।। আমার কথা ।।

দেবীদের মধ্যে মা সরস্বতীকে দেখতে নাকি সবথেকে সুন্দর। জানিনা এটা কার কথা। তবে যেই বলে থাকুক একদম ঠিক কথা বলেছে। আর সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হল এনার মানুষের মত ২ টো হাত রয়েছে। একগাদা হাত নিয়ে অন্য দেব-দেবীগুলো যে কি করে কে জানে। এই যে মা দূর্গা দশখানা হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এতে যে ওনাকে দেখতে কতটা বাজে লাগে তা যদি উনি জানতেন তাহলে হয়ত বাকি ৮ টা হাত ডাস্টবিনে ফেলে দিতেন।
“ওই তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? ওদিকে কত কাজ বাকি জানিস? আর এক ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হবে।”
চিন্তার তার কাটল। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম কথাটা বলেছে রুদ্র। কোমরে হাত দিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।
তাই তো। আর এক ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু। আর আমি একা একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরস্বতী বন্দনা করছি। হেসে বললাম “যাচ্ছি। চল।”
রুদ্র কুঁচকানো ভুরু নিয়ে চলে গেল। আমি এগোলাম ওর পেছন পেছন।
আচ্ছা এখানে একটু ব্যাকগ্রাউন্ডটা দিয়ে দিই। নাহলে বুঝতে সমস্যা হবে পাঠকদের। 

আমার নাম অনিরুদ্ধ । অনিরুদ্ধ রায়। আর ওই যে আমায় ডেকে গেল ভুরু কুঁচকানো ছেলেটা ওর নাম রুদ্রদেব। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আজ সরস্বতী পূজোয় আমাদের স্কুলে একটা প্রাক্তনী পুনর্মিলনের আয়োজন করা হয়েছে। মানে যাকে বলে ‘রিউনিয়ন’ । আমরাও প্রাক্তনী যদিও। গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গিয়েছি। তাও আমরা কমিটিতে রয়েছি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তবে আমার ভূমিকাটা একটু গুরুত্বপূর্ণ আজ। আমি আজ এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। সমস্ত প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের আমন্ত্রন পত্র পাঠানো হয়েছে। অনেকেই এসে গিয়েছে। সন্ধ্যে ৬ টায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা। এখন বাজে ৫ টা পাঁচ।
এগিয়ে গেলাম স্টেজের দিকে। রুদ্র ফোনে উত্তেজিতভাবে কাউকে কিছু একটা বলছে। মনে হয় কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। নাহলে রুদ্র অতটা চাপ খাওয়ার ছেলে তো নয়।
“কি হয়েছে রে?” কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম রুদ্রকে।
ওর ফরসা মুখটা পুরো লাল হয়ে গেছে। ও বলল, “ আরে সব ঘেঁটে ঘ। কফি হাউস থেকে ফোন করেছিল। বলল আমরা যে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেনের অর্ডার দিয়েছিলাম তার থেকে ৫০ টা কম রেডি হয়েছে। ওর বেশি ওরা আজ দিতে পারবেনা। কি যাচ্ছেতাই পাবলিক ভাব একবার। একটা দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নেই!”
বললাম , “এতে এত চাপ খাওয়ার কি আছে?”
“মানে? কি বলছিস রে তুই? আর এক ঘন্টা বাদে অনুষ্ঠান শুরু। সবাই এসে  গিয়েছে প্রায়। এখন ৫০ টা ফ্রায়েড রাইস কোথা থেকে পাব?”
বুঝতেই পারলাম ওর মাথাটা গিয়েছে আজ কাজের চাপে। নয়ত এত সামান্য ব্যাপারে ও টেনশন করত না। আমি বললাম, “গনেশ টী হাউস আর আবির্ভাব হোটেল এর নাম্বার দিচ্ছি। ফোন কর। ২ টো রেস্টুরেন্ট থেকে মোট ৫০ টা পেয়ে যাবি। আর চিলি চিকেনও ওখানে পাবি।”
রুদ্র আমার দিকে একটু অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “এ ব্যাপারটা আমার মাথায় এলনা কেন আগে?”
“কারন তুই একটা ইডিয়ট।” একটু চমকে তাকিয়ে দেখলাম কথাটা বলেছেন সুর্যবাবু। আমাদের ফিজিক্সের স্যার। আমার খুব ভাল লাগে ওনাকে। সেটা হয়ত আমাকে একটু বেশি ভালবাসেন বলেই।
রুদ্র বলল, “না মানে স্যার…”
“আর স্যার স্যার করতে হবেনা। ফোন কর আগে।” তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “ কি অনিরুদ্ধ সব ঠিকঠাক তো?”
ঠিকঠাকই থাকত যদি না সেই মুহুর্তে স্কুলের গেট দিয়ে ওকে ঢুকতে দেখতাম। কিছুক্ষনের জন্য চোখের সামনে বাকি সবকিছুই যেন ঝাপসা হয়ে গেল। শাড়ি পড়েছে ও আজ। ভদ্রতা ভুলে গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ভুলেই গেলাম কয়েক মুহুর্তের জন্যে যে ওর সাথে আমার সম্পর্ক ৬ মাস আগে শেষ হয়ে গিয়েছে।
কাঁধে শক্ত হাত পড়তেই চমকে উঠলাম। “তোমার শরীর ঠিক আছে তো?” সূর্যস্যারের প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলাম।
“হ্যাঁ স্যার।”
“ঠিক আছে। ভালভাবে প্রোগ্রাম করো। তোমার অ্যাঙ্করিং আমি আগে দেখেছি। খুব ভাল লেগেছিল। আশা করি এবারে হতাশ করবে না।”
আর অ্যাঙ্করিং! আমি তখন দেখছি আমার সরস্বতীটাকে। বাসন্তী রঙ এর একটা শাড়ি পরে এসেছে আজ ও। সাথে দেখলাম ভাইকেও নিয়ে এসেছে। ওর ভাইটা খুব মিষ্টি দেখতে। এই স্কুলেই পড়ে ক্লাস সিক্সে। ছেলেটা আগে খুব বকবক করত আমার সাথে। এখন আর কথা বলেনা। দিদির বারণ আছে হয়ত।
যাই হোক দায়সারা গোছের একটা হাসি দিয়ে স্যারকে বিদায় করলাম। আগেরবার যখন স্কুলের সরস্বতী পূজোর অনুষ্ঠানে এসেছিলাম ও আমার পাঞ্জাবীটা দেখে বলেছিল আমায় নাকি দারুন লাগছে। আজকে কি একবারও দেখবেনা আমার দিকে ও। আজ কি কিছুই বলবেনা আমাকে? নাহ ওই আশা করে লাভ নেই। ঘড়িতে দেখলাম ৫ টা কুড়ি বাজে। একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছিল। স্কুলের ছাদে চলে গেলাম আমি। ওই জায়গাটায় বেশি কেউ আসেনা।

সায়ন্তনী। সায়ন্তনী রায়চৌধুরী আমার সরস্বতীর নাম। ইয়ে মানে এক্স-সরস্বতী আর কি। ক্লাস ইলেভেনে আমাদের সম্পর্ক হয়। বন্ধুত্ব তারও দু বছর আগে থেকে। বেশ ভালই চলছিল। মাস ছয়েক আগে হঠাৎ ও একদিন সকালে ফোন  করে ওর বাড়িতে ডাকে আমায়। বলে ওর বাবার শরীরটা নাকি খুব খারাপ হয়েছে হঠাৎ। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। আগেও ওর  বাড়িতে গিয়েছি আমি। কিন্তু সেদিন ওর গলাটা একটু অন্যরকম শোনাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি করে বেরোতে যাচ্ছি এরকম সময় হঠাৎ ওপরের ছাদে একটা জোর আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি মা পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। আসলে ছাদের পাশেই আমাদের ঠাকুরঘর। আর সকালের এই সময়টা মা ঠাকুর ঘরেই থাকে। বৃষ্টিতেই এই বিপত্তিটা হয়েছে বুঝতে পারলাম। বাবা আর আমি মিলে কোনোরকমে মাকে ধরে ছাদ থেকে নামিয়ে আনি। কাজেই বেরোতে অনেকটা দেরী হয়ে যায় আমার। সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি ওর বাড়িতে গিয়ে দেখি। ওর বাড়িতে চাবি। পরে জানতে পারি ওর বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হয়েছে। ওর বাবা মারা যান ওর দুদিন পরেই। তারপর একদিন আমি ফোন করতে ও আমায় বলেছিল, “জীবনে যদি দায়িত্ব নিতে না শিখিস কোনোদিন বড় হতে পারবিনা। আর দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো ছেলের সাথে আমি কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিসনা আর।” আমার কোনো কথাই সেদিন ও শোনেনি। তারপর যে কারনেই হোক আমি আর ওর সাথে যোগাযোগ করিনি। আসলে আত্মসম্মানবোধটা আমার চিরকালই একটু বেশি মাত্রায়। সেই জন্যেই হয়ত আর কথা হয়নি দু’জনের। রাস্তায় কয়েকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু ও ওর মত চলে যায় আর আমি আমার মত।
“বৃষ্টি হবে নাকি বল তো?” স্মৃতিগুলো আবার হারিয়ে গেল রুদ্রর গলা পেয়ে। আমি এখন আমাদের স্কুলেরই ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। রুদ্র আমায় খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে এখানে। আকাশটার দিকে তাকালাম। কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। শীতকাল তো। তাই তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে গেছে। তবে একটা তারাও দেখা যাচ্ছেনা।
“সায়ন্তনী এসেছে দেখেছিস?”
ঘাড় নাড়লাম কিছু না বলে। ও এসেছে আমি দেখব না তা হয়?
“তুই ওকে সব বলে দে না। আমার মনে হয় একদিন কথা বললেই সব সমস্যা মিটে যাবে।”
ওর কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ক’টা বাজে রে?”
“পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ।”
“চল এবার নামা যাক। অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে তো।” জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম আমি।
রুদ্র ঘাড় নেড়ে বলল, “হুম চল।”
ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখে পড়ল স্টেজের উল্টো দিকের বিল্ডিংএর বারান্দার দিকে। ওখানে ৪ টে ছেলে আর একটা বাচ্চামত ছেলেকে কি যেন বলছে। বাচ্চাটাকে আমার খুব চেনা লাগল। পরক্ষনেই চিনতে পারলাম ছেলেটাকে। আরে! ওটা তো রাজ। সায়ন্তনীর ভাই। ও ওখানে কি করছে এই সময়?
“রুদ্র, তুই যা আমি আসছি”  বলে আমি এগিয়ে গেলাম ওই বারান্দার দিকে।

।। রাজের কথা ।।

রাজের একটা জিনিস মাথায় ঢোকেনা বন্ধুদেরকে দেখলে কেউ কি করে কথা না বলে থাকতে পারে। ও তো কখনো পারেনা এরকম করতে। বিশেষ করে যদি বেস্ট ফ্রেণ্ড হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই যেমন দিদি একটা সময় কথায় কথায় মা’কে ‘জানো মা অনি এই বলেছে, অনি সেই বলেছে’ করত। কিন্তু এখন অনিরুদ্ধদাকে দেখলে এমন ভাব করে যেন চেনেইনা। ঠিক আছে বাপু। তুই কথা বলবি না বলবি না। কিন্তু আমায় তো কথা বলতে দে। তাও দেবেনা।
আজ বেরোবার আগে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে “দেখ ভাই, ওখানে অনিরুদ্ধ থাকবে। একদম লাফালাফি করবিনা ওকে দেখে। আর কথাও বলতে হবেনা ওর সাথে”
“কেন রে? কথা বলবনা কেন?” পালটা প্রশ্ন করেছিল রাজ।
“আমি বারন করছি তাই। যদি কথা না শুনিস ঘরে রেখে দিয়ে যাব। আজ সরস্বতীপূজোয় ঘরে বসে থাকতে তোর ভাল লাগবে তো?”
গম্ভীর মুখ করে রাজ বলেছিল, “ঠিক আছে বলব না চল।”
দিদি আর কিছু বলেনি। স্কুলে এসে থেকে ব্যাজার মুখ করে বসে আছে চেয়ারে। অনিরুদ্ধদাকে কয়েকবার অবশ্য দেখেছে রাজ। একটা সবুজ পাঞ্জাবী পরেছে আজ ও। দারুন স্মার্ট লাগছে আজ অনিদাকে। কিন্তু দিদির সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই। কিছু বলতেও পারছে না ও ভয়ে। যদি দিদি বাড়িতে রেখে দিয়ে চলে আসে তাহলে ব্যাপারটা চাপের হয়ে যাবে। চেয়ারে বসে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল ও। তারপর একজন স্যারকে দেখল ওদের দিকে এগিয়ে আসত। এই স্যারটাকে চেনে ও। তবে নামটা জানেনা। একটু আগেই অনিদার সাথে কথা বলতে দেখেছে।
দিদি স্যারকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে।
“আরে দাঁড়াতে হবেনা। আমি কি ক্লাস করতে আসছি নাকি? কেমন আছ বল?” স্যার বললেন দিদির দিকে তাকিয়ে।
দিদি বলল, “ভাল আছি স্যার। আপনি ভাল আছেন?”
“ওই চলে যাচ্ছে। আজ তো তোমার বন্ধু অ্যাঙ্করিং করছে। অনিরুদ্ধ”
চট করে দিদির মুখটার দিকে একবার তাকাল রাজ। একটু শুকনো লাগল কি?
দিদি কিছু না বলে শুধু হাসল।
“ঠিক আছে। এনজয় কর আজ। আজ তোমাদেরই দিন।” বলে স্যার চলে গেলেন।
রাজ এর আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। কতক্ষন এভাবে বসে থাকা যায়। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো আধঘন্টার মত বাকি।
ও বলল, “ দিদি আমি একটু ঘুরে আসছি।”
দিদি তখন কি যেন ভাবছিল। অন্যমনস্কভাবে শুধু ঘাড় নেড়ে দিল। চেয়ার থেকে নেমে ও চলে গেল স্কুলের পুরোনো বিল্ডিং এর দিকে। ওদিকটার বারান্দায় ও আর ওর ক্লাসের বন্ধুরা মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলে। একটা কাঠের টুকরোকে ব্যাট বানিয়ে খেলা চলে ওদের। বারান্দায় গিয়ে সেই টুকরোটাই খোঁজার চেষ্টা করছিল রাজ।
“কি খুঁজছিস বে?” হঠাৎ অচেনা গলার আওয়াজ শুনে পেছনে তাকাল ও। দেখল চারটে লম্বামতন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে।
ও বলল “কিছু না।”
ও পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। একটা ছেলে হঠাৎ ওর রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, “এই তুই সায়ন্তনীর ভাই না?”
ছেলেটার মুখ থেকে খুব বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে। গুটখা জাতীয় কিছু খাচ্ছে বোধহয়।
ও খুব স্মার্টলি উত্তর দিল, “হুম। তো?”
আর একজন পাশ থেকে বলল, “আচ্ছা তোর দিদির সাথে তো ওই ঢ্যাঙা মালটার আর লাফড়া নেই। তাও আমাদেরকে পাত্তা দেয়না কেন বলত তোর দিদিটা?”
পাশের দুটো ছেলে খিক খিক করে হাসল ওই ছেলেটার কথা শুনে।
মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল রাজের। কি অসভ্য ছেলে রে বাবা।
ও বলল, “তোমরা পাত্তা দেওয়ার যোগ্য হলে নিশ্চয় দিত।”
ওদের একজন বলল, “শালা লিলিপুট একটা চড় মারব জানিস? খুব তেজ না তোর?”
সেই সময় অন্ধকার ফুঁড়ে যেন উদয় হল আর একজন।
সে রাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “ এই সময় এখানে কি করছিস? নিচে চল।”
অনিদা। রাজ ওকে দেখেই ছুটে গিয়ে হাতটা  ধরে ফেললা ওর।  তারপর ফিরে তাকাল সেই চারজনের দিকে। ভাবটা এরকম ‘এবার কর কি করবি!’
তারপর অনিদার হাত ধরে ও নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
“কি করছিলি তুই ওখানে?” অনিরুদ্ধ প্রশ্ন করল ওকে।
“কিছু না এমনি ঘুরছিলাম। আচ্ছা, তুমি আজ অ্যাঙ্করিং করবে?”
অনিরুদ্ধ হেসে বলল, “হ্যাঁরে। তোকে কে বলল?”
“ওই একজন জড়বিজ্ঞানের স্যার। দিদিকে বলছিল। আমি শুনলাম।”
আর কিছু বললনা অনিরুদ্ধ।
রাজ দেখল দিদি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আর একটা মোটামতন ছেলে আছে দিদির সাথে। ছেলেটাকে ও চেনে। ও অনিরুদ্ধদার বন্ধু। রুদ্রদা।
ওকে দেখেই রুদ্রদা বলল, “আরে এই তো রাজ।”
তারপর অনিরুদ্ধদা ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে দিদিকে বলল, “ভাইকে যখন এনেছিস তখন একটু দায়িত্ব নিয়ে সামলা।” তারপর চলে গেল স্টেজের দিকে।
রাজ দেখল দিদি তাকিয়ে আছে অনিরুদ্ধদার চলে যাওয়ার দিকে।

।। আবার আমি ।।
আমাদের অনুষ্ঠান জমে গিয়েছে। প্রথমে উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল। ওখানে গাওয়া হল “পুরানো সেই দিনের কথা।” যেহেতু ‘রিউনিয়ন’ তাই এই গানটাই বেছেছিলাম আমরা। ঘটনাটা ঘটল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার এক ঘন্টা পর। আমি ঘোষনা করলাম “এরপর  মঞ্চে গান গাইবে আমাদের স্কুলেরই একজন প্রাক্তনী মৌমিতা দি।”
তারপর নেমে এসে দাঁড়ালাম স্টেজের পেছনটায়। এই জায়গাটা একটু অন্ধকার। তবু ওখানেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি।
“খুব ভাল লাগছে আজ।” হঠাৎ পেছনে অনেকদিনের সেই চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকালাম। পৃথিবীটা একটু নড়ে গেল কি? মনের ভেতর একসাথে কতগুলো যে হাতুড়ির আওয়াজ হচ্ছিল অনেক ভেবেও বুঝতে পারলাম না। কারন? কারন আর কিছুই নয় আমার সরস্বতী সায়ন্তনী দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোনটা? আমাকে না অ্যাঙ্করিং?”
উত্তর এল , “অ্যাঙ্করিং” তারপর একটু থেমে বলল “তোকে শুধু ভাল বললে ভাল শব্দটার অপমান করা হবে।”
এটা বলে আমাকে অপমান করল না প্রশংসা করল সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
শুনতে পাচ্ছি স্টেজে তখন মৌমিতা দি শুরু করেছে “মোর বীনা ওঠে কোন সুরে বাজে…”
সরস্বতী পূজোর জন্য পারফেক্ট গান। এদিকে আমার সরস্বতী এগিয়ে এল আমার দিকে।
হাতটা ধরল আমার।
আমি চট করে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলাম। নাহ! কেউ নেই। নিশ্চিন্ত মনে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললাম।
অনেকদিন পর আমার খুব চেনা দুটো ঠোঁট ছুঁয়ে গেল আমার কপালটা। ঠান্ডা এক ফোঁটা জল পড়ল আমার গালে। বৃষ্টি কি?

মনে পড়লে

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


One thought on “মনে পড়লে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি