“এই তুই এখন লিখিস না কেন রে?”
“কি লিখব?”
“কি আবার? গল্প? তুই তো আগে খুব লিখতিস।”
“আরে লেখা হয় না। সময় পাই না এখন।”
“কেন সারাদিন কি করিস রে? এমন তো নয় যে আমার সাথে সব সময় গল্প করতে হয় বা কিছু। আমি ওরকম গার্লফ্রেন্ড ও নই।”
“হ্যাঁ, আমি জানি সেটা যে তুই ওরকম না”
“তাহলে এখন আর গল্প লিখিস না কেন?”
“দুঃখ ছাড়া গল্প আসে না রে আমার।”
“এটার মানে কি? দুঃখ ছাড়া লেখা আসে না এরকম হয় নাকি কারুর?”
“আরে কারুর হয় কি না আমার জানা নেই। তবে আমার আসে না। যখন তুই ছিলি না তার এক বছর আগে একটা ব্রেক-আপ কাটিয়ে উঠেছি। মন খুব খারাপ থাকত। সেই সময়ে অনেক গুলো গল্প লিখেছি। তারপর তুই এলি আর দুঃখ নেই। তাই ইচ্ছেও হয় না লেখার”
“তার মানে তুই বলছিস যে আমার সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেলে তুই আবার গল্প লেখা শুরু করবি?
“হ্যাঁ কিছুটা ওইরকমই ব্যাপারটা…তার মানে কি তুই আমায় ছেড়ে যাবি নাকি?”
“সেটা ভেবে দেখছি।”
“বাজে বকিস না।”

মেট্রোর একটা কামরা আছে যেটায় দাঁড়ালে মেট্রো রেল টা শ্যামবাজার স্টেশন ক্রস করার সময় ফোনে কয়েক মুহুর্তের জন্যে নেটওয়ার্ক আসে। মানে সবমিলিয়ে মোটামুটি ২০-৩০ সেকেন্ড মত পাওয়া যায় নেটওয়ার্ক টা। কিন্তু পরমুহুর্তে ট্রেন চলতে শুরু করলেই নেটওয়ার্ক চলে যায়। এই ২০-৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই অনুব্রতর ফোনে একটা টেক্সট মেসেজ ঢুকত একসময়। রোজ না হলেও প্রায় দিনই হত এটা। তারপর রিপ্লাই করার আগেই হুস করে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যেত মেট্রো টা। খুব বিরক্ত লাগত মাঝে মাঝে ওর। মনে হত এত তাড়াতাড়ি সময়টা কেটে যায় কেন? কিন্তু এখন যেন বড্ড বেশী মনে হয় এই সময়টা। আজও মেট্রোতে করে যাওয়ার সময় শ্যামবাজারে এসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে কোনো মেসেজ এল কিনা। প্রায় এক বছর হয়ে গেল। ফোনটা স্মার্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ও হয়নি।

“সৌরভ গাঙ্গুলীর ফ্যান?”

মেট্রোর মধ্যে হঠাৎ এই প্রশ্নটা শুনে একটু চমকে গিয়েছিল অনুব্রত। পাশে তাকিয়ে দেখল প্রশ্নটা করেছে পাশে দাঁড়ানো একটা মেয়ে। সম্ভবত ওর ফোনের ওয়্যালপেপারটা দেখে।
“হ্যাঁ”  উত্তর দিল অনুব্রত

“ওহ। তার মানে তো ‘অ্যান্টিধোনি’?” আবার প্রশ্নবান ছুটে এল।

“ধোনির মধ্যে ভালো লাগার মত আছেই বা কি? এর সাথে সৌরভের ফ্যান হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।” এবার নিজের জোনে চলে এসেছে ও।

“কি বলছেন এসব? ধোনি ভারতকে ওয়ার্ল্ড কাপ দিয়েছে। টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ দিয়েছে। এর পরেও বলবেন ভালো লাগার কি আছে?”

ও জানত এর পরে ওকে ঠিক এই কথাটাই শুনতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত হয়ে গেছে। হাতে গরম ছ্যাঁকা লাগলে যেমন মানুষ সাথে সাথে হাতটা সরিয়ে নেয় সেই জায়গা থেকে সেরকমই। ধোনি ফ্যানরা তর্ক শুরু হলে প্রথমেই এই যুক্তি তে চলে আসে। ও বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল এসপ্ল্যানেড এসে গেছে প্রায়। এটাতেই ওকে নামতে হবে।

“দেখুন আমার কাছে ওয়ার্ল্ড কাপটা খুব একটা ম্যাটার করে না। একটা মানুষ কতটা Honest সেটা আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ন। ধোনি ভারতের একমাত্র ক্যাপ্টেন যার নামের সাথে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারী জড়িয়েছে। মুদগল কমিটির রিপোর্টে তার নাম আছে। ধোনি একমাত্র ক্যাপ্টেন যার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। আরও অনেক আছে। কিন্তু এখন আর আমার সময় নেই। নামতে হবে”

উত্তরটা দিয়ে পকেট থেকে মেট্রোর টোকেনটা বের করতে করতে মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও নেমে গেল মেট্রো থেকে। দরজা বন্ধ হওয়ার পর আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি কি? নাহ! এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। সাধারনত এই সব যুক্তি গুলো দেওয়ার পর লোকজন রেগে যায়। সেটা তাদের মুখ দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা হল না বলেই মনে হচ্ছে।

মেঘ করলেই অরিত্রীর মনটা ভালো হয়ে যায়। আর বৃষ্টি নামলে তো কথাই নেই। জানলার ধারে সত্যজিৎ কিম্বা শরদিন্দু কিম্বা জে কে রাওলিং নিয়ে বসে থাকতে পারে ও ঘন্টার পর ঘন্টা। এমনিও যে পারে না তা নয়। তবে বৃষ্টি পড়লে ভালো লাগে ওর খুব। পুরোনো কথা গুলো মনে পড়ে। ও জানে এরকম অনেকের আছে যাদের পুরোনো কথা মনে পড়লে মন খারাপ লাগে। কিন্তু ওর লাগে না। এই স্মৃতিগুলো নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল বলেই না…

“কি খাবি আজ সন্ধ্যেবেলা?” প্রশ্নটা করেছে মধুরিমা। ওর নতুন রুমমেট। নতুন মানে বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে ওরা একসাথে থাকে। খুব চঞ্চল মেয়ে।

“তুই কি খাওয়াবি বল?”

“এগ ম্যাগি খাবি? আমাদের অফিসের ক্যান্টিনে রাজু দা কে বানাতে দেখেছি। আশা করছি নামিয়ে দেব।”

“বানা। তাই খাই।” কথাটা বলে অরিত্রী ওর বই এর আলমারীর দিকে এগোলো আজ একটা ভাল বই পড়তে হবে। যেভাবে আকাশটা কালো করে এসেছে বৃষ্টি আজ হবেই। আর এই ওয়েদারে ভালো বই না পড়তে পারলে জীবনটাই বৃথা।

আলমারীতে প্রথম ২ টো তাকে রয়েছে কয়েকটা বই। আর পরের ২ টো তাকে রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা। তার মধ্যে ওর লেখা রয়েছে এরকম পত্রিকাও রয়েছে। ওদের ব্রেক আপ এর কয়েক মাস পরে ২ টো লিটিল ম্যাগাজিনে  গল্প পড়েছে ওর। তারপর আর পায় নি। নতুন কোন সম্পর্কে ঢুকেছে কিনা কে জানে। আনন্দে থাকলে তো ওর আবার গল্প আসে না।

“জানিস আজ একটা ব্যাপার হয়েছে” মধুরিমা রান্নাঘর থেকেই বলল।

“কি হয়েছে?”

“মেট্রোয় একটা ছেলের সাথে আলাপ হল। আলাপ হল মানে নাম ধাম জানিনা। এমনি দু’একটা কথা হল। তো নামার সময় বেচারা পকেট থেকে টোকেন বের করতে গিয়ে একটা চাবি ফেলে গেছে।”

“এই রে! কীসের চাবি? গাড়ির” অরিত্রী বই এর তাক ঘাঁটতে ঘাঁটতেই জিজ্ঞেস করল।

“দেখে তো মনে হল বাড়ির। গাড়ির হলে বুঝতে পারতাম। বেচারা বাড়ি ঢুকতে পারবে কিনা জানিনা।“

“তো তুই ওটা মেট্রোর “Lost and Found” এ জমা দিসনি?” প্রশ্ন করল অরিত্রী।

“কলকাতা মেট্রোয় আছে নাকি এসব?” ম্যাগির প্লেট গুলো নিয়ে ঘরে ঢোকার সময় জিজ্ঞেস করল মধুরিমা।

ভুরুটা কুঁচকে গেল অরিত্রীর। “তুই কি রে? এটাও জানিস না? এটা তো সব জায়গা তেই থাকে। বেচারা বাড়িতে ঢুকতে পারবে না হয়তো।”

“সে আমি কি জানি। ওর আরো কেয়ারফুল হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক বাদ দে। খেয়ে বল কেমন হয়েছে।”

অরিত্রী আর কিছু না বলে ৩ টে লিটিল ম্যাগাজিন বের করল তাক থেকে। আজ ও পুরোনো গল্পই পড়বে। তারপর বিছানায় বসে মধুরিমার বানানো এগ ম্যাগি টেস্ট করল।

“ফাটিয়ে দিয়েছিস। আমায় শেখাস কীভাবে করলি” প্রথম চামচটা মুখে দিয়েই বলল অরিত্রী।

“Thank you, your honour.” হাসতে হাসতে বলল মধুরিমা, “কী বই পড়বি আজ?”

“আজ শুধু পুরোনো গল্প। পড়ে দেখিস এটা।” একটা গল্পের এর পাতা খুলে ওর দিকে এগিয়ে দিল অরিত্রী।

“এটা কি তোর সেই Lost Case?”

অরিত্রী হাসল। সত্যিই কি Lost Case? সত্যি কী হারিয়ে গেছে ও? আজও কী ভুলতে পেরেছে ও ওকে। আজও কি রিগ্রেট করে না ও সেই ঘটনাটার জন্য। আজও কী ওর কথা মনে পড়লে ওর মন ভালো হয়ে যায় না?

ম্যাগির খালি প্লেট টা আর বই টা নিয়ে পাশের ঘরে চলে যাওয়ার আগে মধুরিমা বলে গেল, “আচ্ছা পড়ে জানাচ্ছি একটু পরেই।”

অরিত্রী আর একটা ম্যাগাজিন টেনে নিল। তারপর সূচিপত্র দেখে ২৩ পাতা খুলল। এই গল্প টা ওর খুব প্রিয় –‘ব্রেক আপ এর পর’ by অনুব্রত রায়চৌধুরী

* * *

“প্লিজ এরকম করিস না।”

“তুই আমার ব্যাপারটা বুঝছিস না একটুও।”

“আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু Just Because তোর দিদির ডিভোর্স হয়েছে তার মানেই কি সব ছেলেই একরকম?”

“আমি সেটা বলছি না। আমার দিদি সুইসাইড অ্যাাটেম্পট করেছে। এখন নার্সিং হোম এ ভর্তি। Trust Me, I’m not Blaming you. কিন্তু দিদির মত যদি আমার হয়।”

“আরে হবে না। আমি বলছি তো। তুই যেটা বলছিস এটা কোনো সলিউশন না।”

“হয়ত না। কিন্তু আমি এটাই চাই। আমার তোর সাথে অনেক ভালো ভালো স্মৃতি আছে। আমি ওগুলো নিয়েই থাকতে চাই।”

“Please Don’t Do This. আমি পারব না।”

“পারবি রে। আর এবার তোর লেখা ভালো গল্পও পড়তে পাব। মন খারাপ থাকলে তুই তো ভালো লিখিস খুব।”

“কিন্তু…”

“লেখা থামাস না প্লিজ।”

      ৩

চাবিটা নিয়ে কী করা যায় এখনো ঠিক করতে পারেনি মধুরিমা। মেট্রোয় গিয়ে দিয়ে আসবে কিনা ভেবেছে কয়েকবার। কিন্তু এতদিন পর গেলে আদৌ লাভ হবে কিনা ও জানে না। সে ব্যাটা এতদিনে নিশ্চয় নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে তালা ভেঙে। তাহলে তো লাভ নেই কোনো এটা রেখে। তবু ফেলে দিতে কেমন একটা লাগছিল ওর। অফিসের টেবিলে বসে চাবিটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল ও। আর ভাবছিল শার্লক হোমস থাকলে নির্ঘাত যেকোনো উপায়ে চাবির মালিকের কাছে চলে যেত খুঁজে খুঁজে। ছেলেটার নামটাও জানে না ও। জানলে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যেত হয়ত।

“কীসের চাবি রে? বয়ফ্রেন্ড বাড়ির চাবি দিয়েছে নাকি?”

চিন্তার রেশটা আপাতত থামল ওর। প্রশ্নটা করেছে সায়ন্তন। ওর অফিসের সবথেকে কাছের বন্ধু এই ছেলেটাই। খুব ভাল এবং efficient ছেলে।

“না রে। এটা মেট্রোতে পেলাম ২ দিন আগে।”

“কুড়িয়ে পেলি?”

“ঠিক কুড়িয়ে না। একটা ছেলের সাথে কথা বলছিলাম। ও নামার সময় ওর পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল।”

“চেনা কেউ?”

“চেনা কেউ হলে চাবিটা আমার কাছে থাকত? ছাগল?”

“ও হ্যাঁ সরি। Lost and Found এ দিসনি কেন?”

উফ! সবাই জানে এটার কথা শুধু ওই জানে না। কিন্তু সবার কাছে নিজের অজ্ঞতার কথা স্বীকার করা একদম বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ও কথা ঘোরাবার জন্যে জিজ্ঞেস করল, “তোর কী খবর ?”

“ও হ্যাঁ যেটা বলতে এসেছিলাম। আজ আমার সাথে একটু অক্সফোর্ড বুকস্টোর যাবি অফিসের পর?”

“কেন রে? কি কিনবি?”

“কিনব… একটা বই… আর সৌরভ গাঙ্গুলী আসছে। ওর Life নিয়েই বইটা।”

এই আর এক ছেলে। সৌরভ গাঙ্গুলী বলতে অজ্ঞান। আর ‘ধোনি হেটার’। সেদিনের মেট্রোর কথাটা মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল। ছেলেটা কত কিছুই না বলে গেল। ওর বেশ মজা লেগেছিল সেদিন। সায়ন্তনের সাথে থাকতে থাকতেই এই সৌরভ ফ্যান মানেই অ্যাান্টি ধোনি এটা বুঝেছে।  তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়।

“কীরে? কী ভাবছিস? যাবি আমার সাথে?” সায়ন্তনের প্রশ্নে আবার বাস্তবে ফিরে এল ও।

“হ্যাঁ আমি তো ফ্রি। যেতেই পারি। বেরোবার সময় ডেকে নিস”

“Okay Boss” বলে সায়ন্তন ওর কিউবিকলের দিকে চলে গেল।

খুব টেনশন হলে সায়ন্তনের ভীষন জলতেষ্টা পায়। ছোটোবেলা থেকেই এই সমস্যাটা আছে ওর। ওর মনে আছে একবার ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় একটা মেয়েকে প্রোপোজ করতে গিয়ে প্রচন্ড টেনশনে বলে ফেলেছিল – “একটু জল হবে?” তার পরের কান্ডটা আর না মনে করাই ভাল। কেলেঙ্কারি হতে গিয়েও হয়নি। যাই হোক আজ সেরকমই একটা দিন।

কারন হল ওই মধুরিমা। আজ প্রথম মধুরিমা ওর সাথে কোথাও যাবে। এটা ওর কাছে একটা বিরাট প্রাপ্তি। অফিসে যেদিন প্রথম জয়েন করে মেয়েটা সেদিনই ওর প্রেমে পড়ে যায়। ভেবেছিল সৌমিত্রর মত “কে তুমি নন্দিনী/আগে তো দেখিনি” গাইতে শুরু করবে। তবে জলতেষ্টা আর বস অরিত্রদার ভয়ে ব্যাপারটা নিয়ে এর চেয়ে বেশি ভাবেনি।

তারপর যা হয় আর কি। আস্তে আস্তে Friend Zone এ চলে যায় সায়ন্তন। অন্য কেউ লাইনে নেই সেটা ও জানে। কিন্তু নিজেও ঠিক লাইনটা করতে পারছে না। আজ ভেবেছে হালকা করে বলে দেবে।

“চল্‌! বেরোবি তো?” মধুরিমার গলায় ও মাথা তুলে তাকাল। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। আর সবথেকে বড় কথা মেয়েটার মধ্যে একটা অদ্ভুত সারল্য আছে।

“কি রে? চল?”

“ও হ্যাঁ। সরি।” নিজের কম্পিউটারটা শাট ডাউন করতে করতে বলল সায়ন্তন। আজকে খুব মিষ্টি লাগছে মধুরিমাকে। সব দিনই লাগে ওর। তবে আজ যেন…

“এই আজ একেবারে ডিনার করে ফিরি চল” মধুরিমা বলল।

মনের মধ্যে একটা পিং পং বল লাফাতে শুরু করে দিয়েছে সায়ন্তনের। এই কথাটা ও বলবে ভেবেছিল। এটা পুরো মেঘ না চাইতেই ঝমঝম বৃষ্টি কেস। ও বলল, “হ্যাঁ শিওর।”

তারপর একটু থেমে বলল, “জল আছে তোর কাছে?”

“হ্যাঁ আছে তো। দেবো?”

“নাহ্‌ পরে লাগবে। চেয়ে নেব।”

ওরা যখন অক্সফোর্ড বুক স্টোর এ পৌঁছোলো তখন ৭ টা বাজে প্রায়। সৌরভ গাঙ্গুলী তার আধঘন্টা আগেই এসে ঢুকেছে। খুব ভীড়। রিপোর্টাররা পুরো শকুনের মত ঘিরে রয়েছে।  ওরা ঢুকতে যাবে, হঠাৎ পেছন থেকে, “এই যে? ধোনি ফ্যান?”

বুঝতে পারল কথাটা ওদের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে। পেছনে তাকিয়ে দেখল একটা ছেলে মধুরিমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার বয়স ওরই মতন হবে। তবে হাইট টা একটু বেশি। মধুরিমার দিকে তাকিয়ে দেখল ও একটু অবাক হয়েছে। তবে মুখের ভাব দেখে মনে হল ছেলেটাকে চেনে।

“কী খবর? এখানে?” ছেলেটা এবার প্রশ্ন করল, “আপনার তো এখানে থাকার কথা না। এটা তো দাদা ফ্যানদের জায়গা আজ।”

তারপর সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ হাই! আমি অনুব্রত… অনুব্রত রায়চৌধুরী।”

সায়ন্তন দেখল মধুরিমার মুখটা অর্ধেক হাঁ হয়ে গেছে। খুব অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কারনটা বুঝতে পারল না। আকাশে মেঘ করেই ছিল। হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ চমকালো মনে হল।

এমন সময় মধুরিমা হঠাৎ বলে উঠল, “চাবি!”

খুব বিরক্ত লাগছে আজ অরিত্রীর। প্রথমত আজ আকাশ মেঘলা যেকোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। সবে বুদ্ধদেব গুহর ‘কোয়েলের কাছে’ উপন্যাসটা নিয়ে বসেছে এমন সময় মধুরিমার তলব। ওকে ধর্মতলা যেতে হবে। ও বলল, “ফোনে বল না কী দরকার?”

মধুরিমা বলল, “ফোনে হবে না। প্লিজ আয়। Its Urgent.”

আজকের আগে এরকম ঘটনা আগে একবারও ঘটেনি। তাই অরিত্রী বুঝতে পারল খুব প্রয়োজন না হলে মধুরিমা ডাকত না।

বাড়ি থেকেই Ola বুক করে নিয়েছে একটা। এত রাত্রে আবার মেট্রোর ধকল নিতে পারবে না ও। ওদের ফ্ল্যাটবাড়িটা শ্যামবাজার এর কাছে। ওখান থেকে ধর্মতলা বেশিক্ষনের রাস্তা নয়। কিন্তু আজ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তে এত জ্যাম কেন কে জানে। শুনেছিল পার্ক স্ট্রীট এর অক্সফোর্ড বুকস্টোরে আজ নাকি সৌরভ গাঙ্গুলীর আসার কথা ছিল। সেই জন্যেই কি এরকম জ্যাম।

সৌরভ গাঙ্গুলীর কথা মাথায় এলেই পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার হানা দেয় মনের মধ্যে। ও মাঝে মাঝে জানতে চাইত অনুব্রতর কাছে। কাকে ও বেশি ভালবাসে? সৌরভ কে না ওকে? প্রত্যেক বারই সে খুব বুদ্ধি করে এড়িয়ে যেত ওর প্রশ্নটা।

ফোনের আওয়াজে চিন্তার তার কাটল ওর। মধুরিমার ফোন।

“বল”

“তুই আসছিস?”

“হ্যাঁ এই তো এসে গেছি প্রায়। চাঁদনি চক এখন।”

“গ্রেট। আচ্ছা শোন আমরা আমিনিয়ায় আছি। সোজা দোতলায় চলে আসিস।”

“আমরা মানে?”

“ওই সায়ন্তন আছে সাথে।”

“ঠিক আছে। আসছি” বলে ফোনটা রেখে দিল অরিত্রী।

সায়ন্তন কে ও চেনে। খুব ভাল ছেলে। বাড়িতেও এসেছে দু’একবার কাজ নিয়ে। তবে প্রত্যেকবারই মুখ্য উদ্দেশ্য অন্য বলেই মনে হয়েছে ওর। সায়ন্তন যেভাবে মধুরিমার দিকে তাকায় সেটা ও খুব ভালভাবে বুঝতে পারে। এক সময় ওর দিকেও একইভাবে তাকাত একজন।

“কোথায় নামবেন ম্যাম?” Ola র ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।

“আমিনিয়া নিয়ে চলুন”

এরা অতীব ভদ্র। মাঝে মাঝে একটু বেশিই মনে হয় অরিত্রীর। তবে সার্ভিস খুব ভাল এখন কলকাতায়। হলুদ ট্যাক্সিকে একদম ভরসা হয় না ওর।

মিনিট পাঁচেক পরে আমিনিয়ার সামনে এসে গাড়িটা থামল। আর ঠিক এই সময়েই শুরু হল বৃষ্টিটা। প্রচন্ড জোরে। মনে হল বৃষ্টিটা যেন গাড়িটা থামবার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। টাকা মিটিয়ে নেমে আমিনিয়ায় ঢুকতে ঢুকতেই বেশ খানিকটা ভিজে গেল ও। বহুদিন পর বৃষ্টির জল গায়ে পড়ল। এই পাগলামি গুলো করার জন্য একটা ভাল সঙ্গী দরকার।

দোতলায় উঠেই চোখে পড়ল ওদের। কোনের একটা সিটে বসে আছে। শুধু সায়ন্তন তো না। আর একজন কে একটা যেন আছে। ওরে দিকে পেছন করে আছে বলে দেখতে পাচ্ছে না  তাকে।

কাছে গিয়ে ও একটু রাগত স্বরেই বলল, “এই ব্যাপার কী রে? এই বৃষ্টির দিনে আমাকে…

আর কিছু বলতে না পারার কারনটা সহজেই অনুমেয়। কারন ওর চোখ তখন গেছে উলটো দিকের সিটে বসে থাকা মানুষটার দিকে। বুকের ভেতর অনেক গুলো হাতুড়ির ঘা এক সাথে পড়ল মনে হল। চোখেও কিছু একটা পড়ল কী? এরকম ঝাপসা লাগছে কেন সব? বৃষ্টি তো বাইরে হচ্ছে। ও জানে রুমাল ওর ব্যাগেই আছে। কিন্তু হাতটা যেন অবশ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে না আজ বৃষ্টিটা আটকাতে। ও বুঝতে পারল ওর হাতটা ধরে পাশে বসিয়ে দিল আর একটা হাত। এই স্পর্শটা ওর খুব চেনা।

 

মেঘ, বৃষ্টি আর একটা চাবির গল্প

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


0 thoughts on “মেঘ, বৃষ্টি আর একটা চাবির গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি