“আচ্ছা আমি কি সত্যি রোবট হয়ে গেছি? যতদিন স্নিগ্ধা ছিল ততদিন আমি তো এরকম ছিলাম না! আমার তো মাথা গরম হত না এত! তাহলে এখন? এখন কেন হচ্ছে? এখন কেন সব সময় আমি বিরক্ত হয়ে থাকি! কেন অল্পেতেই লোকের ওপর চেঁচিয়ে দিই! কেন আমি লিখতে পারছি না আগের মত! কেন আমার লেখা আসছে না আগের মত?”
“কারন তোর একটা বৌ দরকার!”
কথাটা বলেছে সন্তু। না না। কাকাবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সন্তু। আজ রবিবার। অফিস ছুটি তাই ও আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওকেই বলছিলাম সেদিনকার ছাদের ঘটনাটা! সব শুনে ও বলে কিনা আমার একটা বৌ দরকার!
আমি বললাম, “বাজে কথা বলিস না! ভালো লাগছে না!”
সন্তু বলল, “আমি সিরিয়াসলি বললাম ভাই। পৌলমী যবে থেকে এসেছে আমার লাইফ পুরো সেট। তোরও একটা পৌলমী দরকার!”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “ইস! চুপ কর। নিজের বৌ কে নিয়ে অন্তত…
– আহ! ওভাবে মিন করিনি রে ছাগল। আমি বলছি তুই কাকিমার কথা শোন। বিয়ে কর। তোর মামা কাকে দেখেছে শুনলাম।
– What? তোকেও এসব বলেছে মা? দাঁড়া আমি…
– নাহ! শোন অমিত… ঝামেলা বাড়াস না আর। কাকিমা তোকে নিয়ে চিন্তা করছে। আর এই বয়সে এটাই স্বাভাবিক!
– শোন এই বাঙালীর ৩০ বছর বয়স মানেই বিয়ে করতে হবে এই ব্যাপারটাই খুব ফালতু। আমি করব না বিয়ে। গাঁড় মারাক বাঙালী!
সন্তু হেসে বলল, “সে তো এমনিই মারাবে! ওসব ছাড়। টিন্ডারে কাউকে পছন্দ হল?”
আমি বললাম, “ধুর! ফালতু অ্যাপ। খালি টাকা দাও এই দাও সেই দাও। বডি বানাও। তবেই প্রেম জুটবে। নাহলে কেউ পাত্তা দেবে না!”
সন্তু বলল, “এই তোর অফিসের ওই মেয়েটা কেমন? তোদের বস যে?”
আমি বললাম, “এই ভাই তুই এবার যাতা বকছিস! শর্মিষ্ঠা দি আমার থেকে কত বড় জানিস!”
– তো? তো কী? আজকাল এটা কোনো ব্যাপার! শচীন টেন্ডুলকর…
– হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। জানি। টেন্ডুলকর, অভিষেক বচ্চন সবার বৌ তাদের থেকে বড়। আমার বড় বৌ চাই না!
– তাহলে কি চাই মেজ বৌ? না ছোটো বৌ?
– তোর জোকগুলো ইদানীং ভিপিজে হয়ে যাচ্ছে জানিস তো! Very Poor Joke. পিজেরও অধম!
সন্তু বলল, “একটু ভেবে দেখিস তো! সত্যিই কি তাই হচ্ছে নাকি তুই দিনকে দিন একটা আস্ত রোবট হয়ে যাচ্ছিস?”
সন্তুর কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মত নয় আমি জানি। আমার মধ্যে ইদানীং যেন অন্য একটা মানুষ ভর করে থাকে। কাউকে ভরসা করতে পারি না। কাউকে সহ্য করতে পারি না। কেন কে জানে! টিন্ডারে কারুর সাথে ২ দিন কথা বললেই মনে হয় উফফ! বড্ড বোরিং! এই ফেজ টা যে কবে কাটবে কে জানে!
“কাটবে কাটবে তোরও কাটবে!”
হঠাৎ পেছনে কথাটা শুনে একটু চমকে উঠেছিলাম। ফিরে দেখলাম কালকের সেই মেয়েটি। যে আমাকে রোবট বলেছিল। ফোনে কাউকে কিছু একটা বলছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
মেয়েটি একবার কালকের সেই জায়গাতে বসতে গিয়েও আবার ফিরে এসে আমার পাশেই বলল। তারপর নিজেই গলে ঝেড়ে বলল, “কালকের পায়রার পটিগুলো এখনও আছে। তাই এখানে বসছি!”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। ঠিক আছে নো প্রবলেম!”
কিছুক্ষন দু’জনেই চুপ। ইচ্ছে করেই নীরবতা ভাঙলাম আমি নিজেই। বোঝাতে হবে তো আমি রোবট নই বলে। বললাম, “আপনি কি বরাবরই এরকম কম কথা বলেন?”
মেয়েটি বোধহয় ভাবতে পারেনি আমি নিজে থেকে কিছু কথা বলব। তাই অল্প হতচকিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ? কী?”
আমি বললাম, “আপনাকে আমি বসতে বললাম এদিকটায় কোথায় একটা থ্যাঙ্কিউ বলবেন তা না! মুখ গোমড়া করে বসে আছেন! আপনি তো পুরো রোবট!”
মেয়েটি বলল, “ইন্ডিয়ান কপিরাইট অ্যাক্ট ১৯৫৭ র নাম শুনেছেন। আমার ডায়লগ কপি করে আমাকে শোনাচ্ছেন? আপনার নামে মামলা করব!”
আমি বললাম, “তাই নাকি? আপনি কি উকিল?”
মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ তো!”
আমি বললাম, “ওহ! আমি জানতাম না!”
– স্বাভাবিক। আমি তো আগে বলিনি। আপনি জানবেন কীভাবে?
– হুম। আমার নাম অমিত!
– মালব্য না তো!
– হ্যাঁ? কী?
– ওই যে ওই পার্টিটার আইটি সেলের হেড অমিত মালব্য। অনলাইনে ফেক নিউজ ছড়ায়।
– ওহ! না না। আমি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
– আচ্ছা। আমি ত্রিধা। এই বিল্ডিং এর ফিফিটিন্থ ফ্লোরে আমার অফিস। ল ফার্ম রয়েছে একটা।
– বাবাহ! এই বিল্ডিং এ ল ফার্মও রয়েছে?
– আছে তো! প্রোডাকশন হাউস থেকে শুরু করে ল-ফার্ম, ব্যাংক সব আছে এখানে।
– কি নাম আপনার ল-ফার্ম এর?
– কেন আপনার লাগবে নাকি? কিছু কেস টেস খেয়েছেন?
আমি হেসে বললাম, “আরে না না! এমনিই জানতে চাইছি!”
ত্রিধা বলল, “আমার কোম্পানীর নাম – জে অ্যান্ড বি লিগাল। আপনার তো HKN Associates!”
আমি এবার একটু অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ কিন্তু…
ত্রিধা হেসে বলল, “আপনার গলার আইকার্ড এর ফিতেতে লেখাটা দেখা যাচ্ছে।”
– ওহ আচ্ছা। বুঝলাম।
কিছুক্ষন দু’জনেই চুপ। আমার খিদে পাচ্ছিল। টিফিন বক্সটা খুললাম। আজ পরোটা আর আলুর দম আবার। ত্রিধার টিফিন টা দেখলাম পাশেই রাখা আছে।
বললাম, “আপনি খাবেন না?”
ত্রিধা বলল, “হ্যাঁ। খাবো। আপনি শুরু করুন।”
আমি আর কিছু বললাম না। একেই দেরী হয়ে গেছে বেশ খানিকটা। লাঞ্চ ব্রেক শেষ হওয়ার আগে খেয়ে ঢুকতে হবে অফিস!
একটি সত্যি কথা সবার সাথে শেয়ার করা প্রয়োজন। সত্যি কথা অতএব সবার ভালো লাগবে তা নয়। বিশেষ করে মেয়েরা রেগে যেতে পারে এটা শুনলে। তাও আমি বলব। সেটা হল, মহিলারা মানে বিশেষ করে সুন্দরী মহিলারা খুব ভালো মোটিভেশনের কাজ করে। মানে এই যে ধরুন আমি, অমিত চক্রবর্তী, রোজ ছাদে যেতাম কারণ আমার একাকীত্ব ভালো লাগত। এখন সেই একাকীত্বটা আরও ভালো লাগে কারন পাশে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে থাকে। ওহ হ্যাঁ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম ত্রিধা মেয়েটি বেশ সুন্দরী। প্রথম কয়েকদিন খেয়াল করিনি। তারপর কিছুদিন পর কথা বলার সময় খেয়াল করলাম।
রোজ দু’টো বাজার জন্য অপেক্ষা করে থাকি আমি। ২ টো বাজলেই দৌড়োই লিফটের দিকে। যাতে টিফিনের সময় কোনো ভোগান্তি না হয় বা শর্মিষ্ঠা দি যাতে না জ্বালায় তার জন্য ১০ টায় অফিসে ঢুকে আমি আর কোনোদিকে তাকাই না। মন দিয়ে নিজের কাজ করি। একবারও উঠি না। উঠি একদম ২ টো বাজতে ২ মিনিট আগে। ব্যাগ থেকে টিফিন আর জলের বোতল নিয়ে এগিয়ে যাই লিফট এর দিকে। তারপর ১৮ তলার বাটন প্রেস করে লিফট থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই ওপরের ছাদে।
এর মাঝে একদিন একটা ব্যাপার হল। তখন সবে ৫-৬ দিন আলাপ হয়েছে ত্রিধার সাথে। রোজ ত্রিধা আসে। ছাদের অন্যদিকটায় গিয়ে দেখে পায়রার পটি রয়েছে তারপর এসে বসে আমার পাশে। সেদিন ছিল শনিবার। তার আগের দিন রাত্রে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। আমি ছাদে গিয়ে দেখলাম বৃষ্টির জলে পায়রার পটি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে এবং আবার শনিবার সকাল থেকে কড়া রোদ বেরোনোয় ভেজা ছাদ শুকিয়েও গেছে।
আমি দেখেই প্রমাদ গুনলাম। যদি ত্রিধা এসে আজ আমার পাশে না বসে ওদিকে বসে? তাহলে? পরক্ষনেই ভাবলাম আমি এরকম হয়ে যাচ্ছি কেন! একটা মেয়ে আমার পাশে না বসলে কী এমন হবে? কলেজে পড়ি নাকি আমি? বাচ্চাদের মত কেন করছি! না বসলে না বসবে! এসব ভেবেই এসে বসলাম আমি যেদিকে বসি সেদিকে। ত্রিধার আজ আসতে দেরী হচ্ছে কেন কে জানে। আমি ঘড়ি দেখলাম। ২ টো ১৫ বাজে। এত লেট তো ও করে না।
নিজের টিফিন বক্সটা খুললাম। আজ মা দিয়েছে রুটি আর মাংস। মায়ের সাথে ঝামেলা অথচ রোজ সকালে উঠে আমার জন্য এত সুন্দর সুন্দর টিফিন ঠিক বানিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ একটা জিনিস মাথায় খেলে গেল। কিছুক্ষনের জন্য আমার বয়সটা যেন ১০ বছর কমে গেল। একবার দেখলাম কেউ আসছে কিনা। তারপর আমি ওখান থেকে উঠে টিফিন বক্স টা নিয়ে গেলাম ত্রিধা আগে যেদিকে বসত সেদিকে। তারপর আমার টিফিন বক্স থেকে মাংসের ঝোল ছড়িয়ে দিলাম ওদিকটায়। যাতে ওদিকে আর কেউ বসতে না পারে!
“ওদিকে কী করছেন?”
চেনা গলার আওয়াজটা পেয়েই ভয়ে আমার হৃৎপিন্ডটা যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
(চলবে)
ত্রিধা – দ্বিতীয় পর্ব

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি