ট্রেনে উঠেই হাতঘড়িটার দিকে দেখল অয়ন। একটু দেরী হয়ে গেল বেরোতে আজ। তবে পৌঁছে যাবে বলেই মনে হয় টাইমে। আজকের পরীক্ষাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গল্প বা সিনেমার নায়ক হলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো খুব সহজেই পাশ করে যেত হয়তো। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেটা আর হয়ে ওঠে নি। কাজেই এখনও সরকারী চাকরির পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে নিয়ম করে।
নৈহাটি থেকে শিয়ালদা যাওয়ার ট্রেনে ও প্রায় নিয়মিত যাত্রী। তবে আজকে এই রবিবারেও এরকম যাচ্ছেতাই ভীড় হবে সেটা ও ভাবতে পারে নি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই পরীক্ষার জন্যেই বোধহয় এত ভীড়। অন্য সব পরীক্ষার সময় ওর সাথে একজন থাকতো। জোর করেই থাকত। অয়ন হাজার বারণ করলেও শুনতো না।
অয়ন তাকে বার বার জিজ্ঞেস করত, “তুই কী করবি আমার সাথে গিয়ে?”
শৈলী বলত, “কী আবার করব? বাইরে বসে থাকব!”
– আচ্ছা আমার পরীক্ষা তে তুই বাইরে বসে থাকবি কেন?
– কেন? অনেকের সাথেই তো তার গার্জিয়ান আসে।
– তো কী? তুই আমার গার্জিয়ান নাকি?
– হ্যাঁ তো। চুপচাপ বই বের করে পড়। কথা বলিস না বেশী।
“আরে ও দাদা! একটু চেপে দাঁড়ান ব্যাগ টা গায়ে লাগছে!” একটে হেঁড়ে গলার আওয়াজে অয়নের চিন্তার তার কাটল।
কথা না বাড়িয়ে সরে এল অয়ন। এই চেপে দাঁড়ান কথাটা শিয়ালদাগামী ট্রেনে এতবার শুনতে হয়, সেটা জাস্ট বলার নেই। আজ বেরোবোর সময় ওর মা বলছিল, “শৈলী কে একটু বল না সাথে যেতে!”
ছ’মাস হয়ে গেল এখনও মা খালি সারাদিন শৈলী শৈলী করে। আরে ব্রেক আপ হয়েছে ব্রেক আপ। বোঝে না ছাই! অয়ন বলল, “কেন? আবার ওকে কেন যেতে বলব আমার সাথে?”
মা বলল, “ও তো সব পরীক্ষায় সময়েই যেত। কী হবে গেলে?”
অয়ন বলল, “না। ওর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।”
– দেখ আমি তো যেতে পারি না জানিস! পারলে তো যেতাম। আর তোর বাবাও তো আর…
কথাটা বলতে গিয়েই মায়ের গলাটা কেঁপে গেল। এই মুহুর্তগুলো অয়নের বড্ড অসুবিধে হয় হ্যান্ডেল করতে। বাবার অসুস্থতার কথা ও জানে। মাস তিনেক হল প্রায় শয্যাশায়ীই বলা যায়। আর মা সেই কারনেই এক মুহুর্তের জন্য বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না।
শৈলী গেলে মা একটু ভরসা পায়। টাকাপয়সা সব তো ব্যাগেই থাকে। যাদের সাথে গার্জিয়ান যায় না তাদের ব্যাগ গুলো পরীক্ষা হলের বাইরে এক কোনে ফেলে রাখা হয়। সেই জন্যেই আরও জোর করে শৈলী যেতে চাইত। বলত “ব্যাগ টা আমি নিয়ে বসব। তুই যা।”
অয়ন বলেছিল, “মা দেখো তুমি বড্ড বেশী ভাবছো। আমি কি বাচ্চা নাকি যে একা পরীক্ষা দিতে যেতে পারব না?”
কথাটা বলেছিল ঠিকই। কিন্তু আজ ট্রেনে ওঠার পর থেকেই ওর নিজেরও চিন্তাটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ব্যাগে অবশ্য টাকা পয়সা বেশী নেই। একদম মাপ করে অল্প কিছু টাকা নিয়েই আজ বেরিয়েছে কাজেই খুব একটা চাপ হবে না।
“এই তুমি শংকরের ছেলে না?”
নিজের বাবার নাম শুনে একটু চমকে গিয়ে ও পেছনে তাকাল। তাকিয়েই বুঝতে পারল কথাটা বলেছে বিজন কাকু। বিজন কাকু ওর পাড়াতেই থাকে। ওদের বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি আগে। বাবার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক। এর আগেও একবার দেখা হয়েছে এই ট্রেনে।
ও বলল, “হ্যাঁ কাকু।”
কাকু বসে আছে পেছনের একটা সীট এ। ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা কোথায় যাবে? কলকাতা?”
অয়ন বলল, “হ্যাঁ।”
“রবিবারে কেন হঠাৎ?” কাকুর আবার প্রশ্ন
“পরীক্ষা আছে কাকু!” অয়ন যথাসম্ভব ছোট করে উত্তর দেওয়া সারল।
– ও হ্যাঁ। তোমার সাথে তো আগেও একবার দেখে হয়েছিল ট্রেনে। সেই যে তোমার সাথে আর একজন ছিল।
উফফ! এই বুড়োগুলো না! ইচ্ছে করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয়।
অয়ন বলল, “হ্যাঁ হয়েছিল।”
কথাটা বলেই পকেট থেকে ফোন বের করে ও গুগলে কিছু জেনারেল নলেজের প্রশ্ন দেখতে লাগল। বিজন কাকুও আর কিছু বললেন না। হঠাৎ ওর খেয়াল হল ফোনটার ব্যাপারে! তাই তো? ফোনটা কোথায় রাখবে? ব্যাগে টা তো পড়ে থাকবে হলের বাইরে। ফোনটাও কী ওখানে পড়ে থাকবে নাকি?
ইসস! এটা একদম মাথায় আসে নি! এখন কী করবে? ফিরে যাবে? না না। ফিরে গেলে আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। আর এই পরীক্ষাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ বিজন কাকুর দিকে খেয়াল হল ওর। আচ্ছা কাকুর হাতে তো ফোনটা দিয়ে দেওয়া যায়। কাকু তো নিশ্চয় আজ বিকেলেই ফিরবে নৈহাটি তে। তাহলে ফোনটা ওনার কাছে রয়ে গেলে তো ঝামেলা থাকবে না।
কথাটা বিজন কাকু কে বলার সাথে সাথে, কাকু বলল, “না ভাই। আমি আসলে এসবে একেবারে পটু না। আর আমার যা ভুলো মন কোথায় ফেলে দেবো তার ঠিক নেই।”
ও বুঝলো উপায় নেই। দরকারের সময় কোনো কাকুই কাকু নয়। ফোন নিয়েই ওকে যেতে হবে পরীক্ষা দিতে।
শিয়ালদা নেমে ওকে আবার বাস ধরতে হল। এখান থেকে আরও আধঘন্টা। বাসে বসে কনট্যাক্ট লিস্ট টা খুলে শৈলীর নাম্বার টার দিকেই তাকিয়েছিল অয়ন। পরীক্ষার এখনও ঘন্টা দেড়েক বাকি। শৈলী যদি তার মধ্যে চলে আসে তাহলে ওর হাতে ব্যাগ টা দিয়ে দিব্যি চলে যাওয়া যাবে। কিন্তু ব্রেক আপ এর পর কি এটা ঠিক হবে?
আগের বছর একটা পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে ও দেখেছিল শৈলী রোদের মধ্যে বসে রয়েছে হাতে ব্যাগ নিয়ে। ওকে দেখেই উঠে এসেছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, “চল। খিদে পেয়েছে তো? কিছু খাবি চল।”
অয়ন বলেছিল, “আরে ছাগল মানুষ আগে তো জিজ্ঞেস করে পরীক্ষা কেমন হয়েছে!”
শৈলী বলেছিল, “তোর পরীক্ষা ভাল হওয়ার নয়!”
“কি বললি তুই?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল অয়ন।
– সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার দু’দিন আগে থেকে পড়লে কারুর পরীক্ষা ভাল হয় না!
আর কিছু বলেনি সেবার অয়ন। শৈলী খুব ভালো চেনে ওকে।
ও শৈলী কে বলেছিল, “আচ্ছা আমাদের যদি কখনও ব্রেক আপ হয় তাহলেও কি তুই আমার পরীক্ষার সময় বাইরে ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করবি?”
শৈলী বলেছিল, “হ্যাঁ। কেন করব না?”
– ও তার মানে ব্রেক আপ করবি বলছিস?
– আমি ব্রেক আপ শব্দটাই উচ্চারন করিনি এতক্ষন। তুই তো করলি!
– তাতে কী? তোর তো বলা উচিত ছিল আমাদের ব্রেক আপ হবে না।
– মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আমি দিতে চাই না ভাই। ১ মাস পরে বেঁচে থাকবো কিনা তাই জানিনা। আর কার সাথে থাকব সেটা তো আরোই জানিনা।
– মানে ১ মাস পরে আমায় ছেড়ে দিবি তাই তো?
– কে জানে? খুব একটা ইচ্ছে নেই যদিও।
– কেন? ইচ্ছে নেই কেন?
– Satisfaction Baby Satisfaction! ওসব মেয়েদের ব্যাপার। বাদ দে। চল। খাবি চল।
“দাদা আপনার টা দেখি?” কন্ডাকটার ওরটা দেখতে চাইছে শুনেই অয়নের মেজাজটা চটকে গেল। কি সুন্দর স্মৃতিচারনা করছিল। ব্যাগ থেকে ১০ টাকা বের করে দিয়ে দিল। এক্ষুনি ওকে নামতে হবে। নাহ আর শৈলী কে ফোন করে লাভ নেই। এখন বেরোলেও পৌঁছোতে পারবে না সময়ে। পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে দিল অয়ন। আজ এই ফোনটা নিয়ে একটু রিস্ক নিতেই হবে মনে হচ্ছে।
পরীক্ষা হলে পৌঁছে অয়ন দেখল প্রচন্ড কড়াকড়ি চারদিকে। ফ্রিস্কিং হচ্ছে। সব চেক করছে গার্ড। হবেই তো পিএসসির পরীক্ষা বলে কথা। রেজাল্ট বের করছে না তো কি হয়েছে? বছরের বছর পরীক্ষাটা তো নিচ্ছে।
ভেবেছিল ভেতরের পকেটে সুইচ অফ করে ফোনটা নিয়ে ঢুকে যাবে ভেতরে। কিন্তু না! সে গুড়ে বালি। ওর আগে আগেই একটা ছেলেকে মোবাইল নিয়ে ঢুকতে দেখে বের করে দেওয়া হল। ও বুঝলো আজ উপায় নেই। পকেট থেকে ফোন বের করে সুইচ অফ করে ঢুকিয়ে দিল ব্যাগ এ। তারপর ব্যাগটা রাখতে গেল সেই শ’খানেক ব্যাগের ডিপোর কাছে।
একবার পেছন ফিরে তাকালো অয়ন। ঐ যে শাহরুখ খান কি যেন বলেছিল একটা। সত্যি করে মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়। ও তো এখন চাইছে শৈলী আসুক। কই সে তো আসছে না!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন। ব্যাগ টা রেখে দিল ওই অতগুলো ব্যাগের ওপরে। তারপর চলে গেল পরীক্ষা হলে। ২ ঘন্টার পরীক্ষা। অর্থাৎ দু’ঘন্টার টেনশন এবার শুরু হল।
প্রশ্নপত্রের সাথে দু’ঘন্টা যমে মানুষে টানাটানি করে অয়ন যখন বেরোলো তখন বাইরে বেশ ভীড়। ও দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে ব্যাগটা আছে কিনা দেখার জন্য। সারাক্ষন এই টেনশনটা হয়েছে ওর। ব্যাগের সেই ভীড়ের কাছে গিয়ে ও দেখল ওর ব্যাগ নেই। এক মুহুর্তের জন্য বুকের ভেতর টা ধ্বক করে উঠল যেন। ব্যাগ নেই? ব্যাগ সত্যি নেই? এই ব্যাগ সেই ব্যাগ উলটেপালটে দিয়ে পাগলের মত ও নিজের ব্যাগ খুঁজতে লাগল।
একটু পরেই পাওয়া গেল ব্যাগ টা। অনেকগুলো ব্যাগের নীচে চাপা পড়ে আছে। উফফ! ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল অয়নের। কিন্তু তারপর আবার আর এক বিপত্তি। হঠাৎ পাশ থেকে একটা ছেলে এসে ওর হাত থেকে ব্যাগ টা নিয়ে বলল, “এই ভাই, এটা আমার ব্যাগ?”
মানে ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি? এটা কেন ওর ব্যাগ হতে যাবে?
অয়ন বলল, “না। এটা আমার।”
ছেলেটা বলল, “তোমারটা হয়তো এরকমই দেখতে। কিন্তু এটা তোমার না। এই দেখো আমার নাম লেখা।”
খুব খারাপ হাতের লেখায় লেখে রয়েছে একটা নাম। কিছুই পড়া যাচ্ছে না। কিন্তু অয়ন বুঝে গেল এই ব্যাগ ওর না। ওর ব্যাগে নাম লেখা ছিল না। তাহলে ওর ব্যাগ নেই। সত্যি চলে গেল? যে ভয়টা পেয়েছিল সেটাই ঘটল তাহলে?
খুব কান্না পাচ্ছিল ওর। মাথায় হাত দিয়ে ওই ভীড় থেকে পিছিয়ে এল ও। পেছন ঘুরে গেটের দিকে ফিরতেই অয়ন দেখতে পেল ওর ব্যাগ টা। ওই তো ব্লু-আর ব্ল্যাক স্ট্রাইপ। হ্যাঁ ওটাই তো। গেটের সামনে। একটি মেয়ে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে না? চোখের জল টার জন্য সব কিছুই ঝাপসা লাগছে অয়নের। হাত দিয়ে চোখটা মুছে ও দেখল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে শৈলী। হাতে রয়েছে ওর ব্যাগ টা।
ও কি স্বপ্ন দেখছে? নিজেকে চিমটি কাটবে একবার? কিন্তু শৈলী কীভাবে এখানে…। ও তো ফোন করে নি। অয়ন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল শৈলীর দিকে।
বলল, “তুই? মানে… আজ…?
“কাকিমা ফোন করেছিল। শুনলাম তোর পরীক্ষা!” শৈলী বলল
“আমি বারণ করেছিলাম। আমি বারণ করেছিলাম মা কে। ধুর!” বলে উঠল অয়ন।
শৈলী ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, “চল। খিদে পেয়েছে তো? কিছু খাবি চল!”
(জানি প্রেডিক্টেবল!)
Ei lekha gulo porle prem uthle othe. Break up kore nite aar icche hoina. ❤️❤️