জাদুকরের কথা

“আজকে আমাদের এই ম্যাজিক শো শেষ করার সময় হয়ে গিয়েছে। তবে যাওয়ার আগে আরও একবার আপনাদের মোহিত করার জন্য আমার সেরা খেলা দেখানোর সময় হয়ে গিয়েছে।” – জাদুকর বললেন।

দর্শক আসনে বসে থাকা প্রায় সকলেই চেঁচিয়ে উঠলেন উচ্ছাসে। জাদুকর এ.সি. সরকার এর শো যারা দেখেছেন আগে তারা প্রায় সবাই জানেন কি খেলার কথা বলছেন ম্যাজিশিয়ান।

জাদুকর বললেন, “আমার সামনে ২ টো কাঁচের Bowl আছে। তার একটাতে লেখা আছে Row Number. অর্থাৎ এই হল এর যতগুলো ROW আছে। তার নাম্বার লেখা আছে একটা Bowl এ। এবং আর একটা Bowl এ আছে সীট নাম্বার। আমার এই খেলা তে প্রয়োজন আপনাদের মধ্যে থেকে একজন কে। কে আসতে চান বললে বেশীরভাগ জায়গাতেই প্রায় মারামারি শুরু হয়ে যায়। সেই জন্যেই এই ব্যাবস্থা।”

জাদুকরের সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে এল সামনে। লটারির এই কাজ টা ওকেই করতে হয় সাধারনত।

জাদুকর এবার ওঁর সহকারী কে বললেন, “Will you do the Honor Please?”

হঠাৎই দর্শকদের মধ্যে একটা চাপা নীরবতা। কার সীট নাম্বার ওঠে লটারীতে সেই অপেক্ষায় রয়েছে সকলে। মহিলাটি প্রথম Bowl এ হাত ঢুকিয়ে বের করলেন একটি কাগজ। তারপর এগিয়ে দিলেন জাদুকরের দিকে। জাদুকর কাগজ টা খুলে বললেন, “আমার কাছে রয়েছে Row Number….. H”

আবার উচ্ছাসে ফেটে পড়ল হলঘর। Row Number H এ তখন একটা অদ্ভুত টেনশন। সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে জাদুকর এর অ্যাসিস্ট্যান্ট এর দিকে। এবার সীট নাম্বার তোলার পালা।  অ্যাসিস্ট্যান্ট টি এরপর দ্বিতীয় Bowl থেকে তুলে আনলেন আর একটি কাগজ। তারপর একইভাবে পৌঁছে দিলেন জাদুকরের হাতে। জাদুকর কাগজ টা খুলে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, “সীট নাম্বার আমরা পেয়ে গেছি। নাহ বেশী টেনশন দেবো না আর। আজ আমার কাছে Stage এ আসছে H-16। দেখি কে আছে H-16 এ?”

আবার  চিৎকার করে উঠল সারা হল। পেছনের সারিতে বসে থাকা লোকটি এবার একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। এরা যতটা না পারে, তার চেয়ে বেশী দেখায়। একে শীতকাল তার ওপর হলে AC চলছে। সব মিলিয়ে বেশ ঠান্ডাই লাগছে। কাজেই ওভারকোটের কলার তুলে মুখ ঢাকা দিয়ে লোকটি নিশ্চিন্তে বসে মাপছে সবাই কে।

একটু পরেই ম্যাজিশিয়ান এর আর একজন সহকারী এসে Escort করে নিয়ে গেলো H-16 এ বসে থাকা মেয়েটিকে। মেয়েটির মুখ চোখে যেন চাপা একটা ভয়। Nervous লাগছে কী?

Stage এ নিয়ে যাওয়ার পর জাদুকর হাত বাড়িয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে। তারপর বললেন, “আপনার নামটা যদি একটু বলেন।

মেয়েটি বলল, “আমার নাম সুনন্দিতা… সুনন্দিতা চক্রবর্তী।”

–       “আপনি কার সাথে এসেছেন এখানে আজ?”

–       “আমার স্বামীর সাথে। ওই যে বসে আছেন আমার পাশের সীট এ।”

সবাই তাকালো সেদিকে। পেছনে মুখ ঢেকে বসে থাকা লোকটি তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে Stage এ থাকা মেয়েটির দিকে। জাদুকর এবার বললেন, “দর্শক আসনে যারা রয়েছেন তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না আমার শেষ খেলাটা কী। তাদের জন্য আরও একবার বলি… এই খেলার নাম বর্ষ চক্র। আমাদের প্রত্যেকেরই বয়সের একটা চাকা রয়েছে। যেটা একই দিকে ঘুরছে আর তার ফলে আমাদের বয়স ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। আমার হঠাৎ একদিন মনে হল এই চাকাটা কি উলটো দিকে ঘোরানো যায় না? মানে বয়স টা হঠাৎ কি একটু কমিয়ে দেওয়া যায় না? তারপরেই অনেক সাধ্য সাধনা করে আমি এক অভিনব Trick এর খোঁজ পেয়েছি। বয়স কমানো যায়। সেটা আজ আপনাদের সামনে আমি দেখিয়ে দেবো করে। আমার সাথে Stage এ যিনি রয়েছেন তার বয়স আমি অন্তত ১৫ বছর কমিয়ে দেবো। এটাই আমার শেষ খেলা।”

উচ্ছাসে ফেটে পড়ল দর্শকেরা। জাদুকরের দুজন পুরুষ সহকারী এবার একটা কাঠের বড় বাক্স নিয়ে এল Stage এ। বাক্সটির সামনে একটা Wheel। সেটা ডানদিক বাঁদিকে ঘোরানো যায়! তার ঠিক ওপরেই একটা নাম্বার লেখা জায়গা রয়েছে। Wheel টা বাঁদিকে ঘোরালে সেটা মাইনাস সহযোগে বাড়ে অর্থাৎ বয়স কমছে ইঙ্গিত করে এবং ডানদিকে ঘোরালে সেখানে প্লাস সহযোগে বাড়তে দেখা যায়।

জাদুকর এবার Stage এ দাঁড়ানো মহিলা কে বললেন, “আপনি তৈরী তো?”

মহিলা ঘাড় নাড়তেই। জাদুকরের সুন্দরী সহকারী ওই বাক্সের দরজা খুলে দিলেন। বাক্সটিতে একজন ৬ ফুট লম্বা মানুষ অনায়াসে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। সেই জায়গা ভেতরে রয়েছে। জাদুকর এবার দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনার ভালো করে এই বাক্সটা দেখুন। এই বাক্সের মধ্যেই যা ঘটার ঘটবে… আমি এখন সুনন্দিতা দেবী কে অনুরোধ করবো এই বক্সটির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য”

পেছনে বসে থাকা লোকটি আবার হাসল। যত্তসব বুজরুকি। সব ম্যাজিক বক্স এর মধ্যেই। সামনে করার দম নেই কারুর। ততক্ষনে Stage এর ওপরে থাকা ভদ্রমহিলা গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বক্স এর মধ্যে। বক্স এর দরজা বন্ধ করে দিলেন সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্ট।

তারপর জাদুকর এগিয়ে গেলেন বক্স এর সামনে। তারপর বললেন, “আপনারা আমার সাথে গুনতে থাকুন সবাই। আমি যতগুলো Wheel ঘোরাবো। তত বয়স কমবে ওঁর। Let’s Start.”

বলেই ম্যাজিশিয়ান বাঁদিকে ঘোরাতে শুরু করলেন বক্স এর বাইরের Wheel টি কে।

“এক” চেঁচিয়ে উঠল দর্শক।

“দুই”… “তিন”… করতে করতে “১৫” তে গিয়ে থামলেন জাদুকর এ.সি. সরকার।

“সবাই তৈরী তো?” জিজ্ঞেস করলেন জাদুকর।

“হ্যাঁ। একযোগে উত্তর দিল।” দর্শকেরা।

জাদুকর এবার তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট কে ইশারা করতেই তিনি খুলে দিলেন বক্স এর দরজা। দেখা গেল বক্স এর মধ্যে রয়েছে একটি ১৩-১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটিকে হাত ধরে বক্স এর বাইরে নিয়ে এলেন ওই মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট।

“তোমার নাম কী?” জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিশিয়ান

মেয়েটার চোখ মুখের অবাক ভাব এখনও কাটেনি। মেয়েটি বলল, “আমার নাম সুনন্দিতা… সুনন্দিতা চক্রবর্তী।”

“তুমি কার সাথে এসেছো আজ?” আবার জিজ্ঞেস করলেন জাদুকর।

“ওই তো… ওর সাথে…” মেয়েটি হাত তুলে দেখালো স্টেজের একেবারে সামনে এগিয়ে আসা ভদ্রলোকের দিকে। তাঁর চোখ বিস্ফারিত। তিনি ভাবতেও পারছেন না, এই জিনিস ও হতে পারে।

জাদুকর বললেন, “সময় আর নেই আমাদের হাতে। আজ আমাদের শো এখানেই শেষ হল। আমি জাদুকর এ সি সরকার। Good Night সবাই কে।

কথাটা বলার সাথে সাথেই পর্দা পড়ে গেল স্টেজ এর। সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামীর গলা শোনা গেল একবার, “আর আমার স্ত্রী? ও কোথায়?”

কেউ উত্তর দিল না।

পেছনে ওভারকোট পরা ভদ্রলোক কে আর দেখা যাচ্ছে না। তিনিই সবার আগে হল থেকে বেরিয়েছেন সম্ভবত।

একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে গ্রীন রুমে ঢুকলেন সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামী। চেঁচিয়ে বললেন, “আমার স্ত্রী কোথায়?”

জাদুকর এ সি সরকার তখন নিজের মেকআপ তুলছিলেন। না তাকিয়েই বললেন, “ওই গ্রীন রুমে দেখুন। ওখানেই থাকার কথা।”

–       “ওখানে নেই… আমি দেখেই এলাম।”

–       “তাহলে হয়তো বাথরুমে গেছেন। অপেক্ষা করুন। পেয়ে যাবেন বৌ কে।”

সুনন্দিতা চক্রবর্তীর স্বামী তখন রাগে ফুঁসছে, “হয়তো মানে? আপনারা কেউ জানেন না? একটা দায়িত্বজ্ঞান নেই?”

এ সি সরকার এবার বিরক্ত হলেন, বললেন, “আহ! একি বাচ্চা মেয়ে নাকি? দেখুন নিজেই বাড়ি চলে গেছে হয়তো।”

ভদ্রলোক এর পরেও চেঁচামেচি করতে থাকায়, জাদুকরের হুকুমে দু’জন সহকারী এসে টেনে নিয়ে গেল ওঁকে। তারপর বাইরে বের করে আটকে দিল দরজা।

ভদ্রলোক তখন চেঁচিয়ে বলছেন, “এটা কি ইয়ার্কি নাকি? আমি দেখে নেবো? অন্য লোকের স্ত্রী কে কিডন্যাপ করা? আমি পুলিশে নিয়ে আসছি।”

ঐন্দ্রজালিক পাত্তা দিলেন না। এসব ফালতু হুমকি তে কিচ্ছু আসে যায় না ওঁর।

থানায় ঢুকে দাদার ঘরে ঢুকতে যেতেই একজন কনস্টেবল আটকাল আমাকে। হাত টা নো বলের মত সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল, “কোথায় যাবেন?”

রোজ রোজ এই এক জিনিস! এরা কী কিছু মনে রাখে না! বিরক্তিকর! বললাম, “নীলাদ্রী সেনের কাছে যাবো।”

লোকটি হাত টা না নামিয়েই বলল, “হ্যাঁ, সেতো ওনার ঘরের দিকে এগোচ্ছেন মানে ওর কাছে যাবেন বুঝতে পারছি। কিন্তু উনি এখন ব্যস্ত আছেন। মিটিং এ।”

আমার মাথাটা আজ এমনিতেই গরম ছিল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন যেন ওই কনস্টেবল কে ধমক দিয়ে উঠল, “কার সাথে কী কথা বলছিস সেটা একটু ভেবেচিন্তে বল!”

গলাটা শুনেই চিনলাম আমি। জয়ন্তদার গলা। জয়ন্ত দা সাব-ইন্সপেক্টর। দাদার আন্ডারেই কাজ করে।  কনস্টেবল লোকটি আর কিছু বলল না। জয়ন্ত দার সাথে হাসি বিনিময় হল।

আমি দাদার ঘরে ঢুকে দেখলাম একটি ছেলে বসে আছে দাদার উলটো দিকের চেয়ারে। আমাকে দাদা ইশারা করল পাশেরটায় বসার জন্য। তারপর সামনের ছেলেটি কে বলল, “শোনো তুমি কী বলছো আমার মাথায় ঢুকছে না। আর অত সময়ও নেই আমার। পুলিশের কাজ পুলিশ কে করতে দাও।”

ছেলেটি বলল, “মাথায় যদি না ঢোকে তাহলে আর কাজ টা করবেন কীভাবে? সেটা ভেবে দেখেছেন কী?”

দাদা এবার একটু রাগতস্বরেই বলল, “এই যে চেয়ার টা দেখছো, এখানে এমনি এমনি বসে নেই। তুমি কী করো হে? আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছো?”

ছেলেটি বলল, “ওই যে যেগুলো আপনাদের মাথায় ঢোকে না সেগুলো তে মাথা খাটিয়ে সংসার চালাই!”

আমার এবার একটু অবাক লাগল। ব্যাপার টা কী? পুলিশের সাথে কথা বলতে গিয়ে সাধারনত মানুষ একটু হোঁচট খায়। এতো দেখছি সিক্সার মারছে!

দাদা বলল, “তুমি ভাই আজ এসো। আমার অনেক কাজ আছে। দিবাকর দা বলেছিলো বলে তোমার কথা শুনতে বসেছিলাম। আর খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছি না।”

ছেলেটি উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। তারপর আমার দিকে একবার দেখে দাদাকে বলল, “হুম। ভেবে দেখুন যদি মাথায় ঢোকে কিছু।”

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দাদাকে কিছু বলার আগেই আমার দিকে ফিরে দাদা জিজ্ঞেস করল, “ঘর পেলি তুই?”

বললাম, “নাহ পাইনি! ছেলেটা কে ছিলো?”

দাদা বলল, “ধুর! He is a nobody. বেকারত্বের জ্বালায় নিজেকে কী না কী ভাবছে! বাদ দে।”

–       “কী ভাবছে শুনি!”

“তুই কি এখনও হোটেলে?” দাদার এই প্রশ্নবান গুলোর জন্যেই আমি ওর সাথে দেখা করা কমিয়ে দিয়েছি।

বললাম, “হ্যাঁ হোটেলে। বলছিলাম যে এই প্রশ্নগুলো এবার থাক না। রোজ রোজ একই উত্তর দিতে ভালো লাগছে না।”

দাদা আমার কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই তোর আংটি কি হল? মুক্তো বসানো সোনার আংটি টা?”

–       আরে হাতে বড্ড টাইট হচ্ছিল। আঙুলে লাগছিল। তাই খুলে রেখেছি। দোকানে দেবো।”

–       ওটা খুলতে বারন করেছিল কাকিমা তোকে।

–       আঙুলে টাইট হলেও পরে থাকবো নাকি? যাই হোক। বল কেন ডাকলি আজ আমায়?

–       কাকিমা ফোন করেছিল আজ আমাকে।

–       আবার? উফফ! এতো মহা জ্বালা!

–       তুই ওঁর কষ্ট টা একবার বোঝ! নিজের ছেলে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে থাকছে। তুই ওনার জায়গায় থাকলে কী করতিস?

–       এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে! আমি কি কচি খোকা নাকি?

–       তুই ফিরে আয় না এবার! কাকিমা বড্ড কষ্টে রয়েছে।

–       নাহ রে। ও বাড়িতে আমি আর ফিরবো না। আর তাছাড়া বাড়ির মালিকের তো আমার বাঁচা মরা নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই। তাহলে ফিরে কি লাভ বলতো?

সেই লোকটি এসে এবার সিঙাড়া আর দু’কাপ কফি দিয়ে গেল।

দাদা বলল, “কাকুর ওপর রাগটা তুই আমাদের সবার ওপর কেন দেখাচ্ছিস? প্লিজ ফিরে আয়। কতদিন এভাবে থাকবি। একটা চাকরিও তো নেই এখন তোর হাতে।”

আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। বললাম, “চাকরি তো আমি করব না সেটা আগেই জানিয়েছি। যেটা করতে বেরিয়েছি সেটা ঠিকই করব।”

কথাটা বলেই দাদা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম ওর ঘর থেকে।

থানা থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাটছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজে হাঁটার গতি কমল আমার।

কেউ একজন বলল, “এই যে শুনছেন?”

পেছনে তাকিয়ে দেখলাম। থানার সেই ছেলেটি। বললাম, “শুনলাম। বলুন।”

লোকটি বলল, “তা লেখক বাবু কী থাকার জন্য ঘর খুঁজছেন?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। তা তো খুঁজছি। কিন্তু আপনাকে কে বলল?”

ছেলেটি বলল, “কে আবার বলবে? দেখে শুনে মনে হল?”

–       তাই? কীরকম? একটু শুনি তো!

ছেলেটি বলল, “আপনি দেখলাম থানা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে উলটো দিকের Oxford Bookstore এর দিকে খানিকক্ষন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর এগোতে গিয়েও নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়েই পিছিয়ে এলেন। অর্থাৎ খেয়াল হল আপনার কাছে টাকা নেই। আর আপনার শান্তিনিকেতন মার্কা ঝোলাব্যাগ থেকে একটা পান্ডুলিপি উঁকি মারছে। টাকা নেই অথচ পান্ডুলিপি নিয়ে ঘুরছেন মানে লেখক ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার চান্স একটু কম। আর না হলেও আজকাল দু’লাইন লিখেই লোকজন এমনভাবে নিজেকে হনু ক্লেম করছে যে সবাই এখন লেখক।”

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “আর বাড়ি খুঁজছি কে বলল?”

ছেলেটি বলল, “আপনার দাদা।”

–       মানে? কখন?

–       ওই তো আমি যখন বেরোচ্ছিলাম তখন আপনাকে জিজ্ঞেস করল, ঘর পেয়েছেন কিনা! ওটা শুনে মনে হল।

আমি বললাম, “হুম। খুঁজছি।”

ছেলেটি বলল, “আংটি বিক্রি করে কত পেয়েছেন?”

আমি একটু চমকে গিয়ে বললাম, “ বিক্রি করে মানে? বুঝলাম না। ওটা হাতে লাগছিল তাই খুলে রেখেছি। আর আপনাকে কে বলল আংটির ব্যাপার টা?”

ছেলেটি বলল, “ওসব পরে হবে। বাদ দিন। আপাতত যেটা বলার সেটা হল ফ্ল্যাট শেয়ার করবেন কী? আমার সাথে?”

আমি বললাম, “With All Due Respect আমি তো আপনাকে ঠিক চিনি না, জানিনা। অচেনা মানুষের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকাটা একটু Odd. কিছু মনে করবেন না।”

–        “একদম। I understand. No Problem. আমার কার্ড টা রাখুন মাইন্ড চেঞ্জ করলে ফোন করে নেবেন।”

কার্ড টা হাতে নিয়ে আবার অবাক হলাম। কার্ডের ওপর লেখা আছে, S.H. আর তার নীচে ফোন নাম্বার, ইমেইল আইডি। জিজ্ঞেস করলাম “S.H. মানে? আপনার নাম টা…?

ছেলেটি হেসে বলল, “ওহ! আচ্ছা! আমার নাম… শারদ্বত… শারদ্বত হাজরা।”

সেদিন যখন হোটেলে ফিরলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। হোটেলে ঢোকার সময়েই ম্যানেজার ডাকলেন, “দাদা একবার আসবেন তো!”

গেলাম রিসেপশনের দিকে। ম্যানেজার আমাকে বললেন, “ইয়ে মানে… আপনি তো অ্যাডভান্স দিয়েছিলেন হোটেলে চেক ইন করার সময়। বাকি তো আরও প্রায় ৬ দিনের রয়েছে। ওটা একটু দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কত হয়েছে ৬ দিনে?”

উনি কম্পিউটার স্ক্রীনে কি একটা দেখে বললেন, খাওয়া দাওয়া সহ, ৪৬০০/- টাকা।

ওয়ালেট থেকে বের করে ৫০০০ টাকা দিয়ে দিলাম। বলে দিলাম জমা রাখতে।

আংটির টাকাও প্রায় শেষ। এবার যে কী হবে? শেষ পর্যন্ত কি বাড়িতেই ফিরতে হবে? কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথেই মন টা শক্ত করলাম। অসম্ভব। ওই বাড়িতে আমি আর ফিরবো না। তার জন্যে যদি ভিক্ষে করতে হয় তাও ভালো।

চাবি খুলে ঘরে ঢুকতে গিয়েও বুক টা ধ্বক করে উঠল। ভেতর থেকে টিভি চলার আওয়াজ আসছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আজ সকালে আমি একবারও টিভি চালাই নি। দরজাটায় হালকা করে চাপ দিতেই খুলে গেল। হোটেলের লোকজন কে ডাকব কিনা ভাবছিলাম। পা টিপে টিপে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি বিছানার ওপর পা তুলে বসে আছে স্বয়ং শারদ্বত হাজরা।

আমাকে দেখে বলল, “আরে অনিরুদ্ধ, বলছিলাম যে কিছু ভাবলেন নাকি?”

আমি বললাম, “আপনি ঘরে ঢুকলেন কীভাবে?”

শারদ্বত বলল, “ওই তো দরজা দিয়ে। যেভাবে সবাই ঢোকে। আমার প্রস্তাব টা নিয়ে কিছু ভাবলেন?”

আমি এবার বিরক্ত হলাম। প্রাইভেসি বলে কিছু নেই নাকি? এই জন্যে দাদা ওরকম ভাবে তাড়িয়ে দিল অফিস থেকে। এ ছেলে মোটেই সুবিধের নয়।

বললাম, “এই তো ঘন্টাখানেক আগে আপনাকে না বললাম। আবার ফলো করে করে এখানেও চলে এসেছেন? আপনার মনে হয় এরপর আমি আপনাকে হ্যাঁ বলব?”

শারদ্বত বলল, “গল্প লিখছেন এখন কিছু?”

প্রশ্নটায় আমি একটু থমকে গেলাম। কি জিজ্ঞেস করলাম আর কি উত্তর দিল।

আমি বললাম, “নাহ। এই মুহুর্তে কিছু লিখছি না। কেন?”

–       লিখতে চান?

–       লিখতে চাইলেই তো হল না। ভালো প্লট চাই তো।

–       বাস্তব জীবন থেকে প্লট দিলে লিখবেন নাকি?

–       এ আবার কি হেঁয়ালি মার্কা কথা বার্তা?

–       আপনার ওপরের ফ্লোরে। যাবেন নাকি?

আমি বললাম, “দেখুন, আমার মাথায় এমনিতেও অনেক চাপ রয়েছে। এখন এসব হেঁয়ালি ভালো লাগছে না। আপনি কি যাবেন নাকি আমি হোটেলের লোককে ডাকব?”

শারদ্বত বলল, “এক ঘন্টা। ওপরের ফ্লোরে আমার সাথে চলুন। ভালো না লাগলে বা আপনার কোনো কাজে না লাগলে নেমে চলে আসবেন। আপনাকে আমি আর বিরক্ত করব না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাহ এর হাত থেকে মুক্তি নেই। বললাম, “ঠিক আছে চলুন।”

শারদ্বত বলল, “বেশ। আর একটা শর্ত আছে।”

–       আবার কী?

–       আপনি টা ভালো লাগছে না। যেখানে আমরা যাচ্ছি সেখানে পরস্পর পরস্পর কে তুমি বলে সম্বোধন করাটাই ভালো।

–       কেন? কোথায় যাচ্ছি আমরা?

শারদ্বত বলল, “আরে চলো না। দেখতে পাবে।”

বাবাহ! এ তো যেমন বলা তেমন কাজ! সঙ্গে সঙ্গে তুমি তে নেমে গেলো। যাই হোক হোটেলের ঘর চাবি দিয়ে শারদ্বতর সাথে উঠে গেলাম ওই হোটেলেরই ঠিক ওপরের ফ্লোরে।

(চলবে)

ইন্দ্রজাল রহস্য – প্রথম পর্ব

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি