বাইরে একা থাকলে সব থেকে বেশী যে সমস্যাটা হয়, সেটা হল খাওয়ার সমস্যা। নিজে রান্না করতে জানি। কিন্তু এক আধ দিন ছুটি পেলে আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না। কাজেই অগতির গতি সেই ভাতের হোটেল। আমি যে হোটেলে খেতে যাই সেখানে মোটামুটি সমাজের সব স্তরের লোকজনেরাই খেতে আসে। রিক্সাওয়ালা যেমন আসে তেমনি পুলিশও আসে মাঝে মধ্যে। এর মধ্যে একজন পুলিশ আছে তাকে সবাই রায় বাবু বলে ডাকে। সে মাঝে মধ্যেই রয়েল এনফিল্ড নিয়ে খেতে আসে। এবং ও এলেই একটা টেবিল পুরো ওর জন্য ছেড়ে দিতে হয়। মাঝে মধ্যে এরকম হয়েছে কেউ হয়তো  বসে খাচ্ছে কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে উঠে যেতে হয় এই রায়বাবু এলে।

এইভাবেই চলছিল। আমাকে কখনও উঠতে হয় নি। এই রায়বাবুর জন্য। কারন আমি সাধারনত যে সময়ে খেতে যেতাম, সেই সময়ে উনি আসতেন না। উনি আসতেন একটু লেটে। তবে ওর কার্যকলাপের সাথে সবাই পরিচিত ছিলাম। কিন্তু কিছু বলত না কেউই। হোটেল মালিকও কিছু বলতেন না ঝামেলার ভয়ে।

একদিন আমি খাচ্ছি, দেখলাম রায়বাবু একটু তাড়াতাড়ি এসেছেন। আর দুর্ভাগ্যবশত আমি আজ রায়বাবুর টেবিলে। আর ওই টেবিলেই আমার সাথে সবেমাত্র এক বৃদ্ধ খেতে বসেছেন। এই বৃদ্ধ কেও চিনি আমি। ইনি ওই পেপার থেকে শুরু করে লোহা ভাঙার জন্য পাড়ায় পাড়ায় ঘোরেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোক দেখলাম আজ মাংস ভাত নিয়েছে। রায়বাবু গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়ালেন বৃদ্ধের ওই টেবিলের সামনে। বৃদ্ধ খুব মন দিয়ে সবে মাংসের ঝোল টা ভাতে ঢেলেছিল। রায়বাবু কে দেখে একটু বিরক্ত হল। কিন্তু টেবিল ছেড়ে উঠল না।

রায়বাবু একটু গলা খাঁকরিয়ে আমাদের দু’জন কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এই টেবিল টা আমার!”

আমি কাৎলা মাছের ঝোল টা ভাতে ঢালতে ঢালতে বললাম, “আপনার টেবিল আপনি আপনার বাড়ির ডাইনিংএ না রেখে এতদূরে রেখে গেছেন কেন?”

রায়বাবু একটু অবাক হলেন। সাধারনত কেউ এভাবে কথা বলে না ওর সাথে।

রায়বাবু এবার হাতের লাঠিটা দিয়ে টেবিলে জলের মগ টা উলটে দিলেন। তারপর বললেন, “চল ওঠ টেবিল থেকে!”

আমি বুঝলাম সত্যি সত্যি এইভাবে ঝামেলা করে লাভ নেই। পেরে উঠব না। আমি উঠে পাশের টেবিলে চলে গেলাম। সেই পেপারওয়ালা বুড়ো দেখলাম তাও ওঠে না। তার অর্ধেক ভাত খাওয়া হয়ে গেছে। বাকিটাও খাচ্ছে সে। তবে সে এখনও মাংসের পিসে হাত দেয় নি। তরকারী আর ঝোল দিয়েই তার অর্ধেক ভাত খাওয়া হয়ে গেছে। মাংস টা বোধহয় শেষে খাবে বলে রেখেছিল। ওই বৃদ্ধ উঠছে না দেখে রায়বাবু এবার খুব রেগে গিয়ে বুড়ো কে মারলেন এক ধাক্কা। চেয়ার উলটে পড়ে গেল বৃদ্ধ। এবং অবাক ব্যাপার হল হোটেলে তখন অত লোক। কেউ একটা টু শব্দ করল না। কেউ তুলল না পর্যন্ত। বৃদ্ধর খুব লেগেছে বুঝতে পারছি। অগত্যা আমি উঠে গেলাম খেতে খেতে। কাছে গিয়ে কোনোরকমে ধরে তুললাম বৃদ্ধ কে। রায়বাবু দেখলাম ততক্ষনে বসে পড়েছে তার টেবিলে। বৃদ্ধকে ধরে ধরে নিয়ে এলাম বাইরে। তার লোহালক্কড়ের গাড়ির কাছে

বৃদ্ধ রাগে গজগজ করতে করতে বলছেন, “আমি আর কখনও খাবো না এখানে। কখনও খাবো না।”

আমার খুব খারাপ লাগল তখন। আমি আর থাকতে না পেরে বৃদ্ধ কে বললাম, “দাদু, বলছিলাম যে… তোমার মাংস ২ টো তো নষ্ট হবে। ওটা তাহলে আমি খেয়ে নিই?”

ভদ্রলোক হঠাৎ আরও রেগে গেলেন। তারপর আমার হাত ছাড়িয়ে চলে গেলেন গাড়ি নিয়ে। আমি বুঝতেই পারলাম না কেন এত রেগে গেলেন উনি। খাবার কেউ নষ্ট করে নাকি? নিজের টেবিলে যাওয়ার সময় ওই টেবিল থেকে মাংসের বাটিটা নিয়ে আমি চলে গেলাম আমার টেবিলে।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হত। কিন্তু না তা হয় নি।

আমি খেয়ে হাত ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমার পাড়ার এক দাদা এসে যাওয়াতে আর একটু বসে গেলাম হোটেলে। রায়বাবু খেয়ে দেয়ে বিল মিটিয়ে যাওয়ার সময় রয়েল এনফিল্ড স্টার্ট দিয়ে হঠাৎ দেখলেন ২ টো চাকাই লিক হয়ে চাকা বসে গেছে। কেউ  দু’টো ছোটো পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে দু’টো চাকার মধ্যে। বোঝা গেল ঐ লোহাভাঙা বিক্রি করা বৃদ্ধ যাওয়ার সময় কান্ডটি ঘটিয়ে গিয়েছেন। কাছাকাছি বাইকের দোকানও নেই। উনি প্রথমে খুব হম্বি তম্বি করলেন হোটেলে। কিন্তু আমরা কেউই ওই বুড়োর ঠিকানা জানতাম না। কেউই জানত না। কাজেই শেষটায় নিরূপায় হয়েই হেঁটে হেঁটে বাইকে নিয়ে উনি এগিয়ে গেলেন বড় রাস্তার মোড়ের দিকে।

যারা বাইক সম্বন্ধে মোটামুটি জানে তারা সকলেই জানে রয়েল এনফিল্ড এর ওজন কত ভারী হয়। ওই দুপুর রোদে পেট ভরে ভাত খাওয়ার পর ওরকম একটা ভারী বাইক কে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট ব্রেক আপের থেকেও বেশী। আর কাছাকাছি বাইক সারানোর দোকানও নেই। কাজেই ওকে এখন ৪ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে থানায়।

তবে এটা ভালো ব্যাপার যে পেরেকের ওপর কেউ আঙুলের ছাপ খুঁজে পাবে না। নাহলে আমার ভাগ্যে দুঃখ ছিল। ঠিক সময়ে বুড়োর গাড়ি থেকে পেরেক ২ টো বের করেছিলাম। ভদ্রলোক আমায় মাংস খাওয়ালেন। ওর জন্য কিছু না করতে পারলে খারাপ লাগত আমার।

রায়বাবুকে ওই হোটেলে আর দেখিনি তারপর। তবে ওই বৃদ্ধ কয়েকদিন পর থেকেই খেতে আসত আবার। আমার সাথে দেখা হয়েছে কয়েকবার। কথা বলেন নি। আমিও বলিনি। কিছু উপকারের কথা অন্তরালে থাকাই ভালো।

অনর্থ ৯

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি