প্রথম পর্ব – অগ্নিভ
১
বহুদিন একটা মানুষের সাথে থাকতে থাকতে সেই মানুষ টা আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আর অভ্যাস একবার হয়ে গেলে সেটা থেকে বের হওয়া বেশ কষ্টের। তখন সেই অভ্যাসের সাথে জুড়ে থাকা সমস্ত স্মৃতি আরও বেশি করে হানা দেয় মনের মধ্যে।
“কীরে কিছু বল? যাবি তো তুই?”
রাতুলের গলার আওয়াজে ঘোরটা একটু কেটে গেল অগ্নিভর!
“হুম? কোথায় যাবো?” জিজ্ঞেস করল ও।
পুষ্পক হেসে বলল, “সাতকান্ড রামায়ন পড়ে জিজ্ঞেস করছিস সীতা লক্ষনের বৌদি?”
উফফ! এই ছেলেটা সব সময় আমিষ জোক ক্র্যাক করতে থাকে। মাঝে মাঝে বড্ড বোরিং লাগে সেটাও বোঝে না।
অগ্নিভ আবার জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবি সেটা তো বল?”
রাতুল বলল, “আরে বিরিয়ানি খেতে যাবি কিনা বল? আজ তো স্যালারি ঢুকল! তাই ভাবছিলাম অফিসের পর সিরাজে যাই চল!”
আবার বিরিয়ানি? কেন? কেন? এই শব্দটা ওর আর শুনতে ইচ্ছে করে না। কেন তবুও ওকে জোর করে শুনতে হবে এটা? এবার খেয়াল হল অগ্নিভর, একটু আগে এই খেতে যাওয়া নিয়েই আলোচনা করছিল ওরা। তখনই ওই অভ্যাসের কথাটা ওর মাথায় চলে এসেছিল।
পুষ্পক আবার জিজ্ঞেস করল, “কী মামা, যাবে?”
অগ্নিভ বলল, “নারে। আজ ভালো লাগছে না! আজ থাক।”
কথাটা বলেই ও সরে এল ওই আড্ডা থাকে। ওদের সাথে থাকলে ওরা যেমন করেই হোক রাজি করিয়েই ছাড়বে। ওরা অর্থাৎ ওর অফিসের কলিগেরা। অগ্নিভ রাজারহাটে… না… অগ্নিভ কী করে সেটা একেবারেই ইম্পরট্যান্ট নয়। চুরি ডাকাতি করে না এটুকু জেনে রাখলেই আমাদের গল্প এগিয়ে যাবে।
“ওই চল না তুই!”
ব্যাকগ্রাউন্ড দেওয়ার মাঝেই কথাটা বলল অহনা।
ঠিক ভয় টাই ও পাচ্ছিল। ও জানতো অহনা আসবে ওকে বলার জন্যে। তখন পুষ্পকদের কথার মাঝে কিছু বলেনি। আর অহনা কে সব সময় না বলতে ও ভালো লাগে না। মেয়েটা প্রথমত বড্ড ভালো। আর দ্বিতীয়ত অহনার ওপর একটা কিছু রয়েছে সেটা ও বুঝতে পারে। কিন্তু এটা তো কোনোদিনই হওয়ার নয়। কাজেই ও যে বিরিয়ানি খেতে যেতে চায় না সেটা শোনাতে হল অহনাকেও।
কিন্তু অহনা শোনবার নয়। বার বার খালি বলছিল, “কী হবে একটা দিন গেলে? আমরা সবাই তো যাচ্ছি! প্লিজ চল।”
“বললাম তো ইচ্ছে করছে না। কেন জোর করিস?” একটু জোরেই বলল এবার অগ্নিভ, “তোরা যা না তোদের ইচ্ছে হলে। আমায় বলছিস কেন?”
কথাগুলো বোধহয় কানে গেল রাতুল আর পুষ্পলের। অহনা আর কথা না বাড়িয়ে মাথা নীচু করে চলে গেল। একটু খারাপ লাগল অগ্নিভর। ও কথাটা জোরে বলতে চায় নি। কিন্তু… বিরিয়ানির কথাটা শুনেই মাথাটা দপ করে যেন জ্বলে উঠল।
২
– হ্যালো!
– বল রে…
– ব্যাস্ত?
– নাহ চিকেনের একটা নতুন রেসিপি ট্রাই করছিলাম।
– মানে বানাচ্ছিলি না খাচ্ছিলি?
– অত জেনে কী করবি? কেন ফোন করেছিস সেটা বল আগে।
– কোন কারন ছাড়া আমি ফোন করতে পারি না বুঝি?
– ন্যাকা বয়ফ্রেন্ড হয়ে যাচ্ছিস তুই দিন দিন! অবশ্যই পারিস। কিন্তু এটা তোর খাওয়ার সময়। এই সময়ে ফোন করেছিস মানে হয় কোন সমস্যায় পড়েছিস। নয় কোনো ধান্দা আছে।
– খুব ভালো চিনিস বল!
– ৬ বছর হয়ে গেল ভাই। চিনব না আবার! এবার বল তাড়াতাড়ি। আমার মাংস পুড়ে গেল!
– তোর মাংস? চিকেনের বললি যে!
– উফফ! পিজে ক্র্যাক না করে কাজের কথা বল।
– ও হ্যাঁ। বলছি যে নীল ছোটো বোতল টা খুঁজে পাচ্ছি না।
– কেন বড় টা কী হল?
– বড় টায় ভাবছি ঠান্ডা জল রাখব ফ্রীজে। ছোটো টা নিয়ে খেতে বসতাম।
– ছোটো টা ফ্রীজে রাখা আছে। জল ভরে।
– তাই? কখন করলি?
– আজ সকালে চা খাওয়ার পর যখন FRIENDS দেখতে ডাকছিলি…
– ও হ্যাঁ। তুই বললি ২ মিনিট পর আসছিস!
– হ্যাঁ। তখন ওই বোতলেই জলটা ভরছিলাম।
– ওহ! আচ্ছা। Thank you so much.
– মরণ দশা!
– Moron বললি?
– অ্যাই তুই এবার রাখ। নাহলে কাল পোড়া চিকেন খেতে হবে তোকে!
– আমার জন্য বানাচ্ছিস? সত্যি!!
– হ্যাঁ রে বাবা। তোর জন্যেই। আর কার জন্যে বানাবো?
– নাহ মানে… সিক্রেট যদি কেউ থাকে… তাহলে…
– তাকেও অল্প ভাগ দেবো তো! এটা থেকেই।
– কী বললি?
– বললাম রাখ এবার।
– তোকে ছাড়া যে কী করব আমি কে জানে!
– কিচ্ছু করবি না। ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘর সংসার করবি।
– পাগলাচোদার মত কথা বলিস না তো! তোর মনে হয় আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করব?
– আমি না থাকলে তো করতেই হবে!
– বাল করবো আমি।
– বেশ বালই করিস না হয়। আপাতত টাটা। হাতে খুন্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তখন থেকে।
– ওহ হ্যাঁ। সরি। বাই।
৩
বাড়ি ফেরার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল অগ্নিভ। ওর বেঁচে থাকাটা কেমন একটা অদ্ভুত হয়ে গিয়েছে। ও জানে ও বেঁচে আছে। কিন্তু ওর নিজের যেন কোন অস্তিত্ব নেই। রোবটের মত রোজ সকালে ও অফিস যায়। আবার অফিস থেকে ফিরে আসে। বাবা-মার সাথেও কোনো যোগাযোগ নেই। আর ওরাও এখন আর যোগাযোগ করে না নিজে থেকে।
অবশ্য তার জন্য দায়ী অগ্নিভ নিজেই। আসলে সব ভেঙে যাওয়ার পর ওর মা কয়েকবার ওকে ফোন করেছে। ওর কাছে এসে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু ও তখন যেন পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল! তাই ফোন রিসিভ তো করেই নি। উলটে একদিন ফোন করে আজেবাজে যা মুখে এসেছে বলে দিয়েছে!
ফোনের আওয়াজে ওর হঠাৎ ঘোর কাটল, দীপম ফোন করছে। দীপমই এখন এমন একজন যার ফোন ও রিসিভ করে। যার কাছে ফোন করে ও কাঁদতে পারে। এই ছেলেটিই এমন একজন যে কখনও বলে না, “ভাই ছেলে হয়ে কাঁদিস লজ্জা করে না?”
ওর অফিসের কলিগ পুষ্পল কে ও এটা কাউকে একটা ফোনে বলতে শুনেছে! ও দীপমের ফোন টা রিসিভ করল।
– হ্যাঁ বল…
– একটা কথা বলার জন্য তোকে ফোন করলাম। জানিনা কতটা কাজে লাগবে…
– কী হয়েছে?
– ইয়ে… মানে… মেয়েদের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার চুরি করে উল্টোপাল্টা সাইটে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে এ সংক্রান্ত একটা খবর দেখলাম।
– সিরিয়াসলি?
– হ্যাঁ রে। তো ফেসবুক ওই প্রোফাইল পিকচার গার্ড বলে কী একটা নতুন জিনিস ইন্ট্রোডিউস করেছে। ওটা করলে কেউ ডাউনলোড করতে পারবে না প্রোফাইল পিকচার।
– ওহ। আচ্ছা। তা আমাকে কেন বলছিস? ছেলেদের ফটোও কি চুরি হচ্ছে নাকি?
– না… মানে… সৃষ্টির প্রোফাইল পিকচার টা যদি তুই… মানে… প্রোটেক্ট করতে চাস… সেই কারনেই…
সৃষ্টি! যাক… গল্পের মাঝে শেষ অবধি নামটা কেউ একটা বলল! সৃষ্টি কেই ধরে রাখতে পারল না… আর প্রোফাইল পিকচার কে গার্ড করে আটকে রেখে আর কী হবে…
“কীরে শুনলি?” ও প্রান্ত থেকে দীপমের কন্ঠস্বর শোনা গেল।
অগ্নিভ বলল, “হ্যাঁ রে। শুনলাম। কিন্তু একটা কথা বল..”
– কী?
– যদি কেউ স্ক্রীনশট তুলে নেয়। তাহলে? গার্ড দিয়ে কী লাভ?
– ও হ্যাঁ। তাও ঠিক। যাই হোক… হঠাৎ মনে হল তাই তোকে বললাম…
– আরে না না। বেশ করেছিস!
দীপম আর তেমন কিছু বলল না। রেখে দিল ফোন। অগ্নিভ চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। সৃষ্টি কে কতদিন দেখে নি ও। ৬ মাস হয়ে গেল প্রায়। ওর পাসওয়ার্ড তো জানে অগ্নিভ। একবার কী খুলবে ওর প্রোফাইল? আজ দীপমের ফোন টা হঠাৎ কেমন যেন পুরোনো ঘা টা ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেল।
৪
– এই নে। টেস্ট করে দেখ।
– কি নাম এটার?
– পেপার চিকেন।
– কাগজ চিকেন? কাগজ দিয়ে বানিয়েছিস?
– হ্যাঁ রে। তুই অশিক্ষিত। তাই ভাবলাম কাগজ খেয়ে যদি একটু শিক্ষা হয় তোর।
– চটে যাচ্ছিস কেন?
– খেয়ে দ্যাখ আগে… তারপর বাকি কথা…
– দে দে দেখি…
– এই নে…
– ইউ!
– What? ইউ মানে? খারাপ হয়েছে?
– আরে না রে পাগল। আই লাভ টা চিকেনের সাথে গলা দিয়ে পেটের ভেতর চলে গেছে। আমি বলতে গেছিলাম আই লাভ ইউ।
– খুব ভালো মেক আপ দিতে পারিস কিন্তু।
– জানি তো! তা আজ হঠাৎ এত ভালোবাসা কেন?
– আজকের তারিখ টা কত?
– ৭ই সেপ্টেম্বর। কেন?
– মনে কর। মনে কর।
– প্রথম চুমু?
– হ্যাঁ শুরুতেই চুমু? ভাগ শালা!
– তাহলে… প্রথম ইয়ে?
– না। ইয়ের বাইরে বেরো আগে।
– ওহ মনে পড়েছে! আজ প্রোপোজ করেছিলাম না?
– হুম।
– সরি সরি। একদম ভুলে গেছিলাম। সরি রে।
– ঠিক আছে। চাপ নেই। হতেই পারে।
– তুই কখনও রাগিস না… না?
– কেন রাগব না? তবে এই সব পাতি কারনে রেগে যাই না আমি।
– হুম। ঠিক আছে… চল আজ বিরিয়ানি খাই।
– আচ্ছা চল। আমি পে করব কিন্তু।
– দেখা যাবে! এই এক সেকেন্ড?
– কী হল? আজ তো কনফারেন্স হলে মিটিং আছে। মার গেড়েছে। আজ অফিস যেতেই হবে। এবং ফিরতেও রাত হয়ে যাবে! আজ কী করে যাবো?
– ওহ তার জন্য এই তো! বাবার প্রেসক্রিপশনের প্যাড থেকে ছিঁড়ে আনা মেডিকেল রিপোর্ট?
– তুই লিখেছিস এটা?
– আবার কে লিখবে?
– তার মানে তুই জানতিস আমি আজ বিরিয়ানি খেতে নিয়ে যাবো তোকে?
– জানতাম তো।
– আর তুই এটাও জানতিস যে আমার মিটিং আছে অফিসে?
– পরশু রাতেই তো বললি!
– তোর সব মনে থাকে… না?
– সব! আর সব কিছুর জন্য প্ল্যান করা থাকে।
– So you are like Batman?
– উফফ! আবার শুরু করলি ব্যাটা! সবেতেই ব্যাটম্যান খোঁজা বন্ধ কর।
– তোকে ছাড়া যে কী করব আমি!
– অত ভাবিস না তো! আমাকে ছেড়ে কিছু করতে চাইলেও ইয়ে ভেঙে হাতে দিয়ে দেবো!
– কি মিষ্টি করে বললি!
– শাট আপ। তাহলে কখন মিট করছি আমরা?
– মিট কেন করব? তুই এখন থাক না আমার এখানে! কয়েক ঘন্টা পর বেরোবো একসাথে।
– এই না রে। পড়ানো আছে! কোথায় খাবো আজ?
– আর্সেলানে খাই?
– তাই চল। আমি ৯ টার সময় পার্ক সার্কাস আর্সেলানের সামনে মিট করছি তাহলে।
– আচ্ছা বেশ। তাই হবে!
৫
ল্যাপটপ টা খুলে ফেসবুক টা খুলল অগ্নিভ। আই ডি আর পাসওয়ার্ডের জায়গায় সৃষ্টির ইনফরমেশন গুলো দিয়ে লগ ইন ক্লিক করতে গিয়ে একবার থেমে গেল ও। কাজ টা কী ঠিক হবে? ওর অ্যাকাউন্ট খোলাটা কি উচিত হবে? যতই পাসওয়ার্ড জানুক না কেন! এসব বড্ড ব্যক্তিগত জায়গা।
ফোন টা বেজে উঠল ওর। রাতুল ফোন করছে। এই সময় কেন? আবার যেতে বলবে নাকি? ও তো বলল বিরিয়ানি খেতে চায় না ও। ধরবে না ভেবেও শেষ অবধি ফোন টা ধরল ও।
“ভাই কী করলি বল তো?” ও প্রান্ত থেকে রাতুল জিজ্ঞেস করল।
মানে? কী আবার করল ও?
অগ্নিভ জিজ্ঞেস করল, “কী করলাম মানে?”
রাতুল বলল, “জানিস তো অহনার তোকে ভালো লাগে। ওভাবে সবার সামনে ওকে কেন এরকম বললি!”
অগ্নিভ বলল, “এক কথা বলে যাচ্ছিল! আরে আমার ইচ্ছে করছে না বিরিয়ানি খেতে। এই সহজ ব্যাপার টা ওর মাথায় ঢুকছিল না কেন?”
রাতুল বলল, “সব মানছি ভাই। তোর অবস্থাটাও আমরা বুঝি। কিন্তু মেয়েটা বেচারা খুব কষ্ট পেল। অফিসের বাথরুমে গিয়েও নাকি কেঁদেছে শুনলাম। আর আমাদের সাথে তো আর গেলোই না। প্ল্যান টাও ক্যান্সেল হয়ে গেল।”
উফফ! এই মেয়েটাও না! এত অল্পেতে কাঁদলে হয়? আরে ও কি ইচ্ছে করে ওকে ওরকম বলল! নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন টা আস্তে আস্তে যেন হারিয়ে ফেলছে অগ্নিভ।
রাতুল বলল, “যাই হোক… ফোন করিস ওকে একবার। আমি আর পুষ্পল ভাবলাম বাগবাজারে ওর বাড়িতে একবার যাবো। কিন্তু… তারপর ভাবলাম একা মেয়ে থাকে… শুধু শুধু ডিস্টার্ব করে লাভ নেই!”
অগ্নিভ কান থেকে ফোন টা নামিয়ে রাখল! আর শুনতে ভালো লাগছে না ওর। তারপর ক্লিক করে দিল লগ ইন আইকন টায়।
কিছুক্ষন লোড হয়েই সৃষ্টির প্রোফাইল টা খুলে গেল! কতক্ষন যে ও সৃষ্টির ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল ওর নিজেরও খেয়াল নেই! হঠাৎই টুং করে একটা শব্দ শুনে ও দেখল একটা মেসেজ এসেছে। কেউ একটা লিখেছে, “Hi! Long Time no See!”
নাম কৃশানু। শাহরুখ খানের ছবি দেওয়া প্রোফাইলে। এই ছেলেগুলো পারেও বটে। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই এদের অন্তরাত্মা অবধি উত্তেজিত হয়ে যায়। রিপ্লাই না পেলেও লোকজন হাল ছাড়ে না। অগ্নিভ খেয়াল করল এর সাথে আগে কিছু কথা হয়েছে সৃষ্টির। কিন্তু ও তো কখনও এই কৃশানুর কথা বলে নি!
কৌতূহল বশতই চ্যাট টা খুলল অগ্নিভ। ছেলেটি আর মেসেজ করছে না। সম্ভবত অফলাইন হয়ে গিয়েছে! পুরোনো চ্যাট গুলো দেখার জন্য স্ক্রল করতে থাকল অগ্নিভ। সৃষ্টি বেশ নিয়মিত ভাবেই কথা বলেছে এই ছেলেটির সাথে। মেসেজ পড়ে মনে হল ওরা দেখাও করেছে। এবং সব টাই হয়েছে ৬ মাস আগে… অর্থাৎ যখন অগ্নিভর সাথে ওর…
জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে অগ্নিভর। হঠাৎ একটা জায়গায় এসে ওর চোখ টা স্থির হয়ে গেল! সৃষ্টি যে কথাটা লিখেছে সেটা… সেটা ওর নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না। ও লিখেছে, “আজ পেপার চিকেন নিয়ে আসছি তোমার ফ্ল্যাট এ। ৭ টার মধ্যে। তার আগে একটা ছোট্টো কাজে যেতে হবে!”
অর্থাৎ সেদিন সৃষ্টি পড়াতে যায় নি। ওর বাড়ি থেকে… ওর বাড়ি থেকে ও গিয়েছিল কৃশানুর ফ্ল্যাটে। আর ভাবতে পারল না ও। ল্যাপটপ ঠেলে সরিয়ে দিল দূরে। ওর ভেতর থেকে একটা চিৎকার ফেটে বেরোতে চাইছে বাইরে। কিন্তু… কিন্তু… পারছে না ও চেঁচাতে। চোখের কোন দিয়ে জল বেরিয়ে এল অগ্নিভর।
কাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাইছিল ও? এই মেয়েটা? যে ওকে… যে ওর সাথে থাকাকালীন… আর কিছু ভাবতে পারল না ও। আর কিচ্ছু ভাবতে পারল না।
দ্বিতীয় পর্ব – সৃষ্টি
কলেজে পড়ার সময় লোকজন বলত অগ্নিভ সৃষ্টির কোনোদিন ব্রেক আপ হবে না। ওর সারাজীবন নাকি একসাথে থাকবে। কথাটা শুনে বেশ মজা লাগত সৃষ্টির। সারা জীবনের কনসেপ্ট টা খুব ভালো হলেও কতটা বাস্তব সেই নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে ওর মনে। তবে ও এটা বুঝতো ছেলেটা ওকে বড্ড ভালোবাসে।
তাই যখনই অগ্নিভ বলত, “তোকে ছাড়া আমার যে কী হবে?”
তখনই খুব মন খারাপ হয়ে যেত ওর। সত্যিই তো ও না থাকলে এই পাগল ছেলেটাকে কে দেখবে? ওদের অফিসে একটি মেয়ে রয়েছে। নাম অহনা। সৃষ্টির মেয়েটিকে ভালো লেগেছিল। আর এটাও বুঝেছিল মেয়েটির অগ্নিভ কে ভালো লাগে। তবে অগ্নিভ যে কখনও এই বিষয় টাকে আমল দেবে না তা ও জানত।
কিন্তু ও না থাকলে অগ্নিভর কী হবে এটা ওর মাথায় সব সময় ঘুরপাক খেত। কারন ও যতদূর জানে ও কোন কারনে চলে গেলে বা ওর সাথে ব্রেক আপ হলে অগ্নিভ কিছুতেই মুভ অন করবে না।
তাই এর জন্য একটা প্ল্যান করে রেখেছিল ও। একটা ফেক প্রোফাইল খুলে ফ্রী টাইমে নিজেই চ্যাট করত নিজের সাথে। ও ভেবেছিল অগ্নিভকে যদি এটা বোঝানো যায় যে ও cheat করেছে তাহলে রাগে ঘেন্নায় ছেলেটির হয়ত অন্য মেয়ের দিকে মতি ফিরবে। সেই থেকেই কৃশানুর জন্ম। আর কে না জানে! কৃশানু অগ্নির আর এক নাম!
দীপম, মানে অগ্নিভর বেস্ট ফ্রেন্ড কে বলা ছিল ব্রেক আপের ৬ মাস পরেও যদি ও মুভ অন না করে তাহলে কিছু একটা অজুহাত দিয়ে যেন সৃষ্টির প্রোফাইল টা ও অগ্নিভ কে দিয়ে খোলায়। আর পারলে এই কৃশানুর প্রোফাইল থেকে একটা পিং যেন করে। এর পাসওয়ার্ড ও দিয়েছিল দীপম কে।
সেদিন পড়িয়ে বেরোতে খুব লেট হয়ে গিয়েছিল সৃষ্টির। অগ্নিভ পৌঁছে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪৫ মিনিট। বার বার ফোন আসছিল ওর ফোনে। বাস থেকে নেমে রাস্তার এপার থেকে ও দেখল রাগী রাগী মুখ করে আর্সেলানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিভ। সৃষ্টি কে তখনও দেখেনি সে। তাড়াতাড়ি করে রাস্তা পার হতে গিয়েই হঠাৎ কানের কাছে খুব জোরে আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে মুহুর্তের জন্য দেখল একটা লরি চলে গেল ওর মধ্যে দিয়ে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ভীড় জমে গিয়েছিল ওখানে। আরো ১০ মিনিট পরে ভীড় ঠেলে অগ্নিভ এগিয়ে এল সামনের দিকে। সৃষ্টি দেখেছিল অগ্নিভ ওর পড়ে থাকা দেহ টার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
তবে এখন সৃষ্টি ওকে সব সময় দেখতে পায়। কাজেই ওর এখন আর তেমন মন খারাপ লাগে না। ওর শুধু একটাই আক্ষেপ। অগ্নিভ ওই ঘটনার পর থেকে বিরিয়ানি শব্দটাই সহ্য করতে পারে না। যে ছেলেটি একসময় বিরিয়ানির জন্য পাগল ছিল, সে আজ বিরিয়ানি শুনলেই চেঁচিয়ে ওঠে।
আজ সৃষ্টির মন টা একটু বেশী ভালো। ওর প্ল্যান মাফিক সব কাজ কমপ্লিট। ও দেখল একটা বাইক এসে থামল বাগবাজারের একটা পুরোনো বাড়ির সামনে। বাড়িটা অহনার। অগ্নিভ বাইক থেকে নেমে গেটের কাছে গিয়ে কলিং বেল টা বাজাতে গিয়েও থেমে গেল। কী হল? থামল কেন ও? ঢুকবে না নাকি?
সৃষ্টি দেখল অগ্নিভর চোখ তখন গেছে উল্টোদিকের একটি দোকানে। বিরিয়ানির দোকানে। দু’প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে অগ্নিভ হাত বাড়াল অহনার বাড়ির কলিং বেলের দিকে।
যাক! সৃষ্টির কাজ এবার শেষ হয়েছে! এবার অহনার পালা।
ভালোবাসাটা নষ্ট না করলেই পারতে 🙁