“মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
হাত গোন ভাত পাঁচ
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।
ফাল্গুন তাল জোড়
দুই মাঝে ভুঁই ফোড়
সন্ধানে ধন্দায় নবাবে।।”
নাহ। আমি ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’এর রিমেক করছিনা। আর লাইনগুলো চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করে লজ্জাও দিতে চাইছি না। ফেলুদার গল্প পড়েনি বা ফেলুদার সিনেমা দেখেনি এরকম বাঙালীর সংখ্যা হাতে গোনা যায়। আর ‘ফেলুদার গল্প যারা পড়েনি তারা ঠকেছে। ভাল জিনিস উপভোগ না করতে পারার দুঃখ আর কিছুতে নেই’। এটা আমার কথা নয়। বিখ্যাত লেখিকা লীলা মজুমদারের কথা। মোট কথা হল গিয়ে ফেলু মিত্তিরকে দুনিয়া শুদ্ধু লোক চেনে। যারা বইয়ে পড়তে পারেনি তারা চেনে সিনেমার দৌলতে।
ফেলুদার আবির্ভাব ১৯৬৫ সালে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গল্পে। প্রত্যেকটা গল্পই লেখা তার খুড়তুতো ভাই এবং সহকারী তোপসের জবানীতে। তবে প্রথম গল্পে আমরা ফেলুদাকে পাই তোপসের মাসতুতো দাদা হিসেবে। পরের গল্প ‘বাদশাহী আংটি’তে অবশ্য সেটা জ্যাঠতুতো দাদা হয়ে যায়। অনেক পাঠকের মনেই হয়ত প্রশ্ন এসেছিল (আমারও এসেছিল) যে মাসতুতো দাদা হঠাৎ জ্যাঠতুতো হয়ে যায় কি করে! লেখকের নিজেরও হয়ত ঘটনাটা নজরে এসেছিল। তাই কায়দা করে ‘অম্বর সেন অর্ন্তধান রহস্য’তে ফেলুদার জবানিতেই প্রশ্নের উত্তরটা আমাদের দিয়ে দিলেন- ‘প্রথমে (তোপসে) মাসতুতো ভাই লিখেছিল বটে, তখন ও গপ্পের মত বানিয়ে লিখতে চেষ্টা করছিল। আমি ধমক দিতে তারপর সত্যি কথাটা লিখতে শুরু করল। আসলে জ্যাঠতুতো ভাইটাই ঠিক।’ আসলে লেখকের নাম যেহেতু সত্যজিৎ রায় তাই ফাঁকি কোনো জায়গাতেই থাকবে না এটা তো সহজেই অনুমান করা যায়। তবে ফেলুদাকে নিয়ে এতগুলো উপন্যাস বা গল্প যে লিখবেন সেটা হয়ত লেখক প্রথমে একেবারেই ভাবেননি। সেই কারনেই বাদশাহী আংটি উপন্যাসে ফেলুদাকে আমরা একটা বেসরকারী সংস্থায় চাকরী করতে দেখি। তবে লখনউএর পটভূমিকায় এই উপন্যাসটা প্রকাশিত হওয়ার পরে চারিদিকে এমন সাড়া পড়ে গেল যে লেখক ফেলুদাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে প্রায় বাধ্য হলেন। তবে পরবর্তী উপন্যাস ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’এ ফেলুদাকে পাকাপাকি গোয়েন্দা বানানোর পেছনে আরও একটা কারনও আছে। সেটা হয়ত অনেকেই জানেন না। যারা জানেন না তাদের জন্য কারনটা আমি বলে দিই।
১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সংকলনটা প্রকাশিত হয়। এর কয়েকদিন পরে প্রযোজক আর ডি বনশলের ছেলের বিয়ের রিসেপশন পার্টিতে লেখকের সাথে আলাপ হয় দেশ পত্রিকার তখনকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সাথে। ওনার প্রফেসর শঙ্কুর গল্প এতটাই ভাল লেগেছিল যে উনি সরাসরি সত্যজিৎ রায়কে প্রস্তাব দেন দেশের শারদীয়া সংখ্যার জন্য একটা গোয়েন্দা উপন্যাস লিখতে হবে। উনি (লেখক) তো প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন। কারণ ‘দেশ’ পত্রিকা মোটামুটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আর বড়দের জন্য ফেলুদার গল্প লেখার কথা কোনোভাবেই সত্যজিৎ রায়ের মনে ছিলনা। কিন্তু সম্পাদক মশাই তার কথা শোনেননি। এরপর মাঝে মাঝেই ফোন করতেন সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। এদিকে লেখক তখন ‘প্রতিদ্বন্দী’ সিনেমার শুটিং নিয়ে খুব ব্যস্ত। তাই প্রত্যেকবারেই সম্পাদককে না শুনতে হচ্ছিল। শেষটায় একদিন সাগরময় ঘোষ সোজা সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে এসে ধর্না দেন। তিনি ছিলেন হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী। লেখকের বাড়ির তিনতলার সিঁড়ি ভাঙ্গার পর তিনি রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর একরকম বাধ্য হয়েই ওনার জেদের কাছে হার স্বীকার করে সত্যজিৎ রায় ‘দেশ’ এর জন্য লিখতে শুরু করেন ফেলুদাকে নিয়ে। তবে তাঁর একটা শর্ত ছিল। উপন্যাস কিন্তু ছোটদের জন্যই হবে। সম্পাদক মশাই আর না করেননি। এরপরেই লেখা হয় ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’ যার প্রথম খসড়ায় নাম ছিল ‘গ্যাংটকে ফেলুদা।’
এরপরের গল্প সোনার কেল্লা লেখা হয় ১৯৭১ সালে। এই গল্পতেই আমরা প্রথম পাই বিখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুকে। তবে যারা ফেলুদার সব গল্প খুব খুঁটিয়ে পড়েছে তারা হয়ত মনে করতে পারবে ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’ এর নিশিকান্ত সরকারের কথা। এই উপন্যাসে জটায়ু ছিলেন না। কিন্তু ‘রিলিফ ক্যারেক্টার’ হিসেবে ছিলেন নিশিকান্ত। অনেকটা এর আদলেই জটায়ুকে তৈরী করেছিলেন লেখক। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এই নিশিকান্তের সাথে জটায়ুর অনেক চারিত্রিক মিল রয়েছে। আর জটায়ুর কথা আলাদাভাবে আর কি বলব। তবে একটা ছোট্ট তথ্য দিয়ে রাখি। ফেলুদার গল্পের সাথে সাথে জটায়ুর জনপ্রিয়তাও এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে একটা সময় অনেকে ফোন করে সত্যজিৎ রায়ের কাছে জানতে চেয়েছেন যে ‘পরের জটায়ুর গল্প কবে বেরোচ্ছে?’
ফেলুদার গল্প উপন্যাস গুলোতে একজন বিদেশী গোয়েন্দা চরিত্রের ছায়া সবসময় লক্ষ্য করি আমরা। হ্যাঁ। আমি শার্লক হোমসের কথাই বলছি। ফেলুদা নিজেও শার্লককে নিজের গুরু বলে মানত। ‘লন্ডনে ফেলুদা’ গল্পে তো আমরা ফেলুদাকে বেকার স্ট্রীট এ শার্লক হোমসের বাড়ির সামনে গিয়ে গিয়ে বলতে শুনি, “গুরু তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি। আজ আমার লন্ডনে আসা সার্থক হল।” আর ফেলুদার চরিত্রে আর তদন্ত পদ্ধতিতে যে শার্লক হোমসের ছাপ আছে সেটা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখেন না।
ও হ্যাঁ। আর একজনের কথা তো বলতেই হয়। ফেলুদাকে নিয়ে লিখতে বসে এই ব্যক্তির কথা না লিখলে সে লেখা তো অসম্পূর্ন থেকে যাবে। মগনলাল। মগনলাল মেঘরাজ। প্রথম এর সাথে ফেলুদার মোলাকাত হয় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পে। তারপর ‘যত কান্ড কাঠমান্ডু’ তে এবং শেষের বার সাক্ষাৎ হয় ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ তে। এখানেও কিন্তু স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ছাপ স্পষ্ট। শার্লক হোমসেরও এক প্রতিদ্বন্দী ছিল যে অনেক গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। শেষবার এসেছে ‘ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে। যারা হোমসের গল্প পড়েছে। তাদের সকলেরই নামটা জানা। প্রফেসর মরিয়ার্টি। ঘটনা চক্রে ফেলুদারও পয়লা নম্বর শত্রুর নামের প্রথম অক্ষর ‘ম’। তবে ভিলেন ভাল না হলে নায়কের কেরামতি দেখানোর তেমন সুযোগ থাকেনা। আর কাহিনির পটভূমিকা আলাদা হলেও চেনা প্রতিপক্ষ যদি বারবার ফিরে আসে তাহলে হয়ত পাঠকদের মনে হয় যে কিছু শ্বাসরোধকারী ব্যাপার স্যাপার ঘটতে পারে। এইভাবে পাঠকদের মনোযোগ টানাটাও সোজা হয়। আর এই থিওরী মেনেই হয়ত মরিয়ার্টি বারবার ফিরেছে কোনান ডয়েলের লেখায়। আর মগনলাল মেঘরাজ সত্যজিৎ রায়ের লেখায়।
শেষ করব একটা বিশেষ ঘটনা দিয়ে। ১৯৮৩ সালের ১লা অক্টোবর প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হয় সত্যজিৎ রায়ের। সেইদিনই তাকে ভর্তি করা হয় বেলভিউ নার্সিংহোমে। সে যাত্রায় সেরে যান। তবে নার্সিংহোমে তাকে অনেকদিন থাকতে হয়েছিল। ওই বেলভিউতেই ৬ই নভেম্বর লেখক শুরু করেন ‘এবার কান্ড কেদারনাথে’ উপন্যাসটি। একদিন লেখার পর কয়েকদিন বিরতি। তারপর ১৪ই নভেম্বর থেকে টানা দশদিন একনাগাড়ে লিখে শেষ করেন উপন্যাসটি। আর নার্সিংহোমে থাকাকালীন সেই লেখার প্রথম খষড়ায় উপন্যাসটির যে নাম লেখক দিয়েছিলেন সেটা ওইরকম অসুস্থ অবস্থাতেও একমাত্র ওনার পক্ষেই সম্ভব- “কেদারদা, বদ্রীদা আর ফেলুদা!”
আজ ২রা মে ,ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে ওনার প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রনাম।