ঘটনাটা যখন ঘটে আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ইংলিশ এ অনার্স পড়ছি বিদ্যাসাগর কলেজে। দিনকে দিন তখন আমাদের কয়েকজনের মাথার যন্ত্রনার বিষয় হয়ে উঠছিল এই ইংলিশ অনার্স টা। কিন্তু কি আর করা যাবে তখন আর চেঞ্জ করার উপায় ছিল না। রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে। সামনেই মিড টার্ম পরীক্ষা। আর তাছাড়া বিষয় চেঞ্জ করার কথা বাড়িতে বললেই কৈফিয়ত দিতে হবে ‘কেন ? কি অসুবিধে হচ্ছে, সবাই পারলে তুই পারবি না কেন?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভয়েই আমরা কয়েকজন ‘যা হবে দেখা যাবে’ রকমের মনোভাব নিয়ে টিকে ছিলাম। একে তো এই চাপ তার ওপর আমাদের কলেজে ছিলেন রজতাভ দত্ত নামে একজন দজ্জাল প্রফেসর। ছাত্রের মনোবলকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার কাজে ওনার যেন ডক্তরেট করা ছিল। আমরা আড়ালে ওনাকে আর ডি এক্স বলে ডাকতাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টে জয় বলে একটা ছেলে পড়ত। ওই একমাত্র ছেলে ছিল যে ওনাকে খুব একটা পাত্তা দিতনা। বলা বাহুল্য আর ডি এক্স নামটা জয়েরই দেওয়া। কিন্তু সৌভাগ্যবশতই হোক বা দুর্ভাগ্যবশত জয়ের সাথেই সবথেকে বেশি শত্রুতা ছিল ইংরেজির। ও যে ইংরেজি তে কাঁচা ছিল তাও না। ভাল Article লিখত। ইংরেজি গল্পের বই পড়ত অনেক। কিন্তু পড়াশুনো ও করত না। আমার সাথে একই মেসে থাকত তাই খুব কাছ থেকে চিনেছিলাম আমি ওকে। আজ এখানে কাল সেখানে খালি টো টো করে ঘুরে বেড়াত। কাজেই আর ডি এক্স এর (নাকি রজতাভ বাবু বলব?) বকুনিও রোজ ওর জন্যেই বরাদ্দ থাকত। তাতে অবশ্য খুব একটা পরিবর্তন হত না। ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’ প্রবাদের সার্থক উদাহরণ আমরা রোজ দেখতাম। জয়ের ভাল গুন অবশ্য অনেক ছিল। ভালো গীটার বাজাত ও, গল্প লিখত ভাল। আর ও ওর বন্ধুদের খুব ভালবাসত। বিশেষ করে দেবার্ঘ কে। দেবার্ঘ আর জয় এই দু’জনের বন্ধুত্তও ছিল দেখার মত। সব সময় ২ জনে একসাথে থাকত। একজন কলেজ না এলে আর একজনেরও পাত্তা পাওয়া যেতনা কলেজে। যদিও দেবার্ঘ তূলনামুলকভাবে পড়াশোনায় ভাল ছিল। কিন্তু পড়াশোনা ওদের বন্ধুত্ত্বের মাঝে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।
তারিখটা আমার মনে নেই। মনে রাখা সম্ভবও নয় যদিও। সময়টা যতদূর মনে পড়ে নভেম্বর এর মাঝামাঝি। একদিন রজতাভবাবু ক্লাসে এসে বললেন যে ২৭ এ নভেম্বর থেকে আমাদের মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হবে। আর আমাদের ফার্স্ট পেপার এর প্রশ্ন করবেন উনি। অনেকেরই মাথায় হাত পড়ে গেল সেটা শোনার পর। ‘আর ডি এক্স’ কে কে না ভয় পায়। সবাই জানে ও প্রশ্ন করলে হাল খারাপ করে দেবে। স্যার যাবার পর জয় কে বললাম, “কিরে? কি হবে এবার? অবস্থা তো সঙ্কটজনক”। জয় তখন দেবার্ঘর ফোনটা নিয়ে ফেসবুক করছিল। মাথা না তুলেই বলল, “কি আবার হবে? এই পরীক্ষার কিছু গুরুত্ত্ব আছে নাকি? খাতাই দেখেনা শুনেছি। ও কিছু হবে না!” আমি আর কিছু বললাম না। এর পরে আর কি বা বলার থাকে ওকে। গুরুত্ত্ব থাকুক বা না থাকুক পরীক্ষা টা পরীক্ষার মত দেওয়াই ভাল বলে আমার মত। কলেজ থেকে ফিরে টিফিন করেই পড়তে বসে গেলাম। এক ঘন্টা পর উঠে জয় এর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি সে ব্যাটা হেডফোন কানে লাগিয়ে শুয়ে শুয়ে গান শুনছে। আমি থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, “হ্যাঁরে তোর কি ভয়ডর নেই? ২ সপ্তাহ পরে পরীক্ষা আর তুই এই ভরসন্ধ্যেবেলা পড়াশুনা বাদ দিয়ে গান শুনছিস?” ও আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা শুকনো হাসি হাসল। আমি আর কিছু না বলে চলে এলাম নিজের ঘরে। ওকে কিছু বলাও বৃথা। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করাতে পারবেনা।
আস্তে আস্তে পরীক্ষার দিন এগিয়ে এল। দিনের আর কি দোষ। তার তো ওটাই কাজ। ফার্স্ট পেপার পরীক্ষার ২ দিন আগে দেখলাম জয় History of English Literature বইটা উলটে পালটে দেখছে। সেকেন্ড পেপার নিয়ে ওর খুব একটা চাপ নেই আমি জানি। কারণ ওটায় অত মুখস্থ করার ব্যাপারটা নেই। ওকে জিজ্ঞেস করলাম “কি রে? কতদূর হল?” ও বলল, “আরে এই তো বইটা খুললাম। কতদূর পরীক্ষা হবে একটু দাগ দিয়ে দে।”
“পরশুর পরের দিন পরীক্ষা আর তুই সিলেবাসটাই জানিস না?” ভীষন অবাক হয়ে বললাম আমি।
জয় বলল, “আরে জানা হয়নি। দেবার্ঘকে জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম। কিন্তু ওকে ফোন করলে পড়াশুনার কথার থেকে অন্য কথা বেশী হয়”। আমি আর বাক্যব্যয় না করে ওর বই এ দাগ দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। আধঘন্টা পর শুনতে পেলাম জয় গীটারে বাজাচ্ছে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে।’ ছেলেটাকে দিয়ে আর সত্যি কিছু হবে না!
পরীক্ষার দিন অবশ্য আমার আগে কলেজে চলে গিয়েছিল জয়। গিয়ে দেখি ও আর দেবার্ঘ পর পর ২ টো বেঞ্চে বসেছে। আমাকে দেখতে পেয়েই দেবার্ঘ ডাকল, “সুমিত, এখানে বসবি আয়।” আমি জানতাম দেবার্ঘ পড়াশোনাটা করে অন্তত। তাই কোনো অসুবিধে হলে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে এই আশায় ওদের কাছে গিয়েই বসলাম আমি। ২ ঘন্টার পরীক্ষা ছিল। গার্ড খুব কড়া দিচ্ছিল। তাই সাহায্য আমার আর পাওয়া হয়নি। পরীক্ষার বাকি ২ টো দিনও কাটল কোনোরকমে। সেকেন্ড পেপারটা অবশ্য ফার্স্ট পেপারের থেকে ভাল হয়েছিল। যদিও সবারই তাই। আর সেটাই স্বাভাবিক।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় খাতা বেরল। অনেকেই ফেল করল ফার্স্ট পেপার এ। বলাই বাহুল্য জয়ও তাদের মধ্যে একজন। ওর অবশ্য খুব একটা হেলদোল দেখলাম না তাতে। ও হ্যাঁ! আমি পাশ করেছিলাম। মাথায় মাথায় প্রায়। সেদিন একটা মারাত্মক ব্যাপার হল কলেজে। সেদিন লাইব্রেরী তে দেখলাম আমাদের ডিপার্টমেন্ট ২ টো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল হচ্ছে যারা ফেল করেছে মিড টার্ম এ। তারা একসাথে বসেছে। আর বাকিরা আর একজায়গায়। শুধু দেবার্ঘ ব্যাতিক্রম। ও জয়ের কাছেই বসেছিল। ওদের কাছে গিয়েই বসলাম আমি। জয় গীটার নিয়ে গিয়েছিল কলেজে। টুং টুং করে কি জানি সব বাজাচ্ছিল আর বাকিদের উপদেশ দিচ্ছিল, “পরের বার সবারই ভাল হবে। দেখে নিস। এই পরীক্ষার কোন মূল্য নেই। চাপ নিস না।” আমি শুধু ভাবছিলাম ছেলেটা কি ধাতু দিয়ে তৈরী। একটা পেপার এ ফেল করেছে তাতেও কোনো বিকার নেই। দেবার্ঘ ওর কাঁধে হাত দিয়ে বসেছিল আর ওর কথায় কথায় মাথা নাড়ছিল। এমন সময় হঠাৎ ‘আর ডি এক্স’ লাইব্রেরী তে এলেন। জয়ের হাতে গীটার টা দেখেই চোখ যেন জ্বলে উঠল ওনার। চেঁচিয়ে বললেন, “ একে তো ফেল করেছিস তার ওপর কলেজে গীটার নিয়ে এসে নাচানাচি করছিস? লজ্জা করছেনা তোর? এই ছেলেগুলোরও মাথা খাচ্ছিস?” জয় চুপ করেছিল। কি বা বলবে ও। আমরাও সবাই থ বনে গেছি। দেবার্ঘ দেখলাম জয় কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরীর বাইরে। স্যার তখনো থামেননি, বলে চললেন “জানোয়ারগুলো সব জোটে এই কলেজে। বাবা মার কত জন্মের পাপের ফলে এরকম সন্তান হয় ভগবান জানেন”। এই কথাটা শোনার পরেই জয় দেবার্ঘর হাত ছাড়িয়ে স্যারের সামনে এসে, সটান প্রশ্ন করল, “আপনার প্রবলেম টা কোথায়? আমার বাবা মা জানোয়ার এর জন্ম দিয়েছে না মানুষের তাতে আপনার কি আসে যায়?” দেবার্ঘ আবার এসে জয়কে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। এবার আমিও গিয়ে জয়কে ধরলাম। রাগে ফুঁসছিল ও। স্যার এবার চুপ। দেবার্ঘ জয়কে কানে কানে বলল, “টেস্ট এও কি ফেল করার শখ হয়েছে? তুই থাম এবার।” জয় লাইব্রেরীর বাইরে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, “টেস্টে? টেস্টে ওই লোকটা আমার খাতায় পেনের দাগ বসাতে পারবেনা”। কথাটা স্যারের কানেও গিয়েছিল। তিনি এবার এগিয়ে এলেন জয় এর দিকে। এসে গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “ টেস্টেও যদি তুই পাশ করতে না পারিস তাহলে তোকে অন্য কলেজ দেখতে হবে। শুধু তোকে নয়। যে ফেল করবে তাকেই। এটা মাথায় রাখিস।” বলে চলে গেলেন স্টাফ রুমের দিকে। আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে রইলাম লাইব্রেরীর দরজার সামনে।
—- —- —- —- —- —- —- —- —- —- —-
সন্ধ্যেবেলা জয় এর রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম জয় পড়ছে। ২ মাস পর টেস্ট পরীক্ষা। যা হল কলেজে তারপর জয় এর পড়তে বসাটাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হল। ওকে আর ঘাঁটালাম না। নিজের ঘরে এসে পড়তে বসলাম। যদিও পড়াতে মন বসছিল না। খালি কলেজের ব্যাপারটা চোখের সামনে ভাসছিল। তবে একবারের জন্য মনে হয়নি দোষটা জয় এর। স্যার আজ খুব অভদ্র আচরন করেছেন লাইব্রেরীতে। আমি সত্যি মনে মনে চাই। জয় ভাল করে পরীক্ষা দিক। ভালো রেজাল্ট করুক। তবেই স্যারের মুখে ঝামাটা ঘষা হবে।
যাই হোক তারপর থেকে জয়ের মধ্যে সত্যি একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আচার আচরনে নয়। ওই ব্যাপারটা তে জয় জয়ই ছিল। কিন্তু পড়াশোনার দিকে আস্তে আস্তে বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর ভাব ফুটে উঠছিল ওর মধ্যে। যাক! একটা ‘পরিবর্তন’ এ কেউ উপকৃত হবে ভেবে ভাল লাগল।
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ ছিল সেদিন। সবেমাত্র দেশের বাড়ি থেকে ফিরে মেসে ঢুকছি। হঠাৎ জয় দেখলাম রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে বেরিয়ে চলে গেল গেট দিয়ে। ডাকার সময়টুকুও পেলাম না। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। খানিকটা অবাক হয়েই নিজের ঘরে গেলাম। সবথেকে অবাক লাগল যখন দেখলাম সেদিন রাতে ও ফিরল না মেসে। এবার চিন্তা হতে লাগল আমার। তিনবার ফোন করলাম। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। ধরল না। খানিক পর রুমের বাইরে গিয়ে কি মনে হতে আবার ফোন করলাম। শুনতে পেলাম পাশের ঘরে ফোন বাজছে। অবাক কান্ড! অর্থাৎ ফোন নিয়ে যেতে ভুলে গেছে জয়। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। জয় ফোন নিয়ে যেতে ভুলে গেছে! ভাবা যায়! যাই হোক আর চেষ্টা করলাম না। নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। কাল আবার কলেজ যেতে হবে।
কলেজে গিয়ে দেখলাম দেবার্ঘও কলেজ আসেনি। ক্লাসে এসে ম্যাডাম বলে গেলেন আমাদের পরীক্ষা ২৪শে ফেব্রুয়ারী থেকে। অর্থাৎ হাতে আর মেরেকেটে ১৫ দিনের মত। যদিও সিলেবাস শেষ করে দিয়েছে কলেজে। কিন্তু আমার নিজের পড়া হয়নি। আজ বিকেলে টিউশন ছিল। কলেজে থেকেই সোজা চলে গিয়েছিলাম পড়তে। পড়ে ফিরলাম রাত্রে ৯ টায়। দেখলাম জয় তখনো ফেরেনি। গেল কোথায় ছেলেটা?
নিজের ঘরে বসে এটা সেটা ভাবছি। হঠাৎ মনে হল জয় এর রুম খোলা হল। আওয়াজ পেয়েই গেলাম ওর ঘরে। দেখলাম বাবুমশাই জুতোশুদ্ধ পাটা নিয়েই বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল ওকে। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় গিয়েছিলি কাল? কোথায় ছিলি কাল রাতে?” ধরা গলায় উত্তর এল, “দেবার্ঘর বাড়ি গিয়েছিলাম।” বুঝলাম যে আড্ডা দিয়ে ফিরলেন বাবু। “ও! আচ্ছা।” বলে বেরিয়ে আসতে যাব, এমন সময় জয় বলল, “কাকু আর নেই রে! কাল সব শেষ হয়ে গেল।” আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকালাম। হঠাৎ এরকম একটা ব্যাপার শুনব ভাবিনি। খানিক পর জোর করেই জিজ্ঞেস করলাম, “কিভাবে?” ও বলল, “অ্যাক্সিডেন্ট। টিউশন পড়িয়ে ফিরছিলেন। একটা বাস এর সাথে….” আর কিছু বলতে পারলনা ও। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। এটা জানতাম যে দেবার্ঘর বাবা টিউশন করেই সংসার চালান। যদিও খুব একটা অভাবী ছিল না ওরা। কিন্তু এরপর? কি ভাবে চলবে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। একবার মনে হল একটা ফোন করি দেবার্ঘকে। তারপরেই মনে হল কি বলব ফোন করে? এখন ওকে একা থাকতে দেওয়াই ভাল।
পরের দিন জয়কে শুধু জানালাম পরীক্ষার তারিখটা। কিছু বলল না। একটু বেলার দিকে দেবার্ঘর বাড়ি চলে গেল। বলে গেল। তাই জানতে পারলাম। আমিও সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও পড়ায় মন বসাতে পারলাম না। জয় ফিরল রাতে। জিজ্ঞেস করলাম “কেমন আছে দেবার্ঘ?” বলল “ভাল না।”
পরীক্ষার দিন এগিয়ে এল। জয়ও দেখলাম কয়েকদিন পর আবার ঠিকঠাক ভাবেই পড়া শুরু করেছে। যদিও মাঝে মাঝেই দেবার্ঘর জন্যে মনটা খুব খারাপ লাগছিল। ও যে কি পরীক্ষা দেবে জানিনা! জয় বলছিল, “ও ওর বাবার ২টো টিউশন পেয়েছে। ওতেই চলছে ওদের সংসার। তবে টেস্টে ফেল করলে ওকে আর রাখবে বলে মনে হয়না।”
২৪ তারিখ অর্থাৎ পরীক্ষার দিন জয় যথারীতি আমার আগেই কলেজে গেল। গিয়ে দেখলাম একসাথে বসে আছে ওরা। জয় কিছু বোঝাচ্ছে দেবার্ঘকে। আর দেবার্ঘ চুপ করে শুনছে। ওদের কাছে বসার জায়গা ছিল না। তাই সেবার আমায় আলাদা বসতে হয়েছিল। ৪ ঘন্টার পরীক্ষা। প্রশ্ন খুব কঠিন হয়েছিল। বুঝতে পারলাম ‘আর ডি এক্স’ বিশেষভাবে প্রশ্ন করেছেন জয় এর জন্যে। একবার তাকালাম জয় এর দিকে। দেখলাম মাথা নিচু করে লিখে যাচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হবার ১০ মিনিট আগে খাতা দিয়ে বেরিয়ে গেল জয়। আমরা বাকিরা ঘণ্টা পড়ার পরেই জমা দিলাম।
সন্ধ্যেবেলা জয়কে জিজ্ঞেস করলাম, “ কিরে কেমন পরীক্ষা হল?” বলল, “ঠিকঠাক।” কাল আবার সেকেন্ড পেপার। তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে এসে বই নিয়ে বসে গেলাম।
সেকেন্ড পেপার পরীক্ষাটা আগের বারের মতই ফার্স্ট পেপারের থেকে ভাল হল। দেখা যাক রেজাল্ট কি হয়। রেজাল্ট বেরোবে ১৫ দিন পর। এর মাঝে আর বিশেষ কিছু ঘটেনি।
—- —- —- —- —- —- —- —- —- —- —-
সবাই ক্লাসে বসে আছি জড়সড় হয়ে। তারিখটা বোধহয় ছিল ১২ই মার্চ। ফার্স্ট পেপার খাতা দেবার কথা আজ। জয় এর মুখে অবশ্য ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। দেবার্ঘ অবশ্য মাথা নিচু করে বসে আছে। আমার নিজের অবস্থাও খুব খারাপ। খুব টেনশন হচ্ছে। খানিক পরে ক্লাসে ঢুকলেন রজতাভ বাবু (আজ আর আর ডি এক্স বলতে সাহস হচ্ছে না)। হাতে খাতার বান্ডিল। নাম প্রেজেন্ট করার পর দেবার্ঘকে বললেন, “নিজের নামটা লেখার সময় কি ভুলে গিয়েছিলে? ওইভাবে কাটাকাটি করেছ কেন খাতায়?” দেবার্ঘ কিছু বললনা। মাথা নিচু করে রইল। স্যার বলে চললেন, “তবে এতবড় অ্যাক্সিডেন্ট সামলে তুমি যে এরকম পরীক্ষা দেবে আমি ভাবিনি। পড়াশুনো করে যাও। ফাইনাল এ খুব ভাল রেজাল্ট হবে তোমার।” এবার কেন জানিনা মনটা খুব ভাল লাগল। ওকে নিয়ে সত্যি খুব খারাপ লাগছিল। ওর পাশেই বসেছিলাম আমি। হঠাৎ নাক টানার আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারলাম দেবার্ঘ কাঁদছে। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না আমার। ভাল রেজাল্ট হয়েছে শোনার পর কেউ কাঁদে নাকি? তারপরেই মনে হল বাবার কথা মনে পড়ছে হয়ত ওর। জয় দেখলাম কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত করছে ওকে। এরপর স্যার যে কথাটা বললেন তাতে বাকিদের কি হল জানিনা কিন্তু আমি একটা খুব বড় ধাক্কা খেলাম। স্যার বললেন, “মিস্টার জয়, নতুন কলেজ দেখ। এখানে আর জায়গা হবে বলে মনে হয়না”। অবাক হয়ে জয়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম শান্তভাবে তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে। স্যার এবার ওর খাতাটা ক্লাসের সামনে তুলে ধরলেন আর বললেন, “ কনগ্রাচুলেশন জয়কে! আবার ফেল করেছে ও”। সবাই তাকালাম ওর খাতার দিকে। দেখলাম লাল কালিতে ১৯ লেখা। ১০০র মধ্যে ১৯ পেয়েছে ও। সবাই চুপ। আমি ভীষন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম খাতাটার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে সবার খাতা দিলেন স্যার। আমি পেলাম ৪৬। দেবার্ঘ দেখলাম ৫৭ পেয়েছে। তখনো কাঁদছে ও। স্যারের অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। উনি খাতা দিয়েই চলে গেলেন। যাবার আগে কঠিন গলায় জয়কে মনে করিয়ে গেলেন, “অন্য কলেজ!”
মনটা খুব ভারী ভারী লাগছিল। কেন জানিনা মনে হচ্ছিল কোথাও কিছু গোলমাল হয়েছে। স্যার কি ইচ্ছে করে জয়কে কম নাম্বার দিয়েছেন? এসব ভাবতে ভাবতে লাইব্রেরীতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আর এক কান্ড! দেবার্ঘ চেঁচাচ্ছে, “না। এটা ঠিক হয়নি জয়। আমি স্যারের কাছে যাব”। জয় দেখলাম ওকে থামানোর চেষ্টা করছে। আমি ওদের কাছে গেলাম। বললাম, “কিরে কি হয়েছে?” জয় বলল “কিছু না! এই তুই বাড়ি চল তো!” বলে টানতে টানতে নিয়ে চলল দেবার্ঘকে। সেদিন অনেক রাতে ফিরেছিল জয়। মনে হয় প্রিয় বন্ধুর বাড়িতেই ছিল বিকেল থেকে। ও ফিরতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ কি হয়েছে রে? তখন কলেজে কি বলছিল দেবার্ঘ?” বলল, “ কি আবার বলবে? আমার খাতা দেখে ওর মনে হয়েছে স্যার ইচ্ছে করে আমার বেশি নাম্বার কেটেছে। তাই রেগে গিয়েছিল। বাদ দে তো!” কেন জানিনা এই উত্তরটা আমার ঠিক পছন্দ হল না। আর কিছু না বলে আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। ঠিক করলাম কাল জিজ্ঞেস করব দেবার্ঘকে। খুব কৌতূহল হচ্ছে আমার। তখনও ভাবিনি আমার জন্যে কতবড় বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে কাল।
পরের দিন কলেজে একটু তাড়াতাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখলাম দেবার্ঘ বারান্দায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকেই দরকার ছিল আমার। সোজা ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপারটা কি আমায় একটু বলবি? কাল অত চেঁচামেচি করছিলি কেন লাইব্রেরীতে?” ও চুপ করে রইল। আমি খানিক থেমে আবার বললাম, “কি রে?” ও এবার মাথা নিচু করেই বলল, “আমি অনেক বারণ করেছিলাম ওকে। ও শোনেনি।” “কি শোনেনি?” আমি একটু অধীর হয়েই জিজ্ঞেস করলাম। দেবার্ঘ বলল, “ও পরীক্ষা হলে আমার সাথে খাতা চেঞ্জ করেছিল। আমি কিচ্ছু লিখতে পারছিলাম না দেখে জোর করে ও নিজের খাতায় নিজের নাম কেটে আমার নাম লিখে আমাকে ওর খাতাটা দিয়ে দিয়েছিল”। আমি হতভম্ব। কি বলব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এরকমও ছেলে হয়! দেবার্ঘর চোখে আবার জল চলে এল। ধরা গলায় বলল, “আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। ভালো লাগছেনা কিছু!” আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। এদিকে আর একজন কে আসতে দেখলাম। হাসিমুখে, হেলতে দুলতে, বিজয়ীর মত। সেই শান্ত চোখ, সেই নির্বিকার ভঙ্গী। এসেই বলল, “কিরে? এখানে কি করছিস? চল লাইব্রেরীতে যাই।”