সায়নী
১১ই এপ্রিল
সকাল- ৯.৪৫
বাসে ওঠার আগে আকাশটার দিকে একবার তাকাল সায়নী। হালকা মেঘ আছে। তবে নীল রঙ টাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সাদার মাঝে মাঝে। বাসে উঠে সীটে বসতে না বসতেই শুভঙ্করের ফোন। বিরক্তি ভরে উঠল ওর মুখে চোখে। এ ছেলেটাকে ওর পছন্দ হয় না। আর এ শুধু ফোন করে ডিসটার্ব করে। ফোন ধরল না ও। ব্যাগে রেখে দিল। ছেলেটা খুব অসভ্য। কথা বলার সময় ওর চোখদুটো সব সময় মেয়েদের বুকের দিকে থাকে, এটা অনেকবার লক্ষ্য করেছে ও।
আজ বহুদিন পর কলেজ যাচ্ছে ও। ভালো লাগেনা আজকাল আর কিছু। কলেজ যেতে ভাল লাগেনা, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে ভাল লাগেনা। ধুর! কেন যে ওরকম করল ও?
“দিদি টিকিটটা দেখি!” কন্ডাকটরের ডাকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল সায়নী। ও যাবে প্রেসিডেন্সী কলেজ। ব্যাগ থেকে ১০ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে দিল। বলল, “একটা সাত।” টিকিট সমেত তিনটাকা ফেরত দিয়ে দিল কন্ডাকটর। এবার জানলার দিকে মুখটা ফেরাতেই ওর চোখে পড়ল একটা দোকানের সাইনবোর্ড। ‘অরিত্র টেলিকমিউনিকেশন।’ বুকটা ধক করে উঠল সায়নীর। ওহ! আবার ওই নামটা…! নাহ! এই ছেলেটা ওকে আর বাঁচতে দেবে না। হাতঘড়িতে টাইম দেখল সায়নী। ১০ টা ৫। আজ বাসটা বড্ড ঝোলাচ্ছে। ঠিক টাইমে পৌঁছালে হয়।
ওর সাথে আলাপের ঘটনাটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সায়নীর। এই একটা ব্যাপার মনে পড়লেই ওর এত মনখারাপের মধ্যেও ঠোঁটের কোনে হাসি চলে আসে। ছেলেটা সায়নীকে ফেসবুকে মেসেজ করে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার বার্থডেট কত? উইথ ইয়ার প্লিজ।” হাসি পেয়েছিল সায়নীর মেসেজটা দেখে। ও লিখেছিল, “কেন? আমার বয়স জানতে চাও?”
“হ্যাঁ, মানে আমার চেয়ে ছোট না বড় সেটা জানতে চাই।”
“তোমার বয়সটাই আগে শুনি।” সায়নী লিখেছিল।
“নাইন্টিন প্লাস”
“সেম হিয়ার”
একটা হাসির স্মাইলি দিয়ে ছেলেটা লিখেছিল, “বাহ।”
এইভাবেই আলাপ। তারপর বন্ধুত্ত্ব ক্রমশ গভীর হয়েছিল। নাহ। প্রেমটা হয়নি। তার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল। আর তাছাড়া প্রেম হবার মত মানসিক অবস্থা তৈরী হয়েছিল কি দুজনের? কে জানে? সায়নী শিওর নয়। অরিত্র জানে কি?
ব্যাগের ভাইব্রেশনে ঘোরটা কাটল সায়নীর। ফোনটা বের করে দেখল অনুমিতা ফোন করছে। এবার ধরল ও ফোনটা।
“হ্যাঁ বল।”
ও প্রান্ত থেকে কথা শোনা গেল, “কতদূর রে?”
“আর মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যাব।”
“যাক! তাহলে আসছিস সত্যি। শুভঙ্করটার মুখে এবার হাসি ফুটবে।” “ওহ। প্লিজ। ভালো লাগছেনা” বিরক্ত মুখে বলল সায়নী।
“আচ্ছা আছা! ঠিক আছে। তা কি হয়েছিল তোর এতদিন?”
“এখন রাখছি রে। গিয়ে কথা হবে। বাসে খুব ভীড় আজ।” আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও কেটে দিল ফোনটা।
কি বলবে ও? ওর কি হয়েছে? সত্যি কিছু হয়েছে বলে কেউ ভাববে কি? সামান্য একটা ব্যাপারে কোথাকার কে ছেলে তার জন্য… সামান্য ব্যাপারটা অবশ্য সায়নী সামান্য ভাবে নিতে পারেনি। ছেলেটাকে ওর সত্যি খুব ভাল লাগত। ওর সাথে ফেসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাট করেছে। তবে ফোন নাম্বার দেয়নি। ছেলেটা চেয়েছিল একবার প্রথম আলাপের কয়েকদিন পরেই। কিন্তু তখনো ঠিক ভরসা করে উঠতে পারেনি ও। তাই সরাসরি না করে দিয়েছিল। ছেলেটাও আর চায়নি কখনো। হয়ত চাইত। কিন্তু তার আগেই তো ওই গোলমালটা হয়ে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখল কলেজ স্ট্রীট এসে গেছে। নামতে হবে।
অরিত্র
১১ই এপ্রিল
দুপুর ২টো
ধুৎ! এখনো ট্রাম আসছেনা। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে হাতিবাগান মোড়ে। একটা এল কিন্তু সেটা চলে গেল শোভাবাজার এর দিকে। বিরক্ত লাগছে ওর এবার। অনেক সাহস করে আজ বেরিয়েছে। শালা বাসগুলো আবার একটাও কলেজ স্ট্রীট যায় না। ফোনটা বেজে উঠল ওর। পকেট থেকে বের করে দেখল রুদ্র ফোন করছে। সুইচ টিপে কানে ধরল ফোনটা, “হ্যাঁ বল রে।”
“কতদূর বস?”
“ধুর শালা একটা ট্রামও আসছেনা।”
“সে কিবে? এখনো ট্রাম পাসনি? আজ আবার তৃনমূলের মিছিল টিছিল কিসব আছে কলেজ স্ট্রীটে। এক কাজ কর। আজ বরং ফিরে চলে আয়। কাল যাবি।”
ফিরে যাবে? পাগল নাকি? না না। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে আজ যাচ্ছে ও প্রেসিডেন্সীতে। আবার কবে যাওয়া হবে ঠিক নেই। নাহ। আজ ফিরবেনা ও।
ও বলল, “ নারে। আজ ফিরব না। আজ আমি কাজটা করেই ছাড়ব। এক মাস হয়ে গেল। আর পারছিনা ভাই।”
“আরে আজ ওই দিল্লি কান্ডের জন্য কি সব মিছিল টিছিল আছে। ক্যালানি খেয়ে মরবি সালা!”
“ধুর! নিকুচি করেছে মিছিলের। ও কিছু হবেনা। এই ট্রাম এসেছে আমি রাখছি।”
ফোনটা কেটে দিল অরিত্র। সত্যি ট্রাম এসেছে। তবে ওর কাছে এসে পৌঁছায়নি এখনো। আর মিথ্যে কথা ও বলেনা রুদ্রকে। ওই ছেলেটাই এমন একজন যে ওকে সবথেকে ভাল বোঝে। খুব কাছে একটা এরোপ্লেন যাওয়ার আওয়াজ পেল ও হঠাৎ। ওপর দিকে তাকাল ও। এরোপ্লেনটা ততক্ষনে বেরিয়ে গেছে। আকাশটা আজ মেঘলা। নীল রঙ টা দেখা যাচ্ছেনা একটুও। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি কলকাতায়। আজ হবে কি? এরকম আকাশ ভাল লাগেনা অরিত্রর। ওপরে তাকিয়ে নীল রংটা দেখতে না পেয়ে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। ট্রাম এসে গেছে। উঠে পড়ল ও।
সেকেন্ড ক্লাসেই উঠল। এটা ফাঁকা থাকে বেশীরভাগ সময়। ফোন বের করে রুদ্রকে মেসেজ করল, “ট্রাম পেয়েছি। তুই চিন্তা করিস না। কিছু হবেনা।”
খানিক বাদে রিপ্লাই এল, “হুম। সাবধানে যাস। আর যা সত্যি সেটাই বলিস। অল দা বেস্ট”
হ্যাঁ সত্যি তো বলতেই হবে। অনেকগুলো সত্যি বলার আছে আজ সায়নীকে। শেষ দিনের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়লেই বড্ড মনটা খারাপ লাগে অরিত্রর। আসলে ফেসবুকে আলাপের কিছুমাস পরেই সায়নীকে ও ভালবেসে ফেলেছিল। কিন্তু বলতে পারছিল না। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত একটা পার্সোনালিটি আছে। ওর সামনে সাহস করে কিছু বলা যায়না। তাই ভেবেছিল ওকে একটু জেলাস ফিল করাবে। প্ল্যানটা অবশ্য ছিল রুদ্রর। ও বলেছিল এটা করলে তুই বুঝতে পারবি ও তোকে ভালবাসে কিনা! সেই প্ল্যানমত স্কুলের সরস্বতী পুজার সময় স্কুলের একজন বান্ধবী অর্পিতার সাথে কাঁধে হাত দিয়ে ফটো তুলে সেটা ফেসবুকে আপলোড করেছিল। তারপরেই যত গোলমাল। রুদ্রর প্ল্যান তো সাকসেসফুল হলই না। উপরন্তু হিতে বিপরীত হয়ে গেল। আসলে ভগবান বলে একটা প্রজাতি আজকে বিজ্ঞানের যুগেও টিকে আছে খুব ভালভাবে। আর তাদের কাজই হল পেছনে বাঁশ দেওয়া। সায়নী ফটোটায় লাইক করেছিল। এবং কমেন্ট দিয়েছিল, “বাহ! খুব সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে” অবস্থা বেগতিক বুঝে ও ফেসবুকে মেসেজে বলতে গিয়েছিল, আসল ব্যাপারটা। কিন্তু ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে। মেসেজ খুলেই বুঝতে পারল ওকে ব্লক করেছে সায়নী। মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল ওর। কি যে করবে কিছু বুঝতে পারছিল না। ফোন নাম্বার দেয়নি সায়নী। একবার চেয়েছিল ও। কিন্তু সরাসরি না বলেছিল। বলেছিল “তোকে নাম্বার দিলেই তো তুই আমায় জ্বালাবি। আর তাছাড়া আমার ফোন আমার কাছে থাকলেও না থাকারই সামিল। কেউ ফোন করে পায়নি কখনো। একটু ওয়েট কর। ক’দিন পরে নিজেই দেব।” যদিও অরিত্র তারপর আর লজ্জায় চাইতে পারেনি কখনো। আর সেদিন ওই ঘটনার পর আর খুঁজে পায়নি ও সায়নীকে। তার একদিন পরে রাগে দুঃখে নিজের ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট রিমুভ করে দিয়েছিল ও।
কন্ডাক্টারকে হঠাৎ সামনে দেখে সম্বিৎ ফিরল অরিত্রর। পাঁচ টাকা বের করে দিয়ে দিল। তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝল ঠনঠনিয়া এসে গেছে। আর একটু। আজ সায়নীর কলেজে গিয়ে অরিত্র সব বলবে ঠিক করেছে ওকে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুব বোকা বোকা। কিন্তু ভালোবাসায় কি না হয়। ঘড়ি দেখল ও। ২ টো ৪০ বাজে।
সায়নী
১১ই এপ্রিল
দুপুর ২ টো ৩০
লাইব্রেরীতে বসে আছে সায়নী আর অনুমিতা। একটু আগে শুভঙ্কর খুব জোরাজুরি করছিল কফি হাউসে যাওয়ার জন্য। সায়নী না করে দিয়েছে। এখন একটু হতাশ হয়েই বসে আছে অনুমিতার পাশে। এ ছেলেটা যেন বোঝেও না ওকে সায়নী পছন্দ করে না। অনুমিতা ফোনে কিছু একটা করছিল। সায়নী এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। নীরবতা ভাঙ্গল শুভঙ্করই। বলল, “আচ্ছা তুই ফেসবুক থেকে অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দিলি কেন?”
প্রশ্নটা করা হয়েছে সায়নীকে। সায়নী নিজেও সেটা জানে। কিন্তু ও উত্তর দিল না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে খুটখুট করতে লাগল। “কিরে? সায়নী? শুনতে পাচ্ছিস না?” এবার একটু জোরেই বলল শুভঙ্কর। এবার মুখ তুলে উত্তর দিল সায়নী, “আমাকে বলছিস?” অনুমিতা এবার একটু ফিক করে একবার হাসল। ওর হাসি পেয়ে গেছে এদের কান্ড দেখে। শুভঙ্করের বোধহয় গায়ে লেগেছিল ওই অপমানজনক হাসিটা। এবার আর জ়োরে বলল, “হ্যাঁ। তোকেই বলছি? কি ভাবিস কি তুই আমাকে?” সায়নীর মুখ দিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে গেল, “গান্ডু।”
“কি?”
“কিছু না রে। এমনি অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দিয়েছি। ভালো লাগছিল না, তাই।” শুভঙ্কর কিছু না বলে উঠে চলে গেল ওখান থেকে।
সায়নী দেখেও দেখল না। ফেসবুকে অরিত্রর সাথে ওই ফোটো নিয়ে ওই ব্যাপারটার পর ও ব্লক করে দিয়েছিল ওকে। আসলে ও মিথ্যে কথা একদম সহ্য করতে পারেনা। অরিত্র বলেছিল ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। কিন্তু ওই ফোটোটায় ওর সাথে ওই মেয়েটা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তাতে ওটা যে ওর গার্লফেন্ড তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল ওর। যদিও দু’দিন পরে সব রাগ পড়ে গিয়েছিল ওর। আনব্লকও করে দিয়েছিল অরিত্রকে। কিন্তু ওর অ্যাকাউন্ট টা আর ফেসবুকে আর খুঁজে পায়নি ও। ধুর! কেন যে মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে রাখেনি কে জানে! এর ৩-৪ দিন পরই ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছিল ও।
বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজে চিন্তায় বাধা পড়ল সায়নীর। সবাই লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনুমিতা বলল, “চল তো দেখি। কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে।”
অনুমিতার সাথে বেরিয়ে এল ও। ওরা দেখল গেটের কাছে প্রচুর লোক চেঁচামেচি করছে। হাতে তৃনমূলের ঝান্ডা। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে কলেজের অনেকেই। হঠাৎই সায়নীর চোখে পড়ল গেটের কাছে দাঁড়ানো সাদা টি-শার্ট পরা ছেলেটার দিকে। চেনা চেনা লাগছে কি? হাতে একটা কাগজ নিয়ে একমনে কি যেন ভাবছে ছেলেটা। পেছনে অত লোক ওর কি ভ্রুক্ষেপ নেই? হঠাৎ যেন খেয়াল হতে পেছন ফিরল ছেলেটা। ভীড়ের কারও একটা হাতের একটা লাঠি ওর মাথা ছুঁয়ে গেল মনে হল দূর থেকে। মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা।
অরিত্র
১১ই এপ্রিল
দুপুর তিনটে বাজতে পাঁচ
ট্রাম থেকে নামল অরিত্র। মেঘলা ভাবটা কেটে হালকা রোদ উঠেছে। এদিক ওদিক দেখে রাস্তা ক্রস করল । ঢুকে পড়ল প্রেসিডেন্সী কলেজে। নিজের জামাকাপড় গুলোর দিকে একবার দেখল ও। আজ ও একটা সাদা টি-শার্ট আর নীল জিন্স পরেছে। ড্রেস কোডটাও রুদ্রর ঠিক করে দেওয়া। আসলে ওকে ছাড়া এক মুহুর্ত চলেনা অরিত্রর। ওদের বন্ধুরা বলে রুদ্র আর ও নাকি সমকামী মানে যাকে বলে ‘গে’। ব্যাপারটা আদৌ সত্যি নয় যদিও। কলেজে ঢুকে পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বার করল ও। এটাই আজ ওর অস্ত্র। কিন্তু এখন এতবড় কলেজে মেয়েটাকে কোথায় খুঁজবে অরিত্র। ওদের ডিপার্টমেন্ট টা কোথায় সেটাই তো জানেনা ও। হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে কি করবে সেটাই ভাবছিল ও। হঠাৎই কানের কাছে ‘জবাব চাই জবাব দাও’ চিৎকার শুনে পেছনে তাকাল ও। তারপরেই হঠাৎ মাথায় একটা ভারী কিছু পড়ল। মাটিতে পড়ে গেল ও। হাতের কাগজটা ছাড়ল না। চোখটা বন্ধ হবার আগে ও দেখতে পেল ৫-৬ জন দৌড়ে আসছে ওর দিকে।
প্রেসিডেন্সী কলেজ
৪ টে ১০ [ফার্স্ট এডের পর]
একটা বড় বেঞ্চে শোয়ানো রয়েছে অরিত্রকে। ওকে ঘিরে রয়েছে অনেক কৌতুহলী মুখ। জ্ঞান ফিরতে বুঝতে পারল মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রয়েছে। ভারী লাগছে মাথাটা। বাইরে চেঁচামেচি এখনো শোনা যাচ্ছে। একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “কোন ইয়ার তোর ভাই? কোন ডিপার্টমেন্ট?”
অরিত্র বলল, “আমি এই কলেজে পড়ি না। মনীন্দ্রতে পড়ি।”
এবার আর একজন প্রশ্ন করল, “ তা এখানে কি করছিলি?”
“এখানে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। খুব জরুরী দরকার।”
“কার সাথে?”
“সায়নী সেনগুপ্ত। সোসিওলজি অনার্স। ফার্স্ট ইয়ার।”
ভীড় এর থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এল। বলল, “সায়নীর সাথে কি দরকার?”
“সেটা ওকেই বলব।” উত্তরটা দিয়েই বুঝতে পারল ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। হাজার হোক এটা ওর নিজের কলেজ নয়।
ছেলেটা হয়ত আরও কিছু বলত। এবার একটা মেয়ের গলার আওয়াজ শোনা গেল, “শুভঙ্কর তুই ঝামেলা করিস না এখানে।“ তারপর এগিয়ে এসে অরিত্রকে বলল, “বল। কি বলবি?”
এবার একটু থতমত খেয়ে গেল অরিত্র। জিভটা যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। সায়নী ওর সামনে দাঁড়িয়ে। এতগুলো ছেলে ঘিরে আছে ওদের। এখানে বলাটা কি ঠিক হবে? উঠে বসতে যাচ্ছিল ও। সায়নী বাধা দিল। বলল, “উঠিস না। শুয়ে থাক এখন। বল না কি বলবি?”
বোকা বোকা মুখ করে হাতের মুঠোতে ধরা কাগজটা এগিয়ে দিল সায়নীর দিকে। তারপর কোনোরকমে বলল, “আমায় ৫ মিনিট দে প্লিজ। আমি পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলছি।” ঘিরে থাকা ছেলেগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। কিন্তু অরিত্র ওদের দেখছেনা। অরিত্র দেখছে জিন্স আর কুর্তি পরা মেয়েটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে। ওতে লেখা আছে অত্যন্ত পুরানো তিনটে কথা। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য বোধহয় ওই তিনটে শব্দই ব্যবহার করা হয়ে আসছে। “আই লাভ ইউ।” মুখ তুলে এবার ওর দিকে তাকাল সায়নী। কিছু বলবে কি?
বাগবাজার ঘাট
১৪ই এপ্রিল, রবিবার
বিকেল ৫ টা ২০
গঙ্গার ধারটা এইসময় খুব ভাল লাগে অরিত্রর। এই একটা জায়গায় বসে বসেই ও একা একাই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারে। আর সব থেকে বড় কথা এখান থেকে আকাশটা খুব সুন্দর দেখতে লাগে। ওর সেই চেনা নীল-সাদা আকাশটা দেখতে পায় এখান থেকে।
ফোনটা বেজে উঠল ওর। পকেট থেকে বের করে দেখল রুদ্র ফোন করছে। হাসি মুখে ফোনটা ধরে বলল, “বলুন স্যার।”
ও প্রান্ত থেকে রুদ্র বলল, “কি বে? মার্কেট থেকে হাওয়া হয়ে গেলি কেন?”
“যাহ বাবা হাওয়া কেন হতে যাব। এই একটু হাওয়া খেতে এসেছি গঙ্গার ধারে।”
“সে তুই যা খুশি খা। ভাই আমার খাওয়ানো টা বাকি আছে। ওটা একটু তাড়াতাড়ি হলে ভাল হয়।”
অরিত্র হেসে বলল, “হ্যাঁ রে বাবা! হবে হবে। দু’দিন দাঁড়া।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তা রাজকন্যা কোথায়?”
নিজের ডান দিকে একবার তাকিয়ে অরিত্র বলল, “এই তো কাছেই আছে। কথা বলবি?”
“নাহ বস। তোমরা এখন নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা। এখন প্রেম কর। পরে কথা হবে।”
“আচ্ছা টাটা” বলে ফোন রেখে দিল অরিত্র।
সেদিন প্রেসিডেন্সীতে কি কান্ডটাই না হল ওহ! অরিত্র ভেবেছিল সায়নী চড় মারবে হয়ত বা সবার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু বলবে। কিন্তু ওকে অবাক করে সায়নী বলেছিল “আই লাভ ইউ টু!” ভীড়ের মধ্যে থেকে কে যেন একটা সিটি দিয়ে উঠেছিল তারপর বলেছিল “জিও গুরু!” আর অরিত্র মুগ্ধভাবে তাকিয়ে ছিল মেয়েটার চোখের দিকে।
ওর আর একটু কাছে সরে এল সায়নী। অরিত্র বলল, “ওই ফোটোর ব্যাপারটা তুই এখনো শুনলিনা কিন্তু”
“প্রয়োজন নেই শোনার। যখন হবে তখন শুনবো।” বলল সায়নী।
অরিত্র আর কিছু বলল না। আকাশটার দিকে আর একবার তাকাল। পশ্চিম দিকটা পুরো কমলা হয়ে আছে। হালকা মেঘলা আকাশে সূর্যাস্তের সময় এরকম রঙ দেখা যায়। এরকম আকাশ অনেকদিন দেখেনি ও। এটা কি নতুন কিছু ঘটতে চলার ইঙ্গিত? কে জানে!