লকডাউন হয়েছে তখন সবে ৬ দিন হয়েছে। কেউ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি না। বাড়িতে কাজের লোক আসাও বন্ধ। শুধু ৪ জন আমরা বাড়িতে। মাঝে মাঝে বাবা সকালে অল্প কিছু বাজার করে নিয়ে আসছে। এইভাবেই চলছিল। আমরা সারাদিন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এই সব করে আর বাবা-মা খবরের চ্যানেল দেখে চলেছে। ভালো লাগছে না আর এভাবে। আমার মোমো কে কতদিন দেখিনি।

ঘটনাটা ঘটল রবিবার দুপুরের দিকে। দুপুরে লাঞ্চ সারার পরেই হঠাৎ আমাদের কলিং বেল টা বেজে উঠল। আমি তখন ল্যাপটপে কিছু একটা সিনেমা চালিয়েছিলাম। দাদা আমার পাশে বসেই ফোনে কিছু একটা করছিল। বেলের আওয়াজটা শুনেই আমরা চমকে একে অপরের দিকে তাকালাম। এখন বাড়িতে কে এল?

ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম ডাইনিং এ। মা বাবাও বেরিয়ে এসেছে একে অপরের দিকে তাকাতে তাকাতে। আমাদের সংসারে লোক আমরা চারজন। আমি, দাদা আর বাবা,মা। বাইরে থাকতাম শুধু আমি আর দাদা। দাদা চাকরি করে আর আমি কলেজে পড়ি আর টিউশন করি টুকটাক। আমরা লকডাউনের আগের দিনই বাড়ি চলে এসেছি।

কলিং বেল টা আবার বাজলো অধৈর্য গলায়। এরপর মা গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করল “কে?”

বাইরে থেকে উত্তর এল, “আমরা নার্সিং হোম থেকে এসেছি! দরজা খুলুন!”

নার্সিং হোম থেকে মানে? আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। বাবা আর দেরী না করে এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল দরজা টা।

দরজা খুলতেই দেখলাম হলুদ রঙ এর রেনকোটের মত ড্রেস পরা ৪ জন লোক ঢুকে এল আমাদের ঘরের ভেতর। সবার মুখ ঢাকা মাস্কে। টিভিতে করোনা চিকিৎসকদের পরনে এই ধরনের মাস্ক, ড্রেস দেখেছি।

ওদের একজন বলল, “শান্তনু দত্ত কে?”

দাদা এবার পেছন থেকে বলল, “আমি? কেন?”

কথাটা বলার সাথে সাথে ওরা আর অপেক্ষা করল না। ৪ জনে এগিয়ে এসে দাদাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে বেরোতে গেল। আমরা প্রথমে ব্যাপারটায় হতবাক হয়ে গেলেও পরক্ষনেই বাবা জোর গলায় বলল, “এসব কী?”

একজন বলল, “আমাদের কাছে খবর আছে উনি বাইরে থেকে এসেছেন। উনি ইনফেক্টেড হলেও হতে পারেন। তাই ওঁকে কোয়ারান্টাইনে রাখতে হবে আমাদের!”

বাবা বলল, “মানে? কোনো সিম্পটম নেই কিছু নেই এমনি এমনি কোয়ারান্টাইনে রাখতে হবে মানে? কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?”

লোকটি বলল, “আর সিম্পটম দেখা দিতে দিতে যদি আপনারা ইনফেক্টেড হয়ে যান তাহলে? তখন কী হবে? আমাদের রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন জানেন তো? নার্সিং হোমে বেড পাবেন তো?”

মা এইসময় বলল, “কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে আপনারা আমাদের ছেলেকে নিয়ে যেতে পারেন না!”

লোকটি বলল, “তাহলে কি পুলিশ নিয়ে আসব বলছেন?”

দাদা এতক্ষন কিছু বলছিল না। এবার বলে উঠল, “নাহ মা। ঠিক আছে। আপনারা নিয়ে চলুন!”

লোকগুলি আর কিছু বলল না। দাদা কে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আমরা ৩ জন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা তো মাথায় হাত দিয়ে বসেই পড়ল মাটিতে। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না আমরা। বাবা কিছুক্ষন একে তাকে ফোন করল। তারপর আমাদের এসে বলল, “এটা নাকি সরকার থেকে নতুন শুরু হয়েছে! ওরা যাকে সন্দেহজনক মনে করছে তাকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কাউকে পরের দিন আবার কাউকে ২ দিন পর আবার কাউকে সেইদিনই ৬-৭ ঘন্টা পর ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। জয়ন্ত কাকুর মেয়ে লাভি কেও নাকি নিয়ে গেছে।

দাদা কে ফোন করেছিলাম অনেকবারই। ফোন তোলেনি। কয়েক ঘন্টা পর থেকেই ফোন সুইচ অফ। শুনলাম পাশের বাড়ির নিবারন কাকু কেও নিয়ে গেছে কাল সন্ধ্যেবেলা। তারপর আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থাকে একটা ফ্যামিলি। ওদেরও বৌমা কে নিয়ে গেছে নার্সিং হোম থেকে এসে।

মা-বাবা কারুরই মুড ভালো নেই। ক’দিন মা দারুন দারুন সব রান্না করছিল। দাদার জন্য টেনশন করতে করতে সেটাও বন্ধ করে দিল। আসলে ওরা কারা, কোন নার্সিং হোমে নিয়ে গেল সেটাও তো জানিনা ছাই! মোমোও খুব চিন্তা করছে। বড্ড ভালোবাসে তো আমাকে। আমার মন খারাপ থাকলে ওরও কিছু ভালো লাগে না।

পরের দিন সকাল ১০ টা নাগাদ দাদাকে দিয়ে গেল ওরা। হঠাৎ বেল বাজতে আমি সবার আগে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলেছি। দাদাকে দেখে এত আনন্দ হয়েছিল যে আর বলার নেই।

মা বাবাও বেরিয়ে এসেছে। মা কাছে এসে জড়িয়ে ধরল দাদা কে। তারপর বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?”

দাদা বলল, “হ্যাঁ মা। একদম ঠিক আছি!”

বাবা বলল, “ছেড়ে দিল?”

দাদা বলল, “হ্যাঁ। ১২ ঘন্টা অবসারভেশনে রেখে কি ছাতার মাথা দেখল জানিনা। কিছু টেস্ট করবে বলে ব্লাড নিল। তারপর ছেড়ে দিল! বলল আমি ইনফেক্টেড না!”

বলাই বাহুল্য সেদিন আমাদের বাড়িতে বেশ আনন্দের পরিবেশ। খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন বলে কথা। তবে শুনলাম পাশের বাড়ির ওই নিবারন কাকুকে নাকি এখনও দিয়ে যায় নি। কাকিমা তো খুব কাঁদছে।

মা সেদিন দুপুরে আবারও দারুন রান্না করল। দুপুরে বসে বসে আমি আর দাদা গল্প করছিলাম। দাদাকে বললাম, “মা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল জানিস!”

দাদা বলল, “হুম। স্বাভাবিক! আমার নিজেরই অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল! কী করবে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতেই তো… যাই হোক ছাড়! ভালো লাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে!”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। দাদা ফোন পাশে রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। আমারও তন্দ্রা মত এসেছিল। হঠাৎই একটা নোটিফিকেশনের আওয়াজে সেটা ভেঙে গেল! দাদাটা না উফফ! কখনও ফোন সাইলেন্ট করে না। উঠে দাদার ফোনটা সাইলেন্ট করতে গিয়েই চোখে পড়ল লাস্ট মেসেজ টা। মেসেজ যে করেছে তাকে আমি চিনি! তবে মেসেজের বক্তব্য টা দেখে একটু অবাকই হলাম। তার চেয়েও বেশী সম্ভব হলাম কীভাবে সম্ভব সেটা ভেবে!

দাদার ফোনের পাসওয়ার্ড আমার জানা। ফোনটা আনলক করলাম আমি। তারপর অ্যাপ গুলো দেখতে দেখতেই একটা অ্যাপ এ এসে চোখ থেমে গেল। অ্যাপ টার নাম – Prem Corona

আরও কিছু দেখতাম কিনা জানিনা! কিন্তু হঠাৎ দাদা নড়ে চড়ে বসায় আমি ভয় পেয়ে ফোনটা রেখে দিলাম ওর পাশে। তারপর শুয়ে পড়লাম ওর পাশে। তারপর আমার ফোন বার করে প্লেস্টোর টা খুললাম।

এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত এবং মধুর। যারা এখনও বুঝতে পারেন নি সবটা তাদেরই বুঝিয়ে দিচ্ছি সহজ করে। এর পরের দিন দুপুরে নার্সিং হোম থেকে ৪ জন এল আবার আমাদের বাড়িতে। বাবা-মায়ের আপত্তি চিৎকার চেঁচামেচি সত্ত্বেও ওরা আমাকে জোর করে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আমি ইনফেক্টেড কিনা পরীক্ষা করবে বলে।

এই পুরো সময়টা আমি আমার দাদা কে দেখছিলাম। ও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছু বলতেও পারছে না। কারন জানে যদি বলে তাহলে নিজেও ডুববে।

গতকাল ওকে মেসেজ করেছিল লাভি। জয়ন্ত কাকুর মেয়ে। ও লিখেছিল, “কালকের রাতটার জন্য Thank you. উফফ আবার যে কবে পাবো তোকে!”

তারপরেই ওই Prem Corona অ্যাপ টা দেখে আমি বুঝতে পারি এটা একটা নতুন সার্ভিস শুরু করেছে কোনো একটা কোম্পানী। বয়ফ্রেন্ড এবং গার্লফ্রেন্ড কে এই কোয়ারান্টাইনের সময়ে পৌঁছে দেবে কোনো এক হোটেলে। সমস্ত টাকা ক্লায়েন্ট কেই পে করতে হবে।

যেমন আমার দাদা কে পৌঁছে দিয়েছিল কাল লাভির কাছে। পাশের বাড়ির নিবারন কাকুকে নিয়ে গেছে তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে। আমারও টিউশনের অনেকটা টাকা চলে গেল ঠিকই। কিন্তু মোমো কে তো পেলাম আমি।

শুনুন যারা যারা অ্যাপটা ডাউনলোড করবেন প্রত্যেকে প্লিজ ফাইভ স্টার দেবেন কিন্তু। আমি তো দিয়েছি অ্যাপ কে আর আমার মোমো কেও!

‘প্রেম করোনা’

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


2 thoughts on “‘প্রেম করোনা’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি