গেম অফ থ্রোন্স এর প্রথম এপিসোডে জেইমি ল্যানিস্টার একটা দারুন কথা বলেছিল। সেটা এখনও মনে গেঁথে আছে ঋত্বিকার। দাঁড়ান গেম অফ থ্রোন্স দেখেননি বলে পালিয়ে যাবেন না। কথাটা শুনে যান। ভালো লাগবে! জেইমি বলেছিল – The Things We do for Love! যার মোটামুটি একটা বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ভালোবাসার জন্য আমরা কত কীই না করি! আজ কেন বার বার এই কথাটা মাথায় আসছে সেটা ঋত্বিকা জানে। তার কারণ হল আজকের দিনটা। আজকের দিনটা যে ওর জীবনে কখনও আসবে সেটা ও আগে কখনও ভাবে নি।

অনেক মেয়ের কাছে বিয়েটা একটা খুব বড় স্বপ্ন। পারফেক্ট ওয়েডিং এর স্বপ্ন দেখেন অনেকেই। কিন্তু  ঋত্বিকা কখনও দেখেনি। মানে প্রেম করেছে হয়ত বেশ কয়েকটা কিন্তু কোনোটাই যে বিয়ে অবধি যাবে সেটা ভাবেনি। কারন ওর কখনও মনে হয় নি আর একটা মানুষ ওর সাথে থাকতে পারবে! একটা মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোটাই ওর কাছে কেমন যেন একটা ইউটোপিয়া মনে হত। কারন ও দেখেছে অনেক ছোটোবেলাতেই ওর মায়ের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ! বাবা জীবনে কখনও ওর খোঁজও নেয় নি! এমন কি উনি কোথায় আছেন কেউ জানেও না! ওর যা কিছু সব মা!

তো যাই হোক! অনিকেত যখন ওকে রেস্টুরেন্টে এক হাঁটুতে বসে প্রোপোজ করল তখন স্বভাবতই ও খুব শকড হয়েছিল! ভুরু কুঁচকে বলেছিল – “তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস?”

অনিকেত বলেছিল, “সেই কারনেই তো প্রোপোজ করছি। তাই না?”

ঋত্বিকা বলেছিল, “সিরিয়াসলি? আমাকে? মানে আমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাস?”

অনিকেত বলেছিল, “হ্যাঁ রে ভাই। আর না তো কী?”

–       কিন্তু আমি তো বদমেজাজী!

–       জানি।

–       কথায় কথায় রেগে যাই।

–       জানি তো।

–       তারপর তোকেই আমাকে ঠান্ডা করতে হয়!

–       তাও জানি।

–       তাও আমাকেই বিয়ে করতে চাস?

অনিকেত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ চাই চাই চাই! হাঁটুতে এবার লাগছে। তুই কি উত্তর টা দিবি?”

উত্তর ঋত্বিকা দিয়েছিল। আর তার জন্যেই আজকের দিনটা। সত্যি ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে! কিন্তু বড্ড টেনশন হচ্ছে আজ! মজার ব্যাপার হল এর আগে বিয়ে নিয়ে কখনও না ভাবা ঋত্বিকার টেনশন হচ্ছে আজকের দিনটা নিয়ে। ও আর অনিকেত ২ জনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ৩ দিন ধরে বিয়ে করবে না। একদিনেই সবটা হবে। মানে বিয়ে আর রিসেপশন এক দিনেই। সেই অনুযায়ীই আজকেই সবটা হওয়ার কথা। আর সেই জন্যেই ঋত্বিকার টেনশন টা আস্তে আস্তে বাড়ছে।

দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ এবং তার সাথে বাইরে থেকে কেউ একটা জিজ্ঞেস করল, “ভেতরে আসব?”

গলাটা ঋত্বিকার খুব ভালোই চেনা! কিন্তু দুঃখের বিষয় ও না চাইলেও এই মানুষটাকে আজ ভেতরে আসতে দিতে হবে।

ঋত্বিকা গলা ঝেড়ে বলল, “হ্যাঁ!”

ভেতরে এল শতদ্রু। শতদ্রুর সাথে ওর একসময় সম্পর্ক হয়েছিল। তবে সেটা মাত্র ১ মাসের জন্য। এক মাসের মধ্যেই এত অতিষ্ঠ হয়ে যায় দু’জনেই যে দু’জনেই সিদ্ধান্ত নেয় একে অপরের সাথে থাকতে পারবেনা কোনোভাবেই। অগত্যা এক মাস পরেই ব্রেক আপ! সম্পর্ক টা কোনোদিনই আর ঠিক বন্ধুর মত হয় নি। দেখা হলে হাই হ্যালো ব্যাস! এর চেয়ে বেশী আর কিছু নয়।

আপনারা অনেকেই হয়ত ভাবছেন আজ শতদ্রু কেন এল হঠাৎ। এক্স কে কেউ বিয়েতে নিমন্ত্রন করে নাকি?

“খুব সুন্দর লাগছে কিন্তু!” ঘরে ঢুকেই বলল শতদ্রু।

ঋত্বিকা অল্প হাসিমুখ আনার চেষ্টা করে বলল, “থ্যাঙ্কিউ!”

তারপর একটু থেমে বলল, “কিছু বলার আছে?”

শতদ্রু বলল, “ও হ্যাঁ! তোর কি দেরী হবে? সবাই বসে আছে! বিয়ে শেষ হলেই তো নাচতে হবে!”

কথাটার মধ্যে অল্প শ্লেষ আছে কি? এই একটা কথা ঋত্বিকা আজ সারাদিন বার বার মাথা থেকে বের করার চেষ্টা করছিল। ও চাইছিল এই নাচের ব্যাপার টা যেন না হয় তাহলেই সবটা ঘাঁটতে শুরু করবে। কিন্তু এই ছেলেটা আবার সেটা মনে করালো। ও খুব ভালো করেই জানে অনিকেত একদম নাচতে পারে না। মানে যেখানে নাচের কথা হয়, ওর সেখানে টিকি পাওয়া যায় না! ইচ্ছে করেই শতদ্রু এটা আবার মনে করালো যে বিপর্যয় একটা আসতে চলেছে।

ঋত্বিকা বলল, “আমি আসছি ৫ মিনিট পর!”

ও খুব বুদ্ধি করে শতদ্রুকে তুই বা তুমি কোনোটাই ডাকে না। সেই কারনেই সবসময় ইনডাইরেক্ট স্পিচে কথা বলে। থ্যাঙ্কস টু ন্যারেশন চেঞ্জ!।

শতদ্রু মনে হল একটু মুচকি হাসল। তারপর চলে গেল ঘর থেকে।

ঋত্বিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! কী যে হতে চলেছে আজ কে জানে!

“হবে আবার কী? সব ম্যানেজ হয়ে যাবে! আমি আছি তো!”

শতদ্রুর কথায় ভরসা পেল অনিকেত! এই ছেলেটা না থাকলে ওর যে কী হত কে জানে! অনিকেত আর শতদ্রু সেই ক্লাস এইট থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড। অনিকেত জানে শতদ্রু ওকে বড্ড ভালোবাসে। যদিও ঋত্বিকা ওকে একদম পছন্দ করে না। কিন্তু সেটা কোন এক্সই বা করে।

শতদ্রুর সাথে ঋত্বিকার প্রেম ছিল এক মাসের মত। কিন্তু দু’জনের মধ্যে এত সমস্যা হত যে ওরা দু’জনেই বুঝেছিল এভাবে কেউ কারুর সাথে থাকতে পারবে না! তারপরেই ব্রেক আপ। এর প্রায় বছরখানেক পর একে অপরের প্রেমে পড়ে অনিকেত আর ঋত্বিকা। প্রোপোজ করার আগে শতদ্রুর সাথে আলোচনা করেছিল অনিকেত!

ও বলেছিল, “ভাই তুই না চাইলে আমি এগোবো না!”

শতদ্রু বলেছিল, “সত্যি ভালোবাসিস তো ওকে?”

অনিকেত বলেছিল, “হ্যাঁ ভাই! সত্যি। বড্ড ভালোবাসি!”

শতদ্রু বলেছিল, “তাহলে শুধু আমার কেন, পৃথিবীর কোনো চাওয়া না চাওয়াকেই তোর ভালোবাসার মাঝে আসতে দিস না!”

অনিকেত বলেছিল, “এসব নায়কের মত ডায়ালগ মারিস না। কী করব বল?”

শতদ্রু হেসে বলেছিল, “আপাতত প্রোপোজ টা কর। তারপর কিছু করতে না পারলে বলিস। টিউটোরিয়াল বানিয়ে পাঠিয়ে দেবো!”

অনিকেত বুঝেছিল শতদ্রুর আপত্তি নেই। সুতরাং এগোনো যেতে পারে। তারপরেই শুরু হয় ওর আর ঋত্বিকার প্রেম। তবে ও নিজে সত্যিই কখনও ভাবে নি যে ঋত্বিকা ওর সাথে সারাজীবন কাটাতে রাজি হবে! কিন্তু মেয়েটা চিরকালই আনএক্সপেক্টেড থাকারই চেষ্টা করেছে। সেদিনও তাই হল। যখন প্রোপোজ করবে বলে এক হাঁটুতে বসল তখন সত্যিই ওর ইয়ে হাতে চলে এসেছিল। যদি না বলে দেয় তখন সেই হিউমিলিয়েশনটা কাটিয়ে উঠতে উঠতে ও শেষ হয়ে যেত!

কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে না ঋত্বিকা বলে নি। সেই কারনেই আজকের এই বিশেষ দিনটা!

শতদ্রুর আশ্বাস পেয়ে একটু ভরসা পেল অনিকেত। ও যখন বলেছে তখন ও সামলে নেবে। ওই একটা ব্যাপার নিয়েই বড্ড টেনশনে আছে অনিকেত। কী যে হবে!

শতদ্রু বলল, “চল এবার! সবাই বসে আছে তো!”

অনিকেত বলল, “আর ঋত্বিকা কোথায়?”

শতদ্রু বিরক্ত হয়ে বলল, “ডেকে এসেছি! উফফ! সত্যি!”

অনিকেত অবাক হয়ে বলল, “তুই গিয়েছিলি?”

–       আবার কী? কাকিমা বলল যেতে!

–       এই রে! তারপর? ও কিছু বলেনি তো উল্টোপাল্টা!

–       নাহ! কী আবার বলবে? আমার ব্রম্ভাস্ত্র হল তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড! কাজেই আমাকে কিছু বলার উপায় ওর নেই!

–       হুম। চল যাই!

আজকের দিনটা নিয়ে টেনশন টা বড্ড বেশী অনিকেতের। ঋত্বিকা এমন একটা মেয়ে যে কখনও বিয়ে করে সংসার করবে সে কথা কখনও ভাবেই নি। সেই কারনেই আজকের দিনটা যেন ও কখনও রিগ্রেট না করে সেটা মাথায় রাখতেই হবে। কিন্তু সমস্যা ঐ একটাই। নাচার সময়েই না সবটা ঘেঁটে যায়, এটাই ভয়!

“কোথায় কোথায় বৌ কোথায়?”

কে যেন একটা বলল ভীড়ের মধ্যে থেকে।

ভীড়ের মধ্যে থেকেই কেউ একটা উত্তর দিল, “আমি নিয়ে আসছি!”

অনিকেতের মাথা ঠিক কাজ করছে না। হঠাৎ যে কী হল। মনে হল যন্ত্রের মত সব করছে। শতদ্রু ওকে ধরে বসিয়ে দিল বিয়ের মন্ডপে। ও দেখল ঋত্বিকাকে নিয়ে আসছে কেউ একটা।

বিয়ের কাজ আপাতত শেষ। ঋত্বিকা চেঞ্জ করার জন্য ওর ঘরে এসেছে। এর পরেই সেই ভয়ংকর জিনিস। নাচতে হবে। অলরেডি বাইরে বাদশার গেন্দা ফুল চালিয়ে দিয়েছে। ওখানে স্টেজও বানিয়েছে ওরা একটা। ধুর! ওর প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে অনিকেতের জন্য। ও লাস্ট রিহার্সালের সময়ও ২ টো স্টেপ করার পরেই পড়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে। কোনোরকমে নিজেকে সামলেছে। আজকেও এত লোকের সামনে যদি সেটা হয় তাহলে আর দেখতে হবে না।

যেকোনো ভাবে ওকে নাচা থেকে আটকাতে হবে। সেটা কীভাবে করা যেতে পারে তা নিয়ে একটা প্ল্যানও মাথায় এসেছে ওর। কিন্তু সেটা খুব রিস্কি। তবে এটা ছাড়া আর উপায় নেই।

একটু পর দরজায় আবার ঠকঠক শব্দ।

একটু জোরে নিঃশ্বাস নিল ঋত্বিকা। ইচ্ছে না থাকলেও এটা করতেই হবে। ও বলল, “এসো!”

দরজা খুলে দরজা ঢুকল শতদ্রু। বলল, “যাক, ফাইনালি, তুমিতে এসে থামলি। তাও ভালো!”

ঋত্বিকা উত্তর দিল না। ও বলল, “আমার একটা সাহায্য লাগবে।”

শতদ্রু ভুরু কুঁচকে বলল, “কী সাহায্য”

ঋত্বিকা বলল, “তুমি জানো, অনিকেত নাচতে পারে না!”

শতদ্রু বলল, “হ্যাঁ। জানি। তো?”

–       একটু পরেই সবাই যখন নাচবে তখন আমাদেরকেও নাচতে বলা হবে। আমার নাচতে সমস্যা নেই। কিন্তু ও যদি নাচতে গিয়ে কোনো একটা Embarrassing কিছু ঘটায়, তাহলে খুব খারাপ হবে ব্যাপার টা।

–       তা আমায় কী করতে হবে?

–       যখন সবাই আমাদের নাচতে বলবে তখন কিছু একটা ছুতোয় ওকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে অন্য কাজ বলে। ওকে বললেই ও বুঝবে। ওর নিজেরও নাচার ইচ্ছে নেই।

শতদ্রু কয়েক মুহুর্ত থেমে একটু হাসল।

ঋত্বিকা বলল, “কী হল? এটা কী করা সম্ভব তোমার পক্ষে?”

শতদ্রু বলল, “আমার জাস্ট মনে পড়ল তোর সাথে সম্পর্কটা কেন টিকল না!”

ঋত্বিকা বলল, “আজ এসব কথা কী না বললেই নয়!”

শতদ্রু বলল, “সমস্যা হচ্ছে তুই উল্টোদিকের মানুষটাকে ভরসা করিস না। নিজে সব সময় একটা সিদ্ধান্ত নিস। আর ভেবে নিস যে উল্টোদিকের মানুষটাও এটাই চায়!”

ঋত্বিকা বলল, “তুই পারবি না তাই তো?”

কখন যে তুমি টা তুই হয়ে গেল ও খেয়ালও করেনি।

শতদ্রু বলল, “ঠিক আছে। চেষ্টা করব! তবে এই মানুষটার সাথে তোকে সারাজীবন থাকতে হবে। এটা মাথায় রাখিস! একটু ভরসা না হয় করলি। কি এমন সমস্যা হবে তাতে?”

কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শতদ্রু। ঋত্বিকা নাকি ভরসা করে না। ও ভরসা না করলে এই মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকার জন্য রাজি হত নাকি! এই ছেলেটার বাজেভাবে অপমান করার স্বভাবটা এখনও গেলো না!

নাহ! ও ভাববে না এসব আজকের দিনে। মেকআপ আর্টিস্ট বাইরে বসে আছে। ও তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিল। এই শাড়ি পরে এমনিতেও নাচা যেত না। অনিকেত নাচুক বা না নাচুক ওকে তো নাচতেই হবে।

আধঘন্টা পর যখন ও বেরোলো ঘর থেকে তখন দেখল সবাই অলরেডি নাচতে শুরু করে দিয়েছে। অনিকেত তখনও আসে নি। ও বলল স্যুট পরবে। তবে নাচার সময় ব্লেজার টা খুলে দেবে!

একটু পরেই বেরিয়ে এল অনিকেত। ওকে এখনও শতদ্রুর সাথে করা প্ল্যানের কথা বলা হয় নি। শতদ্রু সামলে নিলেই বাকিটা হয়ে যাবে।

অনিকেত এসে ওর পাশে দাঁড়াল। বেশ জোরে গান চলছে। তবু ঋত্বিকা অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, “একটা প্ল্যান করেছি! তুই বেঁচে যাবি!”

অনিকেত অবাক হয়ে বলল, “কী প্ল্যান? কীসের জন্য বেঁচে যাবো?”

এরপর ঋত্বিকা কিছু বলার আগেই লাউডস্পীকারে শোনা গেল শতদ্রুর গলা। সে বলল, “স্টেজটা সবাই খালি করে দিন। কারন এরপর আমাদের সবার জন্য স্পেশাল পারফরম্যান্স নিয়ে আসছেন অনিকেত-ঋত্বিকা জুটি!”

এটা ওরা দু’জন কেউই এক্সপেক্ট করেনি সেটা ঋত্বিকা জানে! এবার কী হবে? এটা কী করল শতদ্রু! বারন করা সত্ত্বেও…

অনিকেতের দিকে তাকাল ও। ও করুন চোখে তাকিয়ে আছে ঋত্বিকার দিকে। কিন্তু ও জানে উপায় নেই। সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওরা স্টেজের দিকে। ঋত্বিকা আড়চোখে দেখল শতদ্রু মুখে একটা ক্রুর হাসি নিয়ে নেমে আসছে স্টেজ থেকে। নাহ। এখন সিন ক্রিয়েট করবে না ও!

স্টেজে ওঠার পরেই প্রথমেই ওদের জন্য চালানো হল Pati Patni Aur Wo থেকে Dheme Dheme.

অনিকেত জড়োসড়ো ছিল শুরু থেকেই। সবাই চিয়ার আপ করছে ওদের দু’জনকে। এতে ও আরও ভয় পাচ্ছিল বুঝতে পারছিল ঋত্বিকা। গানটা শুরু হওয়ার পর সে আরও নার্ভাস হয়ে গেল। প্রথম দু’টো লাইনের পরেই যেখান থেকে ফাস্ট স্টেপ শুরু হওয়ার কথা সেখানেই ঘটল বিপর্যয়। যেটা রিহার্সালে কখনও হয় নি সেটাই হল এখন। স্টেজের ওপর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে গেল অনিকেত!

ঋত্বিকা ওকে তুলতে যেতেই ও হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপর হঠাৎ করে স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল বাইরের গেটের দিকে।

একটা মানুষ কত ভেবে চিনতে একটা পারফেক্ট দিনের প্ল্যান করে। তারপর সেই দিনটা আসে আর বুঝিয়ে দেয় সমস্ত কিছু প্ল্যানমাফিক হয় না। জীবনটা তো এরকমই। কলেজ লাইফে কত কত ট্রিপ প্ল্যান হয়েছে বন্ধুদের সাথে, তারপর যত দিন এগিয়ে এসেছে, আস্তে আস্তে ক্যানসেল করেছে সবাই।

অনিকেত সিনেমার নায়ক হলে বরং ভালো হত। সবাইকে অবাক করে দুর্দান্ত নেচে নায়িকাকে ইম্প্রেস করা যেত।  কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা সেরকম খাজা সিনেমা নয়। এখানে সবটা এত সহজ নয়। জীবনটা এত সহজ নয়।

এখানে মানুষ আসে মানুষ যায়। কেউ থাকার জন্য আসে না। শুধু রেখে যায় একরাশ দুঃখ আর কিছু স্মৃতি। কিন্তু এই একটা বন্ধু, একটা মানুষ জীবনে কখনও অনিকেতের হাত ছাড়েনি। আজও তার ব্যাতিক্রম হবে না সেটা অনিকেত জানে।

স্টেজ থেকে নেমে ও চলে গিয়েছিল বাইরের গেটের দিকে। ও জানে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়েছে ওর দিকে। ও জানে কিছুক্ষনের জন্য সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিছুক্ষনের জন্য থেমে যাবে সব কিছু। কিন্তু সেটাই তো ওর দরকার।

বেশীদূর যেতে হল না। একটু এগোতেই পাওয়া গেল শতদ্রুকে। একটা গাছে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল।

অনিকেত কে দেখে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাবি?”

অনিকেত বলল, “নাহ। আর কত দেরী?”

শতদ্রু হাতঘড়ির দিকে দেখে বলল, “মিনিট পাঁচেক!”

অনিকেত ঘাড় নেড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। শতদ্রু বলল, “তুই এত চাপ নিচ্ছিস কেন! সব ঠিক থাকবে! আমি আছি তো!”

অনিকেত বলল, “না না। তাও টেনশন হচ্ছে। গানটাও থেমে গেছে দেখেছিস তো! আর আমি বেশী দেরী করলে আমাকে খুঁজতে আসবে। তাহলেই সব ভেস্তে যাবে!”

শতদ্রু বলল, “উঁহু! সে ব্যবস্থা করে রেখেছি! আসতে পারবেনা ঋত্বিকা!”

ওর কথা শেষ হতে না হতেই সামনে একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। সিগারেট টা ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল শতদ্রু। অনিকেত বুঝল ও ঘামছে।

ঋত্বিকার সব সময় মনে হয়েছে শতদ্রু ওর আর অনিকেতের সম্পর্কটা একদম পছন্দ করে না। ওর মনের ভেতর একটা রাগ রয়েছে ওদের সম্পর্কটা নিয়ে। তার প্রতিশোধটা যে এভাবে নেবে কে জানত! অনিকেত স্টেজ থেকে ওভাবে নেমে চলে যাওয়ার পরেও প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল ও। তারপর নীচে নেমে গেটের দিকে যেতেই ওকে আটকাল অনিকেতের বোন।

বলল, “কোথায় যাচ্ছো?”

ঋত্বিকা বলল, “ও কোথায় গেল দেখি?”

ওর বোন বলল, “তুমি যেও না। আমি দেখছি! এখানে সবাই আছে। কারুর একটা থাকা দরকার!”

ঋত্বিকা বলল, “কিন্তু আমি গেলে…

–       আরে চিন্তা কোরো না। ওকে তো তুমি জানো। ওর মাথা খুব ঠান্ডা। ও ভুলভাল কিছু করবে না!”

সেটা অবশ্য ভুল বলেনি দীপ্তি। দীপ্তি মানে অনিকেতের বোন। অনিকেত বড্ড ঠান্ডা মাথার ছেলে। কিন্তু শতদ্রু টা কোথায় গেল? ওকে সামনে পেলে টেনে একটা চড় মারবে আজ ঋত্বিকা!

আস্তে আস্তে তখন গান চালানো হয়েছে আবার! আস্তে আস্তে কোমর দোলাচ্ছে অনেকেই। ঋত্বিকার টেনশন টা কাটছে না! একটু পরেই ও দেখতে পেল শতদ্রুকে। বাইরে থেকে আসছে সে। ওর দিকেই আসছে।

ঋত্বিকা বুঝতে পারল ওর মাথাটা গরম হচ্ছে আবার। এই ছেলেটা আজ যেটা করল তার জন্য কিছু একটা শাস্তি ওর প্রাপ্য! কিন্তু এই এতজন লোকের সামনে ওকে কি শাস্তি দেবে সেটাই বুঝতে পারছে না ও।

কিছুক্ষন পর শতদ্রু এসে দাঁড়াল ওর সামনে।

ও বলল, “বাড়াবাড়ি টা না করলে হচ্ছিল না? আজকের দিনে ওকে হিউমিলিয়েট করলেই হল!”

শতদ্রু হেসে বলল, “রুকো Zara.. Sabar Karo!”

উফফ! এই হিন্দুস্তানী ভাউটাকে কোনোদিনই সহ্য হয় না ওর। তার ওপর এক্স হিন্দুস্তানি ভাও এর ডায়ালগ দিলে তো আরও অসহ্য লাগে।

ঋত্বিকা এবার জোরেই বলল, “কিসের জন্য অপেক্ষা করব? অনিকেত কোথায়? কেন করলি তুই এরকম?”

কথাটা বলার পরেই ও পেছনে দেখতে পেল অনিকেত কে। গেট দিয়ে ঢুকে হেটে আসছে। কিন্তু ও একা নয়। সাথে ওটা কে? হুইল চেয়ারে?

মানুষ কখন কাঁদে? খুব কষ্ট পেলে। কিংবা খুব আনন্দ পেলে! আবার যদি এমন হয় মানুষ বুঝতেই পারছে না তার ভেতরে ঠিক কি অনুভূতি হচ্ছে। ৭ বছর বয়সে যে মানুষটাকে শেষ দেখেছে ও সেই মানুষটাকে আজ ২২ বছর পর হুইল চেয়ারে দেখছে। সেই মানুষটাও অবাক চোখে দেখছে নিজের মেয়ের দিকে।

সবাই আবার থেমে গেছে। সমস্ত কিছু আরও একবার স্তব্ধ হয়ে গেছে। শতদ্রু কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “ক্যানসার লাস্ট স্টেজ। Be Kind to him.”

ঋত্বিকা তাকাল অনিকেতের দিকে। অনিকেত খুব কনফিউজড ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কত কিছু যে করেছে ও ওর বাবাকে আজ এখানে নিয়ে আসার জন্যে! ঋত্বিকাকে একবারের জন্য বুঝতে দেয়নি সেটা। তবে শতদ্রু না থাকলে হয়ত এত কিছু সম্ভব হত না। কিন্তু ও বুঝতে পারছেনা ঋত্বিকা এই ধাক্কাটার জন্য ওকে কখনও ক্ষমা করবে কিনা।

ঋত্বিকা নিজেও জানে না ও কী করবে। ও দেখল একটু দূরে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে উনি ইশারায় যেতে বললেন বাবার কাছে। এরপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ও সামনের দিকে।

বাবার সামনে নীচু হয়ে বসল ও। ওর বাবা কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে রাখলেন ঋত্বিকার গালে। ঋত্বিকার আর আটকে রাখতে পারল না চোখের জল।

অস্ফূত স্বরে ও একবার বলল, “বাবা!”

অনিকেত এবার হাসল। ঋত্বিকার একটা হাত ধরল ও। ঋত্বিকাও যেন চাইছিল ওর হাতটা কেউ একটা শক্ত করে ধরুক। অনিকেত শতদ্রুর দিকে তাকাল একবার। শতদ্রুর ঠোঁটেও হাসি।

সত্যি The Things We do for Love. ভালোবাসার জন্য আমরা কত কিছুই না করি!

একটা ছেলে মনের আঙিনাতে…

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


2 thoughts on “একটা ছেলে মনের আঙিনাতে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি