জাদুকরের কথা

“আজকে আমাদের এই ম্যাজিক শো শেষ করার সময় হয়ে গিয়েছে। তবে যাওয়ার আগে আরও একবার আপনাদের মোহিত করার জন্য আমার সেরা খেলা দেখানোর সময় হয়ে গিয়েছে।” – জাদুকর বললেন।

দর্শক আসনে বসে থাকা প্রায় সকলেই চেঁচিয়ে উঠলেন উচ্ছাসে। জাদুকর এ.সি. সরকার এর শো যারা দেখেছেন আগে তারা প্রায় সবাই জানেন কি খেলার কথা বলছেন ম্যাজিশিয়ান।

জাদুকর বললেন, “আমার সামনে ২ টো কাঁচের Bowl আছে। তার একটাতে লেখা আছে Row Number. অর্থাৎ এই হল এর যতগুলো ROW আছে। তার নাম্বার লেখা আছে একটা Bowl এ। এবং আর একটা Bowl এ আছে সীট নাম্বার। আমার এই খেলা তে প্রয়োজন আপনাদের মধ্যে থেকে একজন কে। কে আসতে চান বললে বেশীরভাগ জায়গাতেই প্রায় মারামারি শুরু হয়ে যায়। সেই জন্যেই এই ব্যাবস্থা।”

জাদুকরের সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে এল সামনে। লটারির এই কাজ টা ওকেই করতে হয় সাধারনত।

জাদুকর এবার ওঁর সহকারী কে বললেন, “Will you do the Honor Please?”

হঠাৎই দর্শকদের মধ্যে একটা চাপা নীরবতা। কার সীট নাম্বার ওঠে লটারীতে সেই অপেক্ষায় রয়েছে সকলে। মহিলাটি প্রথম Bowl এ হাত ঢুকিয়ে বের করলেন একটি কাগজ। তারপর এগিয়ে দিলেন জাদুকরের দিকে। জাদুকর কাগজ টা খুলে বললেন, “আমার কাছে রয়েছে Row Number….. H”

আবার উচ্ছাসে ফেটে পড়ল হলঘর। Row Number H এ তখন একটা অদ্ভুত টেনশন। সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে জাদুকর এর অ্যাসিস্ট্যান্ট এর দিকে। এবার সীট নাম্বার তোলার পালা।  অ্যাসিস্ট্যান্ট টি এরপর দ্বিতীয় Bowl থেকে তুলে আনলেন আর একটি কাগজ। তারপর একইভাবে পৌঁছে দিলেন জাদুকরের হাতে। জাদুকর কাগজ টা খুলে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, “সীট নাম্বার আমরা পেয়ে গেছি। নাহ বেশী টেনশন দেবো না আর। আজ আমার কাছে Stage এ আসছে H-16। দেখি কে আছে H-16 এ?”

আবার  চিৎকার করে উঠল সারা হল। পেছনের সারিতে বসে থাকা লোকটি এবার একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। এরা যতটা না পারে, তার চেয়ে বেশী দেখায়। একে শীতকাল তার ওপর হলে AC চলছে। সব মিলিয়ে বেশ ঠান্ডাই লাগছে। কাজেই ওভারকোটের কলার তুলে মুখ ঢাকা দিয়ে লোকটি নিশ্চিন্তে বসে মাপছে সবাই কে।

একটু পরেই ম্যাজিশিয়ান এর আর একজন সহকারী এসে Escort করে নিয়ে গেলো H-16 এ বসে থাকা মেয়েটিকে। মেয়েটির মুখ চোখে যেন চাপা একটা ভয়। Nervous লাগছে কী?

Stage এ নিয়ে যাওয়ার পর জাদুকর হাত বাড়িয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে। তারপর বললেন, “আপনার নামটা যদি একটু বলেন।

মেয়েটি বলল, “আমার নাম সুনন্দিতা… সুনন্দিতা চক্রবর্তী।”

–       “আপনি কার সাথে এসেছেন এখানে আজ?”

–       “আমার স্বামীর সাথে। ওই যে বসে আছেন আমার পাশের সীট এ।”

সবাই তাকালো সেদিকে। পেছনে মুখ ঢেকে বসে থাকা লোকটি তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে Stage এ থাকা মেয়েটির দিকে। জাদুকর এবার বললেন, “দর্শক আসনে যারা রয়েছেন তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না আমার শেষ খেলাটা কী। তাদের জন্য আরও একবার বলি… এই খেলার নাম বর্ষ চক্র। আমাদের প্রত্যেকেরই বয়সের একটা চাকা রয়েছে। যেটা একই দিকে ঘুরছে আর তার ফলে আমাদের বয়স ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। আমার হঠাৎ একদিন মনে হল এই চাকাটা কি উলটো দিকে ঘোরানো যায় না? মানে বয়স টা হঠাৎ কি একটু কমিয়ে দেওয়া যায় না? তারপরেই অনেক সাধ্য সাধনা করে আমি এক অভিনব Trick এর খোঁজ পেয়েছি। বয়স কমানো যায়। সেটা আজ আপনাদের সামনে আমি দেখিয়ে দেবো করে। আমার সাথে Stage এ যিনি রয়েছেন তার বয়স আমি অন্তত ১৫ বছর কমিয়ে দেবো। এটাই আমার শেষ খেলা।”

উচ্ছাসে ফেটে পড়ল দর্শকেরা। জাদুকরের দুজন পুরুষ সহকারী এবার একটা কাঠের বড় বাক্স নিয়ে এল Stage এ। বাক্সটির সামনে একটা Wheel। সেটা ডানদিক বাঁদিকে ঘোরানো যায়! তার ঠিক ওপরেই একটা নাম্বার লেখা জায়গা রয়েছে। Wheel টা বাঁদিকে ঘোরালে সেটা মাইনাস সহযোগে বাড়ে অর্থাৎ বয়স কমছে ইঙ্গিত করে এবং ডানদিকে ঘোরালে সেখানে প্লাস সহযোগে বাড়তে দেখা যায়।

জাদুকর এবার Stage এ দাঁড়ানো মহিলা কে বললেন, “আপনি তৈরী তো?”

মহিলা ঘাড় নাড়তেই। জাদুকরের সুন্দরী সহকারী ওই বাক্সের দরজা খুলে দিলেন। বাক্সটিতে একজন ৬ ফুট লম্বা মানুষ অনায়াসে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। সেই জায়গা ভেতরে রয়েছে। জাদুকর এবার দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনার ভালো করে এই বাক্সটা দেখুন। এই বাক্সের মধ্যেই যা ঘটার ঘটবে… আমি এখন সুনন্দিতা দেবী কে অনুরোধ করবো এই বক্সটির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য”

পেছনে বসে থাকা লোকটি আবার হাসল। যত্তসব বুজরুকি। সব ম্যাজিক বক্স এর মধ্যেই। সামনে করার দম নেই কারুর। ততক্ষনে Stage এর ওপরে থাকা ভদ্রমহিলা গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বক্স এর মধ্যে। বক্স এর দরজা বন্ধ করে দিলেন সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্ট।

তারপর জাদুকর এগিয়ে গেলেন বক্স এর সামনে। তারপর বললেন, “আপনারা আমার সাথে গুনতে থাকুন সবাই। আমি যতগুলো Wheel ঘোরাবো। তত বয়স কমবে ওঁর। Let’s Start.”

বলেই ম্যাজিশিয়ান বাঁদিকে ঘোরাতে শুরু করলেন বক্স এর বাইরের Wheel টি কে।

“এক” চেঁচিয়ে উঠল দর্শক।

“দুই”… “তিন”… করতে করতে “১৫” তে গিয়ে থামলেন জাদুকর এ.সি. সরকার।

“সবাই তৈরী তো?” জিজ্ঞেস করলেন জাদুকর।

“হ্যাঁ। একযোগে উত্তর দিল।” দর্শকেরা।

জাদুকর এবার তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট কে ইশারা করতেই তিনি খুলে দিলেন বক্স এর দরজা। দেখা গেল বক্স এর মধ্যে রয়েছে একটি ১৩-১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটিকে হাত ধরে বক্স এর বাইরে নিয়ে এলেন ওই মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট।

“তোমার নাম কী?” জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিশিয়ান

মেয়েটার চোখ মুখের অবাক ভাব এখনও কাটেনি। মেয়েটি বলল, “আমার নাম সুনন্দিতা… সুনন্দিতা চক্রবর্তী।”

“তুমি কার সাথে এসেছো আজ?” আবার জিজ্ঞেস করলেন জাদুকর।

“ওই তো… ওর সাথে…” মেয়েটি হাত তুলে দেখালো স্টেজের একেবারে সামনে এগিয়ে আসা ভদ্রলোকের দিকে। তাঁর চোখ বিস্ফারিত। তিনি ভাবতেও পারছেন না, এই জিনিস ও হতে পারে।

জাদুকর বললেন, “সময় আর নেই আমাদের হাতে। আজ আমাদের শো এখানেই শেষ হল। আমি জাদুকর এ সি সরকার। Good Night সবাই কে।

কথাটা বলার সাথে সাথেই পর্দা পড়ে গেল স্টেজ এর। সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামীর গলা শোনা গেল একবার, “আর আমার স্ত্রী? ও কোথায়?”

কেউ উত্তর দিল না।

পেছনে ওভারকোট পরা ভদ্রলোক কে আর দেখা যাচ্ছে না। তিনিই সবার আগে হল থেকে বেরিয়েছেন সম্ভবত।

একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে গ্রীন রুমে ঢুকলেন সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামী। চেঁচিয়ে বললেন, “আমার স্ত্রী কোথায়?”

জাদুকর এ সি সরকার তখন নিজের মেকআপ তুলছিলেন। না তাকিয়েই বললেন, “ওই গ্রীন রুমে দেখুন। ওখানেই থাকার কথা।”

–       “ওখানে নেই… আমি দেখেই এলাম।”

–       “তাহলে হয়তো বাথরুমে গেছেন। অপেক্ষা করুন। পেয়ে যাবেন বৌ কে।”

সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামী তখন রাগে ফুঁসছে, “হয়তো মানে? আপনারা কেউ জানেন না? একটা দায়িত্বজ্ঞান নেই?”

এ সি সরকার এবার বিরক্ত হলেন, বললেন, “আহ! একি বাচ্চা মেয়ে নাকি? দেখুন নিজেই বাড়ি চলে গেছে হয়তো।”

ভদ্রলোক এর পরেও চেঁচামেচি করতে থাকায়, জাদুকরের হুকুমে দু’জন সহকারী এসে টেনে নিয়ে গেল ওঁকে। তারপর বাইরে বের করে আটকে দিল দরজা।

ভদ্রলোক তখন চেঁচিয়ে বলছেন, “এটা কি ইয়ার্কি নাকি? আমি দেখে নেবো? অন্য লোকের স্ত্রী কে কিডন্যাপ করা? আমি পুলিশে নিয়ে আসছি।”

ঐন্দ্রজালিক পাত্তা দিলেন না। এসব ফালতু হুমকি তে কিচ্ছু আসে যায় না ওঁর।

থানায় ঢুকে দাদার ঘরে ঢুকতে যেতেই একজন কনস্টেবল আটকাল আমাকে। হাত টা নো বলের মত সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল, “কোথায় যাবেন?”

রোজ রোজ এই এক জিনিস! এরা কী কিছু মনে রাখে না! বিরক্তিকর! বললাম, “নীলাদ্রী সেনের কাছে যাবো।”

লোকটি হাত টা না নামিয়েই বলল, “হ্যাঁ, সেতো ওনার ঘরের দিকে এগোচ্ছেন মানে ওর কাছে যাবেন বুঝতে পারছি। কিন্তু উনি এখন ব্যস্ত আছেন। মিটিং এ।”

আমার মাথাটা আজ এমনিতেই গরম ছিল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন যেন ওই কনস্টেবল কে ধমক দিয়ে উঠল, “কার সাথে কী কথা বলছিস সেটা একটু ভেবেচিন্তে বল!”

গলাটা শুনেই চিনলাম আমি। জয়ন্তদার গলা। জয়ন্ত দা সাব-ইন্সপেক্টর। দাদার আন্ডারেই কাজ করে।  কনস্টেবল লোকটি আর কিছু বলল না। জয়ন্ত দার সাথে হাসি বিনিময় হল।

আমি দাদার ঘরে ঢুকে দেখলাম একটি ছেলে বসে আছে দাদার উলটো দিকের চেয়ারে। আমাকে দাদা ইশারা করল পাশেরটায় বসার জন্য। তারপর সামনের ছেলেটি কে বলল, “শোনো তুমি কী বলছো আমার মাথায় ঢুকছে না। আর অত সময়ও নেই আমার। পুলিশের কাজ পুলিশ কে করতে দাও।”

ছেলেটি বলল, “মাথায় যদি না ঢোকে তাহলে আর কাজ টা করবেন কীভাবে? সেটা ভেবে দেখেছেন কী?”

দাদা এবার একটু রাগতস্বরেই বলল, “এই যে চেয়ার টা দেখছো, এখানে এমনি এমনি বসে নেই। তুমি কী করো হে? আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছো?”

ছেলেটি বলল, “ওই যে যেগুলো আপনাদের মাথায় ঢোকে না সেগুলো তে মাথা খাটিয়ে সংসার চালাই!”

আমার এবার একটু অবাক লাগল। ব্যাপার টা কী? পুলিশের সাথে কথা বলতে গিয়ে সাধারনত মানুষ একটু হোঁচট খায়। এতো দেখছি সিক্সার মারছে!

দাদা বলল, “তুমি ভাই আজ এসো। আমার অনেক কাজ আছে। দিবাকর দা বলেছিলো বলে তোমার কথা শুনতে বসেছিলাম। আর খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছি না।”

ছেলেটি উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। তারপর আমার দিকে একবার দেখে দাদাকে বলল, “হুম। ভেবে দেখুন যদি মাথায় ঢোকে কিছু।”

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দাদাকে কিছু বলার আগেই আমার দিকে ফিরে দাদা জিজ্ঞেস করল, “ঘর পেলি তুই?”

বললাম, “নাহ পাইনি! ছেলেটা কে ছিলো?”

দাদা বলল, “ধুর! He is a nobody. বেকারত্বের জ্বালায় নিজেকে কী না কী ভাবছে! বাদ দে।”

–       “কী ভাবছে শুনি!”

“তুই কি এখনও হোটেলে?” দাদার এই প্রশ্নবান গুলোর জন্যেই আমি ওর সাথে দেখা করা কমিয়ে দিয়েছি।

বললাম, “হ্যাঁ হোটেলে। বলছিলাম যে এই প্রশ্নগুলো এবার থাক না। রোজ রোজ একই উত্তর দিতে ভালো লাগছে না।”

দাদা আমার কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই তোর আংটি কি হল? মুক্তো বসানো সোনার আংটি টা?”

–       আরে হাতে বড্ড টাইট হচ্ছিল। আঙুলে লাগছিল। তাই খুলে রেখেছি। দোকানে দেবো।”

–       ওটা খুলতে বারন করেছিল কাকিমা তোকে।

–       আঙুলে টাইট হলেও পরে থাকবো নাকি? যাই হোক। বল কেন ডাকলি আজ আমায়?

–       কাকিমা ফোন করেছিল আজ আমাকে।

–       আবার? উফফ! এতো মহা জ্বালা!

–       তুই ওঁর কষ্ট টা একবার বোঝ! নিজের ছেলে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে থাকছে। তুই ওনার জায়গায় থাকলে কী করতিস?

–       এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে! আমি কি কচি খোকা নাকি?

–       তুই ফিরে আয় না এবার! কাকিমা বড্ড কষ্টে রয়েছে।

–       নাহ রে। ও বাড়িতে আমি আর ফিরবো না। আর তাছাড়া বাড়ির মালিকের তো আমার বাঁচা মরা নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই। তাহলে ফিরে কি লাভ বলতো?

সেই লোকটি এসে এবার সিঙাড়া আর দু’কাপ কফি দিয়ে গেল।

দাদা বলল, “কাকুর ওপর রাগটা তুই আমাদের সবার ওপর কেন দেখাচ্ছিস? প্লিজ ফিরে আয়। কতদিন এভাবে থাকবি। একটা চাকরিও তো নেই এখন তোর হাতে।”

আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। বললাম, “চাকরি তো আমি করব না সেটা আগেই জানিয়েছি। যেটা করতে বেরিয়েছি সেটা ঠিকই করব।”

কথাটা বলেই দাদা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম ওর ঘর থেকে।

থানা থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাটছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজে হাঁটার গতি কমল আমার।

কেউ একজন বলল, “এই যে শুনছেন?”

পেছনে তাকিয়ে দেখলাম। থানার সেই ছেলেটি। বললাম, “শুনলাম। বলুন।”

লোকটি বলল, “তা লেখক বাবু কী থাকার জন্য ঘর খুঁজছেন?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। তা তো খুঁজছি। কিন্তু আপনাকে কে বলল?”

ছেলেটি বলল, “কে আবার বলবে? দেখে শুনে মনে হল?”

–       তাই? কীরকম? একটু শুনি তো!

ছেলেটি বলল, “আপনি দেখলাম থানা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে উলটো দিকের Oxford Bookstore এর দিকে খানিকক্ষন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর এগোতে গিয়েও নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়েই পিছিয়ে এলেন। অর্থাৎ খেয়াল হল আপনার কাছে টাকা নেই। আর আপনার শান্তিনিকেতন মার্কা ঝোলাব্যাগ থেকে একটা পান্ডুলিপি উঁকি মারছে। টাকা নেই অথচ পান্ডুলিপি নিয়ে ঘুরছেন মানে লেখক ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার চান্স একটু কম। আর না হলেও আজকাল দু’লাইন লিখেই লোকজন এমনভাবে নিজেকে হনু ক্লেম করছে যে সবাই এখন লেখক।”

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “আর বাড়ি খুঁজছি কে বলল?”

ছেলেটি বলল, “আপনার দাদা।”

–       মানে? কখন?

–       ওই তো আমি যখন বেরোচ্ছিলাম তখন আপনাকে জিজ্ঞেস করল, ঘর পেয়েছেন কিনা! ওটা শুনে মনে হল।

আমি বললাম, “হুম। খুঁজছি।”

ছেলেটি বলল, “আংটি বিক্রি করে কত পেয়েছেন?”

আমি একটু চমকে গিয়ে বললাম, “ বিক্রি করে মানে? বুঝলাম না। ওটা হাতে লাগছিল তাই খুলে রেখেছি। আর আপনাকে কে বলল আংটির ব্যাপার টা?”

ছেলেটি বলল, “ওসব পরে হবে। বাদ দিন। আপাতত যেটা বলার সেটা হল ফ্ল্যাট শেয়ার করবেন কী? আমার সাথে?”

আমি বললাম, “With All Due Respect আমি তো আপনাকে ঠিক চিনি না, জানিনা। অচেনা মানুষের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকাটা একটু Odd. কিছু মনে করবেন না।”

–        “একদম। I understand. No Problem. আমার কার্ড টা রাখুন মাইন্ড চেঞ্জ করলে ফোন করে নেবেন।”

কার্ড টা হাতে নিয়ে আবার অবাক হলাম। কার্ডের ওপর লেখা আছে, S.H. আর তার নীচে ফোন নাম্বার, ইমেইল আইডি। জিজ্ঞেস করলাম “S.H. মানে? আপনার নাম টা…?

ছেলেটি হেসে বলল, “ওহ! আচ্ছা! আমার নাম… শারদ্বত… শারদ্বত হাজরা।”

সেদিন যখন হোটেলে ফিরলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। হোটেলে ঢোকার সময়েই ম্যানেজার ডাকলেন, “দাদা একবার আসবেন তো!”

গেলাম রিসেপশনের দিকে। ম্যানেজার আমাকে বললেন, “ইয়ে মানে… আপনি তো অ্যাডভান্স দিয়েছিলেন হোটেলে চেক ইন করার সময়। বাকি তো আরও প্রায় ৬ দিনের রয়েছে। ওটা একটু দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কত হয়েছে ৬ দিনে?”

উনি কম্পিউটার স্ক্রীনে কি একটা দেখে বললেন, খাওয়া দাওয়া সহ, ৪৬০০/- টাকা।

ওয়ালেট থেকে বের করে ৫০০০ টাকা দিয়ে দিলাম। বলে দিলাম জমা রাখতে।

আংটির টাকাও প্রায় শেষ। এবার যে কী হবে? শেষ পর্যন্ত কি বাড়িতেই ফিরতে হবে? কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথেই মন টা শক্ত করলাম। অসম্ভব। ওই বাড়িতে আমি আর ফিরবো না। তার জন্যে যদি ভিক্ষে করতে হয় তাও ভালো।

চাবি খুলে ঘরে ঢুকতে গিয়েও বুক টা ধ্বক করে উঠল। ভেতর থেকে টিভি চলার আওয়াজ আসছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আজ সকালে আমি একবারও টিভি চালাই নি। দরজাটায় হালকা করে চাপ দিতেই খুলে গেল। হোটেলের লোকজন কে ডাকব কিনা ভাবছিলাম। পা টিপে টিপে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি বিছানার ওপর পা তুলে বসে আছে স্বয়ং শারদ্বত হাজরা।

আমাকে দেখে বলল, “আরে অনিরুদ্ধ, বলছিলাম যে কিছু ভাবলেন নাকি?”

আমি বললাম, “আপনি ঘরে ঢুকলেন কীভাবে?”

শারদ্বত বলল, “ওই তো দরজা দিয়ে। যেভাবে সবাই ঢোকে। আমার প্রস্তাব টা নিয়ে কিছু ভাবলেন?”

আমি এবার বিরক্ত হলাম। প্রাইভেসি বলে কিছু নেই নাকি? এই জন্যে দাদা ওরকম ভাবে তাড়িয়ে দিল অফিস থেকে। এ ছেলে মোটেই সুবিধের নয়।

বললাম, “এই তো ঘন্টাখানেক আগে আপনাকে না বললাম। আবার ফলো করে করে এখানেও চলে এসেছেন? আপনার মনে হয় এরপর আমি আপনাকে হ্যাঁ বলব?”

শারদ্বত বলল, “গল্প লিখছেন এখন কিছু?”

প্রশ্নটায় আমি একটু থমকে গেলাম। কি জিজ্ঞেস করলাম আর কি উত্তর দিল।

আমি বললাম, “নাহ। এই মুহুর্তে কিছু লিখছি না। কেন?”

–       লিখতে চান?

–       লিখতে চাইলেই তো হল না। ভালো প্লট চাই তো।

–       বাস্তব জীবন থেকে প্লট দিলে লিখবেন নাকি?

–       এ আবার কি হেঁয়ালি মার্কা কথা বার্তা?

–       আপনার ওপরের ফ্লোরে। যাবেন নাকি?

আমি বললাম, “দেখুন, আমার মাথায় এমনিতেও অনেক চাপ রয়েছে। এখন এসব হেঁয়ালি ভালো লাগছে না। আপনি কি যাবেন নাকি আমি হোটেলের লোককে ডাকব?”

শারদ্বত বলল, “এক ঘন্টা। ওপরের ফ্লোরে আমার সাথে চলুন। ভালো না লাগলে বা আপনার কোনো কাজে না লাগলে নেমে চলে আসবেন। আপনাকে আমি আর বিরক্ত করব না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাহ এর হাত থেকে মুক্তি নেই। বললাম, “ঠিক আছে চলুন।”

শারদ্বত বলল, “বেশ। আর একটা শর্ত আছে।”

–       আবার কী?

–       আপনি টা ভালো লাগছে না। যেখানে আমরা যাচ্ছি সেখানে পরস্পর পরস্পর কে তুমি বলে সম্বোধন করাটাই ভালো।

–       কেন? কোথায় যাচ্ছি আমরা?

শারদ্বত বলল, “আরে চলো না। দেখতে পাবে।”

বাবাহ! এ তো যেমন বলা তেমন কাজ! সঙ্গে সঙ্গে তুমি তে নেমে গেলো। যাই হোক হোটেলের ঘর চাবি দিয়ে শারদ্বতর সাথে উঠে গেলাম ওই হোটেলেরই ঠিক ওপরের ফ্লোরে।

ওপরের ফ্লোরে উঠে শারদ্বত একটা ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা মারল বার কয়েক। কিছুক্ষন পর একটা বেঁটে মত লোক এসে খুলে দিল দরজা। তারপর শারদ্বত কে বলল, “আরে স্যার। আসুন আসুন। আপনার জন্যেই সবাইকে নিয়ে এসচি।”

শারদ্বত আমাকে ইশারা করল ভেতরে আসার জন্য। গেলাম ওর পেছন পেছন। ভেতরে গিয়ে ২ টো চেয়ারে বসলাম আমরা। ঘরের মধ্যে রয়েছেন ৩ জন। একজন কম বয়সী মহিলা। মাথা নীচু করে বসে আছে। আর একজন চশমা পরে সন্দেহজনক ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে। আর ওই বেঁটে মতন লোকটি। যে দরজা খুলে দিল আমাদের। সে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পাশে যেন আমাদের হুকুমের অপেক্ষায় রয়েছে। শারদ্বত তাকে বলল, “নিমাই বাবু, প্রথমে আপনার সাথে কথা বলব। বাকিদের একটু বাইরে করিডরে অপেক্ষা করতে বলুন।”

নিমাই বাবু নামের লোকটিকে আর কিছু বলতে হল না। বাকি দু’জন বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বেরোবার ঠিক আগে শারদ্বত বলল, “ও… ইয়ে…

ফিরে তাকালো দু’জনেই। “কাছাকাছিই থাকবেন। কোথাও যাবেন না। আর দরজাটা বন্ধ করে দিন” , বলল শারদ্বত।

নিমাইবাবু এবার আমাদের সামনে এসে বসলেন বিছানায়। বললেন, “বলুন স্যার। কী জিজ্ঞাসা করবেন করুন।”

শারদ্বত পকেট থেকে সিগারেট টা বার করে বলল, “সে করছি। তার আগে পুরো কেস টা আর একবার বলুন তো। অনিরুদ্ধ জানেনা এখনও কিছু।”

কথাটা বলে আমাকে আর নিমাইবাবুকে সিগারেট অফার করল ও। আমি না বললাম। নিমাইবাবু একটা নিয়ে পকেটে রেখে দিলেন।

শারদ্বত ভুরু কুঁচকে বলল, “সিগারেট খাও না?”

আমি বললাম, “কিছুই খাই না! তুমি আমার নাম জানলে কীভাবে? আমি তো বলিনি!”

–       ভাত, রুটি?

–       ওগুলো খাই।

–       তাহলে কিছুই খাই না বললে কেন?

–       মানে… নেশার জিনিস কিছু খাই না। নামটা কীভাবে জানলে সেটা বলো না।

–       নেশা? কে বলে নেশা?

আমি আর কিছু বললাম না। এ উত্তর দেবে না আমার প্রশ্নের। নিমাইবাবুর দিকে ফিরে বললাম, “হ্যাঁ। আপনি বলুন।”

বলে তো দিলাম। কী বলবে, কেন বলবে কিছুই তো জানিনা ছাই! আর আমিই বা এখানে কী করছি সেটাই জানিনা! এই শারদ্বত ছেলেটা বড় অদ্ভুত। একি তবে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর? মানে গোয়েন্দা নাকি? রিয়েল লাইফ গোয়েন্দা? বাবাহ! এরাও মার্কেটে টিকে আছে এখনও।

“অনিরুদ্ধ?” আবার আমার নাম ধরে ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরল।

–       হ্যাঁ বলো।

–       কীসের এত চিন্তা তোমার? কেস টা শুনবে যে!

উফফ! এই ছেলেটা বড্ড ঘ্যানঘ্যান করে!

বললাম, “হ্যাঁ। শুনবো তো। নিমাইবাবু, বলুন।”

নিমাইবাবু বললেন, “আমরা তিনজনেই জাদুকর এ.সি. সরকারের জন্য কাজ করি। উনি খুব বিখ্যাত জাদুকর। বিভিন্ন জায়গায় শো করেন। আমরা সাথে থাকি। বহুদিন পর কলকাতায় এসেছিলাম শো করতে। আমাদের একটা খুব বিখ্যাত খেলা হচ্ছে বয়স কমানোর খেলা। দর্শক আসন থেকে একজন কে ডাকা হয়। তারপর একটা বক্সে ঢুকিয়ে তার বয়স ১০-১৫ বছর কমিয়ে দেওয়া হয়। এটাই হল খেলা টা।”

“আর ব্যাপার টা কীভাবে ঘটে সেটা বলুন।” শারদ্বত সিগারেটে টান দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল।

নিমাইবাবু বললেন, “আমাদের আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয় কাকে ডাকা হবে স্টেজে। সেই অনুযায়ী আমরা একটা বাচ্চা মেয়ে বা ছেলেকে যোগাড় করি।”

আমি বললাম, “এক সেকেন্ড? নাম, পরিচয় কীভাবে জানেন?”

–       আসলে স্যার আমাদের এখানে যারা টিকিট কাটে সবাই কেই নিজের যেকোনো একটা আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার দিতে হয়। আমরা বলি এটা Security র জন্যে। কিন্তু আসলে এটা পরিচয় বের করার জন্যে।

–       ঠিক আছে। তারপর বলুন।

–       তারপর স্টেজে ডেকে একটি বক্সের মধ্যে ঢুকতে বলা হয় ওই ছেলে বা মেয়েকে। ওই বক্সের নীচের দিকটা খোলা যায়। ওটা খুলে দিয়ে ওই মহিলাকে নীচ দিয়ে গ্রীনরুমের নিয়ে গিয়ে বসানো হয়। আর বাচ্চাটিকে ওপরে তোলা হয়। এর মধ্যেই ওই জাদুকর বাইরে কিছু কথা বলেন। এটা সেটা বলে সময় কাটান কিছুক্ষন। তারপর যখন বাক্সটা খোলা হয় তখন দেখা যায় ওখানে বাচ্চাটা রয়েছে। সেই বাচ্চাটাকে আগে থেকেই সব শিখিয়ে পড়িয়ে রাখা হয়। সে সেইমত সব উত্তর দেয়।

শারদ্বত বলল, “অর্থাৎ পিওর বুজরুকি যাকে বলে! তার ওপর আধার কার্ড থেকে মানুষের তথ্য বের করছেন। মানে Invasion of Privacy. আপনাদের তো গুনের শেষ নেই!”

নিমাইবাবু বললেন, “এগুলো স্যার আমাদের কোনো দোষ নেই। আমাদের বস সবটা হ্যান্ডেল করেন। অনেক ওপরমহল অবধি হাত আছে ওনার।”

শারদ্বত হেসে বলল, “তাই যদি আছে, তাহলে আপনি আমাকে ডাকলেন কেন? ওপরমহলে খবর দিলেন না কেন?”

“এটাও স্যার ওই বসের হুকুম” নিমাইবাবু বললেন, “তার কারণ বোধহয় এই সব আধার কার্ডের ব্যাপার স্যাপারে ওপরমহলের কেউ জড়িত জানতে পারলে তো খুব রিক্স হয়ে যাবে।”

আমি বললাম, “রিস্ক।”

নিমাইবাবু বললেন, “হ্যাঁ স্যার রিক্স। বোঝেনই তো।”

–       সে আমি বুঝেছি। কিন্তু রিস্ক! রিক্স না।

–       আজ্ঞে স্যার?

শারদ্বত আমাকে বলল, “ছেড়ে দাও। ওটা হওয়ার নয়।” তারপর নিমাইবাবু কে বলল, “আপনি বলতে থাকুন। তারপর কী হল?”

নিমাইবাবু আবার শুরু করলেন, “হ্যাঁ তো প্রত্যেকবার যেটা হয় শো শেষের পর ওই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা কে আমরা ছেড়ে দিই। যে যার নিজের মত বাড়ি চলে যান। সেদিনও আমাদের শো এর পর তাই হয়েছিল। ভদ্রমহিলাকে বলেছিলাম বাড়ি চলে যেতে। বা যদি চেনা কেউ ভেতরে থাকে তাহলে তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে। তারপর থেকেই ঐ মহিলা কে পাওয়া যাচ্ছে না!”

আমি বললাম, “পাওয়া যাচ্ছে না মানে? মিসিং?”

শারদ্বত ভর্ৎসনার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “পাওয়া যাচ্ছেনা মানে মিসিং হয় অনিরুদ্ধ। বেসিক ইংরেজী।”

উফফ! মাঝে মাঝে বড্ড চালিয়াৎ এর মত আচরন করে ছেলেটা। এর সাথে এক ফ্ল্যাটে। ভাবাই যাচ্ছেনা!

নিমাইবাবু বললেন, “হ্যাঁ স্যার। মিসিং। ওঁর স্বামী এসেছিলেন ওখানে। খুব হল্লা করলেন। স্যার পাত্তা দেন নি। তারপরের দিন সকালেই পুলিশ এসে স্যার কে তুলে নিয়ে যান।  কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার ওরকম মানুষ না। একটু রগচটা। তাড়াতাড়ি রেগে যান। কিন্তু… মানে অকারনে একজন মহিলাকে উনি কেন কিডন্যাপ করবেন?”

শারদ্বত বলল, “এটা ঘটার পরের দিন সকালেই নিমাইবাবু আমাকে ফোন করেন।”

–       হ্যাঁ। স্যার বলে দিয়েছিলেন আপনাকেই যেন ফোন করি।

শারদ্বত আমাকে বলল, “এবার guess করো। এই কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার কে?”

আমি বললাম, “আমার দাদা?”

–       হ্যাঁ। সেই কারনেই থানায় যাওয়া। ওই জাদুকর ভদ্রলোকের সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তোমার দাদা, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর অ্যালাউ করবেন না জেলে।”

–       হুম দাদা পছন্দ করে না প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর দের।

–       ভাবছে ওনার ভাত মেরে দেব! পুলিশগুলোও সত্যি! পারে বটে!

নিমাই বাবু বললেন, “এবার স্যার আমরা কী করব? বস কে ছাড়া বাড়িও ফিরতে পারব না। হোটেলে রোজ রোজ এত টাকা করে গুনতে হচ্ছে!”

শারদ্বত জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এ.সি. সরকারের কোনো শত্রু রয়েছে?”

–       দেখুন শত্রু তো এই লাইনে থাকবেই। Competition এর বাজার! জাদুকর জে.পি. নামে একজন আছে। তার সাথে স্যারের খুব রেষারেষি। আমরা যেখানে শো করব ওই সময়েই দু’দিনের তফাৎ – এ উনিও সেখানে শো ফেলেন নিজের।

–       ওই মহিলা কে শেষ কে দ্যাখেন?

–       বোধহয় আমিই। আমিই ওনাকে বললাম বাইরে অপেক্ষা করতে। তারপর আর কেউ দ্যাখেনি।

শারদ্বত কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, “ঠিক আছে এবার আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। আর ওই ভদ্রমহিলা কে পাঠিয়ে দিন।”

নিমাইবাবু বললেন, “স্যার ও বাংলাটা ঠিকমত বলতে পারে না। মানে মোটামুটি পারে। বোঝে সবই। কিন্তু বলার সময় একটু আটকে আটকে যায়। আমি কি থাকব এখানে? মানে… কিছু বুঝতে না পারলে… বলে দিতাম”

শারদ্বত বলল, “না না। আপনি বাইরেই দাঁড়ান। আমরা কাজ চালিয়ে নেবো।”

নিমাইবাবু ব্যাপার টাতে একটু যেন ক্ষুন্ন হলেন মনে হল। তবে শারদ্বত তাতে পাত্তা দিল না। নিমাইবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর ঢুকলেন ওই মহিলা। বয়স বেশী না। ২০ থেকে ২২ এর আশেপাশে। বেশ সুন্দরী। তবে মাথাটা নীচু করে আছে। ভয় পাচ্ছে নাকি?

শারদ্বত বললো, “আপনার নাম?”

মেয়েটি বলল, “শ্রদ্ধা।”

–       কতদিন কাজ করছেন এই অখিলেশবাবুর হয়ে?

কথাটা শুনে বুঝলাম জাদুকর এ.সি. সরকারের আসল নাম অখিলেশ। এটা জানতাম না আমি।

শ্রদ্ধা বলল, “এই তো এক বছরের একটু বেশী হবে।”

–       আপনার কাজ কী ছিল?

–       আমি তো স্যারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম। স্টেজপে উনকো হেল্প করতি থি।

–       কেমন মানুষ ছিলেন আপনাদের স্যার?

–       ভালো।

শারদ্বত গলা নামিয়ে বলল, “শুনুন। আপনাকে ভয় পেতে হবে না। আপনি যেটা সত্যি সেটাই বলুন। কেউ জানবেনা।”

মেয়েটি কি বুঝল জানিনা। বলল, “আচ্ছা হি তো থে। ঠিক টাইমপে টাকা দিতেন। তবে একটু রাগী ছিলেন। একটুতেই রেগে যেতেন।”

–       গায়ে হাত তুলেছে কখনও?

–       নেহি। কভি নেহি।

–       সেদিনের ওই যে মহিলা কি যেন নাম ওনার?

–       সুনন্দিতা চক্রবর্তী।

–       হ্যাঁ, তা ওঁর সাথে আপনার শেষ কখন দেখা হয়?

শ্রদ্ধা বলল, “ম্যানে হি তো উসকো আখরিবার দেখি থি।”

শারদ্বতর ভুরুটা দেখলাম কুঁচকে গিয়েছে। এই তো নিমাই বাবু বলে গেলেন উনি নাকি শেষবার দেখেছেন ওই মহিলা কে।

শারদ্বত বলল, “তাই? কী করছিলেন তখন উনি?”

শ্রদ্ধা বলল, “ও মুঝসে পুছ রাহি থি কি বাথরুমটা কোন দিকে? আমি দেখিয়ে দিলাম। উনি চলে গেলেন।”

–       এটা আপনি পুলিশ কে বলেননি?

–       হ্যাঁ বলেছি তো!

–       ওই অডিটোরিয়ামে কোথায় ছিল বাথরুম টা?

–       ওখানে তো দোঠো বাথরুম থা। আচ্ছাওয়ালা স্যার কে গ্রীনরুম পে থা। আমি ওখানেই যেতে বললাম ম্যাম কে।

–       তার মানে আপনি শেষবার দেখেননি ওনাকে।

–       জি?

শারদ্বত আমাকে বলল, “তাহলে কেস টা যেটা দাঁড়ালো, অখিলেশবাবুর সাথে একবার দেখা করতে হবেই। কারন সুনন্দিতা চক্রবর্তী কে শেষ দেখেছিলেন উনিই।”

আমি ঘাড় নাড়লাম। শারদ্বত মেয়েটিকে বলল, “ঠিক আছে। আপনি ম্যানেজারবাবু কে পাঠিয়ে দিন।”

শ্রদ্ধা বিছানা থেকে উঠে এগোলো দরজার দিকে।

শারদ্বত বলল, “আপনি বাংলা লিখতে বা পড়তে জানেন নাকি?”

শ্রদ্ধা বলল, “নেহি সাহাব। শিখে নেবো। স্যার বলেছে শিখিয়ে দেবে।”

শারদ্বত বলল, “বেশ। আপনি ম্যানেজারবাবু কে ডেকে দিন একটু।”

কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘরে ঢুকলেন সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক। এখনও চোখের চাউনি তে সন্দেহ স্পষ্ট। শারদ্বত বলল, “আপনার নাম টা জানা হয়নি।”

“রঞ্জন মল্লিক” বিছানায় বসতে বসতে ভদ্রলোকের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

শারদ্বত বলল, “এবার বলুন। ওই সুনন্দিতা মহিলা কে কী আপনিও শেষ দেখেছিলেন?”

ভদ্রলোক বললেন, “আমি কিছু দেখিনি।”

শারদ্বত বলল, “ম্যাজিক দেখছিলেন তো স্টেজে?”

ভদ্রলোক আবার বললেন, “আমি কিছু দেখিনি।”

আমি শারদ্বতর মুখের দিকে তাকালাম। ও দেখলাম অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে রঞ্জনবাবুর দিকে। কয়েক মুহুর্ত থেমে শারদ্বত বলল, “দেখতে পান তো? চোখ গুলো Functional?”

রঞ্জন মল্লিক বললেন, “আমি কিছু দেখিনি। আমি কিছু জানিনা।”

এতো মহা জ্বালা। টেপ রেকর্ডারের মত এক কথা বলে যাচ্ছে!

শারদ্বত বলল, “সুনন্দিতা চক্রবর্তীর বাড়ির ঠিকানাটা দিন। ওগুলো আপনিই হ্যান্ডেল করেন তো।”

রঞ্জনবাবু বললেন, “আমি কিছু…

শারদ্বত ওনাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বলল, “জানেন না। বুঝে গেছি।” তারপর জোরে চেঁচিয়ে ডাকল, “নিমাইবাবু?”

একবার ডাকতেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এলেন নিমাইবাবু।

এদিকে তখন বিছানার ওপর বসে রঞ্জন মল্লিক ক্রমাগত বলে চলেছেন। “আমি কিছু দেখিনি। আমি কিছু জানিনা।”

এক কথা। বার বার। গলার আওয়াজ টা আস্তে আস্তে কমছে। স্পষ্ট কথাগুলো বিড়বিড় শোনাচ্ছে।

শারদ্বত বলল, “আপনাদের ম্যানেজার কী পাগল? এক কথা বার বার বলে যাচ্ছে।”

নিমাইবাবু এবার বললেন, “রঞ্জু দা? ও রঞ্জু দা? কী হল তোমার?”

ভদ্রলোক দেখলাম কোনো কথার উত্তর দিলেন। শারদ্বত হঠাৎ করে বিছানা থেকে উঠে বলল, “নিমাইবাবু ওনার বোধহয় স্ট্রোক হচ্ছে। কিংবা মাথা ঘুরছে। ডাক্তার ডাকুন। আর আমাকে আমার অ্যাডভান্স ফিস টা আর সুনন্দিতা চক্রবর্তীর ঠিকানা টা পাঠিয়ে দেবেন।”

তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “চলো অনিরুদ্ধ। একটু চিকেন রোল খেতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ।”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ ছেলে তো বদ্ধ পাগল! একজন বয়স্ক মানুষের শরীর খারাপ সেখান থেকে এমন ভাবে বেরিয়ে এল যেন কিছুই হয় নি। আবার তাদের সামনেই বলে চিকেন রোল খাবে। এর সাথে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো মনে হচ্ছে! এর চেয়ে আমার হোটেলের ঘরই ভালো।

মাঝে মাঝে এরকম হয় যে ঠিক কী ঘটছে কেন ঘটছে বুঝতেই পারি না। যে ছেলেটাকে আজ আমি প্রথম দেখলাম তার সাথে এখন আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি একটা রোল চাউমিনের দোকানের সামনে। কিন্তু কেন হঠাৎ আমার হোটেল থেকে এত দূরে রোল খেতে এলাম সেটাও বুঝছি না। এটা কি এই কেসের কোন অঙ্গ? আর আমার ভূমিকা টা কী এই কেসে? আমার ওপর শারদ্বত এত সদয় হয়ে কেসের সঙ্গী করতে চাইছে কেন? আমি লিখি না লিখি, বাঁচি, মরি তাতে ওর কী এসে যায়?

“তোমার রোলে লংকা হবে?”

শারদ্বতর ডাকে ফিরে এলাম ইহজগতে। “হুঁ? কী?”

“চিকেন রোলে লংকা? খাবে?”

বললাম, “আরে ভাই কেন এমনি এমনি চিকেন রোল খেতে যাবো? তোমার মতলব টা কী একটু বলবে? হঠাৎ রাতদুপুরে এখানে কেন রোল খেতে এলাম আমরা?”

শারদ্বত দোকানের দিকে ফিরে বলল, “অল্প লংকা দিন” তারপর আমায় বলল, “বলব বলব। সব বলব। কিছু খাবার আগে পেটে পড়ুক। তারপর।”

কথাটা শুনেই খেয়াল হল সত্যি বেশ খিদে পাচ্ছে। দুপুরের পর আর কিছু খাওয়া হয় নি। ইতিমধ্যে ২ টো চিকেন রোল চলে এল আমাদের হাতে। শারদ্বত তাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, “ওই যে উলটো দিকে দেখছ… ওটা তোমার দাদার থানা।”

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “হ্যাঁ তো? তাতে কী?”

শারদ্বত বলল, “অখিলেশ চন্দ্র সরকার কে এখনও কোর্টে হাজির করা হয় নি। কাল সম্ভবত হবে। সুতরাং উনি এখনও এই থানারই হোল্ডিং সেলে আছেন।”

–       বেশ। তো? আমি কী করব তাতে?

–       তুমি যেটা করবে সেটা হল থানায় গিয়ে সবাই কে একটু ডিসট্র্যাক্ট করবে। আর আমি সেই ফাঁকে ম্যাজিশিয়ান বাবুর কাছে গিয়ে যা জানার জেনে চলে আসব।

–       অ্যাঁ? না না। আমি পারবো না। দাদা জানলে…

–       আরেহ তোমার দাদা বাড়ি চলে গেছে। এখন থানায় নেই।

–       সে তোমার না জানলেও চলবে। তুমি কাজ টা পারবে কি না বলো।

–       কিন্তু আমি বলব টা কী? জয়ন্ত দা থাকবে। আরও কনস্টেবল থাকবে কয়েকজন। ওদের কে ডিসট্র্যাক্ট করব কী করে?

শারদ্বত একটু ভেবে বলল, “এক কাজ করো। বলো তোমায় কেউ ফলো করছে! তুমি মাঝে মাঝে একটা অচেনা ছেলে কে দেখত পাচ্ছো তোমার পেছনে। এটা নিয়ে কী করা উচিত সেটা জানতে চাও সবার কাছে।”

আমি বললাম, “দেখো ব্যাপার টা একটু রিস্ক হয়ে যাবে। দাদা জানতে পারলে ভাগ্যে দুঃখ আছে।”

–       কেউ জানবেনা। তুমি আমায় ১০ মিনিট দাও। তার মধ্যেই সব করে নেবো আমি।

কেন যে রাজি হলাম জানিনা। হয়তো এই রিস্ক নেওয়ার রোমাঞ্চ টা উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। চিকেন রোল শেষ করে এগিয়ে গেলাম থানার দিকে। সকালের সেই কনস্টেবল দেখলাম বাইরে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে এখন আর কিছু বলল না। আমি বললাম, “আপনার নাম কী?”

কনস্টেবল বলল, “সুজয়।”

বললাম, “সুজয় দা, আপনি একটু জয়ন্তদা কে ডেকে দিন। আমি দাদার ঘরে বসছি।”

কনস্টেবলটি কিছু না বলে চলে গেল। আমি ভেতরে গিয়ে বসলাম দাদার ঘরে। দাদা নেই। ৭ টায় বেরিয়ে গেছে বোধহয়। প্রায় দিনই ঐ টাইমেই বাড়ি ফিরত আগে। এখন জানিনা। বেশ কয়েকদিন হল আমি বাড়িতে নেই। রুটিন চেঞ্জ হতেও পারে।

জয়ন্ত দা ঢুকল ঘরে। সাথে সেই কনস্টেবল। “কী হয়েছে অনিরুদ্ধ?”

ঘড়ির দিকে দেখলাম। পৌনে আট টা। ঠিক ১০ মিনিট নাটক করতে হবে আমাকে।

জয়ন্তদা কে বললাম, “বসুন না বলছি।”

জয়ন্ত দা কি বুঝল জানিনা। বসে পড়ল পাশে রাখা চেয়ারে। বলল, “হ্যাঁ বলো।”

আমি গলা ঝেড়ে বললাম, “গত কয়েকদিন ধরেই আমাকে কেউ ফলো করছে। কে আমি জানিনা। কিন্তু করছে।”

–       মানে? কী বলছ? ছেলে না মেয়ে?

–       জানিনা। শীতকাল তো। গায়ে জ্যাকেট থাকে আর হুড দিয়ে রাখে মাথায়। যখন রাস্তা ভীড় থাকে দেখতে পাই না। কিন্তু খালি হলেই বুঝতে পারি কেউ একজন হাঁটছে পেছনে।

–       স্যার কে জানিয়েছো?

স্যার অর্থে আমার দাদা। বললাম, “না জানাই নি। এমনিতেই আমি বাড়ি ছেড়ে একা থাকছি এই নিয়ে দাদার খুব টেনশন। তার ওপর আর টেনশন বাড়াতে চাই না।”

জয়ন্ত দা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, “হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক।”

–       কী করা যায় একটু বলবে?

–       দাঁড়াও আমি বরং একটা রিপোর্ট লিখে নি এটার। তারপর দেখছি কী করা যায়।

হঠাৎ বাইরে আওয়াজ শুনলাম একটা। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলছে, “এগ রোল, চিকেন রোল, চাউমিন, মোগলাই এদিকে এদিকে এদিকে।”

গলা শুনেই বুঝলাম। কাজ হয়ে গিয়েছে। উঠে পড়লাম চেয়ার থেকে। বললাম, “আজ থাক জয়ন্ত দা। আজ আসি।”

জয়ন্ত দা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে? কী হল? রিপোর্ট লেখাবেনা?”

আমি বললাম, “নাহ। থাক। আমার মনের ভুলও হতে পারে। শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ নেই। আসছি আমি।”

কথাটা বলেই জয়ন্ত দা কে আর কিছু বলতে না দিয়েই বেরিয়ে এলাম ওই ঘর থেকে। পেছনে না তাকিয়েও পরিস্কার বুঝতে পারলাম ২ জোড়া চোখ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

ডিনার সেরে এসে হোটেলের ঘরে শুয়েছিলাম। ভাবছিলাম আজকের সারা দিনটা কেমন অদ্ভুত কাটল। সাধারনত আমার দিন গুলো বড্ড বোরিং হয়। সকালে উঠে বদ্ধ হোটেলের ঘরে বন্দী হয়ে থাকা। ইচ্ছে হলে কিছু লেখা। লেখাগুলোও ঠিক হচ্ছিল না শেষ ক’দিন। আসলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই কীভাবে যে সব চলবে সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আর লেখা হচ্ছিল না। আজ সারাদিনের অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে দিয়ে যেন একটা অদ্ভুত থ্রিল এলো।

থানা থেকে বেরোনোর পর দেখলাম উলটো দিকে ফুটপাথে সেই রোলের দোকানের সামনে শারদ্বত দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কাজ হলো?”

শারদ্বত বলল, “হুম হলো। চলো।”

–       কী বলল এসি সরকার?

–       প্রচন্ড ইগো। বলল, উনি যখন ঘরে মেক আপ তুলছিলেন তখন কেউ একজন ওর ঘরে ঢুকেছিল বাথরুম যাবে বলে। কিন্তু উনি খেয়াল করেননি খুব একটা। কারন উনি নাকি তখন নেশা করছিলেন।

–       কি নেশা?

–       একটা নয় সম্ভবত।

–       আর কী বললেন?

–       আর বললেন যে উনি নির্দোষ। ওঁর রাইভাল ওর দুর্নাম করার জন্য এসব করছে। কিন্তু তাতেও কেউ ওর কিস্যু করতে পারবে না।

–       রাইভাল মানে ওই জাদুকর জে.পি?

–       ইয়েস। জাদুকর জটিলেশ্বর পান।

–       পান?

–       Yup.

–       এরকমও পদবী হয় নাকি?

–       হয় বৈকি। পান, আলু, মুলো। সব হয়।

তারপর একটু থেমে আমায় বলল, “অনিরুদ্ধ তোমায় আজ আর আটকাবো না। কাল দেখা হচ্ছে।”

তারপর আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেল উল্টোদিকে। কোথায় দেখা হবে। কীভাবে দেখা হবে কিচ্ছু জানিনা। ওর কাছে তো আমার ফোন নাম্বারও নেই। ধুর ছাই! এই ছেলেটা একটা আস্ত পাগল।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলাম হঠাৎ ওপরের ফ্লোর থেকে একটা আওয়াজ পেলাম। পা টিপে টিপে কেউ তাড়াতাড়ি হাঁটলে যেরকম আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ খানিক টা। একটু মন দিয়ে শুনলাম। আওয়াজ টা থামছে না। শীতকাল তো। তাই চারিদিক আরও বেশী নিস্তব্ধ। লেপ টা সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। তারপর দরজা খুলে পা টিপে টিপে উঠে গেলাম ওপরের ফ্লোরে।

কেউ কোত্থাও নেই। বেশ ঠান্ডা ওপর টা। সকালে যে ঘরে গিয়েছিলাম সেই ঘর থেকে একটা ছোট্টো আলোর রেখা বেরিয়ে আসছে। দরজা টা অল্প করে খোলা। পা টিপে টিপে সেই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেতরে ৩ জন কথা বলছে ফিসফিসিয়ে।

এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একটা আমায় শক্ত করে ধরল। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। আমি কোনো আওয়াজ করার আগেই আমার নাকের কাছে ধরা হল একটা রুমাল। সেই রুমালের গন্ধ টা খুব মিষ্টি। খুউউব মিষ্টিইই। ক্লোরোফর্ম কী? আমার হাত-পা গুলো অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখ টা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।

যখন চোখ খুললাম তখন দেখলাম আমি হোটেলে নিজের বিছানায় শুয়ে রয়েছি। আমার ঘরের দরজা জানলা হাট করে খোলা। আর বিছানার ঠিক সামনে বসে আছেন। ইন্সপেক্টর নীলাদ্রী সেন। আমার দাদা। ওকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। ও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

নীরবতা ভাঙলাম আমিই। “তুই কখন এসেছিস?”

দাদা বলল, “ঘন্টাখানেক আগে। কী হয়েছিল?”

আমি বললাম, “মানে? কীসের কী হবে?”

দাদা বলল, “তুই জানিস না আমি কীসের কথা বলছি?”

আমি বললাম, “না মানে কীসের?”

–       শোন তোকে একটা কথা বলি। ক্রিমিনালদের চরিয়ে আমায় খেতে হয়। তাই তাদের আচার আচরন অনেকটাই আমার জানা। তুই এখন একজন ক্রিমিনাল দের মত আচরন করছিস। লুকোনোর চেষ্টা করছিস সহজ একটা সত্যি কে।

মাথাটা ভারী হয়েছিল তখনও। কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, “কী হয়েছে? কীসের কথা বলছিস একটু বলবি?”

দাদা এবার একটু জোরেই বলল, “কাল সন্ধ্যে বেলা থানায় যেটা ঘটালি সেটা কি আমি জানতে পারবো না ভেবেছিলি? ওই যে ছেলেটা? কি যেন নাম। শারদ্যুতি না কি একটা –

–       “শারদ্বত”

–       হ্যাঁ। শারদ্বত। তুই শেষ পর্যন্ত ওর পাল্লায় পড়লি? মানুষ চিনলি না এতদিনেও? ও ছেলে তোকে এক হাতে কিনে আর এক হাতে বেচে দেবে রে!

এসব শুনতে ভালো লাগছিল না। চা খেতে হবে। বললাম, “তুই যা এখন। ভালো লাগছে না।”

দাদা চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। বলল, “এরকম করতে থাকলে তোর সাথে কেউ থাকবে না। সবাই চলে যাবে আস্তে আস্তে। আর ওই শারদ্বত? ও তো দু’দিনের জন্য। আজ তোর দরকার আছে তাই তোকে ব্যবহার করছে। কাল যখন দরকারে লাগবে না তখন জাস্ট ছুঁড়ে ফেলে দেবে।”

আমি কিছু বলার আগেই করিডরে একটা খুব চেনা গলার আওয়াজ পেলাম।

“অনিরুদ্ধ রেডি হও। আজকেই –

শারদ্বত কথাটা বলতে গিয়েও ঘরে ঢুকে দাদাকে দেখে থেমে গেল। তারপর বলল, “- বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়ে যাবো।”

আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম ওর দিকে।

শারদ্বত দাদা কে বলল, “আরে কী খবর? ভাই এর খোঁজ নিতে এসেছেন?”

দাদা ঠান্ডা গলায় শারদ্বত কে বলল, “তুমি জানো তোমায় আমি এক্ষুনি অ্যারেস্ট করতে পারি?”

শারদ্বত হাতের ফোনে কি একটা করতে করতে বলল, “সে আপনি পারেন। কিন্তু তারপর আপনার বস আপনাকে ফোন করবে আমায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য।”

দাদা বলল, “ওহ। তাই নাকি? চলো তো দেখি!”

কথাটা বলে দাদা শারদ্বতর দিকে এগোতেই হঠাৎ ওর ফোন টা বেজে উঠল। দাদা এক মুহুর্ত ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই থেমে গেল। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

আমি বললাম, “এটা কী হল?”

শারদ্বত বলল, “আরে তোমার দাদার বস, পুষ্পল রায় আমার কাছ থেকে প্রায়সই অ্যাডভাইস চান কেস নিয়ে। ওঁকেই একটা টেক্সট করে দিলাম। কথা বলতে বলতে!”

–       উফ! তোমার তো অনেক লম্বা হাত!

–       তা বটে। এই তুমি হঠাৎ দরজার বাইরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে কেন? তোমার কী মৃগী আছে নাকি?

–       তোমাকে আবার এটা কে বলল?

–       যে তোমার মৃগীরোগ আছে?

–       নাহ! উফফ! এই যে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।

শারদ্বত বলল, “এই তো হোটেলের ম্যানেজার বললেন ঢোকার সময়।”

এরপর আমি শারদ্বত কে কাল রাত্রের পুরো ঘটনাটা বললাম। সব শুনে শারদ্বত বলল, “বুঝলাম। এই কেসের আর একটা অ্যাঙ্গেল বাকি আছে। মোটিভ। সেটা জানলেই সব সমাধান পাওয়া যাবে। চলো বেরোতে হবে।”

“কোথায় বেরোবে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

শারদ্বত বলল, “যার গেছে, তার কতটা গেছে দেখে আসি চলো।”

–       মানে?

–       মানে সুনন্দিতা চক্রবর্তীর হাসব্যান্ডের সাথে একবার দেখা করে আসা যাক।

কথাটা বলেই শারদ্বত পকেট থেকে বের করল একটা ভাঁজ করা কাগজ।

জিজ্ঞেস করলাম, “ওটা কী?”

শারদ্বত বলল, “নিমাইবাবু যতজন সেদিন হলে ছিল তার লিস্ট টা কাল পাঠিয়েছিলেন। সেটা থেকেই Person of Interest  দের কে আমি আলাদা করেছি এই কাগজে।”

–       সেরকম ক’জন আছে?

–       আপাতত তিনজন। যাও যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। বেশি দেরী করলে চলবে না।

আমি আর কোনো কথা না বলে ঢুকে গেলাম বাথরুমে।

সুনন্দিতা চক্রবর্তীর বাড়ি টালিগঞ্জে। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে শারদ্বত কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ঐ ম্যানেজার বাবু কেমন আছেন?”

শারদ্বত বলল, “বেশ ভালোই আছেন। কিছুই হয় নি ওঁর।”

আমি বললাম, “আর কাল রাতে যেটা আমার সাথে ঘটল সেটা নিয়ে কী মনে হয় তোমার? আমার তো মনে হচ্ছে ওই নিমাইবাবু টাই ওরকম করেছে। কিছু একট ব্যাপার তো আছেই। এমনি এমনি পকেটে ক্লোরোফর্ম নিয়ে ঘুরবে নাকি লোকজন?”

শারদ্বত বলল, “সব জানা যাবে। আগে সব দিক টা ভালোভাবে বুঝে নিতে দাও।”

বেল বাজানোর পর একটা কাজের মেয়ে এসে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল। জিজ্ঞেস করল, “কাকে চাই?”

শারদ্বত বলল, “নীশিথ বাবু আছেন?”

সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামীর নাম তাহলে নীশিথ। এটা জানা ছিল না। শারদ্বত সম্ভবত ওই লিস্ট থেকে জেনেছে।

মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ। দাঁড়ান ডেকে দিচ্ছি।”

একটু পর এলেন ভদ্রলোক। লম্বা, গায়ের রং একটু চাপা। বয়স ওই ৪০ এ কাছাকাছি হবে। শারদ্বত বলল, “ভেতরে আসতে পারি?”

ভদ্রলোক একটু সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনারা?”

শারদ্বত বলল, “আপনার স্ত্রী সুনন্দিতা চক্রবর্তী মিসিং তো। আমরা ওটা নিয়েই কিছু প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে।”

“আপনারা পুলিশ।” ভদ্রলোকের আবার প্রশ্ন।

শারদ্বত বলল, “নাহ। এই অনিরুদ্ধ হলে গিয়ে পুলিশের ভাই। আর আমি হলাম ভাই এর বন্ধু।”

–       দেখুন আমি তো পুলিশ কে যা বলার বলেছি।

শারদ্বত বলল, “আপনি কি বৌ কে ফেরৎ চান আপনার?”

নীশিথবাবু একটু রেগে গিয়ে বললেন, “এ আবার কী প্রশ্ন? অবশ্যই চাই।”

–       গুড। তাহলে পুলিশ কে যা যা বলেছেন ভুলে যান। আমাদের প্রশ্নের উত্তর গুলো দিন।

ভদ্রলোক এরপর ভেতরে ডেকে বসতে বললেন আমাদের। আমি বসলাম সোফায়। শারদ্বত ঘরের এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল। নীশিথবাবু বললেন, “বলুন এবার কী প্রশ্ন আছে আপনাদের?”

শারদ্বত বলল, “আপনার সাথে আপনার স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন?”

–       ভালোই।

–       শুধু ভালো? খুব ভালো নয়?

–       না মানে… ভালো মানে ভালোই। কোনো সমস্যা নেই।

–       আপনাদের কোনো ছেলে মেয়ে নেই?

–       না। নেই।

–       সেদিন কখন গিয়েছিলেন আপনারা হল এ?

–       আমরা গিয়েছিলাম ৭ টার দিকে।

–       আর শো ক’টায় শেষ হয়?

–       সাড়ে ৯ টার দিকে।

“আচ্ছা ওনার ফোন টা একবার দেখা যায়?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

প্রশ্ন টা করেই শারদ্বতর দিকে তাকালাম। ঠোঁটের কোনায় হাসি। আমি কেসটাতে আগ্রহ পেয়েছি দেখে বোধহয় হাসছে।

নীশিথবাবু বললেন, “হ্যাঁ দাঁড়ান দিচ্ছি।”

পাশের ঘর থেকে ভদ্রলোক ফোন টা নিয়ে এসে শারদ্বতর হাতে দিলেন।

“উনি সেদিন হলে ফোন না নিয়ে গিয়েছিলেন?” শারদ্বত জিজ্ঞেস করল।

–       হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিল। আর তাছাড়া আমি তো সঙ্গে ছিলামই। সেই জন্যেই দরকারও হয় না সব সময়।

এমন সময় কাজের মেয়েটি বলল, “আমি আসছি বাবু।”

নীশিথবাবু বললেন, “হ্যাঁ যাও। বিকেলে আসতে হবেনা আজ আর। কাল চলে আসবে।”

শারদ্বতও এবার বলল, “ঠিক আছে। নীশিথবাবু আমরাও আসি। আপনার স্ত্রীর ফোন টা নিয়ে গেলাম। কিছু জানাতে পারলে আপনাকে ফোন করে নেবো।”

ভদ্রলোক এবার অবাক হয়ে বললেন, “আপনার ফিস টা?”

শারদ্বত বলল, “আপনি তো আমাকে Hire করেন নি। অন্য একজন করেছেন। আমার ফিস তিনিই দিয়ে দেবেন। চলি।”

কথাটা বলেই একরকম তাড়াহুড়ো করেই আমরা বেরিয়ে এলাম টালিগঞ্জের ওই ফ্ল্যাট থেকে। আমি বললাম, “কী হল? তুমি আর কিছু প্রশ্ন করলে না?”

শারদ্বত বলল, “ওনার কাছ থেকে আর তেমন কিছু জানা যাবে না।”

–       তাহলে কার কাছ থেকে জানা যাবে?

–       ওই তো। সামনে তাকাও।

কথাটা বলার পরেই সামনে তাকিয়ে দেখলাম। শারদ্বত ইঙ্গিত করেছে বাড়ির কাজের মেয়েটির দিকে। যে এখন আমাদের ঠিক সামনে সামনে হাঁটছে।

“দিদি?” শারদ্বত ডাকল।

ফিরে তাকালেন মহিলা। চোখে একটু ভয় কী?

শারদ্বত বলল, “আপনাকে দেখে মনে হল আপনি কিছু জিনিস জানেন। যেগুলো আমরা জানি না।”

মহিলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “না না। আমি কিছু জানি না।”

শারদ্বত বলল, “তাহলে যেদিন থেকে সুনন্দিতা দেবী কে পাওয়া যাচ্ছে না সেদিন সকালে আপনি কিছু দেখেন নি বলছেন তো?  পুলিশ এরপর এই প্রশ্ন টা জিজ্ঞেস করতে আসবে। তখন কিন্তু ওরা দু’বার জিজ্ঞেস করবে না।”

এই রে! সেদিন সকালে আবার কী হল? শারদ্বত মাঝে মাঝেই এমন সব কথা বলে যেগুলো শুনে মনে হয় আমি যখন ওর সাথে থাকি তখন কী নেশা করে থাকি? কত কিছু বলে দেয় যেগুলো আমি জানিই না।

মহিলা কয়েক মুহুর্ত একটু ভাবলেন। তারপর আমাদের বললেন, “বৌদি যদি মরে গিয়েও থাকে, তাহলেও ভালো থাকবে। ওই পশুটার সাথে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।”


ইন্দ্রজাল রহস্য (শেষ পর্ব) – https://secularweirdo.com/2018/09/30/ইন্দ্রজাল-রহস্য-পঞ্চম-পর

ইন্দ্রজাল রহস্য (এখনো অবধি যা ঘটেছে)

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি