তখন বোধহয় ৮০র দশক। ১৯৮৮ সম্ভবত। আমি তখনও কর্পোরেশনে সরকারী চাকরিটা পাইনি। অবস্থা খুব একটা সচ্ছল নয়। কাজেই পেটের দায়ে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ অবধি করতে হত। সেবার ভোটের সময় চেষ্টা চরিত্র করে আমি আর আমার এক বন্ধু হোমগার্ড এর ডিউটি পেয়েছিলাম। তখন হোমগার্ড এর ডিউটিতেও প্রায় ১৫০০ টাকা করে দেওয়া হত। আর সেই বাজারে টাকাটা অনেকটাই। সুতরাং খুব আনন্দের সাথেই গেলাম ডিউটি করতে। প্রত্যেকটা ভোটের সময়ই প্রচুর লোকজনকে প্রচুর দায়িত্ব দেওয়া থাকে। সেক্টর অফিসার থাকেন। তার আন্ডারে থাকেন কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসার। এই প্রিসাইডিং অফিসার আবার একটি বুথের সর্বময় কর্তা। তার আন্ডারে থাকে অন্যান্য কর্মীরা, পুলিশ এবং হোমগার্ডরা।
আমাদের বুথে যিনি প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন, তার নাম ফনীভূষন মান্না। কোনো এক সরকারী ব্যাংকের ক্লার্ক ছিলেন তিনি। সব বিষয়েই তার ছিল বিরাট হম্বিতম্বি। যেহেতু হোমগার্ডরা ছিল এই বিরাট কর্মযজ্ঞের সবচেয়ে নীচের তলার লোক, তাই তাদের ওপর ফনীবাবু চোটপাট করতে ভীষন ভালবাসতেন। “এই চা নিয়ে এসো” “এই জল নিয়ে এসো” “এই করো ওই করো!” সারাক্ষন চলছিল তার হুকুম।
দুপুরে লাঞ্চ এর জন্য প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে কিছু টাকা দেওয়া থাকত। তার আন্ডারে যারা কাজ করে তাদের খাওয়া দাওয়ার খরচা ওঁর দেওয়ার কথা। উনি দেখলাম হোমগার্ড বাদে সবাই এর জন্যই খাবার আনালেন। এত বিভাজন কীসের জন্য সেটাই বুঝতে পারলাম না। তখন ভোটের মাঝে আমাদের কারুর বাড়িতে খাওয়ার নিয়ম নেই। কাছেই একটা দোকানে ডিমের ঝোল ভাত করছিল সেটাই খেলাম আমি আর আমার বন্ধুটি।
রাত্রে ঘুমোনোর সময় ফনীবাবু আমাদের দু’জন কে বললেন, “শোন্ তোরা বাইরে শুবি। বেঞ্চের ওপর।”
আমরা খুব অবাক হয়ে বললাম, “মানে? বাইরে কেন স্যার? ভেতরে…”
আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে ফনীবাবু বললেন, “ভেতরে শুবি মানে? ইয়ার্কি নাকি? এত ব্যালট বক্স রয়েছে। যা বাইরে ঘুমোবি যা।”
এরপর আর কথা বলতে না দিয়ে আমাদের ঘর থেকে বের করে দিলেন উনি। তারপর দরজা বন্ধ করে দিলেন মুখের ওপর। ঘরের ভেতরে তখন পুলিশ, প্রিসাইডিং অফিসার আরো বেশ কয়েকজন লোক। আর আমরা দুই বন্ধু হোমগার্ড বাইরে বেঞ্চে মশার কামড় খেতে খেতে ঘুমোলাম।
পরের দিন আবার আর এক ঝামেলা। ফেরার সময় ফনীবাবু আমাদের বললেন, ব্যালট বাক্স গুলো বওয়ার কথা। হোমগার্ড দের ডিউটির মধ্যে এটা পড়ে না। আমার বন্ধু বলল, “আমরা কেন বইব? এটা কি হোমগার্ড দের ডিউটি নাকি?”
ফনীবাবু চেঁচিয়ে বললেন, “আমাকে ডিউটি শেখাচ্ছিস? কমপ্লেন ঠুকে দিলে এক টাকাও পাবি না। যা বলছি সেটাই কর।”
অগত্যা কুলির মত বইলাম ব্যালট বাক্স।
এর ঠিক ২ বছর পরে আমি কর্পোরেশনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের পোস্টে চাকরি পেলাম। মোটামুটি আমাদের এলাকার সমস্ত বিল্ডিং এর প্ল্যান আমার কাছ থেকে অ্যাপ্রুভ হয়ে তারপরেই যেত। মাস খানেক পরে শুনলাম ফনীবাবু জায়গা কিনেছেন। ওঁর প্ল্যান এল আমার হাতে। দেখে অ্যাপ্রুভ করে দিলাম। ঝামেলা করিনি।
জাম্প কাট টু ২০০৬। বিরাট ভোট হচ্ছে সেবার। আর ভোটের মেশিনও অনেকটাই পালটে গেছে। আমার তখন অনেকটাই প্রোমোশন হয়েছে। আমি তখন কর্পোরেশনের Assistant Engineer. চেনাশুনোও বেড়েছে অনেকটা। আমাকে দেখলাম সেক্টর অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হল। আমার সাথে সব সময় পুলিশ থাকবে। গার্ড হিসেবে। নিয়ম হল যদি কোনো প্রিসাইডিং অফিসার নতুন ভোটের মেশিনের কাজ না জানে তাহলে তাকে সেটা সেক্টর অফিসারের কাছ থেকে শিখে নিতে হবে।
আমার আন্ডারে ছিল সাতজন প্রিসাইডিং অফিসার। শুনলাম একটা বুথের প্রিসাইডিং অফিসার কিচ্ছু পারছে না। গেলাম সেই বুথে। সেক্টর অফিসার কে দেখেই ছুটে এলেন প্রিসাইডিং অফিসার স্বয়ং ফনীভুষন মান্না। বললেন, “স্যার আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না মেশিনের ব্যাপার টা। একটু প্লিজ বুঝিয়ে দেবেন?”
স্যার ডাক টা শুনে অসাধারন একটা আনন্দ হল মনের মধ্যে। দেখলাম পেছনে দু’জন হোমগার্ড দাঁড়িয়ে জুলু জুলু চোখে দেখছে পুরো ব্যাপার টা। আমি বুঝিয়ে দিলাম কীভাবে কাজ করে মেশিন টা। ফেরার সময় বললাম, “রাত্রে হোমগার্ড দু’জন কে ঘরেরে মধ্যেই শোয়াবেন। আর ওদের খাওয়ার টাকা ঠিক সময়ে ওদের দিয়ে দেবেন অথবা একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।”
ফনীবাবু এবার একটু মেজাজ নিয়ে বললেন, “কিন্তু স্যার ওদের তো বাইরে ডিউটি করতে হবে। আর ওরাও তো টাকা পাবে। আমাকে খাওয়াতে হবে কেন?”
গলা ভারী করে বললাম, “আমাকে ডিউটি শেখাবেন না। আপনার নামে কমপ্লেন গেলে এক টাকাও পাবেন না। তার সাথে হয়রানির একশেষ। তার চেয়ে যেটা বললাম সেটাই করবেন।”
কথাটা বলেই গাড়িতে উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম মুখের ওপর।
আহ! শান্তি!
[সত্য ঘটনা অবলম্বনে]