বিখ্যাত রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু টেবিল থেকে সিঙাড়া টা তুলে নিয়ে একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন তারপর সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে চেবাতে চেবাতে বললেন, “এরকমটা আগে কখনো হয়েছে কী?”

প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যেই করা। উত্তর দিলাম “না। তা হয় নি”

“কতদিন ধরে তোমার দাদা কে বলছি একটা ফোন কিনতে, কিন্তু কিছুতেই কিনবে না!”

“আপনি তো জানেন ফেলুদা মোবাইল পছন্দ করে না। তাহলে কেন আর এসব বলছেন?”

“আরে বলছি কি সাধ করে? ফেলুবাবু কখন বেরিয়েছেন সেটা খেয়াল আছে? তাও আবার মগনলাল মেঘরাজ এর সাথে দেখা করতে। সত্যি তোমার দাদার এলেম আছে।”

চিন্তা যে আমারও হচ্ছে না তা নয়। এটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল ফেলুদা। কিন্তু এখন তো চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই কোনো। এই কেসটা শুরু হয়েছে গত পরশু দিন। আশুতোষ চৌধুরী নামে একজন ভদ্রলোক ফেলুদার কাছে এসেছিলেন। বললেন উনি নাকি সিধু জ্যাঠার পরিচিত। ওনার ধর্মতলায় গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে একটা কিউরিও শপ রয়েছে। সম্প্রতি ওর হাতে একটা নটরাজ এর মূর্তি এসেছিল। মূর্তিটা পুরোপুরি সোনার এবং মূর্তির মুকুটের মাঝে একটা ছোট্টো হীরে বসানো।

তো এই মূর্তিটা পাওয়া যাচ্ছে না। কিভাবে পাওয়া যাচ্ছে না উনি জানেন না। তবে মূর্তি মিসিং হওয়ার আগের দিন নাকি একজন ওটা কেনার জন্য অনেক টাকা অফার করেছিলেন। কিন্তু ওঁর দামে না পোষানোয় উনি বিক্রি করবেন না জানিয়ে দেন । ফেলুদা স্বভাবতই জিজ্ঞেস করে, ‘কি নাম ভদ্রলোকের?’

‘নাম টা… দাঁড়ান ওঁর কার্ড দিচ্ছি। উনি হায়াতে উঠেছেন বললেন। আর বললেন যদি মত চেঞ্জ করি তাহলে যেন ওঁকে জানাই। কিন্তু এখন তো আর মত চেঞ্জ করার প্রশ্নই নেই।”

কার্ড হাতে নেওয়ার পর আমরা দুজনেই কয়েক মুহুর্তের মত থ মেরে গিয়েছিলাম। কার্ডে নাম লেখা – মগনলাল মেঘরাজ। আর কতবার? আর কতবার এই লোকটার সাথে মোলাকাৎ হবে? প্রতিপক্ষ হিসেবে এর থেকে সাংঘাতিক আর কাউকে কল্পনাও করা যায় না।

ফেলুদা বলল, “বিক্রি করবেন না শুনে এঁর প্রতিক্রিয়া কীরকম ছিল?

“ভদ্রলোক খুব একটা খুশি হননি বলাই বাহুল্য। বললেন উনি নাকি সব জিনিস চেয়ে নেন না। এবং মূর্তিটা নাকি ওঁর হাতেই আসবে। এটাই ভবিতব্য।”

“ভবিতব্য বললেন? I mean এই শব্দটা ব্যবহার করলেন?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। কেন বলুন তো!”

“নাহ্‌। বাংলাতে বেশ Develop করেছেন ভদ্রলোক।”

“মানে? আপনি ওঁকে চেনেন নাকি?”

 “হ্যাঁ। অনেক দিন ধরেই চিনি।”

এই কেসের সূত্র ধরেই ফেলুদা আজ মগনলালের সাথে দেখা করতে গেছে। আমিও যেতাম জানলে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি ও নেই। আর টেবিলের ওপর একটা চিরকূটে লেখা, “মগনলালের কাছে যাচ্ছি। বাড়িতেই থাকিস”

কি জ্বালা। সাড়ে আটটা বাজতে চলল। এখনও পাত্তা নেই। তার ওপর বৃষ্টি যে শুরু হয়েছে আর থামতেই চায় না।

লালমোহনবাবু নীরবতা ভেঙে বললেন, “বুঝলে তপেশ, আজ ভাবছি তোমার এখানেই রয়ে যাব। তোমার দাদা কখন আসবে তার ঠিক নেই। তুমি একা একা চিন্তা করবে তার চেয়ে বরং-

লালমোহনবাবু কথা শেষ করতে না পারার কারন বেল বেজেছে। আর আমি দৌড়েছি দরজার দিকে। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেখি ফেলুদা দাঁড়িয়ে। হাতে ছাতা, কিন্তু পুরো চান করে গেছে বৃষ্টিতে। তারপর ঘরে ঢুকে লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর একটু বসুন। আসছি।” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “তোপসে চা দিতে বল। কুইক।”

মিনিট সাতেক পরে চেঞ্জ করে ফেলুদা যখন এল তখন আমি আর জটায়ু উদগ্রীব হয়ে বসে আছি মগনলালের গল্প শোনার আশায়।

গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফেলুদা বলল, “মগনলাল চুরিটা করে নি।”

“কি বলছেন কী মশাই? আপনি এ কথা বলছেন?”

“আরে কারন আছে তাই বলছি। মগনলাল তো আজ আমায় দেখে হেসে গড়াগড়ি খায় পারলে। বললে কোন নটরাজের মূর্তি? উনি নাকি কোনো অ্যান্টিকের দোকানেই যান নি। ইনফ্যাক্ট উনি নাকি পরশুর আগের দিন এসেছেন কলকাতায় একটা কাজে।”

আমি বললাম, “আর তুমি এটা বিশ্বাস করলে?”

“বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। কারণ ধর্মতলায় গ্র্যান্ডের নিচে ওই ভদ্রলোকের কোনো কিউরিও শপ খুঁজেই পেলাম না। আশুতোষ চৌধুরী নামে কারুর ওখানে দোকান নেই।”

“সে কি মশাই” লালমোহন বাবু চোখ বড় বড় করে বলল, “এতো হাইলি সাশপিসাস ব্যাপার।”

“তারপর?” আমি বললাম।

“তারপর গেলাম তোর সিধু জ্যাঠার বাড়ি। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হল না। সিধু জ্যাঠাও লোকটার হদিশ দিতে পারল না। বলল ওই নামে কাউকে চেনেই না।”

আমরা সবাই চুপ। ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “ফেলু মিত্তির ফেল মেরে গেল বুঝলি। কেউ একটা প্র্যাকটিক্যাল জোক করল আমার সাথে।”

হঠাৎ শ্রীনাথ এসে বলল, “বাবু এই কাগজটা আপনার পকেটে পেলাম।”

আমরা সবাই সেদিকে তাকালাম। ফেলুদা হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে সেটা পড়ল। তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

বুকের ভেতরে হাতুড়িটা পড়ছিল বেশ বুঝতে পারছি। লালমোহনবাবু বললেন, “জোরে জোরে পড়োতো তপেশ। শুনি।”

আমি পড়তে শুরু করলাম –

“স্নেহের ফেলু,

তোমার পসার বেড়ে যাওয়ার পর আর এমুখো হওনা। কিংবা Google এর দৌলতে আমায় আর দরকার হয় না হয়ত। এই বিষয় নিয়ে আমার ক্ষোভটা অনেক দিনেরই। তাই একটা ছোটো মজা করলাম তোমার সাথে। মগনলালের আসার খবরটা এয়ারপোর্ট এ কাজ করে আমার এক পরিচিতের থেকেই পাই। জানতাম শেষ অবধি আসতেই হবে আমার কাছে। আশা করি অপরাধ নেবে না।

ভালো থেকো।

ইতি – তোমাদের সিধু জ্যাঠা।

ফেলুদার দিকে তাকালাম। ফেলুদার সেই লজ্জা মিশ্রিত মুখটা আর নেই। বরং ঠোটের কোনে অল্প হাসিও চোখে পড়ল।

“আজ কত তারিখ রে তোপসে?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

“৫ই সেপ্টেম্বর”

“আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন উনি। শিক্ষক শিক্ষকই থাকে চিরকাল। সে ছাত্র যতই বড় হোক না কেন!”

ফেলুদা অন্তর্ধান

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


2 thoughts on “ফেলুদা অন্তর্ধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি