বোধন পর্ব ৭ঃ https://secularweirdo.com/2018/01/14/বোধন-পর্ব-৭
নবমী, সকাল
অয়ন
মাঝে মাঝে কত কিছু করতে চেয়েও তা করা যায় না। এই কথাটা আজ বার বার মনে হচ্ছে অয়নের। মনে হওয়ার যথেষ্ট কারনও রয়েছে যদিও। কাল রাতে বাড়ি ঢোকার পরেই বাবার কাছে যাতা রকমের ঝাড় খেয়েছে ও। শুধু রিভলবার এর জন্য হলে তো হয়েই যেতো! সেটা তো রয়েইছে তার ওপর কে আবার বাবা কে ফোন করে থ্রেট দিয়েছে। বলেছে, “নিজের ছেলেকে কন্ট্রোল করুন, নাহলে হঠাৎ একদিন কোথায় ভ্যানিশ হয়ে যাবে, সেটা কী ভালো লাগবে?”
অয়ন শুধু ভাবছে শানুদের কতটা সাহস! রামনগর এর সবাই জানে অয়নের বাবা কেমন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। তাও একটু ভয়ডর না করে সোজা ফোন করে দিল? অয়ন ওর বাবাকে সমস্ত ঘটনা বলল কাল। ওর বাবা শানুর নাম শুনে জিজ্ঞেস করল, “শানু মানে বিজয় বসুর ভাইপো?”
বিজয় বসু ওদের ওখানকার MLA. সবাই চেনে ওকে। সেই কারনেই শানু গোটা গ্রামটা দাপিয়ে বেড়ায়!
অয়ন জানে এসব ক্ষেত্রে ওর বাবার হাঁত বাঁধা। কাজেই চাইলেও কিছু করতে পারবেন না উনি। খুব শক্তপোক্ত প্রমান থাকলে তবু না হয় ভাবা যেত। কিন্তু প্রমান তো নেই ওদের কাছে। মৈনাক কে কাল ফোন করেছিল রাতেই। মৈনাক এর বাড়িতেও থ্রেট গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ওদের বাড়ির সবাইও খুব ভয় পেয়ে রয়েছে। মৈনাকের খুব অসহায় লাগছিল। কীভাবে ওদের কোনঠাসা করে দিল একটা ছেলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে। সব অন্যায়, সব নোংরামি মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে ওদের।
রাতে রঞ্জনা মেসেজ করেছিল ওকে। লিখেছিল – “ওই”
“বল” রিপ্লাই দিয়েছিল অয়ন!
– একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
– খুব জরুরী কী? আসলে this is not a good time.
– ওহ! কেন? কী হয়েছে?
– আমার বাড়িতে, মৈনাক এর বাড়িতে থ্রেট এসেছে। জয় এর বাড়িতেও গেছে কিনা জানিনা।
– What? কে দিল থ্রেট? কী বলেছে?
– কে হতে পারে বলে তোর মনে হয়?
– শানু?
– হুম। বাবাকে বলল, বেশী বাড়াবাড়ি করলে আমাদের ভ্যানিশ করে দেবে!
– কাকু কী বলল?
– কি আর বলবে কিছু বলার আগেই কেটে দিল ফোন!
– কি যাতা শুরু হয়েছে সবার সাথে! ধুর! বিরক্তিকর!
– হুম কী আর করা যাবে। যাই হোক তুই কী বলবি বলছিলি বলে ফেল।
– নাহ। থাক! পরে বলব। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
– আরে বল না। কী বলবি বল!
– আসলে… আজ আমি তুই আর রাজর্ষি একটা ঘরে ওভাবে ছিলাম যখন খুব awkward লাগছিল! জানি তোরও হয়তো লাগছিল।
– হুম। তবে আজ অত কিছু ভাবার মত অবস্থায় ছিলাম না।
– বলছিলাম যে তুই কী বলবি রাজর্ষি কে?
– কী বলব?
– আমার আর তোর… মধ্যে যা হয়েছে সেসব কথা।
– জানিনা। ভাবিনি অত কিছু! এই মুহুর্তে ভাববার মত অবস্থায় নেই আমি।
– হুম Okay.
– তুই কি বলবি ভাবছিস?
– হ্যাঁ আমি বলব। অবশ্যই বলব। তবে আমার মনে হয় তোর দিক থেকেও ব্যাপারটা পরিস্কার থাকা জরুরী।
– হুম। ঠিক আছে। সুস্থ হোক ও। তারপর দেখা যাবে!
আর কিছু বলেনি রঞ্জনা। ও নিজেও আর মেসেজ করেনি। সারা রাত ভালো করে ঘুমোতেও পারেনি ও। কেমন একটা অদ্ভুত হয়ে আছে পরিবেশ টা। মা ভালো করে কথা বলছে না। বাবা আরও গম্ভীর হয়ে আছে। সব মিলিয়ে একটা দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যে রয়েছে অয়ন!
নবমী, সকাল
অনিন্দিতা
জানলা দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেখল অনিন্দিতা একবার। বৃষ্টিটা একটু কমেছে। একেবারে থামেনি যদিও তবে মিনিট পনেরো আগে যেরকম মুষলধারে হচ্ছিল তার তুলনায় অনেকটাই কমেছে। ওহ! আজকের দিনটাই মাটি হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে। সকাল থেকে বৃষ্টি যেন হচ্ছে তো হচ্ছেই। আচ্ছা ওর কি মন খারাপ? না, খুব বেশী নয়। একটু খারাপ। আসলে জয় এর এস এম এস টা পেলে ভাল লাগত। ও যদি আজকের দিনটা ভুলে যায়, তাহলে কে মনে রাখবে? আর বাপি? বাপিও তো ভুলে গেছে। সকালবেলাতেই কোথায় না জানি বেরিয়ে গেল বৃষ্টি মাথায় করে। এখনো ফেরেনি। কি হয়েছে কি সবার আজ? সবার কি একই দিনে অ্যামনেশিয়া হয়ে গেল নাকি? মা। মাকে খুব মনে পড়ছে আজ। মা থাকলে কি বাপি আজকের দিনটা ভুলে যেতে পারত? কখনোই পারত না। কেন যে হঠাৎ চলে গেল মা না বলে। কলিং বেলটার হঠাৎ আওয়াজ এ সংবিৎ ফিরল ওর। বাপি এল বোধহয়। চুপচাপ গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। ঘরে ঢুকল বাপি। ঢুকেই চেঁচিয়ে বলল, “কোন বেয়াদপ বাড়ির সামনে একটা স্কুটার রেখে দিয়েছে। গেটটা পুরো ব্লক হয়ে আছে। যা তো মা, একটু সরিয়ে দে তো।”
“যাচ্ছি” বলে জুতোটা পায়ে গলিয়ে নেমে গেল অনিন্দিতা নিচে। কে না কে স্কুটার রেখেছে বাড়ির সামনে সেটা নিয়ে চেঁচামেচি করছ। কিন্তু আজ যে নিজের মেয়ের জন্মদিন সেটা ভুলেই গেছ। কেমন বাবা তুমি? বুকটা ফেটে কান্না আসতে চাইল ওর। কাছের মানুষেরা সবাই কি করে ভুলে গেল আজকের দিনটা।
নিচে নেমে দেখল গেটের সামনেই একটা হিরো হন্ডা প্লেসার রাখা। একদম নতুন মনে হচ্ছে। কে কিনল আবার এটা? সামনের বাড়ির জয়ন্ত কাকুর মেয়ে কি আমেরিকা থেকে চলে এল নাকি? ও পায়ে এগিয়ে গেল স্কুটিটার দিকে। দেখল সিটের ওপর একটা বড় কার্ডবোর্ডের ওপর রাখা একটা সাদা কাগজে লেখা আছে, “Happy Birthday Ma”. মানে? কিছু ভাবার আগেই পেছন থেকে বাবার গলা শোনা গেল, “কিরে? ভেবেছিলি আমি ভুলে গেছি?” আর কিছু ভাবতে পারল না ও। চোখে হঠাৎই জল চলে এল। লজ্জা পেয়ে ঝাপিয়ে পড়ল বাবার বুকে। “আই লাভ ইউ বাপি। সরি আমি ভেবেছিলাম তুমি ভুলে গেছ।”
“হয়েছে। আর মাখন লাগাতে হবেনা। এই নে চাবি।”
চোখটা মুছে চাবিটা নিয়ে ও ছুটে গেল ওর স্কুটির দিকে। চাবি লাগিয়ে স্টার্ট দিল গাড়িতে।
“সাবধানের চালাস। আজ রাস্তা কিন্তু খুব স্লিপ হয়ে আছে।” বলল বাবা।
“ঠিক আছে। চাপ নিও না। একপাক ঘুরেই চলে আসব।”
“আর হ্যাঁ, বাইক পছন্দ করা থেকে আজ নিয়ে আসার আগে অবধি সব কিছুই কিন্তু তোর এক বন্ধু করেছে।”
অবাক হল ও। “আমার বন্ধু? কে?”
“ঘুরে আয়। তারপর বলব।”
“ওকে টাটা। এখুনি ফিরব।”
তারপর স্কুটি চালিয়ে বেরিয়ে গেল ও। বৃষ্টি এখন আর পড়ছে না। ওহ! কি আনন্দ যে হচ্ছে ওর কেউ ভাবতেই পারবেনা। কতদিনের ইচ্ছে ছিল নিজের একটা স্কুটি হবে। আজ ইচ্ছে পূরন হয়েছে। বাঁদিকে সুদীপদার গলি, ডানদিকে হলুদ-কালো রেলিং দেওয়া পচা পুকুর পেরিয়ে ও এগিয়ে চলল স্কুটার নিয়ে। আস্তে ও এসে পড়ল কাটান যাওয়ার মরাম দেওয়া রাস্তায়। এই রাস্তায় ও আগে অনেকবার এসেছে। প্রথম যখন প্রেমে করছে তখন এখানে চলে আসত দু’জনে। বাড়িতে কেউ জানতেও পারত না। আর এদিকটায় লোকজনও বিশেষ নেই। দুদিকে সবুজ মাঠ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। হঠাৎই ওর চোখ গেল ওর সামনে হেঁটে যাওয়া ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে। ছেলেটার টি-শার্টটা খুব চেনা লাগছে। মেয়েটাকেও চেনা লাগছে পেছন থেকে। দু’জনে হাত ধরে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিন্তে। কে ওরা? এত চেনা লাগছে কেন ওর? ছেলেটা একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ চুমু খেল মেয়েটার গালে। তারপর পেছনে তাকাল একবার। আরে? এতো……..
স্কুটার এর হ্যান্ডেলটা একটু নড়ে গেল কি? চাকাটা স্লিপ করল মরামে। উলটে পড়ার মুহুর্তে ওর একটাই কথা মনে এল। মানুষ বিশ্বাস ভাঙ্গে কেন? কি আনন্দ পায় ওতে? মাথায় খুব ব্যাথা অনুভব করল ও। মুখটাও খুব জ্বালা করছে। পায়ের ওপর কিছু একটা ভারি জিনিস পড়েছে। চোখটা আর খুলে রাখতে পারল না ও।
স্বপ্নটা এখানেই ভেঙে গেল অনিন্দিতার। আসলে সারা রাত না ঘুমোনোর পর হঠাৎই ভোরের দিকে একটা তন্দ্রা মত চলে এসেছিল ওর! তার পরেই এই স্বপ্ন। বালিশটা কেমন যেন ভেজা ভেজা লাগছে। চোখের জলের জন্য বোধহয়! কাল তমালিকা ফোন করে ওকে বলে, “ও আর শুভদ্বীপ দুজনে দুজনকে ভালোবাসে!”
ও প্রথমে ভাবছিল তমালিকা বোধহয় কোনো মজা করছে ওর সাথে। কিন্তু তমালিকা তার পরেই বলে, “আমি কিন্তু একেবারেই কোনো প্র্যাকটিক্যাল জোক করছি না!”
ও আর কিছু ভাবতে পারেনি তখন? শুধু জিজ্ঞেস করে, “কেন? কেন এরকম করলি আমার সাথে?”
তমালিকার বোধহয় উত্তর তৈরীই ছিল। ও বলল, “It’s not personal. ভালবাসা তো এভাবে ভেবেচিন্তে হয় না। ওর আমায় ভালো লেগেছে আর আমিও অকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর বিষয়টা লুকিয়ে রাখতে পারছি না। তাই মনে হল তোকে জানানো দরকার।”
অনিন্দিতা কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর থেকে অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে! মাথাটাও বোধহয় ঘুরছে। এরকম একটা কথা ওর জন্মদিনের দু’দিন আগে শুনতে হবে এটা ও ভাবতেও পারে নি।
তমালিকা আবার বলল, “আচ্ছা শোন, শুভদ্বীপ এখনও কিছু জানেনা। মানে আমি তোকে বলেছি বলে। ও ফোন করলে জানিয়ে দিস!”
অনিন্দিতা তক্ষুনি বেরিয়ে এসেছিল নার্সিং হোম থেকে। জয় এর সাথে আর একটাও কথা বলে নি। জয় একবার, “কীরে কী হল? কোথায় যাচ্ছিস” জিজ্ঞেসও করেছিল বোধহয় কিন্তু ও উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় তখন ছিল না।
ফোনের আওয়াজে চমকে উঠল অনিন্দিতা হঠাৎ। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ফোনটা ধরবেনা ভাবতে ভাবতেও কী মনে হতে রিসিভ করল ও।
– হ্যালো?
ও প্রান্ত থেকে আওয়াজ এলো, “হ্যালো অনিন্দিতা আমি জয় এর মা বলছি।”
এই রে জয় এর মা আবার কেন এই সময়! ওর ব্যাপারটা বাড়িতে জেনে যায় নি তো!
“হ্যাঁ কাকিমা বলুন” গলা খাঁকরে বলল অনিন্দিতা!
– জয় এর কী হয়েছে তুমি জানো?
এই ভয়টাই পাচ্ছিল অনিন্দিতা। কাকিমা কি তাহলে জেনে গেছে। ও কিছু বলার আগেই জয় এর মা আবার বললেন, “তোমার কী ঠান্ডা লেগেছে? গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?”
– হ্যাঁ কাকিমা। ঠান্ডা লেগেছে একটু। আর বলছিলাম যে জয় এর কী হবে? কালকেই তো দেখা হল?
– না মানে, বাড়িতে এলো না কাল রাতে।
– কাল রাতে মন্ডপে ছিল ও। চিন্তা করবেন না আপনি ও ভালো আছে।
– হুম। তার পর একটা ফোন এসেছিল।
– কী ফোন? কে করেছিল?
– কে করেছিল জানিনা। বলল, “ছেলেকে সাবধানে থাকতে বলুন নাহলে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরতে হবে না। সোজা মর্গে পাঠিয়ে দেবো!” বলেই কেটে দিল।
অনিন্দিতা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে ফোনটা কে করেছিল। এরা এবার যাচ্ছেতাই রকমের বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।
ও বলল, “Wrong Number ছিল হয়তো! নাহলে নার্সিং হোমের কথা কেন বলবে?”
– জয় এর বাবাও তাই বলল। তবে মায়ের মন বোঝোই তো!
– হ্যাঁ কাকিমা। বুঝতে পারছি। চিন্তা করবেন না। জয় ভালো আছে।
– ঠিক আছে। তুমি একদিন এসো আমাদের বাড়ি। জয় খুব বলে তোমার কথা।
– আচ্ছা কাকিমা। যাবো অবশ্যই।
ফোনটা রেখে ও দেখল ১২ টা মিসড কল। শুভদ্বীপ ৯ বার। জয় ২ বার ফোন করেছে। আর একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। true caller এ একবার খোঁজার চেষ্টা করল নাম্বার টা। কিন্তু দেখালো না কিছু। ও মেসেজ করলো “Who is this?”
কয়েক মুহুর্ত পরেই ফোন এল ওই নাম্বার থেকে। ফোনটা ধরল ও। খুব চেনা একটা গলা ও প্রান্ত থেকে বলল, “হ্যালো!”
না জয় নয়। শুভদ্বীপও নয়। অন্য আর একটা গলা।
ও কিছু বলার আগেই ও প্রান্তে থাকা মানুষটা নিজের পরিচয় দিল। যদিও ততক্ষনে অনিন্দিতা বুঝে গিয়েছিল গলাটা কার।
ও বলল, “বল? কি ব্যাপার?”
উত্তর এল, “বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকা উচিত। আর কতদিন এভাবে সহ্য করতে হবে সব?”
(চলবে)
One thought on “বোধন – পর্ব ৮”