৮
৮
“তারপর”
প্রশ্নটা করেছে সন্তু! আজ রবিবার তাই সকালেই ও চলে এসেছে আমার বাড়ি। বহুদিন থেকে আমাদের এই পুরোনো রুটিন। কোনো রবিবার আমি ওর বাড়ি যাই। কোনো রবিবার ও আমার বাড়ি আসে।
আমি বললাম, “তারপর আর কী?”
সন্তু বলল, “তোর এই গল্পলিখিয়ে সত্তাটা থেকে বেরো। আর বল কী হল তারপর?”
আমি হেসে বললাম, “আরে এক মুহুর্তের জন্য ভাবলাম আমি শেষ। কি যাচ্ছেতাই লজ্জাজনক ব্যাপার ভাবতে পারছিস? এত বড় ছেলে হয়ে আমি…”
– দেখতে পায় নি তো?
– না। পায়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করল ওদিকে কী করছি। বললাম এদিকে কেউ খাবার বা কিছুর ঝোল টোল ফেলে গেছে। ওটাই দেখছিলাম। ও বলল, ওহ আচ্ছা। তবে সেদিন আমার খাওয়া হয় নি।
– কেন?
– আরেহ ও যদি মাংসের গন্ধ পায় তাহলেই কেস। খুব চালাক মহিলা। তার ওপর উকিল। সন্দেহ হলেই কেস খাবো। তাই আমি বলেছি আমি খেয়ে নিয়েছি। একটু অবাক হল যদিও শুনে। কিন্তু আমি বললাম আমি ভেবেছিলাম ও আর আসবে না তাই।
সন্তু কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, “তুই কি প্রেমে টেমে পড়লি নাকি মামা?”
আমি বললাম, “জানিনা ভাই! তবে এই মেয়েটার সাথে সময় কাটাতে বেশ লাগে!”
সন্তু বলল, “ফোন নাম্বার নিয়েছিস?”
আমি বললাম, “নাহ রে। সাহস হয় নি চাওয়ার। যদি না বলে দেয়।”
– তাহলে কাকিমা কে কি বলব যে আল্টিমেটলি বৌমা পাওয়া গেছে?
– আবার ফালতু বকছিস তুই। এখন এসব ভাবতে ভালো লাগছে না। আর তাছাড়া মহিলা প্রচন্ড সুন্দরী। আমার দ্বারা হবে বলে মনে হয় না।
– এই ভাই! শোন শোন… পৌলমীকে দেখেছিস তো?
– হ্যাঁ। তো?
– আর আমাকে দেখ ভালো করে? তোর কী মনে হয় আমি ওর যোগ্য। কিন্তু বিশ্বাস কর মেয়েটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। এই ভালোবাসা ব্যাপারটাই সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট। বাকি সব বকওয়াস! ভালো মেয়েরা শুধু ভালোবাসা খোঁজে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “কিন্তু সন্তু আমি তো ভালোবাসতে ভুলেই গেছি!”
সন্তু নিজের মাথায় থাপ্পড় মেরে বলল, “উফ! তোরা লেখক মালগুলোই শালা এরকম। সব ব্যাপারে কাব্যি করিস।”
আমি বললাম, “তুই ভাবছিস আমি ইয়ার্কি মারছি? আমি সত্যিই জানিনা রে আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব কিনা! কাউকে ভরসা করতে পারব কিনা! ব্রেক আপ এর পর থেকে কি কি হয়েছে আমার সাথে সেটা তো তুই জানিস।”
সন্তু বলল, “শোন ভাই, আমি এত জটিলতা বুঝি না। একটা সহজ কথা তোকে বলি। যখন তোর জন্য পারফেক্ট একটা মানুষ আসবে তোর লাইফে, তখন নিজেই বুঝতে পারবি তোর কী করা উচিত! কীভাবে ভালোবাসা উচিত!”
৯
“কিছু হয়েছে নাকি?”
প্রশ্নটা করেছে ত্রিধা! আজ সোমবার। ছাদের একদম কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আছি আমরা দু’জনেই। আমার যেন কিছুই ভালো লাগছে না। বার বার মনে হচ্ছে এই চাকরিটা ছেড়ে দিই। লেখাতে ফোকাস করি। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হচ্ছে খাবো কী? বাবা রিটায়ার করেছে। এখন আমার ওপরেই পুরো ফ্যামিলি ডিপেন্ড করে আছে।
বললাম, “নাহ! তেমন কিছু না!”
ত্রিধা বলল, “আরে কেমন কিছু শুনি না সেটাই!”
ত্রিধা জানতনা আমি লিখি বলে। ওকে বললাম মাথার মধ্যে কী ঘুরছে!
ও চোখ বড় বড় করে বলল, “আরিব্বাস! আপনি লেখক নাকি? এটা জানতাম না তো!”
আর লেখক। কেউ কখনও শুনেছে চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিনা লেখক হয়েছে? আমার দ্বারা এসব হবে না। কলেজে পড়ার সময় কত স্বপ্ন ছিল। সেগুলো সারাজীবন অধরাই থেকে যাবে।
বললাম, “ওই আর কি! তবে এখন আর সময় পাই না। তাই লেখাও হয় না!”
ত্রিধা বলল, “শুনুন সময় পাই না বলে কিছু হয় না। সময় বের করে নিতে হয়। অফিস থেকে ফিরে কী করেন?”
আমি বললাম, “কী আবার করব? একটু সিনেমা দেখি, বা কিছু বই পড়ি বা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম!”
ত্রিধা বলল, “তাহলে সময় তো পান ঠিকই। সময়টা কাজে লাগান না!”
– আরে এটা আমিও যে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু এনার্জি থাকে না বিশ্বাস করুন। অফিস থেকে ফিরে মনে হয় একটু ল্যাধ খাই। একটি রিল্যাক্স করি।
– আর গল্প লেখাটা আপনার কাছে রিল্যাক্সের কাজ নয়?
– জানিনা… হয়ত… কি জানি…
ত্রিধা বলল, “শুনুন একটু জ্ঞান দিই। স্বপ্ন নিজে থেকে পূরন হয় না। তার জন্য পরিশ্রম করতে হয়। আপনার যদি সত্যিই স্বপ্ন থাকে আপনি গল্প লিখবেন, লোকজন আপনাকে চিনবে, জানবে তাহলে আপনাকে সেরকম কষ্ট করতে হবে। যেকোনো জিনিস পেতে গেলে আপনাকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। পৃথিবীতে সব কিছু সহজলভ্য হয় না মশাই! লেগে থাকুন, দেখবেন যেটা চান সেটা ঠিক পেয়ে গেছেন!”
ত্রিধা যখন কথাগুলো বলছিল তখন এক দৃষ্টিতে আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। কথাগুলো ও শুধু গল্প লেখা নিয়ে বলল নাকি আরও অন্য কিছু নিয়েও বলল। সেটাই ভাবছিলাম আমি। এরপর আমি একটা সাহসী পদক্ষেপ নিলাম। বুকে বল এনে বলে ফেললাম, “এই আপনার নাম্বার টা দিন তো?”
ত্রিধা একটু অবাক হয়ে বলল, “আমার নাম্বার? কেন?”
বললাম, “আপনি খুব ভালো মোটিভেশনাল স্পিচ দেন। পরে কখনও আবার মন খারাপ হলে আপনাকে কল করব না হয়!”
ত্রিধা বলল, “বুঝতে পারছি মজা করছেন। কিন্তু ব্যাপারটা হল, ভালো স্পিকার না হলে ভালো উকিল হওয়া যায় না। আমাদের পেশায় কথা বলাটাই হল আসল। বুঝলেন?”
বললাম, “বুঝলাম। তা নাম্বার টা কি দেওয়া যাবে?”
১০
“তারপর কী হল?”
সন্তুকে ঘটনাটা বলছিলাম, হঠাৎ মায়ের গলা পেয়ে চমকে গেছি!
চোখ পাকিয়ে বললাম, “তুমি সব শুনছিলে?”
মা বলল, “হ্যাঁ। শুনছিলাম তো! বল না। তারপর কী হল?”
আমি বললাম, “এই তোমার সাথে না আমার ঝগড়া! কথা বলছ কেন?”
মা বলল, “আরে ধুর ঝগড়া! বল না। তারপর কী হল? নাম্বার দিল ত্রিধা?”
আমি উত্তর দিতে গিয়েও থমকে গেলাম, “তারপর বললাম, তুমি নাম জানলে কী করে? আমি তো নামটা আজ একবারও বলিনি!”
মা কাঁচুমাচু মুখ করে সন্তুর দিকে তাকাতেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেল! আমি রেগে গিয়ে সন্তুকে বললাম, “সিরিয়াসলি? তুই এরকম চুকলিবাজ হয়ে গেছিস?”
সন্তু বলল, “শোন ভাই! কাকিমা টেনশনে ছিল! আমরা সবাই ছিলাম। সেই কারনেই বলেছি! তুই বুঝবি না!”
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, মা বলল, “তুই কি এখন এটা নিয়ে রাগারাগি করবি? তাহলে আমি বরং যাই!”
আমি রাগার চেষ্টা করেও পারলাম না। আসলে মনটা বেশী ভালো থাকলে যা হয় আর কি! তাও জোর করে রাগী রাগী গলায় বললাম, “ঠিক আছে। আর ঢং করতে হবে না!”
সন্তু বলল, “আমরা অলরেডি বার পাঁচেক এটা জিজ্ঞেস করে ফেলেছি! আরও একবার করছি, যাতে তুই শুনতে পাস! ও কি তোকে নাম্বার দিল?”
আমি বললাম, “হুম। দিল!”
– আচ্ছা! তারপর? কথা হল?
– না কথা হয় নি!
– কেন?
– কেন মানে? কাল নাম্বার নিলাম! আজ ফোন করব নাকি?
সন্তু আর মা একসাথে বলল, “হ্যাঁ!”
আমি ওদের দিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকিয়ে বললাম, “পাগল নাকি! ডেসপারেট ভাববে তো!”
মা বলল, “কেন? ও যখন নাম্বার দিয়েছে তার মানে তো ও চায় তুই ওকে ফোন করিস! মেয়েরা এসব পছন্দ করে!”
আমি মায়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম, “তুমি হইচই তে ভুলভাল সিরিজ দেখা বন্ধ করো! বাস্তবে এসব হয় না! এখানে দাম বাড়াতে হয়! নিজেকে এত সস্তা করতে নেই!”
মা বলল, “আমার বয়স তোর থেকে অন্তত ২৫ বছর বেশী! প্রেম ভালোবাসা নিয়ে আমাকে কেন জ্ঞান দিচ্ছিস!”
সন্তু বলল, “হ্যাঁ ভাই! ফোন না করিস, একটা টেক্সট অন্তত করতে পারতিস! আজ তো ছুটি! কথা তো হত অন্তত!”
আমি বললাম, “আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। তোমাদের সামনেই ফোন করছি! খুশী! উফফ! জ্বালিয়ে মারল!”
সন্তু বলল, “হ্যাঁ। আমরা না বললে তো তোর কোনো ইচ্ছেই ছিল না ফোন করার! ঠিক আছে। আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্যেই ফোনটা কর!”
মা দেখলাম মুচকি হাসল কথাটা শুনে। আমি বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে কনট্যাক্ট লিস্ট এ ত্রিধার নাম্বার টা খুললাম! তারপর কয়েক সেকেন্ড ভাবলাম! যে কী বলব ফোন করে!
মা বলল, “কী হল? কর?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ! দাঁড়াও! ভাবতে দাও! কী বলব!”
– এত ভাবার কী আছে! বলবি আমি অমিত বলছি। কাল ফোন করা হয় নি। ব্যস্ত ছিলাম তারপর…
– মা… মা… প্লিজ! খুব Weird কথা বার্তা বলছ! আমি বলতে পারব মা! প্লিজ চুপ করো!
মা থেমে গেল। আমি নাম্বারটা ডায়াল করলাম। তারপর ফোনটা কানে দিলাম।
৫ সেকেন্ড পরেই সন্তু, “কীরে কী বলছে? কলার টিউন আছে? লাউড স্পিকার কর না!”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাউডস্পীকার দিলাম। যাতে সবাই শুনতে পায় গলাটা! এই গলা আমাদের সবারই খুব চেনা। “আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন, সেই নাম্বারটির কোনো অস্তিত্ব নেই!”