যা লিখব সত্যি লিখব। সত্যি ছাড়া মিথ্যে লিখবো না। কথাটা বললাম তার কারণ হল লোকজন এ লেখা পড়ে ভাবতে পারে গল্প লিখছি কিংবা হয়তো খুব ভালো গঞ্জিকা সেবন এর ফল। কিন্তু বিশ্বাস করুন আজ যা লিখবো তা বর্ণে বর্ণে সত্যি।
প্রত্যেক বছর মহালয়া এলেই আমার ভয় টা বাড়তে থাকে। শরৎকালের রাতে… না না… হচ্ছে না। ঘেঁটে যাচ্ছে। আমার নাম অদ্বৈত মজুমদার। আমি একজন লেখক। পাঁচ বছর আগে আমি ‘দেবীপক্ষ’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। গল্প টি অনেকেই পড়েছে। বেশ কয়েকজন প্রশংসাও করেছে আমার সে লেখা পড়ে। কিন্তু সে কথা বলার জন্য আমি আজ কলম ধরিনি। আমি আজ লিখতে বসেছি তার পরের ঘটনা। সেই কথায় আসার আগে একটা বাস্তব ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিই বরং।
সুবীর ব্যানার্জীর নাম শুনেছেন আশা করি। উনি ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে অপুর ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অপুর জীবন টা যেমন Tragedy তে পরিপূর্ণ ছিল বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্পে। ঠিক তেমনই ঐ ছবিতে অভিনয় এর পর ওঁর জীবন টাও হয়ে গিয়েছিল অভিশপ্ত। একে একে বাবা, সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় স্ত্রী সবাই মারা যায়। ঠিক যেমন টা ঘটেছিল সিনেমা বা উপন্যাস এর অপুর সাথে।
এই কথাটা বললাম তার একটাই কারন, এই ঘটনাটা সত্যি ঘটনা। মানুষের যদি এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট না হয়, তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। হ্যাঁ অনেক ভূমিকা হল। এবার আমার কথা আসি।
প্রত্যেক বছর মহালয়া এলেই আমার ভয় টা বাড়তে থাকে। নাহ। কোনোরকম কোকিলের ডাক আমি শরৎকালে শুনি না। তবে প্রত্যেক বছর এই দিনে আমার পরিবারের একজন করে মারা যায়। ঠিক যেই ক্রমানুসারে আমি আমার ‘দেবীপক্ষ’ গল্পে লিখেছিলাম মৃত্যুগুলো, ঠিক এভাবেই ঘটে চলেছে সব কটা মৃত্যু। আর এভাবে যদি চলতে থাকে আজ আমার এই পৃথিবীতে শেষ দিন। তাই আজ সব লিখতে বসেছি আমি।
গল্পটি লেখার পরের বছর চলে গেলেন ঠাকুমা। মহালয়ার ভোরে বিছানায় নিথর দেহ টা পড়ে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে আমার স্ত্রী। কাছে গিয়ে দেখি নাড়ি বন্ধ। ঘুমের মধ্যেই চলে গিয়েছেন। ঠিক তার এক বছর পর চলে গেলেন বাবা। সেই একই ভাবে। একই দিনে। মহালয়ার ভোর। ঠাকুমার ঘটনার পর অতটা কিছু মনে হয় নি। যদিও একটা খটকা ছিল মনের মধ্যেই। বাবার ঘটনার পরেই প্রথম লক্ষ্য করলাম আমি Pattern টা। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। কাকুও থাকেন আমাদের সাথেই। তবে কাকু বিয়ে থা করেন নি। একা মানুষ। দেবীপক্ষ গল্প অনুযায়ী চলতে গেলে তার পরের বছর পালা ছিল কাকুর। আমি খুব ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে গিয়েছি মহালয়ার আগের রাতে। মনে মনে ভগবান কে ডেকেছি আর ভেবেছি যেন আমার ভাবনা মিথ্যে হয়। কিন্তু আর ভগবান! পরের দিন ভোরে আবার এক জিনিস। কাকুর নিথর দেহ। অদ্ভুত ভাবে যেন হৃৎপিন্ড টা হঠাৎ থেমে গেছে কাজ করতে করতে। আমি আর থাকতে পারিনি। সেদিনই সব খুলে বললাম মা এবং স্ত্রী কে। কারন এই জিনিস যদি সত্যি ঘটতে থাকে তাহলে মায়ের কাছে আর মাত্র ১ বছর আছে। মা খুব শান্ত ভাবে শুনলেন সব তারপর বললেন, “দেখ যদি যাওয়ার হয় তাহলে যাবো। অত ভাবিস না। এমনিতেও আমার বয়স তো কম হল না।”
খুব অসহায় লাগছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, এর কী কোনো সমাধান নেই। অনেক ভাবার পর একটা উপায়ের কথাই মাথায় এল। সেদিনই বেরিয়ে কিনে আনলাম একটা Whitener. মানে সাদা কালি যাকে বলে। তারপর আমার লেখার খাতা খুলে দেবীপক্ষ গল্প থেকে মায়ের মৃত্যুর কথাটা সাদা কালি দিয়ে মুছে দিলাম। জানিনা কী হবে এরপর। এটা কাজ করলো কিনা সব বোঝা যাবে এক বছর পর।
কয়েকদিন বাদে আমার স্ত্রী বলল, “দেখো, তোমায় একটা কথা বলার ছিল।”
সবে মাত্র কাকুর শ্রদ্ধা শান্তির কাজ শেষ হয়েছে। কিছু হিসেব পত্র নিয়ে বসেছিলাম। মুখ তুলে বললাম, “কী?”
স্ত্রী কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “দেখো, তুমি যে ওই সাদা কালি দিয়ে মায়ের ওই ব্যাপারটা মুছে দিলে তোমার গল্প থেকে, তাতে আমার মনে হয় না কোন লাভ হবে?
– ”কেন?
– কারন মৃত্যু ব্যাপার টা এতটাও সহজ নয় জানো তো! Final Destination বলে একটা সিনেমা দিয়েছিল TV তে কয়েক দিন আগেই। ওতেও দেখলাম মৃত্যু কে বোকা বানানো এত সহজ না। আর তুমি যদি একটা মৃত্যু এড়াতে চাও তাহলে আর একটা মৃত্যু অনিবার্য।
কয়েক দিন আগেই বাড়িতে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। তারপরেই এসব কথা একদম ভালো লাগল না আমার। একটু রূঢ় ভাবে বলতেই হল ওসব গাঁজাখুরি হলিউড সিনেমায় যা দেখানো হচ্ছে তা নিয়ে এত বেশী ভাবার কোনো দরকার নেই। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটাবো আমরা। স্ত্রী আর কিছু না বলে চলে গেল।
গত বছর মহালয়া পড়েছিল অক্টোবর মাসে। সেদিন অনেক রাত অবধি জেগে গল্প করলাম আমি আর স্ত্রী মায়ের সাথে। ভেবেছিলাম ঘুমোবো না। কিন্তু ইজিচেয়ারে বসে বসে হঠাৎ চোখ টা ধরে গিয়েছিল দু’জনেরই। মা শুয়েছিল বিছানাতেই। ঘুম ভাঙতেই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। দেখলাম চারটে বেজে গেছে। ধড়ফড় করে উঠেই মাকে ডাকলাম। “মা… মা… ও মা… শুনছো?”
কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে মায়ের হাত টা ধরতেই দেখলাম বরফের মত ঠান্ডা। নাহ। হয়নি শেষ রক্ষা। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলাম মাটিতে।
আজ সেরকমই একটা দিন। এখন বাজে প্রায় ১০ টা। কাল মহালয়া। অর্থাৎ আমার গল্প অনুযায়ী যদি সব চলে, তাহলে আমার হাতে আর মাত্র ৫-৬ ঘন্টা। স্ত্রী কে বললাম, “আজকের রাতটা আমার শেষ রাত। তাই একটু থাকতে চাই।”
খুব অবাক হলাম যখন দেখলাম ও একেবারেই আপত্তি করল না। বাড়িতে আর লোক বলতে কেউ নেই প্রায়। আমি যদি আজ চলে যাই তাহলে সারা বাড়িতে ও একদম একা। জানিনা কীভাবে কী করবে। সব উইল করে দিয়েছি ওর নামে। ১২ টার একটু আগে আমি স্ত্রী কে বিদায় জানিয়ে একটা শতরঞ্চি নিয়ে চলে গেলাম ছাদে।
ছোটোবেলায় মা বলত, যখন কেউ মারা যায় তখন নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। আজকের পর আমারও জায়গা হবে ওরকম একটা জায়গায়। কেউ মনে রাখবেনা এই অদ্বৈত মজুমদার কে। নিচে কয়েকবার খুটখাট আওয়াজ পেলাম। বিড়াল ঢুকলো নাকি? নাহ। আজ কোনো কিছুর দিকেই খেয়াল দেবো না। যা হয় হবে। একটা আলোর রেখা আসছিল অনেকক্ষন থেকেই স্ত্রীর ঘর থেকে। সেটা বন্ধ হল এবার। কটা বাজে বোঝার উপায় নেই। কারন ঘড়ি নিয়ে আমি উঠিনি। ছাদে বোধ হয় শিশির পড়ছে। কারন হালকা ঠান্ডা লাগছে আমার। তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল একটা ক্ষীন আওয়াজে। অনেক দূর থেকে মহিষাসুর মর্দিনি শোনা যাচ্ছে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে। অর্থাৎ ভোর ৪ টে বেজে গেছে। তাহলে কি আমি মৃত? আমার গল্পের মত আবার আমার দেহ টা শোয়ানো দেখব শতরঞ্চির ওপর? তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়লাম। নাহ। দেহ তো নেই আমার। কে সরালো তাহলে?
খটকা লাগল একটু পরেই। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। নাহ ঠান্ডায় নয়। মহিষাসুর মর্দিনি শুনে। আমি কি জীবিত নাকি এটা পরলোক। ছাদ থেকে নেমে নীচে গেলাম। আমাদের শোবার ঘোরে গিয়ে লাইট জ্বেলে দেখলাম স্ত্রী নেই। এই রে? এত রাতে কোথায় গেল আবার?
হঠাৎ বিছানার ওপর আর একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার তখন। আমার লেখার সেই পুরোনো খাতাটা। যাতে দেবীপক্ষ গল্পটি লিখেছিলাম প্রথম। আর তার পাশেই সাদা কালির কাঁচের শিশি টা। বুঝলাম আগের বছরের মত স্ত্রী শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিল। তবে সে যাই করুক না কেন। কাজ হয়েছে। খাতাটা তুলে নিলাম হাতে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম বারান্দার কাছে ইজিচেয়ারে বসে আছে আমার স্ত্রী। বসে তো নেই। ঘুমোচ্ছে মনে হল। কাছে গিয়ে ডাকলাম দু’বার। সাড়া দিল না।
হঠাৎই আগের বছরের একটা কথা মনে পড়তেই আমি শিউরে উঠলাম। স্ত্রী বলছিল একটা মৃত্যুর জন্য আর একটা মৃত্যু নাকি অনিবার্য। সাথে আমার লেখার খাতাটা খুললাম আমি। খুলে দেখলাম আমার গল্পের শেষ বদলে গেছে। যেখানে লেখা ছিল, “বিছানায় আমার স্ত্রীর পাশে শোয়ানো আছে আমারই দেহটা।” সেখানে সাদা কালি দিয়ে মুছে লেখা রয়েছে, “বিছানায় আমার পাশে শোয়ানো আছে আমার স্ত্রীরই দেহ টা।”
একটা অস্ফুট আর্তনাদ বেরোলো আমার গলা দিয়ে। এটা কী করল ও? আমার জন্য নিজের জীবন টা শেষ করে ফেলল? আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না আমি। পেটের ভিতর টা খালি খালি লাগছিল। এরপর আমার কী করা উচিত কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। কাকে ডাকব? আমার তো আর কেউ নেই।
এরপরে যে ঘটনা টা ঘটল সেটাকে কি Climax বলব না Anticlimax বলব জানি না। হঠাৎই স্ত্রী ধড়ফড়িয়ে উঠল ইজি চেয়ার থেকে। তারপর সাথে সাথে দৌড়ল সিঁড়ির দিকে। আমি কিছু বোঝার আগেই খুব দ্রুত ঘটে গেল সেই ঘটনা টা। কয়েক মুহুর্ত পর খেয়াল হতে আমিও গেলাম পেছন পেছন। ও যাচ্ছে ছাদে। কিন্তু ছাদে গিয়ে কী হবে? আমি তো এখানেই। ছাদে যাওয়ার পর স্ত্রীকে দেখতে পেলাম। আমার শতরঞ্চির পাশে। বসে আছে। আমার স্ত্রী আর একটা কথাও বলেছিল সেবার, “মৃত্যু কে বোকা বানানো এত সোজা নয়।” এতক্ষনে হাসি ফুটল আমার মুখে। আর হাসবো নাই বা কেন? শতরঞ্চিতে স্ত্রীর ঠিক সামনেই শোয়ানো রয়েছে আমার নিথর দেহ টা। তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় মহিষাসুর মর্দিনি এখনও শুনতে পাচ্ছি আমি। আর গায়ে এখনো কাঁটা দিচ্ছে। যাক! মহালয়ায় মৃত্যু ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ নয় তাহলে!