দমদম এ মেট্রো থেকে নেমেই লোকজন এত জোরে দৌড়োয়, মনে হয় দুর্লভ শৌচালয় এ যাওয়ার ডাক এসেছে। সামনে কেউ না দৌড়োলে তাকে ধাক্কা খেতেই হবে। ভিকটিম, “দাদা? এটা কী হল” বলার আগেই হাওয়া হয়ে যাবে আততায়ী। এই কারনে দমদম ট্রেন থামলে একেবারে সবার পেছনে নামে অভিজ্ঞান। ঠিক তারপরেই খুব smoothly সাইডে চলে গিয়ে মানুষজনের ঘোড়দৌড় দেখে। তারপর স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেলে বেরোবার রাস্তা ধরে।

আজও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। ট্রেন থামতেই লোকজন একে তাকে ঠেলে দিয়ে নিজের রাস্তা যখন তৈরী করছে ও তখন নিজেকে সুপিরিয়র হোমো সেপিয়েন্স ভাবতে ভাবতে ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়ালো একটু কোনের দিকে। এখানেই ও রোজ দাঁড়ায় ট্রেন থেকে নেমে। কানে হেডফোন থাকে কাজেই কোনও কলকাকলিই কানে আসে না ওর। আজ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই পাশে তাকিয়ে দেখল একটি অচেনা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। একবার নিজের বাঁদিকে তাকাল ও। বুঝে নিতে চাইল ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে না পাশে কেউ রয়েছে ওর। নাহ! কেউ তো নেই। আচ্ছা এমনটা কী হতে পারে থাকলেও ও দেখতে পাচ্ছে না! ওর দিকে তাকিয়ে একটা অচেনা মেয়ে তাকিয়ে হাসাটা বেশী বিশ্বাসযোগ্য নাকি পাশে অদৃশ্য কেউ দাঁড়িয়ে থাকা টা? Tough Choice.

অভিজ্ঞান Music টা Pause করে হেডফোন খুলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু বলবেন?”

মেয়েটির মুখে তখনও হাসি লেগে আছে। বলল, “নাহ! ভবিষ্যতে বলবো কিনা ভাবিনি। একটু আগে বলছিলাম।”

–       কী বলছিলেন?

–       তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ওই আর কি!

–       বলতে পারেন। আমার কানে আসলে হেডফোন ছিল তো তাই বুঝতে পারিনি

–       আরে না না। Its Fine.

মেট্রো স্টেশন ততক্ষনে ফাঁকা হয়েছে। অভিজ্ঞান একটু ভদ্রতার খাতিরে বলল, “নামবেন তো?”

মেয়েটি কিছু একটা ভাবছিল। ওর কথা শুনে বলল, “ও হ্যাঁ চলুন। যাওয়া যাক।”

বেশ খানিকক্ষন থেকেই ও শুধু ভাবছিল মেয়েটা কী এমন বলে থাকতে পারে। একবার ভাবল আর একবার জিজ্ঞেস করবে কিনা। তারপর মনে হল থাক ব্যাপারটা Desperate দেখাবে হয়তো! কিন্তু তারপর যে প্রশ্নটা ওর দিকে ধেয়ে এল সেটার জন্য ও একটুও প্রস্তুত ছিল না।

–       আচ্ছা আমায় কি খুব Desperate লাগল?

অভিজ্ঞান প্রথমটা থতমত খেয়ে গেল প্রশ্নটা শুনে তারপর বলল, “না… মানে… এই রে! Desperate কেন লাগবে? কেন?”

–       নাহ আপনি হয়তো ভাবছেন এ আবার কেমন গায়ে পড়া মেয়ে রে বাবা! যেচে যেচে কথা বলছে!

–       না না। একেবারেই তা ভাবছিনা আমি। আমি শুধু ভাবছি আমি কি বললেন সেটা আমি শুনলামই না।

–       ঠিক আছে পরে কোনো একদিন বলবো। আজ যাই আমি। Tata.

কথাটা বলেই প্রচন্ড স্পীডে মেয়েটা মেট্রোর গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। অভিজ্ঞান আবারও খুব অবাক হল ব্যাপার টায়। মেয়েটা কথা বলল নিজেই। কী কথা বলল এখনো জানেনা ও। এমন কি নাম টাও জানেনা! তারপর আবার এখন হঠাৎ করে টাটা করে দিয়ে চলে গেল! কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা!

লোকগুলো অনেকক্ষন থেকেই মাপছে ওকে, সেটা বুঝতে পারছে অভিজ্ঞান। তবে সেটা খুব অবাক করার মত ব্যাপার নয়। এই বয়সী একটা ছেলে থানায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলে লোকজনের কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। বসে আছে কি আর সাধে! ওকে আজ ডেকে পাঠানো হয়েছে।

দিন কয়েক আগে বেলঘরিয়া স্টেশন থেকে অভিজ্ঞান এর ল্যাপটপের ব্যাগটা চুরি যায়। খুব দামী একটা ল্যাপটপ তো ছিলোই। তার থেকেও দামী ছিল ওর একটা ডায়রি। তাতে ওর সমস্ত লেখা রয়েছে। আসলে ইন্ডিয়া ডিজিটাল হয়ে গেলেও অনেক মানুষই এখনও পুরোনো দিনের মত ডায়রি তেই লেখে এবং দুর্ভাগ্যবশত অভিজ্ঞান ও ওই তালিকা তেই পড়ে। নিজের সারা জীবনের লেখার ডায়রি টা হারিয়ে স্বভাবতই খুব মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিল ও। সেইদিনই বেলঘরিয়া থানায় ডায়রি করে এসে। তবে জানতো যা গেছে তা আর পাওয়া যাবে না।

কিন্তু ওর ধারনা ভুল প্রমানিত হয় আজ সকালেই। যখন একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে ওর নাম্বারে।

–       হ্যালো।

–       অভিজ্ঞান রায় বলছেন?

–       হ্যাঁ। বলুন।

–       আমি বেলঘরিয়া থানা থেকে ফোন করছি। আপনি একটা ডায়রি করেছিলেন আগের সপ্তাহে। ল্যাপটপ চুরি গিয়েছিল।

–       হ্যাঁ। করেছিলাম। ওটা কি পাওয়া গেছে।

–       হুম। আপনি আজই ল্যাপটপের ডকুমেন্টস নিয়ে চলে আসুন থানায়।

খুশিতে ডগমগ করছিল অভিজ্ঞান! ও ভাবতেই পারে নি ল্যাপটপ টা আর পাবে ও! তবে ওর সবচেয়ে বেশী আনন্দ হচ্ছে নিজের গল্প লেখার ডায়রি টা ফিরে পাবে এটা ভেবে।

তবে এসে থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা একইভাবে বসিয়ে রেখেছে ওকে। এমনিতে ওর মাথা খুব তাড়াতাড়ি গরম হয়। অন্য কোথাও এরকম হলে হয়তো রেগে কথাও শুনিয়ে দিত। কিন্তু জানে থানায় এসব চলবে না। বাড়াবাড়ি করলে এত কাছে এসেও জিনিসটা হাতছাড়াও হয়ে যেতে পারে!

এইসব ভাবতে ভাবতেই ওই ঘরে ঢুকে এল একজন সাদা পোষাক এর পুলিশ। ওঁকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল কনস্টেবল থেকে শুরু করে ঘরে উপস্থিত অন্যান্য কর্মীরা। ভদ্রতার খাতিরে উঠে দাঁড়ালো অভিজ্ঞান।

–       আরে বসুন বসুন” বললেন অফিসারটি, “এই বিমল, ল্যাপটপের ব্যাগ টা নিয়ে এসো।

অভিজ্ঞান ওর সাথে আনা আর একতা ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে পুলিশটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে স্যার! কাগজপত্র গুলো!”

–       কীসের কাগজপত্র?

–       ল্যাপটপের। মানে বিল, ওয়ারেন্টি কার্ড এগুলো।

–       ওগুলো আমি নিয়ে কী করব? আপনার কাছেই রাখুন।

আর কথা বাড়ালোনা অভিজ্ঞান। ভাবল একবার বলবে, “আপনাদের থানা থেকেই তো বললো আনতে।” তারপর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই ভেবে আর কিছু বললো না। বিমল নামের লোকটি একটা ব্যাগ এনে রাখলো টেবিলে। দেখেই চিনতে পারল ও। এটা ওরই ব্যাগ। একদম অক্ষত অবস্থায়!! ভাবা যায়! কলকাতা পুলিশ তাহলে এখন বেশ করিতকর্মা হয়ে উঠেছে বোঝা যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি করে ব্যাগটা খুলল ও। ল্যাপটপ আর চার্জার এ একদম কেউ হাত দেয়নি মনে আছে। যেমনটা ছিল তেমনই আছে। আর আছে ৩২ জিবি পেনড্রাইভ টাও। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ডায়রি টা পেলো না অভিজ্ঞান। বার বার একই জায়গায় দেখছে দেখে পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু মিসিং নাকি?”

–       হ্যাঁ আসলে একটা ডায়রি ছিল। সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না।

–       ডায়রি?” পুলিশ অফিসার টি বিরক্ত বোঝা যাচ্ছিল, “ল্যাপটপ পেয়ে গেছেন! আবার ডায়রি কীসের জন্য লাগবে আপনার? নিন সাইন করুন এখানে।”

সেদিন সকালে খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অভিজ্ঞান এর। বাড়িতে ও একাই থাকে আপাতত। মা বাবা থাকে দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদ এ। বারান্দায় বসে বসে কফি খেতে খেতে বাইরেটা দেখছিল ও। এমনি রাস্তাটা ফাঁকা। কিন্তু মাঝে মাঝেই কয়েকজন দৌড়চ্ছে আবার কয়েকজন খুব জোরে জোরে হেঁটে চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। বুঝতে পারল বাঙালী চর্বি কমানোর চেষ্টায় অনড়। তাই মর্নিং ওয়াক। একটু আলো ফুটেছে তখন। হঠাৎ ই ওর বয়সী একটা ছেলে আর মেয়ে কে একসাথে দৌড়োতে দেখল ও। ওরা দৌড়োচ্ছে কম নিজেদের দিকে তাকিয়ে হাসছে বেশী। সাধারনত জনস্বার্থে প্রচারিত প্রেম দেখতে অভিজ্ঞান এর ভালো লাগে না তাই ও নিজেও ওরকম খুব একটা করে না… থুড়ি… করত না। কিন্তু আজ যেন বেশ মিষ্টি লাগল ওর ব্যাপার টা। কতদিন হল যেন আজ নিয়ে? প্রায় বছর তিনেক তো হবেই।

প্রেম টা যখন হয় অভিজ্ঞান এর তখন সেকেন্ড ইয়ার। হঠাৎ ই হয়ে গিয়েছিল সব টা। স্মৃতিগুলো এখনো কেমন যেন টাটকা!

– “রঙ দিস না। প্লিজ দিস না আমার স্কিন এলার্জি আছে”

– এটা কে রঙ বলে না। আবির বলে।

– সে যাই বলুক না কেন! দিবি না ব্যাস!

– দেবোই!! তুই যেন দিবি না আমায়!?

– আমি? কখনো রঙ দেবো না তোকে।

– শুধু কি রঙ ই দেওয়া যায় না কি? অন্য কিছু দেওয়া যায় না?

– অন্য… ইস!! তুই দিন কে দিন একদম অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস!!

– থ্যাঙ্ক ইউ!

– আমি Compliment দিই নি।

– Who cares?

সত্যি কেয়ার করতো না মৃনালিকা। কাউকেই কেয়ার করতো না। শুধু ওর জন্যই…। সব জেনেও কেন যে সব শেষ করল অভিজ্ঞান সেটা মনে পড়লেই ওর নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। আসলে যে দেড় বছর ওরা একসাথে ছিল সেই সময়টা অভিজ্ঞান কিছু লিখতে পারেনি। সময় পেতো না একদমই। মৃনালিকা কে যে খুব বেশী সময় দিতে হত তা নয়। তাও সেদিন যেন ওর মাথাটা হঠাৎই খুব গরম হয়ে গিয়েছিল।

–       কী হয়েছে তোর?

–       কিছু না।

–       আরে বল না কি হয়েছে?

–       বললাম তো কিছু না।

–       দেখ তোকে দেখে কিন্তু কিছু না মনে হচ্ছে না।

–       তাহলে কী মনে হচ্ছে?

–       মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু হয়েছে!

–       তাহলে হয়েছে!

–       কী হয়েছে?

–       তুই বুঝবি না। ছাড়!

–       আরে বল না।

–       দেড় বছর হয়ে গেল আমি কিছু লিখিনি।

–       কি লিখিস নি?

–       গল্প। আমার ডায়রি তে।

–       কেন লিখিস নি?

–       সময় পাই নি।

–       তো সময় বের কর।

–       সেটাই তো সমস্যা। যে সময় টা বের হয় সেটা তোর পেছনে চলে যায়। লেখা আর হয় না।

–       তুই কি বলছিস আমিই তোর না লেখার কারন?

–       দেখ… আমার বহুদিনের একটাই স্বপ্ন, আমার বই বেরোবে। সেই জন্যেই ফেসবুকে বা অন্য কোন জায়গায় গল্প না দিয়ে, আমি আমার ডায়রি তে লিখি। কাউকে পড়তে দিই না। কিন্তু…

–       আমি তো পড়েছি।

–       What??? তুই আমার ডায়রি পড়েছিস?

–       হ্যাঁ। পড়েছি। তুই খুব ভালো লিখিস কিন্তু। প্লিজ আরও লেখ।

–       তুই আমায় না জিজ্ঞেস করে…

–       আরে কি আবার জিজ্ঞেস করবো। তুই তো আমার নিজেরই লোক। তোর গল্প আমি পড়লে সমস্যা কোথায়?

–       সমস্যা আছে। তুই ঠিক করিস নি। একদম ঠিক করিস নি কাজ টা।

–       আরে তুই এভাবে রিয়্যাক্ট করছিস কেন??

–       আমায় একটু একা থাকতে দে। পরে কথা হবে।

–       আরে?? এরকম কেন করছিস তুই?

–       You know what? Let’s take a break!!

–       তুই ব্রেক আপ করতে চাস???

–       আমি শুধু চাই আমার বই প্রকাশ করতে। আর কিচ্ছু চাই না। I don’t think তুই থাকলে সেটা কখনো সম্ভব হবে!!

–       Wow!! এত দিন কি তাহলে সব নাটক চোদাচ্ছিলি?

–       ভদ্রভাবে কথা বল।

–       ভদ্রভাবে? এত কথা বলার পর you want me to be ভদ্র???? Go to hell. Bye.

 ৪

এক একটা দিন থাকে যেদিন কোনো কারন ছাড়াই মন ভালো লাগে। আজ সেরকমই একটা দিন অভিজ্ঞান এর জন্য। আজ ওর জন্মদিন। সকাল থেকেই একটা সাজো সাজো রব যেন। আজ কোথায় যেন একটা বসন্ত উৎসব! তবে ওর আজ কোনো দায়িত্ব নেই। মা-বাবা আসবে একটু পরেই মুর্শিদাবাদ থেকে। সব দায়িত্ব আজ ওঁদের। আজ ও শুধু লিখবে। ডায়রি টা হারিয়ে যাওয়ার পর প্রায় ৭ মাস হয়ে গেছে। কিছু লেখেনি ও। একটা অদ্ভুত হতাশা গ্রাস করেছিল ওকে। ও আগে থেকেই ঠিক করেছে আজ আবার লিখবে ও। নতুন একটা ডায়রি তে।

ন’টার দিকে কলিং বেল এর আওয়াজ এ একটু অবাক হল ও। এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে বাবা-মা? ১০ টার আগে তো ট্রেনই ঢুকবে না। তাহলে কে এল এত সকালে আবার? দরজা খুলে যাকে দেখল তাকে দেখে এতটাই অবাক হল ও, ততটা অবাক ও “Game of Thrones” এর Twist দেখার সময়ও হয় নি।

“ভেতরে আসতে পারি।” প্রশ্ন করলো মেট্রোর সেই অপরিচিত মেয়েটি।

ও হতবাক হয়ে কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলো হাঁ করে।

“মাছি ঢুকে যাবে মুখে” কথাটা বলে মেয়েটি নিজেই ঢুকেই পড়ল ওর ফ্ল্যাটে। ও দরজাটা বন্ধ করতে করতে অঙ্ক মেলানোর চেষ্টা করছিল। কী করে ওর বাড়ির ঠিকানা জানতে পারল মেয়েটি। আর তার চেয়েও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল মেয়েটি কে?

ডাইনিং এ রাখা একটা চেয়ারে বসে, মেয়েটি বলল, “আমার এই চেহারার সাথে তুই হয়তো পরিচিত নোস!”

সেন্স অফ হিউমর টা মাঝে মাঝে খুব ভালো কাজ করে অভিজ্ঞান এর। বলল, “ কেন? আপনি কি ইচ্ছাধারী নাগিন?”

–       নাহ! আমি মানুষই। তোর খুব চেনা একজন।

–       কে?

–       আমি মৃনালিকা।

নামটা শুনে এক মুহুর্তের জন্য একটু চমকে গেলেও পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে অভিজ্ঞান বলল, “নেশা করেছেন নাকি?”

–       নাহ! প্লাস্টিক সার্জারী করিয়েছি। একটি বিশেষ কারনে। যাই হোক সে কথা থাক।

–       হ্যাঁ সে থাক বরং। আপনার কি চাই সেটা বলুন তো!

–       কিছুই চাই না দিতে এসেছি। ভুলভাল ভাবিস না আবার!

এবার একটু সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে ব্যাপার টা। এই রকম ইয়ার্কি তো মৃনালিকাই মারত ওর সাথে।

আবার বলল, “আমি যেটা বলতে এসেছি প্লিজ শোন মন দিয়ে। খারাপ লাগবে না কথা দিচ্ছি”

–       “বলুন শুনছি!”

–       বলুন না। আগে যা বলতিস তাই বল। তুই বল। আর দয়া করে বিশ্বাস কর। আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়, তার পরেই প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয় আমাকে।

এবার একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে অভিজ্ঞান।

–       আচ্ছা বল। কী বলার আছে? কোথায় হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্ট?

–       অ্যাক্সিডেন্ট এর কথা বলতে আসিনি আমি। যেটা বলছি মন দিয়ে শোন।

–       বল।

–       তোর সাথে সব শেষ হওয়ার পর খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একটা Depression Period এ চলে গিয়েছিলাম। তারপরেই খুব recklessly একটা কাজ করি আমি। লোক লাগিয়ে বেলঘরিয়া স্টেশন থেকে তোর ল্যাপটপ চুরি করাই। যদিও আমার লক্ষ্য ল্যাপটপের দিকে ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল তোর ডায়রিটা হাতানো।

–       What? কেন?? নষ্ট করবি বলে?

–       নষ্ট? না… একেবারেই না… যে জিনিসটা কে তুই এত ভালোবাসিস সেটা নষ্ট করে কি লাভ বল তো?

–       তাহলে?

–       তুই ডায়রিতে লিখতিস আর ভাবতিস কবে এটা প্রকাশিত হবে। এখন ব্যাপারটা হল তার জন্য যেটা করা দরকার সেটাই তুই করতিস না। প্রকাশকের কাছে নিয়ে না গেলে প্রকাশক কি নিজে আসবে তোর কাছে?

–       হুম। তারপর? বলে যা…

–       কি আর বলব। বললাম তো সব! ডায়রি পেয়ে যেতেই পুলিশ এর চোখে পড়বে সেভাবেই ল্যাপটপ শুদ্ধ ব্যাগ টা ফেরত পাঠিয়ে দিই।

–       আর ডায়রিটা?

মেয়েটি (নাকি মৃনালিকা বলব?) এবার উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। বারান্দায় গিয়ে তাকাল বাইরের দিকে।

অভিজ্ঞান আবার জিজ্ঞেস করল অধৈর্য গলায়, “আমার ডায়রি টার কী হল?”

“একটু অপেক্ষা কর। জানতে পারবি” বলল মৃনালিকা।

অভিজ্ঞান দেখল ১০ টা বেজে গেছে। ওর মা-বাবার আসার সময় হয়ে গিয়েছে। এসে যদি ফ্ল্যাট এ অচেনা মেয়েকে দেখে তাহলেই হয়েছে আর কি! ভাববে কলকাতায় থেকে এসবই করে বেড়াচ্ছে। ও বলল, “দেখ… মা-বাবা আসবে এখুনি। তুই এখন যা। আমি পরে যোগাযোগ করে নেবো তোর সাথে।”

–       মা-বাবা আসবে তো কী হয়েছে? আসুক না। আমরা কি ভুল-ভাল কিছু করছি নাকি?

–       না করলেও। কিছু ভাবতেই পারে। তুই প্লিজ যা।

–       যাবো তো। একটু পরেই যাবো।

কথাটা বলার পরেই কলিং বেল বাজলো। মা-বাবা এসে গেল বোধ হয়। দরজা খুলে কী উত্তর দেবে ও? বলবে এক্স গার্লফ্রেন্ড এর প্লাস্টিক সার্জারী হয়েছে? কিন্তু ওর ফ্ল্যাটে কি করছে তাহলে? এসব ভাবতেই ভাবতেই বাইরে থেকে অধৈর্য বেল বাজল আবার। মৃনালিকা এগিয়ে গেল এবার দরজা খুলতে। খোলার পরে যেটা ঘটল তার জন্যে অভিজ্ঞান একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মৃনালিকা নিজে। ওর মৃনালিকা মানে যার সাথে ওর দেড় বছর আগে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই চেহারা, সেই হাসি মুখ। হঠাৎই কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ওর ঘরে থাকা মেয়েটি বলল, “Oh By the way, আমি শুধু আমার নামটা মিথ্যে বলেছি।  বাকি সব সত্যি। আরপ্লাস্টিক সার্জারী করে গার্লফ্রেন্ডের মুখ বদল বাংলা সিরিয়াল ছাড়া কোথাও সম্ভব না। আমি তোমার এক্স এর বোন, চয়নিকা।”

ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কেসটা কী হচ্ছে? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। আজ সারাদিন টাই তো একটা পরিকল্পনা মাফিক এগোনোর কথা ছিল। সেটা তো কিছুই হচ্ছে না।

মৃনালিকা ভেতরে ঢুকে বলল, “কীরে? চমকে গেছিস খুব?”

চমকে গেছে বললে ব্যাপারটা understatement হবে। ওর মাথা ঘুরছে। ডাইনিং এ রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ল ও। মৃনালিকার একটা বোন ছিল ও জানত। কিন্তু কখনও দেখেনি ও। বিশ্বভারতী তে না কোথায় একটা পড়ত।

চয়নিকা এইসময় বলল, “সেদিন মেট্রো তে তোমার সাথে দেখা হওয়াটা খুব কাকতালীয়। এত ছবি দেখেছি তোমার, একবার দেখেই চিনতে পেরে গেছি। তবে তাড়াতাড়ি চলে গেলাম মেট্রো থেকে বেরোনোর সময় কারন দিদি অপেক্ষা করছিল স্টেশনে। আমার সাথে ওকে দেখে নিলে সব প্ল্যান বানচাল হয়ে যেত।”

মৃনালিকা এরপর ব্যাগ থেকে বের করে দিল একটা গিফট এর কাগজে মোড়া বই জাতীয় কিছু একটা।

“কি এটা?” জিজ্ঞেস করল অভিজ্ঞান।

–       তোর ডায়রি। নে ফেরত দিয়ে দিলাম।

গিফট এর কাগজ টা ছিঁড়তে ভেতর থেকে যেটা বেরোলো সেটা কোনো দিক থেকেই ডায়রির মত দেখতে নয়। বরং বই এর সাথেই সাদৃশ্য বেশী সেটার। বই এর মলাটের ওপর লেখা “বসন্ত এসে গেছে” তার নীচেই লেখকের নাম অভিজ্ঞান রায়।

আজ সকাল থেকে কী হচ্ছে একটুও বুঝতে পারছে না অভিজ্ঞান। বার বার অবাক হতে হতে ওর কথা বলার শক্তিটুকুও যেন শেষ হয়ে গিয়েছে। চোখেও একটা বিরাট আলোড়ন চলছে জল আসার। ও প্রানপন চেষ্টা করছে সেটা ঠেকিয়া রাখার। মৃনালিকা এবার ব্যাগ থেকে বের করলো কিছুটা আবীর। তারপর অভিজ্ঞান কে মাখাতে যেতেই অভিজ্ঞান বলে উঠল, “রঙ দিস না প্লিজ। আমার স্কিন…

ওর কথা শেষ করার আগেই মৃনালিকা বলল, “এটা কে রঙ বলে না। আবির বলে।”

বসন্ত এসে গেছে

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


2 thoughts on “বসন্ত এসে গেছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি