– শোনো আজ আমায় তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে।
– মানে? আর সেটা তুমি এখন আমায় জানাচ্ছো? এখনও পুজো করা হয় নি। এই তো বাজার করে আনলে। পুজো করে এসে আমি এত তাড়াতাড়ি রান্না করব কী করে?
– মিটিং কি বলে কয়ে এসেছে নাকি? আমি কি করব? আমি জানিনা। তুমি সময়ে খাবার দিয়ে দিও তাহলেই হবে।
– এত সহজ নাকি? কী মনে হয় তোমার? সংসারে কাজ নেই আর কোনো?
– কাজ থাকলে করো না। সক্কাল সক্কাল কেন বিরক্ত করছো?
– বিরক্ত করছি? আমি? আর তুমি যে হঠাৎ কাজের বোঝা চাপিয়ে দিলে মাথায়। তার বেলা? কেন? ছেলেদেরকেই সংসারের সমস্ত কাজ করতে হবে কেন?
– কারন এটাই নিয়ম। ছোটো বেলা থেকে এটাই দেখে এসেছি। আমার বাবা সংসারের কাজ করছে। মা অফিস যাচ্ছে। আমার দাদুর সময়েও তাই। হঠাৎ করে তোমরা ছেলেরা Ultramodern হতে চেয়ে সব পালটে দিতে চাইলে কী করে হবে?
– আরে যেটা ভুল সেটা পাল্টাবে না? সে তো পতীদাহ প্রথার মত একটা Tradition চলে আসছিল কত দিন ধরে। সবাই ভাবছিল ওটাই ঠিক। তারপর তো বন্ধ করা হল সেটা।
– কোথা থেকে আমার রানী রাজমোহিনী রায় এলেন রে!
– তুমি কি কোনোদিন বুঝবে না? কেনো ছেলেরা বাড়ির কাজ করবে? কেন মেয়েরা রান্নাঘরে ঢুকবে না? আমাদের কি চাকরি করতে ইচ্ছে করে না?
– চাকরি করতে ইচ্ছে করলেই তো হবে না? নাইট ডিউটি দিলে কীভাবে করবে শুনি?
– মানে? তুমি নাইট ডিউটি করো না?
– আমি তো মেয়ে! একা একটা ছেলে রাত্রে অফিস থেকে ফিরবে। রাস্তায় কিছু হয়ে গেলে? একদম সেফ না ওসব। তার চেয়ে তোমরা বরং বাড়িতেই থাকো।
– সেটাই। আমাদের বাড়িতে রাখতেই তো তোমাদের যত আনন্দ। সাজিয়ে রাখার জিনিস তো আমরা।
– উফফ! এতো মহা ঝামেলা হল! বিয়ের সময় ভাবিনি এত বাওয়াল দেবে তুমি সংসারে এসে।
– আমিও ভাবিনি। বিয়ের পর ছেলেরা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্বশুর শাশুড়িকে নিজের বাবা-মায়ের মত আপন করে নেয়। আমিও তাই করেছিলাম। কিন্তু তোমার মা বাবা যা এক একটা পিস! বাপরে!
– শোনো মা বাবা তুলে কথা বলবে না।
– কেন বলব না? তুমি বলো না?
– আমার বলার কারণ রয়েছে। বিয়ের সময় কত করে বললাম যে পুত্রপন-টন আমাদের লাগবে না। শুধু লাখ পঞ্চাশেক টাকা আর একটা গাড়ি দিলেই আমরা খুশি। কিন্তু যা একখানা গাড়ি দিল তোমার মা! ওটা নিয়ে রাস্তায় বেরোনো যায় নাকি?
– সেটা নিয়ে তো তোমার মা কথা শুনিয়েছে অলরেডি। আমার বাবা কে কাঁদতে হয়েছে তোমার মায়ের কথা শুনে। এখনও ওটা নিয়ে শোনাবে?
– আরে ওসব কে শোনাচ্ছে? শুধু বলেছিলাম আজ ভাতটা একটু আগে দিতে। তুমিই তো কথা শোনাতে শুরু করলে!
– আমি পারব না। আমি আর এই সংসারে থাকব না। আমি আজকেই মায়ের বাড়ি চলে যাবো!
– বেশ তো যাও না। আটকাচ্ছে কে?
[ফিলার]
– শোনো, সরষের তেল শেষ হয়ে গেল আজ। কাল নিয়ে আসবে।
– হুম নিয়ে আসব। রেগে আছো?
– না।
– আরে রেগে যেও না। দেখো এভাবেই তো হয়ে আসছে সব। ছেলেরা রান্নাঘরে থাকবে। আর মেয়েরা বাইরে। মানতে না চাইলেও এটাই সত্যি। এই নারীশাসিত সমাজের নিয়ম তো এটাই।
– দেখো নিয়ম পাল্টাতে বলছি না। শুধু বলছি সমান অধিকারের কথা! এটা কি খুব অন্যায়।
– দেখো একটা প্রকান্ড সমুদ্র থেকে এক বালতি জল তুলে নিলে সমুদ্রের জলের পরিমান কী একটুও কমে বলে মনে হয়? আমি একা ভাবলে তো হবে না। এই পরিবর্তন টার কথা সবাই কে ভাবতেই হবে।
– কিন্তু আজকাল অনেক ছেলেই তো মেয়েদের কাজ করছে। অফিস যাচ্ছে। তার পাশাপাশি আবার সংসারও করছে।
– জানি করছে। কিন্তু তুমি জানো, আমার মা-বাবা এসব মেনে নেবেন না। যে সংসারের যেমন নিয়ম।

– একটা সিগারেট দিন না দিদি।
– কি? সিগারেট?
– হ্যাঁ, একটা সিলভার ফ্লেক দেবেন।
– মানে টা কি? আপনি একটা ছেলে হয়ে সিগারেট খাবেন?
– হ্যাঁ, মানে কেন খাব না? একটা সিগারেট খাওয়ার জন্যে সেক্স চেঞ্জ করে মেয়ে হতে হবে নাকি? আর তাছাড়া সিগারেটের প্যাকেটে কি Only for women লেখা আছে নাকি?
– ছিঃ ছিঃ ছিঃ! সত্যি আজকালকার এইসব ছেলেগুলোর জন্যই আমাদের সমাজটা পুরো রসাতলে গেল। শেষ করে দিল সব কিছু এরা এইসব করে। ছেলে হয়ে জন্মেছে, কোথায় বাড়িতে স্ত্রী সন্তানের জন্য নতুন নতুন রান্না করবে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করবে তা না জিন্স-টি-শার্ট গলিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে পড়ল সিগারেট খেতে। সত্যিই কিছু বলার ভাষা নেই আর এদের।
– দিদি, আপনি এসব কি বলছেন? সমস্যাটা কি আপনার?
– কিইই? সমস্যাটা কি আমার? লজ্জা করেনা একটা ছেলে হয়ে মেয়েদের মত সিগারেট টানতে? মুখে মুখে তর্ক হচ্ছে আবার? ছিঃ ছিঃ এটুকু ভদ্রতা শেখায়নি বাবা মা যে একটা মেয়ের কখনো মুখে মুখে কথা বলা উচিত না? সত্যি আরো কত কি যে দেখতে হবে এই জীবনে কে জানে।
– উফফ! আপনি কি দেবেন?
– নাহ। দেবো না। বাড়ি গিয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বসে থাকবে যাও। একজন আদর্শ স্বামী তাই করে।

– হ্যালো,
– হ্যাঁ বলো।
– কথা আছে তোমার সাথে।
– হ্যাঁ বলো না, কি কথা?
– না এভাবে ফোনে বলা যাবে না, জরুরী কথা।
– আচ্ছা আমি আধ ঘন্টার মধ্যে তোমার কলেজে আসছি।
– ওকে।

* * *

– হ্যাঁ বলো, কি জন্য এমন জরুরী তলব?
– শোনো, বিয়ে করতে পারবে আমায়?
– কি? বিয়ে? কি বলছ তুমি এখন এসব?
– মানে?
– দেখো, তুমি তো জানো আমি তোমায় ভালোবাসি আর তোমাকেই বিয়ে করব।
– তাই? তাহলে কবে বিয়ে করছি আমরা?
– হোয়াট? এখন কি করে এসব বলব? দেখো তুমি তো জানো আমার পরিবারের কথা, জানো তো আমার মা চলে যাওয়ার পর কিভাবে আমি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। জানো তো বাবা একা হাতে কত কষ্ট করে আমার আর ভাইয়ের জন্য। বাবা কে দেখতে হবে, ভাইয়ের একটা বিয়ে দিতে হবে, তার আগে আমি আমার বিয়ের কথা স্বার্থপরের মত কিভাবে ভাবি তুমি-ই বল?
– শোনো এত কিছু আমি জানি না। এভাবে আমাদের একসাথে থাকা তাহলে আর সম্ভব নয়।
– কি বলছ কি তুমি এসব?
– হ্যাঁ, ঠিক-ই বলছি আমি। দেখো, আমার-ও তো পরিবার আছে, মা-বাবা আছে। আমাকে তাদের কথা-ও তো ভাবতে হবে। তুমি জানো আমার মা-বাবা কিভাবে উঠে পড়ে লেগেছে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য? জানো প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমাকে পাঞ্জাবী পরে মুখে রঙ মেখে চা-এর ট্রে নিয়ে যেতে হয় পাত্রীপক্ষের সামনে? জানো এর মধ্যে প্রায় তিন-চার জন মেয়ের বাড়ি থেকে আমায় দেখে গেছে, একজন তো বিয়ের যৌতুক নিয়ে পর্যন্ত কথা বলেছে, বলেছে পাকা কথা বলতে আসবে, জানো এসব?
– কি বলছ কি তুমি এসব? তুমি এরম করবে? তুমি সত্যি-ই আমায় ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করতে পারবে?
– পারব। দেখো, কুড়ি বছর বয়স তো হয়ে গেলো আমার, আর কত দিন বল? আর কত দিন আমার মা-বাবা একটা আইবুড়ো ছেলেকে এভাবে ঘরে বসিয়ে রাখবে? আর মা-বাবা-ই বা কি করবে বল? আশেপাশের লোকজন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনরা কি বলবে? তারা তো এখন-ই নানান কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। আমার মা-বাবার সম্মান থাকবে এভাবে?
– দেখো, তুমি একটু শান্ত হয়ে আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর। আমি তো এখন বেকার, কিভাবে আমি এখন বিয়ে করি বল? আর দু’টো বছর সময় দাও আমায়, আমি একটা ভালো চাকরী পেলেই তোমায় বিয়ে করব বিশ্বাস কর।
– তাই? ভালো চাকরী? সরকারী চাকরী? সরকারী চাকরী পাবে তো তুমি?
– সরকারী চাকরী?
– হ্যাঁ, সরকারী চাকরী। জানোই তো আমার মা-বাবা সরকারী চাকুরীরতা মেয়ের সাথেই আমার বিয়ে দেবে। কাজেই তুমি সরকারী চাকরী না পেলে আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা কোনো মতেই সম্ভব না।

– ম্যাম আমার একটা কথা বলার ছিল।
– আরে বোসো বোস। বলো কি ব্যাপার?
– বলছিলাম যে… আমার যে প্রোমোশন টা হল সম্প্রতি। ম্যানেজারের পোস্টে। ওটা নিয়েই কথা বলতে চাইছিলাম।
– কি বলো!
– বলছিলাম যে শ্রুতি দি যখন প্রোমোশন পেয়েছিল তখন প্রায় ৪০,০০০ টাকা বেতন পেতো। আমার ক্ষেত্রে কেন ওটা ৩০,০০০ টাকা?
– দেখো, তুমি তো একজন ছেলে। কাজেই এটা স্বাভাবিক যে একজন মেয়ের সমান বেতন তুমি পাবে না। এটাই তো হয়ে আসছে।
– আপনারা এভাবে ছেলে মেয়ে আলাদা করে কেন দেখেন? ছেলে ও মেয়েদের সমান অধিকারের কথা বলা হচ্ছে সব জায়গায়। তারপরেও কেন করেন এরকম আপনারা?
– ছেলে মেয়েদের সমান অধিকার? ওসব থিওরিতেই সম্ভব ভাই। বাস্তবায়িত কখনও হবে না।
– কেন হবে না?
– তুমি রাত্রে ওভারটাইম কাজ করতে পারবে কী? তোমার মা-বাবা বা স্বামী সেটা অ্যালাউ করবে কখনও? তুমি অফিসের Business Trip এ বিদেশে যেতে পারবে একা একা? পারবে না। একটা ছেলে কখনও একা একা এসব পারে না। সুতরাং মেয়েদের সমান স্যালারি এক্সপেক্টও কোরো না।

উলটপুরান

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি