‘বরুন বিশ্বাস কে?’ এখন অনেকেই হয়ত তাকে চেনেন আপনারা। আবার অনেকেই চেনেন না। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী সুঁটিয়ার বরুন বিশ্বাসকে নিয়ে ফিল্ম বানালেন। ছবি সুপারহিট্! একজন প্রতিবাদী মানুষের commercialization খুব ভালই খেল public. কিন্তু “বরুন বিশ্বাস কে?”। লাখ টাকার প্রশ্ন। সন্দেহ হয় এটা ভেবে যে এই রাজ্যের কতজন মানুষ বরুন বিশ্বাসকে চিনতেন রাজ চক্রবর্তীর ‘প্রলয়’ সিনেমার আগে।
চলুন, একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। আজ থেকে ১৩ বছর পিছিয়ে যাব। বাম শাসিত পশ্চিমবঙ্গে গাইঘাটার সুঁটিয়াকে বলা হত ‘ধর্ষনগ্রাম।’ সুঁটিয়ার সাধারন মানুষদেরর কথা অনুযায়ী ওখানকার নাগবাড়ির কুখ্যাত তোলাবাজ এবং মস্তান সুশান্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে শুরু হয় অন্ধকার যুগ। সময়টা মোটামুটি ওই ১৯৯৯ থেকে ২০০২। সুঁটিয়া এবং তার সাথে সাথে বিষ্ণুপুর, গাজনা, কানাপুকুর, কুঁটিপাড়া, পশ্চিম বারাসাত, স্বরূপনগর এর মত কিছু জায়গায়ও সুশান্ত চৌধুরী আর তার দলবলের কোপ পড়েছিল। পুলিশ আর কিছু রাজনৈতিক নেতার হাত ছিল তার মাথায়। কাজেই সুঁটিয়া বা ওই এলাকা সংলগ্ন জায়গার মানুষজনের ওই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির কোনো উপায় ছিল না। শোনা যায় সুশান্ত চৌধুরী তার ‘কার্গিল পার্টি’র ছেলেদের বলত, “এলাকার কোন মেয়েটাকে ভাল লাগছে বল। তুলে আন, রেপ কর। বাকিটা আমি সামলে নেব।” সিনেমার মত মনে হচ্ছে কি? হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই সত্যি।
একটা ঘটনার কথা বলি। পাড়ায় বিয়েবাড়ি হচ্ছে। হঠাৎ সুশান্তর দলবল এসে সেখান থেকে একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। মেয়েটির অপরাধ? সে নাকি বলেছে বিয়েবাড়ির ফুচকাটা ভাল নয়। সারা রাত ধরে গন ধর্ষন করে রক্তাক্ত এবং অজ্ঞান অবস্থায় তাকে বাড়িতে ফেলে দিয়ে আসা হল। হুমকি দেওয়া হল মেয়েটির পরিবারকে -পুলিশকে জানালেই বাড়ি সুদ্ধু লোক ‘ফিনিশ’ হয়ে যাবে। তার পরের রাতে আবার তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করা হল তাকে। তারপর আবার, আবার। শেষটায় মেয়েকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালালেন মা।
এই খেলাটাই ঘুরে গেল যখন বন্যা-বিধ্বস্ত সুঁটিয়ার হাইস্কুলের মাঠে একটা ‘ফ্লাড সেন্টার’ বানানোর জন্য টাকা বরাদ্দ করল সরকার। কাজ শুরুর আগে সুশান্ত সরকারী ঠিকাদারের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা দাবি করে। ঠিকাদার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা সরকারকে জানান। জল অনেকদূর গড়ায়। সরকারের মুখরক্ষার খাতিরে সুশান্তর পেছনে থাকা রাজনৈতিক নেতারাই সাময়িকভাবে তাকে আত্মসমর্পন করতে বলেন।
এরপর অল্প কিছু মানুষ সাহসে ভর করে তৈরী করলেন ‘প্রতিবাদী মঞ্চ।’ আসলে মানুষের অনেক দিন ধরে ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুনগুলো বাইরে আসতে শুরু করে সুশান্ত জেলে যাওয়ার পরেই। ২৭ জুলাই, ২০০২, ‘প্রতিবাদ মঞ্চ’এর প্রথম সভায় বক্তৃতা দিতে সাহস হচ্ছিল না কারও। কারন সুশান্তর দলের অর্ধেক ছেলে তখনও জেলের বাইরে। হঠাৎই মানুষের ভীড় ঠেলে এগিয়ে এলেন একজন ছিপছিপে চেহারার যুবক। সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দারের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে গর্জে ওঠেন তিনি “আমরা যদি নিজেদের মা-মেয়ে-বোনেদের সম্মান রক্ষা করতে না পারি তাহলে সভ্যসমাজে থাকার যোগ্য নই আমরা। ধর্ষকদের মুখোমুখী হওয়ার সাহস না থাকলে তাদের চেয়েও বেশি শাস্তি হওয়া উচিত আমাদের।”
শয়তানদের দুর্গ কেঁপে উঠল। সেই প্রথম সামনে এলেন বরুন। ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’এর আন্দোলনের চাপে ধরা পড়েছিল পাঁচজন অপরাধী। একজন অভিযুক্তের হাতে নাকি বরুন তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’। বলেছিলেন “জেলে বসে পড়িস।” ভাবা যায়! এই বরুনকে কিছু মানুষ চিনল তার মৃত্যুর পর। আর কিছু মানুষ চিনল এক বছর পর পেপারে লেখা পড়ে এবং রাজ চক্রবর্তীর সিনেমার প্রোমো দেখে। সত্যি কথা বলতে কি আমি এত বড় বড় কথা বলছি, কিন্তু আমিও বরুন বিশ্বাসকে চিনেছি তার মৃত্যুর পরে। আমাদের এই পোড়া দেশে প্রকৃত সৎ মানুষেরা চিরকালই উপেক্ষিত।
৫ই জুলাই, ২০১২। মিত্র ইনস্টিউশনের বাংলার শিক্ষক বরুন কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। গোবরডাঙা স্টেশনের কাছে তাঁর মোটরসাইকেল রাখা থাকত। সেদিন নিজের বাইকে উঠে স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে পেছন থেকে ছুটে আসে একটা গুলি। প্রায় আধঘন্টা ওই স্টেশনে রক্তে মাখামাখি হয়ে কাতরেছেন। কেউ এগিয়ে আসেনি। প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার লিখেছেন, “যতক্ষন বরুনের দেহে প্রান ছিল ও বলেছিল- আমায় বাঁচাও। স্টেশন সংলগ্ন শ্রমিক সংগঠনের অফিসে ১৫-২০ জন সদস্য থাকা সত্ত্বেও কেউ এগিয়ে আসেনি বরুনকে বাঁচাতে।” এখন কথা হল যারা সেদিন বরুনকে সাহায্য পর্যন্ত করতে আসেনি আবার তারাই রাত্রে বরুনের মরদেহ আঁকড়ে ‘আমাদের লোক’ বলে চেঁচিয়েছেন। আর আজ যখন বরুন-খুনের ষড়যন্ত্রে জড়িত বলে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বিরুদ্ধে বরুনের বাবা অভিযোগ করেছেন তখন তারাই তাঁর বিরুদ্ধের মামলা দায়ের করেছে। ধন্যি রাজনীতি!
কেমন আছে এখন সেই সুঁটিয়া। শান্তিরক্ষকরা বলছেন ‘আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। পরিস্থিতি শান্তিপূর্নই আছে।’ আসল পরিস্থিতি কিন্তু অন্য কথা বলছে। কোথাও যেন সেই প্রতিবাদের বাঁধনটা আলগা হয়ে আসছে। দেশটার নাম আসলে ভারতবর্ষ তো। এখানে তো চিরকালই এরকমই হয়ে আসছে। দেখা যাক আর একজন বরুন এগিয়ে এসে এই পোড়া দেশের হাল ধরেন কিনা। ততদিন অবধি ‘বিশ্বাস’ থাক বরুনেই।