথা দাদাকে জানানো টা ক্রিয়া হয় তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হল অর্চনের বাড়ি কাঁপানো চিৎকার – “মানে? তুই লেসবিয়ান মানে? কেন? How can you be a bloody lesbian? Tell me.”
অরিত্রী কি বলল বা আদৌ কিছু বলতে পারল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। তবে ঠিক সেই মুহুর্তে পাশের বাড়ির রুকুর গলা শোনা গেল। রুকু বলছে, “মা! মা! আমি পেরে গেছি। I-N-D-I-A তো INDIA হয় তাই না মা? I for INDIA!!!”

ভারত আমার ভারতবর্ষ

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি