“A4 paper আছে?”

অনুকূলবাবুর দুপুরের ভাত টা খাওয়ার পর সবে একটু ঢুলুনি এসেছিল। এরকম সময় একটি কর্কশ গলার আওয়াজে ওঁর ভাতঘুম টা গেল চটকে।

অনুকূলবাবু চশমার ফাঁক দিয়ে ছেলেটিকে একবার দেখলেন। বয়স কম। উৎসাহ বেশী। এখন খুচরো ২-৫ টাকার A4 Paper বিক্রি করতে ওর ইচ্ছে করছিল না।

উনি বললেন, “আছে। কিন্তু Loose বিক্রি হয় না। কিনলে পুরো প্যাকেট কিনতে হবে”

“এক প্যাকেটে ক’টা থাকে?” ছেলেটির প্রশ্ন ছুটে এল সাথে সাথে।

“পাঁচশো” অনুকূলবাবুর দায়সারা উত্তর।

ছেলেটি তাতেও না দমে গিয়ে বলল, “দাম কত ওটার?”

অনুকূল বাবু বুঝলেন ঘুম টা ওঁর আজ হবে না। উনি বললেন, “২৫০ টাকা।”

ছেলেটি বলল, “ঠিক আছে। দিয়ে দিন। পেটিএম এ টাকা দেওয়া যাবে তো?”

বয়স ৫০ এর দোরগোড়ায় হলেও পেটিএম এর সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত অনুকূল বাবু। এই তো মাস তিনেক আগে একটা বড় লম্বা টাচ ফোন কেনার পরেই অনুকূল বাবুর ছেলে ওকে পেটিএম ব্যাপার টা শিখিয়ে দিয়েছে।
অনুকূল বাবু এবার ঘাড় নাড়লেন। অর্থাৎ দেওয়া যাবে।

ছেলেটি বলল ঠিক আছে। দিয়ে দিন। আর সাথে ৩ টে ক্যুরিয়ার খাম দেবেন। আর একটা বড় সেলোটেপ।

একটা বড় হাই তুলে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন অনুকূল মুখার্জী। তারপর পাশের একটা তাক থেকে বের করলেন A4 Paper এর একটা প্যাকেট। ছেলেটি কিছুক্ষন থেকেই নিজের পকেট হাতড়াচ্ছিল দেখে অনুকূলবাবুর একটু সন্দেহ হল।
ক্যুরিয়ার খাম তিনটে বের করে সামনে রাখার পরেই ছেলেটি হঠাৎ বলল, “ইয়ে… বলছিলাম যে কাকু…

অনুকূলবাবু জানেন ইয়ে আর বলছিলাম যে পাশাপাশি বসে কখনও একটা ভালো বাক্য তৈরী করতে পারে না। হলও ঠিক তাই।

ছেলেটি বলল, ” আসলে… আমি অন্য ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। আপনি এগুলো একটু রাখুন। আমি ওটা নিয়ে এসেই টাকা দিচ্ছি আমাকে।”

অনুকূলবাবু বললেন, “কোথায় বাড়ি তোমার?”

“এই তো সামনেই। মোড়ের মাথায়।”

ছেলেটি ডাহা মিথ্যেবাদী। মোড়ের মাথায় বাড়ি অথচ এই পাড়ায় আগে কখনও উনি দ্যাখেন নি ছেলেটিকে? হতেই পারে না। কিন্তু সেটার জন্য তো আর কাউকে মিথ্যেবাদী বলতে পারেন না। উনি বুঝলেন ওঁর ঘুম টা তো গেলোই আর বিক্রিও হবে না। ছেলেটি সম্ভবত বুঝতে পেরেছে এতগুলো ওর লাগবে না। সেই কারনেই এরকম একটা গল্প ফাঁদল।

“ঠিক আছে। নিয়ে এসো ফোন।” অনুকূল বাবুর গলায় একটা প্রচ্ছন্ন রাগ।

ছেলেটি বুঝতে পারল কী? তা উনি জানেন না। সাথে সাথে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল ছেলেটি। অনুকূলবাবু গজগজ করতে করতে A4 Paper টা যথাস্থানে রাখতে গিয়েই খেয়াল করলেন ব্যাপার টা। একটা কালো রঙের বস্তু ওঁর টেবিলের ওপর রাখা। বস্তুটি একটি মানিব্যাগ। এইমাত্র যে ছেলেটি বেরিয়ে গেল দোকান থেকে সম্ভবত তারই।

এবার? ছেলেটি কী আসবে আর দোকানে? মানিব্যাগ ফেলে গেছে মানে আসতে তো হবেই। আলতো করে মানিব্যাগে হাত দিয়ে ভেতর টা দেখলেন অনুকূলবাবু। একটা দশ টাকার নোট পড়ে আছে ভেতরে। তাও ছেঁড়া। নাহ! এর জন্য ছেলেটি আর আসবে বলে মনে হয় না।

মানিব্যাগ টা নিয়ে পাশের টেবিলের ওপর রেখে দিলেন অনুকূলবাবু। তারপর নিজের চেয়ারে বসে চোখ টা একটু বুজলেন। দেখা যাক, যদি ঘুম ধরে একটু। ঠিক ২ মিনিট পরেই আবার পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন তিনি। সেই ছেলেটি? হাসি মুখে ঢুকছে দোকানের দিকে। ওঁকে দেখেই বললেন, “কাকু? এসে গেছি আমি।”

“বাহ উদ্ধার করেছো তুমি আমায়!” কথাটা অবশ্য মনে মনে বললেন অনুকূল বাবু। ছেলেটি এসেই বলল, “কাকু আপনি আমায় আর একটা A4 Paper এর প্যাকেট দিয়ে দিন এরকম।”

অনুকূল বাবু অবাক হলেন আবার খুশিও হলেন। যাক তাহলে ছেলেটি সত্যি কথাই বলছিল। ছেলেটি পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের ওপর নিজের মানিব্যাগ দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল! “আরে এটা ফেলে গেছিলাম আমি?”

অনুকূল বাবু বললেন, “মানে? তুমি জানতে না তুমি ফেলে গেছো?”

ছেলেটি বলল, “না। আমি তো খেয়ালই করিনি! ইস!”

অনুকূল বাবু আর কিছু বললেন না। চেয়ার থেকে উঠে তাক থেকে নামিয়ে দিলেন দু’ প্যাকেট A4 Paper. তারপর ৩ টে ক্যুরিয়ার খামও দিলেন। ছেলেটি পেটিএম এ পেমেন্ট করে দিয়ে গেল। আসার সময় বলে গেল, “আসছি কাকু!”

অনুকূল বাবুর মুড টা বেশ ভালো হয়ে গিয়েছিল। উনিও হেসে বললেন, “হ্যাঁ এসো।”

কিন্তু মনের মধ্যে একটা খটকা যেন রয়েই গেল ওঁর। উনি বাইরে এলেন ছেলেটি কোন দিকে যায় সেটা দেখার জন্য। ওঁর দোকানের ঠিক পাশেই একটা রোল চাউমিনের দোকান। তার মালিক নিবারন চক্রবর্তী বাইরে চেয়ারে বসে পান চিবোচ্ছিলেন। ছেলেটিকে দেখেই হাত তুলে বললেন, “কি ব্যাপার শানু? ভালো আছো তো?”

“হ্যাঁ কাকু। ভালো!” ছেলেটি অর্থাৎ শানু হাত নাড়িয়ে প্রতি-উত্তর দিল।

অনুকূল বাবুর সাথে নিবারন বাবুর সম্পর্ক বেশ ভালোই। ছেলেটি চলে যাওয়ার পর অনুকূল বাবু চাউমিনের দোকানের মালিক কে জিজ্ঞেস করলেন, “নিবারন দা, তুমি চেনো ওই ছেলেটিকে?”

নিবারন বাবু পানের পিক ফেলে বলল, “হ্যাঁ রে। শানু। এই গত সপ্তাহে এসেছে এই পাড়ায়। বড় ভালো ছেলে। মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করে খাবার অর্ডার দেয়। তারপর ও বা ওর ভাই এসে নিয়ে যায়।”

অনুকূল বাবু বললেন, “কিন্তু তুমি চিনলে কীভাবে?”

নিবারন বাবু হেসে বললেন, “সে আর এক গল্প। আমার দোকানে এসে ২ টো মোগলাই অর্ডার দেওয়ার একটু পরে বলে মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছে! একটু পর এসে দিচ্ছে। আমি চিনতাম না ছেলেটিকে তাই প্রথম টা বিশ্বাস করিনি। তারপর ও দেখলাম ওর বাড়িতে মানিব্যাগ আনতে ছুটল। এদিকে আমি দেখলুম বেচারা একটা ফোন ফেলে গেছে আমার দোকানে। তারপর একটু পরে এল। এসে বলল, ও নাকি খেয়ালই করেনি ফোন টা ফেলে গেছে। ভাগ্যিস আমি দেখলাম! অন্য কেউ হলে তো ঝেড়ে দিত!”

“খুব ভালো ফোন নাকি?” অনুকূল বাবু জিজ্ঞেস করলেন।

নিবারন বাবু বললেন, “খুব ভালো ফোন নয়। ওই সুইচ টেপা। টাচ স্ক্রীন নয়। তাও ফোন তো! খুব দরকারী জিনিস ভায়া। তারপর পাশের বংশীর চপের দোকানেও মানিব্যাগ ফেলে গেছিল ছেলেটি। সাথে সাথে ফিরে আসে যদিও। আসলে খুব ভুলো মন ছেলেটার।”

অনুকূল বাবু হেসে “হ্যাঁ সেটাই” বলে নিজের দোকানে ফিরে এলেন। অদ্ভুত তো। পর পর তিন’টে দোকানেই একই রকম জিনিস? এ তো ভারী আশ্চর্য ব্যাপার!

হঠাৎ ফোন টা বেজে উঠল অনুকূল বাবুর। অচেনা নাম্বার। ফোন টা ধরার পরেই ও প্রান্ত থেকে আওয়াজ এল, “হ্যালো কাকু, আমি শানু বলছি। একটু আগেই আপনার দোকানে…

“হ্যাঁ বলো। তুমি আমার নাম্বার পেলে কীভাবে?” অনুকূল বাবু ওকে কথা শেষ করতে দেওয়ার আগেই জিজ্ঞেস করলেন।

“ওই তো দোকানের বাইরেই লেখা আছে।” শানু বলল।

অনুকূল বাবুর খেয়াল হল। ও হ্যাঁ তাই তো!

“হ্যাঁ। বলো কী বলবে?”

শানু বলল, “কাকু আমি বোধহয় খামগুলো ফেলে এসেছি। একটু দেখবেন?”

অনুকূল বাবু এইমাত্র খেয়াল করলেন তিনটে ক্যুরিয়ার খাম টেবিলের ওপরেই পড়ে আছে। উনি সব গুলোই নামিয়ে টেবিলের ওপর রেখেছিলেন। সেটাও ছেলেটা নিতে ভুলে গেছে!

“হ্যাঁ আছে এখানেই” অনুকূল বাবু বললেন।

শানু বলল, “ঠিক আছে। আমি আমার ভাই কে পাঠাচ্ছি। একটু দিয়ে দেবেন?”

অনুকূল বাবু হেসে বললেন, “আচ্ছা পাঠাও।”


ফোন রাখার পর পুরোনো একটা ফোনের পাশে নিজের এই মানিব্যাগ টা রেখে দিল শানু।

কানু জিজ্ঞেস করল, “এগুলো রেখে দিস কেন রে? ব্যবহার তো করিস না। ফেলে তো দিতে পারিস।”

কানু ওর ভাই। ওর থেকে বছর পাঁচেক এর ছোটো।

শানু বলল, “তুই বুঝবি না এগুলোর কি মাহাত্ম্য। যা ওই বই খাতার দোকান থেকে তিনটে খাম এনে দে।”

ওরা এই পাড়ায় এসেছে বেশীদিন হয় নি। শানু একটা জিনিস খুব ভালো জানে কোনো মানুষ তোমাকে এমনি এমনি মনে রাখবে না। তার জন্য তোমায় একটু আলাদা হতেই হবে। আর যদি আলাদা হতে না পারো তাহলে এমন কিছু করো যাতে লোকজন তোমায় মনে রাখে। নাহলে কোনো দোকানে ফোন করে তুমি যদি বলো দাদা আমি অমুক বলছি ২ দিন আগে A4 Paper কিনতে গিয়েছিলাম। কেউ মনে করতে পারবে না তুমি কে!
কাজেই বিভিন্ন দোকানে এই ধরনের ঘটনাগুলোর অর্থ হল লোকজন এরপর মনে রাখবে এই ছেলেটা মানিব্যাগ ফেলে গিয়েছিল। কিংবা এই ছেলেটা ফোন ফেলে গিয়েছিল।

অর্থাৎ এবার ফোন করে মোগলাই অর্ডার করলে অর্ডার টা বানানোই থাকবে। কিংবা চপ দোকানে বলা থাকলে চিকেন চপ রাখা থাকবে। অর্থাৎ একদিনের খাটনির উপকারিতা হিসেবে রোজ পাঁচ মিনিট করে কম খাটনি।

পুনশ্চ – ওপরের শব্দটার মানে হল ‘কুঁড়ে’.

খট্বারুঢ়

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি