[ শুরুতেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। ওপরের দেওয়া নামটা নিয়ে ব্যোমকেশের তীব্র আপত্তি ছিল। বলেছিল ভুলভাল তথ্য দিয়ে তুমি পাঠকদের Mislead করছো। এটা ঠিক না। আমি ওর কথায় কর্ণপাত করিনি। কেন করিনি আপনারাও বুঝতে পারবেন একটু পর। ]
বেশ কয়েকদিন ধরেই ব্যোমকেশ কে নিজের ঘর থেকে বেরোতে দেখছি না। জিজ্ঞেস করলেই বলছে ATM কার্ড নিয়ে যে জালিয়াতি টা শুরু হয়েছে সেটা যতদিন না একটা সুরাহা করতে পারছে তত দিন নাকি ঘর থেকে বেরোবে না। পূজো সবে গেল। ইউনিভার্সিটিও বন্ধ। অগত্যা আমার জীবন টাও বেশ ঘটনাবিহীন ভাবেই কাটছে।
সেদিন ছিল শনিবার। ব্যোমকেশ যথারীতি ল্যাপটপের সামনে বসে বসে না জানি কি করছে। বিকেল অবধি এভাবে কাটার পর আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, “আজ তোমায় বেরোতেই হবে আমার সাথে। সারাক্ষন এভাবে বসে আছো! মাথাটাকে অন্তত একটু বিশ্রাম দাও এবার।”
ব্যোমকেশ ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে বলল, “কোথায় বেরোতে হবে বলো।”
আমি এক মুহুর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলাম। ওর এই উত্তরটা আমি আশা করিনি। ভেবেছিলাম হয়তো প্রতিবাদের স্বরে না বলে উঠবে। তাই কোথাও সত্যি যাব ভেবে এসে ওকে বলিনি। তৎক্ষনাৎ মাথায় এলো নতুন কি একটা সিনেমা যেন রিলিজ করেছে গতকাল। শেক্সপীয়ার এর জুলিয়াস সীজার থেকে অনুপ্রানিত সম্ভবত। বললাম, “নন্দন যাব চলো। ভালো সিনেমা দেখতে।”
– “সিনেমা আজকাল আবার ভালো হয় নাকি? জানতাম না তো?”
এই হচ্ছে ওর সমস্যা। কোনো বাংলা সিনেমাই ওর পছন্দ হয় না। ওর কথা হচ্ছে সত্যজিৎ রায় ঋত্বিক ঘটকের পর সিনেমা ভালো সিনেমা বানাতে পারে এরকম মানুষ বাংলায় আর জন্মায় নি। ঋতুপর্ণ ঘোষ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই! চেষ্টাই। ব্যবসা করতে গেলে নাকি সিনেমা করা যায় না।
যাই হোক ওকে বাড়ির বাইরে বের করার চেষ্টাটা এভাবে সফল হতে হতেও ভেস্তে যাবে এটা হতে দেওয়া যায় না। আমি বললাম, “সিনেমা না দেখে ভালো খারাপ Judge করার চেষ্টা কোরো না। তুমি না সত্যান্বেষী! Fact ছাড়া Conclusion এ পৌঁছোলে কী করে?”
কথাটা বলেই বুঝতে পারলাম ধাক্কাটা একদম ঠিক জায়গাতেই দিয়েছি। ব্যোমকেশ আর কথা না বাড়িয়ে পাঞ্জাবীটা পরে বলল, “চলো তাহলে। facts collect করে আসি।”
সিনেমা দেখার পর আমি চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। কারন তখন আর আমার কিছু বলার যো ছিল না। ব্যবসা সত্যিই একটা সিনেমার Quality কে কোন জায়গায় নামাতে পারে সেটা এই জুলিয়াস সীজার না দেখলে সত্যিই কেউ বিশ্বাস করবে না। সিনেমা চলাকালীন কয়েকটা দৃশ্যে তিতিবিরক্ত হয়ে আমি নিজেই ব্যোমকেশের দিকে তাকিয়েছি কিন্তু ওর কোনো তাপ উত্তাপ নেই। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে মন দিয়ে ছবি দেখে যাচ্ছিল। Facts Collect করছে হয়তো। বেরিয়ে আমার মুন্ডপাত হবে।
হল থেকে বেরিয়ে ব্যোমকেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, “Thanks.”
বুঝতে পারছিলাম এর পরে আরও কিছু আসতে চলেছে।
“বুঝলে অজিত” ব্যোমকেশ বলল, “ভালো সিনেমা অনেক দেখেছি। এখনো দেখি কিছু মাঝে মাঝে। তবে খারাপ সিনেমা যে কতটা খারাপ হতে পারে সেটা জানাটা সত্যি প্রয়োজন ছিল। আজ জেনে গেলাম। Thanks to you.”
আমি কিছু হয়তো উত্তর দিতাম। দিলাম না তার কারন পেছন থেকে অনেক দিন না শোনা একটা গলার আওয়াজ পেয়ে।
“আরে অজিত না!”
পেছন ফিরে যাকে দেখলাম তাকে শেষ এত সামনে থেকে দেখেছি সেকেন্ড ইয়ার এ পড়তে পড়তে। ফেসবুকে যখন DP চেঞ্জ করে তখন অবশ্য মাঝে মধ্যেই দেখি। কিন্তু কথাবার্তা নেই প্রায় ২ বছর হয়ে গেল।
“কী রে চিনতেও পারছিস না নাকি?”
ওকে চিনতে পারবো না এত খারাপ স্মৃতিশক্তি আমার না। মোহনা দাসগুপ্ত। স্কুলে আমার সাথে পড়ত। তারপর আমি চলে আসি সাহিত্য নিয়ে পড়তে। আর ও চলে যায় ডাক্তারি পড়তে। সেকেন্ড ইয়ার অবধি যোগাযোগ ছিল। তারপর আর…
একটু গলা ঝেড়ে বললাম, “আরে না না। চিনতে পারব না কেন? আসলে অনেক দিন পর দেখছি তো!”
তারপর ব্যোমকেশের সাথে আলাপ করিয়ে বললাম, “ও আমার স্কুল এর বন্ধু মোহনা দাসগুপ্ত আর ইনি হচ্ছেন আমার Flatmate. ব্যোমকেশ বক্সী!”
- “সিরিয়াসলি?” মোহনার ভুরু তখন কুঁচকে গিয়েছে।
- “কি সিরিয়াসলি?” আমি বললাম
- “মানে ব্যোমকেশ বক্সী নামে কেউ সত্যিই রয়েছে?”
- “মানে? থাকবেনা কেন?”
- “না মানে। তোর ব্লগে পড়েছিলাম ব্যোমকেশ কে নিয়ে লেখা একটা গল্প। কিন্তু আমি তো ভাবছিলাম ওগুলো তোর মনগড়া গল্প।”
- “আরে না না। তা কেন হতে যাবে? যেটা পড়েছিস সেটা মোটেই মনগড়া না।”
মোহনার তখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। ব্যোমকেশ এর ঠোঁটে মৃদু হাসি। মোহনা তারপর ব্যোমকেশের দিকে ফিরে বলল, “ তার মানে কি আপনি সত্যিই গোয়েন্দা?”
- “একদম না। Never!” ব্যোমকেশ বলল।
- “তাহলে অজিত যে লিখেছে…”
ব্যোমকেশ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “তুমি গোয়েন্দা লিখেছো? বারন করেছিলাম না তোমায়।”
আমি এবার বিরক্ত হয়ে বললাম “মোটেই লিখিনি। সত্যান্বেষীই লিখেছি। উফফ্।”
মোহনা বলল, “ও হ্যাঁ হ্যাঁ। সরি। আমারই ভুল। আসলে ২ টোর মানে তো প্রায় একই।”
ব্যোমকেশ বলল, “No Mam. এটা একটা misconception. গোয়েন্দা আর সত্যান্বেষীর মধ্যে মিল এর থেকে অমিল বেশী। পরে একদিন সময় করে বলব। আজ একটু তাড়া আছে। অজিত, যাবে তো?”
আমি কিছু বলার আগে, মোহনা কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল মনে হল। ব্যাপারটা ব্যোমকেশেরও নজর এড়ায় নি। ও বলল, “আপনি কী কিছু বলবেন?”
“বলব মানে। ব্যাপারটা হয়তো অতি সামান্য একটা ব্যাপার। কিন্তু…”
আমি বললাম, “আরে বলে ফেল। চাপ নেই কোনো।”
ব্যোমকেশও বলল, “হ্যাঁ বলুন। অত ভাববেন না,”
“Samandarin ড্রাগ এর নাম শুনেছেন?” মোহনা জিজ্ঞেস করল।
ব্যোমকেশ বলল, “পড়েছি কোথাও একটা। Salamander এর শরীর থেকে বানানো ড্রাগ কী?”
- “হ্যাঁ। এদেশে সহজে পাওয়া যায় না। কারন প্রথমত এটা খুব আর দ্বিতীয়ত এটা বেআইনি”
- বেআইনি টা খুব একটা Matter করে না এখন। দাম টাই বড় কথা।
আমি বললাম, “জিনিস টা কী আমায় একটু বলবে। কি ড্রাগ, খায় না মাথায় দেয় কিছুই বুঝছি না।”
মোহনা বললো, “Salamander নামে একটা প্রানী আছে। কিছুটা গিরগিটির মত দেখতে। বলতে পারিস গিরগিটি আর গোসাপ এর মাঝামাঝি একটা সরীসৃপ প্রানী। ওই প্রানীর শরীর থেকে একটা রস বের হয়। সেই রস আর অ্যালকোহল মিশিয়ে একটা ড্রাগ বানানো হয়। সেটাই Samandarin Drug নামে পরিচিত।”
ব্যোমকেশ বলল, “হ্যাঁ এবার মনে পড়ছে। গিরগিটির মত দেখতে ওই প্রানীটাকে অ্যালকোহলের শিশির মধ্যে ডুবিয়ে রেখে দেওয়া হয়। শ্লোভানিয়া তে খুব বিখ্যাত এই ড্রাগটা। Hallucination হয় এটা খেলে। মানে ওই LSD টাইপের একটা জিনিস।”
- “শুধু Hallucination না। এটা খেলে হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু করে শ্বাসকষ্ট জনিত প্যারালিসিস অবধি হতে পারে।” মোহনা বলল।
আমি বললাম, “তা এটার সাথে তোর কি সম্পর্ক? তুই খাস নাকি?”
“উফ্। আমি খেতে যাব কেন?” একটু বিরক্ত হয়ে বলল মোহনা।
ব্যোমকেশ এবার একটা আগ্রহ পেয়েছে বোঝা গেল। বলল, “একটু খুলে বলবেন কী সব টা?”
মোহনা বলতে শুরু করল, “আমার পিসেমশাই নন্দদুলাল চৌধুরী খুব বড় একজন ব্যবসায়ী। এক কালে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন। তার সাথে সাথে বহু বদ নেশাও করেছেন। সেই জন্যেই ৫০ বছর হতে না হতেই শরীরে যেভাবে রোগ বাসা বেঁধেছে তা আর বলার নয়। ৬ মাস আগে একটা অ্যাকসিডেন্ট এ পা চলে যাওয়ায় এখন একেবারেই পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছেন। একবার Already Stroke হয়ে গিয়েছে।”
এতটা বলে মোহনা একটু থামল। তারপর একবার ঘড়ির দিকে দেখে আবার বলতে শুরু করল, “আমার পিসেমশাই এর চরিত্র সম্পর্কে যে কীভাবে আপনাকে বোঝাবো একদম ভেবে পাচ্ছি না। নিজের লোক সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে নেই। কিন্তু নন্দদুলাল চৌধুরীকে নিয়ে ভালো কথা বলার মত ভাষা কোনো অভিধানে আছে কিনা আমার জানা নেই। মুখের ভাষা ভীষন খারাপ। তার সাথে অত্যন্ত কুটিল, সন্দেহপ্রবন এবং হিংসা পরায়ন। আমার সাথে উনি যে ভাষায় কথা বলেন তা মুখে আনা যায় না। বাড়িতে আমার পিসি আর পিসতুতো দাদারা রয়েছে। কিন্তু কারুর সাথে ভালো সম্পর্ক নয় ওঁর। সারা জীবন যেভাবে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করেছেন ওঁর ইচ্ছে এখনো তাই করেন কিন্তু শরীর তো আর সঙ্গ দেয় না। তাই দুনিয়াশুদ্ধু লোকের পর ওঁর রাগ আর ঈর্ষা। যেন ওর এই অবস্থার জন্য তারাই দায়ী।”
মোহনা এবার একটু থামল। বোধহয় সাজিয়ে নিচ্ছে এরপর কীভাবে বলবে। তারপর বলল, “সারাক্ষন বিছানায় বসে ল্যাপটপে অজস্র নোংরা ছবি আর সিনেমা দেখে। আর বাকি সময় সাদা কাগজে লাল, সবুজ, কালো কালি দিয়ে যা ইচ্ছে লিখতে থাকে। নিজেকে মনে করে বিরাট কোনো সাহিত্যিক। বিভিন্ন পত্রিকায় বাড়ির লোককে দিয়ে লেখা পাঠায় কিন্তু কেউ ছাপে না। তাতেই ওঁর ধারনা সবাই ষড়যন্ত্র করে ওর লেখা ছাপে না।”
এবার আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী লেখেন উনি?”
“সাধারনত গল্প লেখেন। তবে যে ভাষায় লেখেন তা তুই পড়তে পারবি না। অসভ্য , নোংরা ভাষায় যা ইচ্ছে তাই লিখতে থাকেন উনি।”
ব্যোমকেশ বলল, “বাহ! চরিত্র টাকে যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। বলে যান আপনি।”
মোহনা বলল, “এবার আসল কথায় আসি। তো আমার এই গুনধর পিসেমশাই একটি নেশা করেন। Samandarin drug. ওই গিরগিটি জাতীয় প্রানীটার রস। যেটার কথা বললাম শুরুতে। এই নেশার জন্য ওর শরীরটা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাতে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! কান্নাকাটি করে করে পিসির চোখের জল শুকিয়ে গেছে বলা যায়। কিন্তু পিসেমশাই পাত্তাই দেয় না ওসব। বরং আরও দু’চার কথা শুনিয়ে দেয়।”
“কিন্তু তুই তো বললি উনি পঙ্গু। তাহলে ওঁকে এসব যোগায় কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
- “সেটাই হচ্ছে মূল রহস্য। আমি জানিনা। কেউ জানে না। কখন নেশা করেন, কীভাবে করেন, কে দেয় কিচ্ছু জানিনা। তবে এটুকু জানি। বাড়ির লোকেরা সব সময় ওঁকে চোখে চোখে রাখে। তা সত্বেও যে কী করে সবার চোখে ধূলো দেন কিছু জানিনা। এমন কী ওর কাছে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। শুধু একজন আয়া আছেন। সকালের দিকেই থাকেন। তারপর দুপুরে স্নান করিয়ে আবার চলে যান। বাকি সময় পিসি এবং দাদারা পালা করে পাহারা দেয়। কিন্তু তাও কেউ আটকাতে পারে না ব্যাপারটা। শুধু নেশা করার পর চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারা যায় যে নেশা করেছেন। আর একজন ডাক্তার রয়েছেন। আমার খুব কাছের একজন। মাঝে মাঝে দেখতে আসেন অবস্থার কোনো উন্নতি হল কিনা।”
ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল, “বুঝলাম। সমস্যা সত্যিই রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে মোহনা আপনাকে একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। এই মানুষটা যদি পৃথিবী থেকে চলে যায় তাতে কী সত্যি কিছু যায় আসবে কারুর?”
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই মোহনা বলল, “কী জানেন তো, একজন বাইরের লোক হয়ে এই কথাটা বলা সত্যিই সহজ। কিন্তু ওই মানুষটার কাছে যারা রয়েছে, যারা তাকে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখছে তারা হয়তো আপনার সাথে সহমত হবেন না।”
“তা ঠিক। তা আপনি এখন ঠিক কী চাইছেন?”
“আমি চাই আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু অনুসন্ধান করুন। আমি পিসিকেও বলে দেবো। আপনার যা পারিশ্রমিক লাগে উনি দিয়ে দেবেন।”
ব্যোমকেশ বলল, “ঠিক আছে। তাই হবে। আপনি পিসির বাড়িতে বলে রাখুন। আমি আর অজিত কাল সকালে যাব। আপনার ফোন নাম্বারটা অজিত কে দিয়ে দিন। ঠিকানাটা মেসেজ করে দেবেন।”
এতক্ষন পরে মোহনার মুখে অল্প হাসি ফুটলো মনে হল।
ব্যোমকেশ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “চলো অজিত। ফিরতে হবে তো!”
২
“তুমি সত্যি বিশ্বাস করছো এই গিরগিটির রস এর ব্যাপার টা? কেমন একটা গাঁজাখুরি লাগছে না?” রাতে বাড়ি ফেরার পর জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যোমকেশ কে।
ও বলল, “First of all ওটা গিরগিটি না। Salamander. ২ টোর মধ্যে অনেকটা তফাৎ। আর দ্বিতীয়ত, হ্যাঁ আমি বিশ্বাস করছি। এবং আমি এরকম কিছু মানুষের কথা শুনেছি যারা মাকড়সার রস খেয়ে নেশা করে।”
আমি প্রায় আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মাকড়সার রস?”
- “হ্যাঁ। তাই বলে ভেবো না দেওয়াল থেকে মাকড়সা ধরে তার রস বের করে খায় কেউ। ওটা খেলে গায়ে বিষফোঁড়া বেরোবে। এটার জন্য ট্যারান্টুলা নামে একটা বিশেষ প্রজাতির মাকড়সা লাগে।”
- “ইস্! ভাবতেই ঘেন্না করছে।”
- “স্বাভাবিক। এসব কি আর তোমার আমার খাওয়ার ইচ্ছে বা সামর্থ্য হবে ভায়া?”
আমি আর কিছু বলিনি। পরের দিন সকাল থেকে ব্যোমকেশ আবার সেই ল্যাপটপের সামনে বসে ছিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ বললাম, “চলো। কখন যাবে?”
ব্যোমকেশ ল্যাপটপ থেকে ঘাড় তুলে বলল, “ও হ্যাঁ। আমি ভাবছিলাম আজ যাবো না। এই কেস টা নিয়ে মাথাটা ঘেঁটে রয়েছে।”
“মানে? তাহলে যে মোহনা কে বললে যে তুমি যাবে। এরপর ও কি ভাববে বল তো না গেলে?” আমি এবার একটু বিরক্তির স্বরেই বললাম।
- “কী আবার ভাববে? বুঝে যাবে ব্যস্ত আছি। আর একেবারে যাবো না তা তো নয়। আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।”
খুব রাগ হচ্ছিল ব্যোমকেশ এর ওপর। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না। যাই হোক মোহনা কে মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম যে আজ যাচ্ছি না। আর তারপরেই ফোন এল ওর।
- বল
- কেন আসছিস না?
- ব্যোমকেশ অন্য একটা কেস নিয়ে ব্যস্ত আছে বলল।
- তুই একবার ওঁকে ফোনটা দে। কথা বলব।
- ও কাজ করছে একটু। রেগে যেতে পারে।
- আমি বেশিক্ষন কথা বলবও না। তুই দে না ফোন টা.
অগত্যা! দিলাম ফোন। ওদিক থেকে কী বলা হল জানিনা। এদিকের কথা গুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি।
- হ্যাঁ মোহনা বলুন।
- ……
- হ্যাঁ আসলে অন্য একটা কেস নিয়ে আটকে পড়েছি তো।
- ……
- না না। তা তো বলিনি। আমি যেতে পারবো না। কিন্তু আজ অজিত যাবে।
- ……
- হ্যাঁ ওকে তো সেরকমই বললাম।
এটা বলেই আমার দিকে চোখ টিপল ব্যোমকেশ।
- অজিত আপনার বন্ধু বলে হয়তো আপনি ঠিক ভরসা পাচ্ছেন না। কিন্তু আমি আশ্বাস দিচ্ছি আপনাকে। হয়তো দেখবেন আমায় আর যেতেই হবে না। অজিতই সমাধান করে দিল সবটা।
- ……
- হ্যাঁ ও একটু পরেই পৌঁছোবে। আর চিন্তা করবেন না। ও না পারলে তো আমি রইলামই।
“এটা কী হল?” ফোনটা রাখার পরেই রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ব্যোমকেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “কী আবার হবে? তোমার একটা সুযোগ করে দিলাম।”
- মানে? কীসের সুযোগ?
- Oh Please! কাল মোহনা কে দেখার পর তোমার মুখের অবস্থা কি হয়েছিল একবারও আয়নায় দেখেছিলে। You two have history। এটা বোঝার জন্য সত্যান্বেষী লাগে না।
একটা খুব পুরোনো ক্ষত এই ধাক্কাটা দিল ব্যোমকেশ। হ্যাঁ আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তা শেষ হয়ে গিয়েছে ২ বছর আগে। আমি বললাম, “কিন্তু আমি গিয়ে করব টা কী? এই তো কয়েক মাস হল তোমার সাথে রয়েছি। একটা মাত্র কেসে তোমাকে কাছ থেকে দেখেছি। আমি তো এসবের কিছুই বুঝি না।”
ব্যোমকেশ বলল, “কিছু বোঝার তো দরকার নেই। তোমার কাজ হবে পর্যবেক্ষন করা। যে ঘরে নন্দদুলাল বাবু থাকেন। সেই ঘরটা ভালো ভাবে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করবে। সামান্যতম অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়লেও মনে রাখবে। আর বাড়ির সবাই কে প্রশ্ন করবে। নেশা সাধারনত কোন সময়ে করেন উনি। কে কে কী অর্ডারে পাহারা দেন। সব জিজ্ঞেস করবে।”
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই ব্যোমকেশ বলল, “আর কথা নয়। বেরিয়ে পড় এবার”
বেরিয়ে পড়েছিলাম তক্ষুনি। তখনও ভাবিনি সামনে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে রয়েছে। ওর পিসেমশাই এর বাড়ি টালিগঞ্জ এ। বাড়ির সামনে গিয়েই দেখলাম বাইরে নাম লেখা রয়েছে। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পর যে বেরিয়ে এল সেই ছেলেটি আমার থেকে অন্তত বছর খানেকের ছোটো হবে। বলল, “কাকে চাই?”
- নন্দদুলাল বাবুর বাড়ি তো এটা? মোহনা আমায় আসতে বলেছিল…
- মোহনা নামে কেউ এখানে থাকে না।
আমি বললাম, “হ্যাঁ সেটা আমি জানি। আমি মানে… নন্দদুলাল বাবু কে দেখতে…
“দেখুন দাদা,” ঝাঁঝের স্বরে বলল ছেলেটি, “তিন্নিদি আপনায় কী বলেছে জানিনা। তবে আমাদের কোনো বাইরের লোকের সাহায্য লাগবে না। আপনি আসতে পারেন।”
কথাটা বলার পরেই দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল আমার। তিন্নি মানে মোহনা আমি জানি। প্রথমবার গোয়েন্দাগিরি করতে এসে এরকম অভিজ্ঞতা হবে ভাবিনি। প্রথমটায় থ বনে গিয়েছিলাম। তারপর সম্বিৎ ফিরতে পেছন ফিরে হাঁটা দিলাম আমার বাড়ির পথে।
৩
“এইটা বলার পরে তুমি চলে এলে?” ব্যোমকেশের গলায় শ্লেষ বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না একটুও।
- “What did you expect me to do?”
- “আরে মোহনা কে একবার ফোন করতে হয় তো? এটা কি ১৯৫০ সাল নাকি? মোবাইল ফোন কে Utilise করতে শেখো!”
ব্যোমকেশ এবার একটু উত্তেজিত হয়ে গেছে বুঝতেই পারছি। আমি বললাম, “আসলে আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত। আর তাছাড়া ওরাও তো খুব বুল বলেনি তাই না? ওরা বাইরের লোক কে নিজেদের বাড়িতে ঢোকাবেই বা কেন?”
“এটা এখন আর বাইরের লোক নিজের লোক এর জায়গায় নেই।” ব্যোমকেশ বলল, “ডাক্তার বাইরের লোক না? আয়া বাইরের লোক না? নিজের পরিবারের একজন কে বাঁচানোর জন্য ২ টো বাইরের লোক কে ঘরে ঢোকাতে Hesitate করবে তুমি?”
আমি বললাম, “তাহলে এরপর কী করনীয়?”
- “কিছুই না। অপেক্ষা কর। ফোন আসবে।”
- “কে ফোন করবে?”
- “মোহনাই করবে সম্ভবত। Obviously এতক্ষনে জানতে পেরে গেছে যে তোমায় গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।”
ব্যোমকেশের এই ভবিষ্যদবানীটাও সত্যি হল অক্ষরে অক্ষরে। আধঘন্টা পরেই মোহনা ফোন করল।
- “সরি অজিত এরকম টা হবে জানলে…
- “আরে কোনো ব্যাপার না। তুই জানবিই বা কী করে?”
- “শোন। এরপর কখন আসবি বল। আমি থাকব।”
- তুই ব্যোমকেশের সাথে কথা বল।
বলে আমি ফোন টা ওকে ধরিয়ে দিলাম।
- হ্যাঁ বলুন।
- ……
- আরে It’s Okay.
- ……
- আমরা ভাবছি আজ বিকেলেই একবার যাবো। অসুবিধে নেই তো?
- ……
- ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইলো। বিকেলে দেখা হচ্ছে।
ব্যোমকেশ একটা আশ্চর্য রকমের প্রানশক্তি খুঁজে পেয়েছে মনে হল। সেটার কারনটাও ঠিক বুঝলাম না। বললাম, “তুমিও যাচ্ছো তাহলে বিকেলে?”
ব্যোমকেশ বলল, “অবশ্যই!”
- “তাহলে ATM জালিয়াতির কী হল?”
- “ওটা এখন তোলা থাক। আপাতত আমাদের এই নন্দদুলাল বাবু এবং তার পরিবারটিকে একটু দর্শন দিয়ে আসি।”
***
কলিং বাজানোর পর দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছিলাম। আর ভাবছিলাম এবার নতুন কোন অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে কিনা। রাস্তায় ব্যোমকেশ কে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার হঠাৎ এই উৎসাহের কারন টা কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। ও উত্তর দেয়নি। শুধু হেসেছে। দরজা খুলল মোহনা নিজেই। বলল, “আসুন। সকালের জন্য আবার ক্ষমা চাইছি।”
ব্যোমকেশ বলল, “আরে ঠিক আছে। অজিত কিছু মনে করেনি।”
- “প্রথমে কোন ঘরে যাবেন বলুন।”
- “আপনার পিসেমশাই এর ঘরেই যাওয়া যাক। তারপর বাকিদের সাথে কথা বলব।
- “আচ্ছা তাই চলুন। তবে আপনাদের তো আগেও বলেছি ওঁর মুখের ভাষার কোনো সীমা নেই। তাই Please কিছু মনে করবেন না।”
ব্যোমকেশ মৃদু হেসে বলল, “ওসব নিয়ে ভাববেন না আপনি। আমার যা পেশা তাতে একটু-আধটু নির্লজ্জ না হলে হয় না।”
তবে এই নির্লজ্জের সীমা যে কতটা ছাড়িয়ে যাবে সেটা নন্দদুলাল বাবুর ঘরে ঢোকার পরেই টের পেলাম। উনি বিছানায় বসে কাগজে কিছু লিখছিলেন। আমাদের ঘরে ঢোকার আওয়াজে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কীরে বেহায়া মেয়েছেলে? একটা ছেলে কে নিয়ে এসে কাজ হয় নি? আবার ২ টো কে নিয়ে এসেছিস?”
ব্যোমকেশ হাত জোড় করে করে বলল, “নমস্কার। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী। আর ইনি আমার বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।”
নন্দদুলাল বাবু একবার আমাদের কে মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষন করলেন, তারপর বলে, “হ্যাঁ তো আমি কী ধেই ধেই করে নাচবো? সব শালা ছিঁচকে চোরের দল ঢুকেছে আমায় লুট করতে। পুলিশ ডেকে তোদের আমি ঘর থেকে দূর করে দেবো হতচ্ছাড়া।”
তারপর আবার জোর গলায় বাড়ির সবাই কে শোনানোর জন্যে বলে উঠলেন, “বাইরের লোক কে ঘরে ঢুকিয়ে আমার নেশা করা আটকাবি তোরা? দেখি তোদের কত ক্ষমতা? বন্ধ করে দেখা।”
এরকম অভদ্র লোক আমি আগে কখনো দেখিনি। ব্যোমকেশ অবশ্য ওঁকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে ঘরটা ভালো করে দেখতে শুরু করল। আমিও এদিক ওদিক দেখে নিলাম একবার। ঘরে আসবাব পত্র বেশী নেই। আমি একবার বিছানার কাছে গিয়ে ওনার লেখা একটা কাগজের দিকে তাকিয়েছিলাম। যে ভাষা উনি ব্যবহার করেছেন দেখলাম তা পড়লে তারপর গঙ্গাস্নান করলেও সেই পাপ পরিস্কার হবে না। উনি দেখলাম কাগজে লেখার জন্যে কালো কালি ব্যবহার করেন। আর লেখার মধ্যে যেই জায়গা গুলো বেশি অস্লীল তার তলায় লাল দাগ দিয়ে Mark করে রেখেছেন।
নন্দদুলাল বাবু এখন আর কিছু বলছেন না। আস্তে আস্তে গজরাচ্ছেন আর আমাদের ভালো ভাবে লক্ষ্য করছেন। হঠাৎ ঘরের ডানদিকে রাখা একটা ফুলদানির পাশে একটা ছোটো শিশি দেখেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। আমি শিশিটার ঢাকনা খুলে গন্ধ শুঁকে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ পেলাম। ব্যোমকেশ ডাকতে যাচ্ছি তখন হঠাৎ নন্দদুলাল বাবু বলে উঠলেন, “আরে ওটা আতরের শিশি রে টিকটিকি! যা ওটা তোকে দিয়ে দিলাম যা। ঘরে গিয়ে মাখিস। শালা আতর চেনেনা গোয়েন্দাগিরি ফলাচ্ছে।”
মোহনা দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার বোকা বোকা গোয়েন্দাগিরি দেখে মজা পেয়েছে হয়তো। এরপর ব্যোমকেশ যেটা করল তাতে আমি আর মোহনা দু’জনেই চমকে গিয়েছিলাম। বিছানার কাছে গিয়ে নন্দদুলাল বাবুর সামনে রাখা ল্যাপটপ টা তুলে নিয়ে একটু দূরে রাখা একটা চেয়ারে গিয়ে বসল।
এরপর নন্দদুলালবাবু যে ভাষাগুলো ব্যবহার করলেন সেগুলো লেখার যোগ্য না। তাই লিখছি না। নেহাত পঙ্গু মানুষ তাই। নাহলে বিছানা থেকে নেমে এসে গুলি করে মারতেন। চিৎকার শুনে ওঁর স্ত্রী ছুটে এলেন তাড়াহুড়ো করে। মোহনা তাঁকে কিছু একটা বলায় তিনি আর কিছু না বলে চলে গেলেন। ওঁরা সবাই মনে হয় বাড়ির কর্তার এহেন আচরনের সাথে পরিচিত।
মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই ব্যোমকেশ ল্যাপটপ টা আবার বিছানায় ওর সামনে রেখে দিল। নন্দদুলাল বাবু তখন রাগে ফুঁষছেন সাদা কাগজে লাল-কালো পেন দিয়ে কীসব আবোল তাবোল লিখে চলেছেন।
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ব্যোমকেশ বলল, “মোহনা, এবার তো বাড়ির লোকজনের সাথে একটু কথা বলতে হবে।”
৪
এক একটা সময় থাকে যখন ব্যোমকেশ কোনো কথা না বলে একদম চুপ করে যায়। আমার তখন খুব বিরক্ত লাগে। এখনও এরকম একটা সময়। বুঝতে পারছি ও একটা কিছু ভাবছে। শেষটায় আমিই নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম, “ল্যাপটপ এ কী দেখলে?”
ব্যোমকেশ বলল, “তুমিই বল না দেখি।”
- “আমি গোয়েন্দা না তুমি গোয়েন্দা?”
- কী বললে?
- উফ! সরি। মানে কে সত্যান্বেষী আমি না তুমি?
- তা হলেই বা। তুমি তো একটা কেসে আমায় কাছ থেকে দেখেছো। তুমি বল না কী দেখার জন্য আমি ল্যাপটপ টা নিলাম?
ব্যোমকেশ এটা বলার পরে কিছুক্ষন ভাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম এ আমার দ্বারা হওয়ার নয়। ওকে আবার জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় মোহনা তার পিসি কে সাথে নিয়ে ঢুকল বসার ঘরে।
সবাই বসার পরে ব্যোমকেশ বলল, “আপনাকে বিব্রত করার জন্য মাফ চাইছি। কিন্তু যে কাজের জন্য আমায় ডেকেছেন সেটা আপনাদের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।”
ভদ্রমহিলা একটু গলা ঝেড়ে বললেন, “আপনি যেভাবে ইচ্ছে আপনার কাজ করুন। কিন্তু ওঁকে এই বিষ খাওয়া থেকে আটকান।”
- “সে তো অবশ্যই। আচ্ছা এই নেশাটা উনি কবে থেকে করছেন জানেন?”
- “জানি। ২০০৯ সাল নাগাদ উনি একবার ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন এই অদ্ভুত নেশা নিয়ে।”
- “দেশের বাইরে কোথায় গিয়েছিলেন?”
- “তা তো ঠিক জানিনা। উনি আসলে তখনো সব কথা ঠিক করে বলতেন না আমাদের সাথে।”
- “উনি কি প্রথম থেকেই এরকম বদমেজাজী।”
- “নাহ। এতটা নয়। ওই অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই ব্যাপারটা মাত্রাছাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
- “ওঁর কাছে কারা কারা যায়?”
- “বাইরের লোক কেউ যায় না। আমি আর আমার তিন ছেলে অরুন, অভয় আর অনন্ত।
- “ঠিক আছে আপনাকে আর বিব্রত করব না। একবার আপনার বড় ছেলেকে পাঠিয়ে দেবেন। একটু কথা বলব।”
মিনিট ৩-৪ পরেই অরুন বাবু ঘরে ঢুকলেন। হাসি মুখ। হাইট প্রায় ৫ ফুট ৮ মত হবে। ব্যায়াম করা শরীর মনে হচ্ছে।
ব্যোমকেশ হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, “আমার নাম – ”
অরুনবাবু হেসে বললেন, “আমি জানি আপনার নাম। বলুন কী জানতে চান।”
“আপনি কী করেন” ব্যোমকেশ প্রশ্ন শুরু করল।
- “আমি থিয়েটার করি। কিছু বাংলা সিরিয়ালেও অভিনয় করি”
- “আপনার বাবার এই অবস্থা সম্পর্কে আপনার কী ধারনা?”
- “দেখুন ধারনা বলতে আর পাঁচজন সুস্থ মানুষের নেশা সম্পর্কে যা ধারনা হওয়া উচিত আমারও তাই ধারনা।”
- “হুম। আচ্ছা আপনাদের কী নির্দিষ্ট কোনো সময় রয়েছে ওঁর কাছে যাওয়ার।”
- “মানে? বুঝলাম না ঠিক।”
- “মানে আপনারা তো পালা করে পাহারা দেন শুনেছি। কে কোন সময়ে পাহারা দেন সেটা কি ঠিক করা থাকে?”
- “As a matter of fact we have a routine. আসলে কী বলুন তো আমরা সবাই তো যে যার কাজে ব্যস্ত থাকি। অনন্ত ছাড়া। তাই আগে থেকেই এটা ঠিক করা থাকে কে কোন সময় বাবার ঘরে থাকবে।”
- “ওটা কি একটু পাওয়া যেতে পারে?”
- “হ্যাঁ। আপনি একটা কাজ করুন আপনার নাম্বারটা আমায় দিন আমি Whatsapp এ পাঠিয়ে দেবো।”
- “আচ্ছা। অনেক ধন্যবাদ। এবার একটু অভয়বাবু কে ডেকে দিন”
অরুনবাবু চলে যাওয়ার পরেই আমি ব্যোমকেশ কে জিজ্ঞেস করলাম, “কি বুঝছো?”
ব্যোমকেশ আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, “আপাতত শুধু Facts Collect করছি।”
অভয়বাবুও ঢুকলেন মিনিট ২-৩ পরে। ব্যোমকেশ আর নতুন করে পরিচয় দিল না। শুধু বলল, “বসুন।”
অভয়বাবু বসতে বসতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে গোয়েন্দা আপনি না ইনি?”
ব্যোমকেশ ই উত্তর দিল। “কেউ না।”
অভয়বাবুর ভুরুটা একটু কুঁচকে গেছে বুঝতে পারছি। কাজেই আমায় বলতেই হল যে ব্যোমকেশ গোয়েন্দা কথাটা খুব একটা পছন্দ করে না। ও সত্যান্বেষী। অভয়বাবু কী বুঝলেন জানিনা। তবে ঘাড় নাড়লেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি করছেন এখন?”
- “আমি তো বাবার ব্যবসাটাই দেখছি।”
- “কেমন চলছে?”
- “ভালোই। বেশ ভালো।”
- “আপনার দাদার তো বোধহয় এদিকে খুব একটা লক্ষ্য নেই?”
- “দাদারও নেই, ভাই-এরও নেই।”
- “তাহলে তো বলতে হয় আপনার বাবা আপনাকে বাকি দু’জনের থেকে বেশী স্নেহ করেন?”
- “স্নেহ? আমার বাবা? উনি শব্দটা জানেন কিনা আমার ঠিক জানা নেই।”
- “আচ্ছা এরকম কখনও হয়েছে যে আপনি পাহারায় থাকাকালীন আপনার বাবা নেশা করেছে?”
- “অনেকবারই হয়েছে। In fact প্রত্যেকের সময়েই হয়েছে। তবে…”
- তবে?
- “একটা কথা আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। আপনারা তো তিন্নির বন্ধু”
- “তিন্নি মানে মোহনা তো?”
- হ্যাঁ।
- “বলে ফেলুন। আপনি বলেছেন কেউ জানবে না। কথা দিচ্ছি।”
অভয়বাবু একটু ইতস্তত করতে করতে বললেন, “নতুন ডাক্তার আসার পর থেকে নেশা করাটা একটু বেড়ে গেছে মনে হয় বাবার।”
ব্যোমকেশ বলল, “তো আপনার ধারনা ডাক্তার এর এতে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে?”
“আমি একদম Sure না। তবে হলেও হতে পারে।” অভয়বাবু বললেন।
আমি বললাম, “এতে মোহনা কে না বলার কী সম্পর্ক?”
অভয়বাবু একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনার জানেন না?”
“কী জানব?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
- যেই ডাক্তার এখন বাবাকে দেখেন ওকে তো মোহনাই ঠিক করে দিয়েছে। ও আর মোহনা তো কয়েক মাস পরেই হয়তো বিয়ে করবে ওরা।
বুকের ভেতরটা হঠাৎ খালি খালি লাগল কী? হবে হয়তো। মাঝে মাঝে ভাবলে অবাক লাগে একটা মানুষের সাথে সব শেষ হয়ে গিয়েছে ২ বছর আগে অথচ তার বিয়ের কথা শুনলে এখনও মনটা কেমন ভারী হয়ে এল।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে অভয়বাবু চলে গিয়েছে খেয়ালও করিনি। ব্যোমকেশ এর “আসুন অনন্তবাবু” শুনে সম্বিৎ ফিরল।
ঘরে এরপর যিনি ঢুকলেন তাঁর সাথে আমার আলাপ সকালেই হয়েছে। নাম জানতাম না যদিও এখন জেনে গেছি। অনন্ত চৌধুরী। এ বাড়ির ছোট ছেলে। একটা বেশ জোরালো বডি স্প্রের গন্ধ পাচ্ছি। এই গন্ধটা আমার চেনা। Park Avenue- এর গন্ধ এটা। আমি নিজেই ব্যবহার করি।
ছেলেটি ঢুকেই বলল, “যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আমার তাড়া আছে।”
ব্যোমকেশ বলল, “হ্যাঁ নিশ্চয়। আপনি বসুন তো আগে।”
ছেলেটি মোবাইলে কিছু একটা টাইপ করল। তারপর বসল সোফায়।
“কী করেন আপনি?” ব্যোমকেশ জিজ্ঞেস করল।
“রাজনীতি করি” ছেলেটির সাথে সাথে উত্তর।
- “সে তো অল্পবিস্তর সবাই করে। এমনি কাজকর্ম কিছু করেন না পড়াশুনো করছেন?”
- “পলিটিক্যাল সায়েন্স অনার্স।”
- “আপনি তো শুনলাম অজিত কে বাড়িতেই ঢুকতে দিচ্ছিলেন না”
এই কথাটা বলার পরেই অনন্ত আমার দিকে একবার তাকালো। তারপর ব্যোমকেশ এর দিকে ফিরে বলল, “হ্যাঁ। তো?”
ব্যোমকেশ বলল, “কেন? আপনি কি চান না আপনার বাবা সুস্থ হোক?”
- “শুনুন ব্যোমকেশ বাবু একটা কথা বলি। আমার বাবার যা অবস্থা তাতে উনি সুস্থ হলেও বাড়িশুদ্ধু লোকের শান্তি হবে না। আর উনি নিজেও শান্তি পাবেন না। একটা পরিবারের অনেক লুকোনো কথা থাকে। বাইরের লোক কে বাড়িতে ঢোকানোর মানে হল সেই সব কথাগুলো থেকে বাইরে বেরোনো। ঠিক এই জিনিসটাই আমি চাই না।”
- “তার মানে আপনি বলছেন যে এই পরিবারের এমন কিছু ঘটনা আপনি জানেন যেগুলো বাইরে বেরোলে সবার সমস্যা?
- “সেটা আপনি বুঝছেন। আমি একবারও বলিনি।
- আপনার বাবার কাছে চিঠিপত্র আসে কিছু?
- নাহ। এখন আবার কেউ চিঠি পাঠায় নাকি?
- পাঠাতেই পারে।
- আপনার প্রশ্ন শেষ হলে বলবেন।
- কেন? কোথায় যাবেন?
- এটা কি জেরা হচ্ছে নাকি?
- আপনার যদি তাই মনে হয় তাহলে হচ্ছে।
- শুনুন ব্যোমকেশবাবু…”
“আপনি শুনুন অনন্তবাবু” ব্যোমকেশের গলার স্বর পালটে গেছে, “একজন মানুষ কে চোখের সামনে দিনের পর দিন মরতে দিতে কেউ চায় না। হয়তো আপনি ঠিক। হয়তো আপনার বাবা শান্তি পাবেন না। কিন্তু আপনার পরিবারের বাকি মানুষগুলো একটু হলেও নিশ্চিন্ত হবে এটা ভেবে যে একটা মানুষের মৃত্যুর জন্য ওরা অন্তত দায়ী নয়।”
তারপর চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে ফিরে ব্যোমকেশ বলল, “চলো অজিত। আমাদের কাজ শেষ হয়েছে আজকের মত।”
৫
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যোমকেশ নেই দেখে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। আগেরবারও ঠিক এরকমই করেছিল। এবার সারাদিন টেনশন করতে হবে। একবার ফোন করব ভাবলাম। কিন্তু তাহলে রেগে গিয়েছি বোঝানো যাবে না বুঝতে পেরে আর করিনি।
কাল রাতে ব্যোমকেশ বাড়ি ফেরার সময় একটা কথাও বলেনি। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ল্যাপটপে কি দেখলে বলা যাবে?”
ট্যাক্সির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েই ব্যোমকেশ উত্তর দিয়েছিল, “ইতিহাস”
আমি আর ঘাঁটাই নি। এখন ওর হেঁয়ালি মোড অন হয়ে গেছে। যাই জিজ্ঞেস করব এভাবেই উত্তর দেবে। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। একটারও উত্তর পাচ্ছি না। ভেবেছিলাম হয়তো সন্ধ্যে অবধি ব্যোমকেশ এর পাত্তা পাব না আজ। কিন্তু সকালে ১১ টার দিকে হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে দেখি ব্যোমকেশ হাজির। ঘরে ঢুকেই বলল, “বুঝতে পারছি রেগে রয়েছো। কিন্তু তোমায় আজ নিয়ে যাইনি তার কারন আছে।”
বললাম, “আমি তো কৈফিয়ত চাই নি।”
ব্যোমকেশ বলল, “আমি মোহনার would be husband এর চেম্বারে গিয়েছিলাম কথা বলতে। তোমায় নিয়ে গেলে ভালো লাগত না জানি। তাই আর কিছু বলিনি।”
আমি বললাম, “দেখা হল?”
- “হ্যাঁ হল। He has been very helpful”
- ওহ। ভালো তো।
- আর গিয়েছিলাম একবার নন্দদুলাল বাবুর ওখানে। আয়ার সাথে একবার কথা বলার দরকার ছিল।
অনেকক্ষন থেকেই পচা একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম মনে হল। এখন বুঝতে পারলাম সেটা ব্যোমকেশ এর গা থেকেই আসছে। বললাম, “আর কোথায় গিয়েছিলে? নাকি মোহনার হবু বর এর চেম্বারের গন্ধ এটা?”
ব্যোমকেশ বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলে গেল, “নাহ। এটা ডাস্টবিন এর গন্ধ। রেডি হও। এখনি বেরোতে হবে।”
***
“কোথায় যাচ্ছি আমরা এখন?”
আমার প্রশ্ন ব্যোমকেশ শুনতে পেলেও খুব একটা গুরুত্ব দিল না বোঝা গেল। আমাদের হ্যারিসন রোডের ফ্ল্যাট টা থেকে একটু দূরেই গিরীশ পার্ক মেট্রো স্টেশন। প্রথমে ভাবলাম আমরা হয়তো মেট্রো তে যাব কোথাও। ব্যোমকেশের হাত দেখিয়ে ট্যাক্সি দাঁড় করানো দেখে সেই ধারনা ভুল প্রমানিত হল।
ট্যাক্সিওয়ালা কে ব্যোমকেশ বলল, “Northern Avenue চলুন।”
আগে হলে এই হলুদ ট্যাক্সি নির্ঘাত refuse করত। এখন Ola, Uber এসে গিয়ে এদের ভাত মেরে দেওয়ায় না বলার সাহস পায় না এরা। বলাই বাহুল্য সারা রাস্তা ব্যোমকেশ স্পিকটি নট হয়েই বসে ছিল।
৪৫ মিনিট পর ট্যাক্সি টা ব্যোমকেশের নির্দেশে ডানদিক বাঁদিক শুনে যেখানে এসে থামল সেখানে আগে কখনো এসেছি বলে মনে হল না। পাশের একটা গলি দেখে মনে হল কত বছর সূর্যের আলো পৌঁছোয় নি কে জানে!
ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা পুরোনো সাইনবোর্ডে লেখা আছে, “REBECCA LIGHT’S INSTITUTION FOR ORPHANS.”
ব্যোমকেশ সেদিকেই এগিয়ে গেল। আমিও গেলাম পেছন পেছন। পুরোনো জং ধরা গেট টা খুলে ভেতরে ঢোকার সময় আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা এখানে কাকে দেখতে এসেছি?”
“গিরগিটি”- ব্যোমকেশের আবার সেই হেঁয়ালির উত্তর।
Reception এ যে ছেলেটি বসেছিল তার মত কঙ্কালসার চেহারার ছেলে আমি আগে কখনও দেখিনি। ছেলেটির ডান গালে একটা আঁচড়ের দাগ। ব্যোমকেশ ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল, “Samandarin.”
ছেলেটি তার সামনে রাখা কম্পিউটার এর স্ক্রীন দেখে বলল, “1st floor. Room 116.”
আমি তখন অল্প অল্প বুঝতে পারছি আমরা যেখানে এসেছি এটা একটা ড্রাগের ঠেক। কিন্তু দোতলার ওই ঘরে গিয়ে আমাদের কী লাভ হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
এমন সময় ব্যোমকেশ বলল, “তুমি এখানেই অপেক্ষা কর। আমি আসছি।”
অগত্যা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ব্যোমকেশ সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। একটু দূর থেকেই একটা কঙ্কাল জাতীয় প্রানী আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পারছি। নিজেরও অস্বস্তি লাগছিল। এক একটা মুহুর্ত কেও মনে হচ্ছিল অনেকক্ষন সময়। প্রায় ২০ মিনিট পর ব্যোমকেশ নেমে এসে বলল, “চলো।”
আমি বললাম, “কাজ হল?”
ব্যোমকেশ বলল, “চলো বেরিয়ে বলছি সব।”
গেট দিয়ে বেরোতে যাব এমন সময় ব্যোমকেশ হঠাৎ পেছন ফিরে আমায় টেনে নিয়ে সরে গেল পাশের ঝোপের দিকে। দেওয়ালে হাতগুলো ঘষা হয়ে গেল দু’জনেরই। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আমাদেরও কারুরই। কারন আমাদের ঠিক একটু দূর দিয়েই জং ধরা গেট খুলে ভেতরে যিনি ঢুকলেন তাকে আমরা দু’জনেই খুব ভালো করে চিনি। Park Avenue এর গন্ধে চারপাশটা একেবারে ম ম করছে। তিনি নন্দদুলাল বাবুর ছোটো ছেলে অনন্ত চৌধুরী।
***
বাড়ি ফেরার সময় ব্যোমকেশ ২ বার বলল, “ঘেঁটে যাচ্ছে। সব ঘেঁটে যাচ্ছে।”
কী ঘেঁটে যাচ্ছে? কেন ঘেঁটে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হয় নি। সন্ধ্যে নাগাদ একটা ফোন এল ব্যোমকেশের সেটার পরেই যেন একটু প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে মনে হল। রাতে খাওয়ার সময় বলল, “বুঝলে অজিত একটা পঙ্গু লোক যে এভাবে মানুষদের ধোঁকা দিয়ে চলেছে দিনের পর দিন সেটা ভাবতেই অবাক লেগে যাচ্ছে।”
আমি বললাম, “একজনের সাহায্য পাচ্ছে তাই পারছে। নাহলে খুব একটা সুবিধে করতে পারত না হয়তো।”
- সে তো বটেই। তাহলে ভেবে দেখো নেশা কি যাচ্ছেতাই একটা বস্তু। করেছো কী মরেছো”
- হুম। তা তোমার আর কত দিন লাগবে?
- কীসের জন্যে?
- নন্দদুলাল বাবুর কপাল পুড়ছে কবে সেটা জানতে চাইছি।
- সে তো কালই।
- কাল? Case Solved?
- একদম। মোহনা কে ফোন করে দাও। কাল সবাই এর থাকা চাই। ডাক্তার কেও আসতে বলতে বলবে।
৭
আমরা সবাই নন্দদুলাল বাবুর বাড়িতে বসার ঘরে অপেক্ষা করছি। ঘরে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা কাজ করছে। সবাই খুব টেনশনে রয়েছে বুঝতেই পারছি। আমি খানিকটা আন্দাজ করেই ফেলেছি কালপ্রিট কে। এবার শুধু ব্যোমকেশ কীভাবে তথ্য প্রমান পেশ করে সেটাই দেখার। এমন সময় নন্দদুলাল বাবুর স্ত্রী এবং আয়া ঢুকলেন ২ টো ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে।
ব্যোমকেশ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “প্রথম যখন আমায় এই কেসটার সাথে involve হতে বলা হয়, তখন আমি খুব একটা Interest পাইনি। তারপর যখন আমার বন্ধু অজিত কে দরজা থেকে ফিরে যেতে হয় তখন বুঝতে পারি যে এই বাড়িতে কিছু একটা খেলা চলছে যেটা বাইরের লোক জানুক সেটা কেউ কেউ চাইছে না।”
“একটু তাড়াতাড়ি বলবেন যা বলার। তাড়া আছে আমার।” ব্যোমকেশ কে Interrupt করেছে অনন্ত।
“অনন্ত বাবু,” ব্যোমকেশ বলল, “ আপনার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার তাড়া আছে জানি। কিন্তু আমার কথার মাঝে আর কথা বলবেন না। তার ফল ভালো হবে না।”
- “কী করবেন আপনি? কথার মাঝখানে কথা বলার জন্য পুলিশ ডাকবেন?”
- নাহ। বেআইনি নেশা করার অপরাধে পুলিশ ডাকব। আর অনাথ আশ্রম থেকে সাক্ষীরও অভাব বলে মনে হয় না।
জোঁকের মুখে নুন পড়ল মনে হল। ঘরে আবার এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। নন্দদুলালবাবুর আওয়াজও পাচ্ছি না আজ। ঘুমোচ্ছেন নাকি!
ব্যোমকেশ বলতে শুরু করল, “আপনাদের সবার সাথে কথা বলে একটা কথা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে বাড়ির ভেতরের কেউ একজন নন্দদুলাল বাবু কে সাহায্য করছেন। নাহলে ওঁর পক্ষে একা একা বাড়ির সকল কে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু এখন প্রশ্নটা হল এটা করে বাড়ির ওই মানুষটির সুবিধে কী? নিজের বাবা কে বিষ দিয়ে দু’দন্ড শান্তি দেওয়া? এত মহৎ উদ্দেশ্যটা ঠিক মানতে মন চাইলো না। সুতরাং আর একটু অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম।”
“ক্রাইম ডিটেকশনের ক্ষেত্রে Micro Expression বলে একটা Term রয়েছে। যারা খুব ভালো মিথ্যে বলতে পারেন না তাদের বাঁ চোখের মনিটা কথা বলার সময় অল্প একটু বাঁদিকে সরে সরে যায়। এটা অবশ্য Theory একটা। এটা থেকে কিছুই প্রমান করা যায় না। কিন্তু প্রথম দিন সবাই কে প্রশ্ন করার সময় একজনের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা ২-৩ বার চোখে পড়ে। খটকার শুরু তখনই।”
এতটা একটানা বলে ব্যোমকেশ থামল। আমরা সবাই গোগ্রাসে গিলছি। এমন সময় আয়া এসে সবার চায়ের কাপ-প্লেট নিয়ে গেল। ব্যোমকেশ আবার বলতে শুরু করল, “এবার একটু নন্দদুলাল বাবুর কথায় আসি। প্রথম দিকে একটা ভুল পথে আমি এগোচ্ছিলাম এখন বলতে লজ্জা নেই। আমি ভেবেছিলাম এই ড্রাগটা হয়তো নন্দদুলাল বাবু শিশিতে করে খান। সেই কারনে দ্বিতীয় দিন এসে আমি আপনাদের বাড়ির ডাস্টবিনে শিশিবোতল খুঁজছিলাম। কিন্তু তা আমি পাইনি। পেয়েছিলাম যেটা সেটা হল একটা ছোট্টো ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। নীল রঙের কয়েক ফোঁটা তরল তখনও তলায় পড়ে রয়েছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারি নন্দদুলাল বাবুর গায়ে কয়েক জায়গায় সিরিঞ্জ ফোটানোর চিহ্ন রয়েছে। সোজা চলে যাই লালবাজারে। কলকাতা পুলিশের Forensic Lab এ জিনিসটা পরীক্ষা করে জানতে পারি। ওটা Samandarin Drug.”
এতটা বলার পর থেমে ব্যোমকেশ এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। আমরা কিছু বোঝার আগেই মোহনা উঠে এসে জলের বোতল টা এগিয়ে দিল ওর দিকে।
জল খেয়ে একটু দম নিয়ে ব্যোমকেশ বলল, “যাই হোক সুতরাং বুঝতে পেরে যাই যে নন্দদুলাল বাবু নেশাটা নিজের শরীরে inject করে করেন। এবার আসা যাক ওঁর সহকারীর কথায়। ওর সহকারী হয়তো ভেবেছিল নন্দদুলাল বাবু কে Drug দিয়ে খুশি করে পুরো সম্পত্তিটা নিজের নাম এ করে নেওয়া যাবে। কিন্তু নন্দদুলাল বাবু কে রাজি করানো সহজ কাজ নাকি? দিনের পর দিন উনি তাঁকে বিষ খেতে সাহায্য করে চলেছেন কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধে এখনও অবধি করতে পারেন নি। আর এটা উনিও খুব ভালো করে জানেন। কী তাই তো অভয়বাবু?”
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। আমি শুরু থেকেই ভেবে আসছিলাম অনন্ত পুরো ব্যাপারটা তে সাহায্য করছে নন্দদুলাল বাবু কে। ঘরের মধ্যে সবার শ্বাস-প্রশ্বাস এর শব্দ ও খুব জোরে শোনা যাচ্ছে। সবার বিস্ফারিত চোখ গেল অভয়বাবুর দিকে।
“Excuse Me?” অভয়বাবুর ভুরু কুঁচকে গিয়েছে।
ব্যোমকেশ বলল, “আপনি তো কালকেও আপনাদের উকিল এর কাছে খোঁজ নিয়েছেন শুনলাম যে আপনার বাবা উইল চেঞ্জ করেছেন কিনা?”
- হ্যাঁ তাতে কী প্রমান হয়? যে আমি বাবাকে সাহায্য করি?
- না না। ওটা এখনো বলিনি তো। আপাতত আপনার Motive টার কথা বললাম। এরপর বাকি কথায় আসছি।
“যদিও প্রথম দিন অভয়বাবু খুব সাহায্যের মনোভাব নিয়েই আমায় বলেছিলেন, ওঁর ধারনা নতুন ডাক্তার আসার পর থেকেই নন্দদুলাল বাবুর নেশা করা বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু খুব একটা কাজের কাজ কিছু হল না তাতে।” ব্যোমকেশ বলল।
অভয়বাবু বললেন, “আপনার এই মনগড়া নাটক আর কতক্ষন চলবে একটু বলবেন? Some of us has works to do.”
- “আর মিনিট দশেক দাঁড়ান যবনিকা পতনের সময় হয়ে এসেছে। হ্যাঁ যেটা বলছিলাম। অজিতের হয়তো মনে আছে। আমি প্রথম দিন নন্দদুলালবাবুর ল্যাপটপ টা মিনিট খানেকের জন্য নিয়ে নিয়েছিলাম। আমি Browsing History চেক করে দেখতে চেয়েছিলাম জিনিসটা উনি Online এ অর্ডার করেন কিনা। কিন্তু দেখলাম যে না। সুতরাং বুঝলাম যে জিনিসটা physical store থেকেই আসে। এখন কথা হল এ তো আর গাঁজা নয় যে যেখানে সেখানে পাওয়া যাবে। এই ড্রাগ কলকাতায় মাত্র একটি জায়গাতেই পাওয়া যায়। Rebecca Light Institution। সেখানে গিয়ে খোঁজ করে জানতে পারলাম অভয়বাবু ওখান থেকেই থেকে ড্রাগ কিনে নিয়ে যান। এবং সবার অলক্ষ্যে একটা করে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ রোজ বাবার কাছে চালান করে দেন। আবার কাজ হয়ে গেলে সেটা ফেলে দেওয়ার দায়িত্বও ওঁরই ছিল।”
“What Nonsense” অভয়বাবুর গলায় এবার বিরক্তি, “যা ইচ্ছে তাই আপনি বলবেন আর সেটাই কি সত্যি হয়ে যাবে নাকি? কি ভেবেছেন কী আপনি?”
অরুনবাবু এতক্ষন চুপ করে ছিলেন। এবার বলে উঠলেন, “ব্যোমকেশবাবু এত কিছু যে বললেন এটা প্রমান করতে পারবেন?”
ব্যোমকেশ বলল, “নিশ্চয় পারবো। আপনাদের সবাই কে আর একটা কথা জানাতে ভুলে গিয়েছি। ওই ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ থেকে ড্রাগ ছাড়াও আরও একটা জিনিস পাওয়া গেছে। ২ সেট আঙুলের ছাপ। একটা অবশ্যই নন্দদুলাল বাবুর নিজের। বাকি রইলো আর এক সেট। তা আজ যে কাপ এ চা খেলেন অভয়বাবু সেটা আপনাদের আয়ার হাত থেকে চলে গেছে আমার আর এক সহকর্মীর হাতে। এতক্ষনে আশা করি ফরেন্সিক ল্যাব এ পৌছেও গেছে কাপ টা। ২ টো আঙুলের ছাপ একজনেরই বলেই প্রমানিত হবে বলেই আমার ধারনা। আর যেখান থেকে অভয়বাবু ড্রাগ কিনতেন সেখানকার লোকও ওকে চিনতে পেরেছে ছবি দেখে।”
অভয়বাবু একদম চুপ। মাথা নীচু। অরুনবাবু বললেন, “নেশা একটা মানুষ কে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে সেটা নিজের চোখে দেখার পরেও তোর শিক্ষা হয়নি? তারপরেও সম্পত্তির নেশায় তুই এতটা নীচে নামতে পারলি যে বাবা কে বিষ দিয়ে চলেছিস দিনের পর দিন?”
ব্যোমকেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। একটা পরিবারের অন্তর্বতী গোলমালের মধ্যে ঢুকে পড়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমারও। এখন বুঝতে পারছি অনন্ত কী গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিল। সম্ভবত ওই ড্রাগ কিনতে গিয়েই ও নিজের দাদাকে দেখে ফেলে। আর বুঝতে পারে বাড়িতে যে খেলাটা চলছে তার কথা। কিন্তু Confront করতে পারেনি কারন তাহলে তো ওর নিজের নেশা করার কথাও ফাঁস করতে হবে সবার কাছে। ব্যোমকেশও দেখলাম ওই ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাঁটালো না।
আমরা বেরিয়েই যাচ্ছিলাম। এমন সময় মোহনা এসে ডাকল, “ব্যোমকেশ বাবু?..
- হ্যাঁ বলুন।
- আপনাকে এবং অজিতকে অনেক ধন্যবাদ। জানি ব্যাপারটার হয়ত ভালোভাবে শেষ হল না। কিন্তু এতেই হয়তো সবার ভালো। যাই হোক আপনার পারিশ্রমিকটার কী হবে?
- “ওটা পরে এসে নিয়ে যাব। আজ থাক।”
নন্দদুলাল বাবুর বাড়ি থেকে তখনই বেরিয়ে এসেছিলাম দু’জনে। একবার ভেবেছিলাম মোহনা কে জিজ্ঞেস করব ওর বিয়ের কথাটা আমাদের কাছে চেপে গেল কেন? শেষ পর্যন্ত আর করা হয় নি। সব সময় সব কিছুর শেষ ভালো হয় না। কিছু প্রশ্নের উত্তর না পেলেই ভালো হয়তো। ব্যোমকেশ বক্সীর সাথে এরপর বহু বছর একসাথে কাটিয়েছি আমি এবং খুব ভালো করে যে সত্যিটা উপলব্ধি করেছি সেটা হল – সত্য খুব নিষ্ঠুর। আর সত্যান্বেষী? তার চেয়েও বেশি।