সকালে যখন ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল ঘুমটা তখনও ভালো করে কাটেনি অভীকের। আজ রবিবার, তাই কাটানোর কোনো ইচ্ছেও ছিল না। এই একটা ঝামেলার জিনিস । যখন তখন বেজে উঠে ঘুমের তেরোটা বাজিয়ে দেয়। এমনিতে রোজ সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয় ওকে। তারপর স্নান করে, নমো নমো করে দু’টি খেয়েই স্কুলে ছুটতে হয়।  পড়তে নয় পড়াতে। মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলের ফিজিক্সের টিচার ও। বাসে করে ওর স্কুলে যেতে ২ ঘন্টা লাগে। কাজেই খুব সকালে উঠেই ওকে রেডি হতে হয়। অবশ্য অভীকের কাছে ৮ টা মানেই খুব সকাল।
আজ স্বভাবতই ফোনটার অকাল আগমনে একটু বিরক্ত ও। এত সকালে কে জ্বালাতে ফোন করল? বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে দেখল দেবাশীষ ফোন করছে। ধুর! বিরক্তি মাখানো গলায় ফোনটা তুলল অভীক।
“বল”
“তুই কোথায় এখন”
দেবাশীষের গলাটা একটু অন্যরকম শোনাল কি? হতে পারে।
“নিজের বিছানায় বলেই মনে হচ্ছে। কেন?”
“একটা বাজে ব্যাপার হয়েছে।”
শালা সকাল বেলায় তুমি বাজে ব্যাপার জানাতে ঘুম ভাঙালে আমার। খিস্তি দিতে ইচ্ছে করছিল অভীক এর।
“কি?” অভীকের ঘুমজড়ানো গলায় বিরক্তিটা চাপা পড়ল না এবারও।
“মেঘনা… মেঘনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আজ সকালে।”
হঠাৎই বুকের ভেতর যেন একটা হাতুড়ি পড়ল অভীকের। পেটের ভেতরটা খালি খালি লাগল। পৃথিবীটা হঠাৎ বোঁ বোঁ করে উলটো দিকে ঘুরতে শুরু করল কী! অ্যাকসিডেন্ট! মেঘনার? কি বলছে কি দেবাশীষ! মাথার ভেতর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে ওর।         
“কি? কা-কার?”
“মেঘনার…আজ সকালে।” উত্তর এল।
“কীভাবে?” একটু থেমে জিজ্ঞেস করল অভীক,
“সকালে স্কুটি নিয়ে বেরিয়েছিল। ওর বাবার শরীর খারাপ। বাজার করতে বেরিয়েছিল তাই। একটা এক্সপ্রেস বাসের সাথে ধাক্কা লেগেছে শুনলাম। মেদিনীপুর টাউন নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওকে। ওর মা আর শ্রীপর্না গেছে সাথে। ওর কাছ থেকেই শুনলাম। মনে হল তোকে জানানো প্রয়োজন। তাই…”
অভীক চুপ। আজ কতদিন পর ওর নামটা শুনল যেন! কত দিন না কত বছর? শেষ কবে কথা হয়েছে ওদের? মনে পড়ছে না।
“তুই কি যাবি?”
দেবাশীষের কথায় একটু চমকে উঠল অভীক।
“কি?”
“বলছি তুই কি যাবি?”
“কোন নার্সিং হোম?”
“সঞ্জীবন নার্সিং হোম। চিনিস?”
“হুম। রাখছি এখন।”
ফোন রেখে এক মুহুর্ত ভাবল অভীক। যাবে? যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল ৮ টা ১০ বাজে। যেতে হলে আর দেরী করা যাবেনা। টাউন যেতে দু’ঘন্টা লাগবে প্রায়। এখুনি বেরোতে হবে। বেডসাইড টেবিল থেকে নিয়ে নিজের রিমলেস চশমাটা পরে নিল ও।

                                                                              ২

 আজ ট্যাক্সি করল অভীক। বাসের থেকে তাড়াতাড়ি পৌঁছোবে এটা। ভাড়া হয়ত অনেকটা বেশী, কিন্তু সেসব ভাবলে এখন ওর চলবেনা। ওয়েদারটা আজ সকাল থেকেই কেমন যেন একটা। কাল টিভিতেও দেখাচ্ছিল যে  ক’দিন ধরেই নিম্নচাপ থাকবে দক্ষিনবঙ্গে। আর এখন জুলাই মাস। এই তো সময় এসবের। ওর এরকম ওয়েদার ভালই লাগে। হালকা নিম্নচাপ। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। এই সময় জানলার ধারে বসে বসে বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা। যদিও মেঘনার এইরকম ওয়েদার একদম সহ্য হত না। ও বলত, “এতে আবার ভালো লাগার কি আছে? বিরক্তিকর একটা ওয়েদার। সারাদিন খালি ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজই করা যায় না।”
অভীক বলত, “ঘরে বসে থাকতে ভাল না লাগলে এই বৃষ্টিতে ভিজলেই পারিস। কেউ তো আর আটকাচ্ছেনা!”
চোখ দু’টো বড় বড় করে মেঘনা বলত, “কি? দিয়ে তারপর নিউমোনিয়ায় পড়ি আর কি? ও তোর দরকার হয় তুই ভেজ্‌ নয়তো কবিতা লেখ জানলার ধারে বসে। আমি ওসবের মধ্যে নেই।”
“দাদা জানলার কাঁচটা তুলে দেবেন অসুবিধে হলে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে তো!”
ড্রাইভারের কথায় বাস্তবে ফিরল অভীক। বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। নাহ! জানলার কাচ তুলবেনা ও আজ। আসুক ছাঁট। জানলার বাইরে তাকাল ও। সব কিছুই কেমন যেন ঝাপসা লাগছে এই বৃষ্টিতে। ঝাপসা মাঠ, ঝাপসা সবুজ গাছপালা। একদিক থেকে আর একদিকে চলে যাচ্ছে সব। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মনের গভীরে ঝাপসা হয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি হঠাৎই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর।

                                                                                  ৩

“পৃথিবীতে কটা রঙ আছে বল তো?”
এই খেয়েছে। এ আবার কেমন প্রশ্ন। ঢোঁক গিলল অভীক। প্রশ্নটা করেছে পল্লবদা। ওদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র। সবাই বলে এর মাথায় নাকি একটু ইয়ে মানে ছিট্‌ আছে। একবার বকতে শুরু করলে নাকি থামে না। আগে সেভাবে ব্যাপারটা যাচাই করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আজ ও এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
“র-রঙ?”
“হ্যাঁ রঙ। মানে কালার। কতগুলোর নাম বলতে পারবি একসাথে?”
মনে মনে একটু গুনে নিল অভীক। ‘বেনীআসহকলা’ ছোটোবেলায় পড়েছে। ওখানেই তো ৭ টা হয়ে যাচ্ছে। বাকি আর ৪-৫ টা পারবে হয়তো।
“১২-১৩ টা” অভীক উত্তর দিল।
“সবাই তাই বলবে। কিন্তু তুই কি জানিস পৃথিবীতে রঙের কোনো শেষ নেই।” বলল পল্লবদা, “আসলে একটা রঙের অনেক তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে। মানে যাকে বলে ‘ফ্রিকোয়েন্সি’। বিভিন্ন তরংদৈর্ঘ্যে বিভিন্ন রঙ পালটে যায়। আবার ২ টো তিনিটে রঙ একসাথে মেশালে অন্য একটা নতুন ধরনের রঙ তৈরী হয়। এবার ভাব বিভিন্ন রঙকে যখন বিভিন্ন ফিকোয়েন্সিতে মেশানো হবে তখন তো প্রত্যেকবার আলাদা আলাদা রঙ পাওয়া যাবে। সুতরাং পৃথিবীতে রঙ রয়েছে অসংখ্য। বুঝলি কিছু? পুরোটাই খেলা। রঙ এর খেলা”
আর কিছু বুঝুক না বুঝুক আজ ওর ভাগ্যে দুঃখ আছে এটুকু বুঝে গেছে অভীক। শালা ওই দেবাশীষ জানোয়ারটার জন্য আজ ওকে ভুগতে হচ্ছে। কলেজ হয়ে গেছে অনেকক্ষন। ও অপেক্ষা করছে দেবাশীষ এর গার্লফ্রেন্ড শ্রীপর্নার বন্ধুর জন্য। সে-মেয়েকে নাকি বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছেনা। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছেনা দুজনে দুজনের সাথে। তাই এক বন্ধুর হাত দিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে। প্রথমে এরকম ডাকপিওনের কাজ করতে হবে শুনে সঙ্গে সঙ্গে না করে দিয়েছিল অভীক। তারপর দেবাশীষ কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “দেখ অভীক। ওর বন্ধু তোর কলেজেই পড়ে। তুই কলেজের পর একটু অপেক্ষা করিস প্লিজ। ও তোকে দিয়ে দেবে।”
একটা প্রশ্ন সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এসেছিল অভীকের।
“আচ্ছা তোর কথা হচ্ছেনা যখন তখন তুই চিঠির ব্যাপারটা জানলি কীভাবে?” জিজ্ঞেস করেছিল ও।
দেবাশীষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “আমাকে ওর ওই বন্ধুই জানালো সব। প্লিজ একটু হেল্প কর ভাই।”
আর না করেনি অভীক। ভেবেছিল এমন কিছু ভীড় কাজ তো নয় এটা। কিন্তু এখন পল্লবদার বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে কাজটা না নিলেই হত। আর ওর বন্ধুটাও বড্ড দেরী করছে।
“তুই কে?”
ভারী গলায় পল্লবদার হঠাৎ চিৎকারে ঘোর কাটল অভীকের। ওরা বসে আছে লাইব্রেরীতে। দেওয়ালে “সাইলেন্স” লেখা বোর্ডটা একপাশে হেলে গিয়ে খুব করুন অবস্থা বলেই বোধহয় এই শব্দদূষনের জন্য কেউ কিছু বলল না।
“বল, তুই-আমি, আমরা কারা?” আবার বলল পল্লবদা।
ছেলেটার মাথায় সত্যিই গোলমাল আছে বোধহয়।
উত্তরটা সে নিজেই দিল অবশ্য।
“এই যে ধর আমি। আমায় ক’জন চেনে? কেউ চেনে না? তাহলে ‘I am nobody’. এবার ধর আমি হঠাৎ মরে গেলাম। সেটা কোনো পার্টির মিছিলেই হোক বা মাওবাদীদের গুলিতেই হোক তখন দেখবি আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। ফেসবুকে সবার ওয়ালে আমার ছবি থাকবে। আমার মৃত্যূর প্রতিবাদে মোমবাতি মিছিল বেরোবে রাস্তায় রাস্তায়। তখন কিন্তু ‘I am somebody’. তাই না?”
হেঁ হেঁ করে ঘাড় নাড়ছিল অভীক। আর মনে মনে বাপ-বাপান্ত করছিল দেবাশীষ আর তার গার্লফ্রেন্ডের বন্ধুর। ঘড়ি দেখল একবার ও। ৪ টে পেরিয়ে গেছে। আর বসা যাবে না। অনেক দেরী হয়ে গেছে। উঠে পড়ল ও।
“আজ আসি পল্লব দা।”
“আসবি? কেন? আর একটু থাক না” একটু হতাশ হল মনে হল ছেলেটা।
আর একটু! নো, নেভার। পাগলা হয়ে যাবে ও আর বেশিক্ষন এই রং-তুমি-আমির চক্করে থাকলে। সময় থাকতে সাইড নেওয়া টা বেটার।
“না গো। অনেকক্ষন আছি। এবার ফিরতে হবে। পরে কথা হবে আবার।”
এর পর পল্লবদা কে আর কিছু বলতে না দিয়ে ও বেরিয়ে চলে আসছিল লাইব্রেরী থেকে। তখনই ঘটল ব্যাপারটা।
“তুই অভীক?”
হঠাৎই পেছনে অচেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাল ও। যে মেয়েটা প্রশ্নটা করেছে তার পরনে একটা ঘিয়ে রঙের কুর্তি আর নীল রঙের জিন্স। ভুরু দুটো সামান্য কুঁচকোনো। এই কি শ্রীপর্ণার বন্ধু। বাহ! বেশ মিষ্টি দেখতে তো!
“হ্যাঁ” একটা মেকি বিরক্তিটা সমেত কথাটা বলল  অভীক।
সাইডব্যাগ থেকে একটা মেয়েটি খাম বের করে বাড়িয়ে দিল অভীকের দিকে।
“এটা শ্রী দিয়েছে। সরি আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল।” বলল মেয়েটি।
একটু মানে এর কাছে ঠিক কতটা? ৪০ মিনিট লেট করে বলে একটু! কিন্তু তবু আর অভীকের রাগ হচ্ছে না। খামটা নিয়ে নিল ও। মনে একটা প্রশ্ন আসছে ওর। কিন্তু কোনোদিন কোনো অচেনা মেয়েকে ওই প্রশ্নটা করেনি অভীক। একে করবে কি?
“আসছি তাহলে আমি।” এবার বলল মেয়েটি।
“ইয়ে তোমার মানে… তোর নামটা যেন কী?”
মেয়েটি একটু অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলেছিল, “মেঘনা। মেঘনা চক্রবর্তী।”
তারপর আর দাঁড়ায়নি। বেরিয়ে গিয়েছিল লাইব্রেরী থেকে। আর সেকেন্ড ইয়ার এর অভীক সাহা হঠাৎই বুঝেছিল লাইব্রেরীর পুরোনো ‘সাইলেন্স’ লেখা বোর্ডটা ওর মনকে ভেংচি কাটছে।

মেঘনার সাথে এর পরের সাক্ষাৎও হয়েছিল লাইব্রেরীতে। এই ঘটনার ৪ দিন পর। অভীক একা একা ফিজিক্সের কিছু অঙ্ক করছিল।
হঠাৎই মেয়েলি গলায়  “কিরে খুব ব্যস্ত?” শুনে পাশে তাকিয়ে দেখে মেঘনা দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একটা চেয়ার টেনে ওর পাশে বসে পড়ে।
“নাহ। একটুও ব্যস্ত নয়।” অভীক হেসে উত্তর দেয়।
“আজ কলেজের পর কি করছিস?”
“কিছুই না। কেন?”
“আমার সাথে টাউন যাবি একবার। ওখানে একটা বই কিনতে যাব।”
অভীক গিয়েছিল। এইভাবেই শুরু সবকিছু। তারপর ফেসবুকে চ্যাট। এসএমএসে গল্প। তারপর ফোন। প্রোপোজ। অভীকই করেছিল। ২ দিন সময় নিয়ে হ্যাঁ বলেছিল মেঘনা। মাঝে মাঝে অভীকের মনে হয় সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিল বলেই হয়ত শেষের দিনটাও খুব তাড়াতাড়ি চলে এল।
কলেজ শেষ করে এমএসসি পাশ করেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল অভীক। এখন যেমন বিএড ছাড়া এসএসসি তে বসা যায়না। তখন এই ব্যাপারটা ছিল না।
এসএসসির রেজাল্টের খবর জানাতে মেঘনাকে ফোন করেছিল অভীক।
“হ্যালো মেঘনা?”
“হূম বল”
“আজ আমার এসএসসি রেজাল্ট বেরোনোর কথা ছিল। ভুলেই গেছিস বল?”
“আরে না না ভুলিনি। ফোন করতাম তোকে”
“আচ্ছা। তা তোর বাড়িতে কবে নিয়ে যাচ্ছিস সেটা বল।”
“মানে?” একটু অবাক হয়েছিল মেঘনা।
“আমি সিলেক্টেড রে।”
“বাহ! খুব ভাল খবর তো।”
কোথাও যেন একটা কিছু মিসিং ছিল সেদিন। অভীকের সিক্সথ সেন্স অন্তত সেরকমই কিছু একটা বুঝেছিল। দু’একটা ফরম্যাল কথার পর অভীক আবার তুলেছিল সেই প্রসঙ্গ!
“আমার মনে হয় এবার তোর বাড়িতে আমাকে নিয়ে কথা বলা উচিত”
কিছুক্ষন ওদিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। ও একটু অধৈর্য হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই…
“আমার তোকে কিছু বলার আছে অভীক।”
“বল।”
“বাড়িতে আমি আগেই কথা বলেছি।”
“এতদিন বলিস নি কেন আমায়?”
“কারন বলার পর যেটা হয়েছে সেটা শুনতে তোর ভাল লাগত না তাই।”
“কি হয়েছে? প্রবলেমটা কী?” অভীক বুঝতে পারছে ওর মাথা গরম হচ্ছে আস্তে আস্তে।
উত্তর না দিয়ে মেঘনা বলেছিল, “তুই…” তারপর একটু থেমে, “তুই ব্রাম্ভন নয়। এটাই প্রবলেম”
মাথা জ্বলে গিয়েছিল অভীকের কথাটা শুনে।
ও সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল , “তাতে কার বাবার কি?”
তারপরেই “আমি রাখছি। ভাল থাকিস” বলে ফোন রেখে দিয়েছিল মেঘনা।
সঙ্গে সঙ্গে ও রিং ব্যাক করে দু’বার। কিন্তু দু’বারই মেঘনা ফোনটা কেটে দেয়।
নাহ! আর করেনি অভীক। ইচ্ছে বহুবার হয়েছে। কিন্তু কোথাও যেন আত্মসম্মান বলে একটা বস্তু বার বার আটকে দিয়েছে ওকে। দেবাশীষ ওকে অনেকবার জোর করেছে ফোন করার জন্য কিন্তু ও পাত্তা দেয়নি।

“দাদা এসে গিয়েছি আমরা।”
ড্রাইভারের কথায় সংবিৎ ফিরল অভীকের। বৃষ্টি এখন আর হচ্ছেনা। বরং খুব হালকা একটা রোদ উঠেছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে অভীক ড্রাইভারকে বলল অপেক্ষা করতে। তারপর ভাল করে জরিপ করল নার্সিং হোমটাকে। পাঁচতলা বাড়িটাকে নিচ থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন আকাশ ছুঁয়েছে।
ঢুকে গেল নার্সিং হোমের ভেতর। ভেতর ঢুকেই একটা খুব বড় ধাক্কা খেল ও। মাথা কাজ করছিল না ওর। ভিজিটর্স সেকশনে ও কি করছে?  আজকাল রোগীদেরকেও এখানে রাখা হচ্ছে নাকি? পাঁচতলা নার্সিং হোমের এত খারাপ দশা?
মেঘনাও ওকে দেখে এগিয়ে এসেছে।
“তুই এখানে কি করছিস? কেবিনে নেই কেন তুই?” মেঘনা প্রশ্ন করল।
“মানে?” অভীক আকাশ থেকে পড়ল যেন, “আমি কেবিনে থাকতে যাব কোন দুঃখে? অ্যাকসিডেন্ট তো তোর হয়েছে।”
মেঘনা কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোকে কে বলল সেটা?”
“দেবাশীষ ফোন করেছিল সকালে।”
“বুঝে গেছি। আর আমায় বলা হয়েছে তোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”
মানে? সকাল বেলা কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ছেলে টা গল্প দিল। কিন্তু এরকম কেনই বা করল। একবার আড়চোখে আশেপাশে তাকিয়ে অভীক দেখল ভিজিটর্স রুমে বসে থাকা মানুষের মত দেখতে প্রানীগুলো ওদের কথাবার্তা গোগ্রাসে গিলছে। স্বাভাবিক। ওদের কাছে এটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা।
“তাহলে এবার কি করবি?”
চমক ভাঙল অভীকের!
ও বলল, “চল ফিরি। আর কি করব? ওদের ব্যবস্থা বাড়ি ফিরে করব।”
আর কিছু বলল না সে। হালকা গোলাপী রঙ এর শালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটা এগিয়ে গেল নার্সিং হোমের গেটের দিকে। অভীক কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে। তারপর নিজেও চলল একই রাস্তায়।
নিজের ট্যাক্সির কাছে গিয়ে দেখল ট্যাক্সিতে হেলান দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে মেঘনা। হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না ও। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে গেল । কি হল এটা? মেঘনার গায়ে সাদা রঙের শালোয়ার কামিজ দেখছে কেন ও? কি হচ্ছে কি আজ ওর। চোখের সামনেটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল ওর। মাথার মধ্যে পাঁচ বছর আগে শোনা কলেজের কয়েকটা কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
“পৃথিবীতে শুধু রঙ এর খেলা।”
হঠাৎই চোখের সামনের অন্ধকার সরে গিয়ে তীব্র আলো পড়ল ওর মুখে। চোখ দু’টো যন্ত্রনায় বন্ধ হয়ে গেল ওর।

“কিরে এরকম ছটপট করছিস কেন! খারাপ কোন স্বপ্ন দেখছিস নাকি?”
কপালে  মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল অভীকের। সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল ও। চোখের পাতাদু’টো ভারী হয়ে আসছে আজ। পূবদিকের জানলা দিয়ে সকালের হালকা আলো ঘরের মধ্যে ঘাঁটি গেড়েছে।
“কটা বাজে মা?”
কপালে বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা ঘামটা মুছে নিয়ে অভীক প্রশ্নটা করল।
“সাড়ে সাতটা। তবে বাইরের তাকালে বুঝতে পারবিনা। ভীষন মেঘ করেছে। রোদ ওঠেনি এখনও”
মায়ের এই স্বভাব। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তিনটে উত্তর দেয়।
“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও। আমি একটু পরে উঠছি”
আর কিছু না বলে মা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে জানলার কাছে গেল অভীক। তারপর হঠাৎই একসময় বৃষ্টি নামল। পাশের বাড়ির কার্নিশে শুয়ে থাকা সাদা-কালো বেড়ালটা মাথার ওপর একটু ছাদের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
ফোনটা এল তারপরেই। বিছানা থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে নাম্বারটা দেখে একটু অবাক হল অভীক।
“বল।”
“তুই কোথায় এখন” ওপ্রান্ত থেকে আওয়াজ এল।
অভীক জানে এরপর ও কি বলবে।
“অভীক, মেঘনা… মেঘনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”
খুব হাসি পেল অভীকের। কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে বিছানায় ছুড়ে দিল ও।
তারপর জানলার গ্রিলগুলো দুহাতে ধরে দাঁড়াল। বিড়ালটা আশ্রয় খুঁজে পেল কি? কে জানে! আর দেখা যাচ্ছেনা ওকে। এদিকে বৃষ্টি বেড়েই চলল। স্মৃতির ভেতর হারিয়ে গেল অভীক। আর একসময় চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর গালে। বৃষ্টি তখনও পড়ছে।

শ্রাবনের ধারার মত

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি