মিস কল টা দেখে একটু অবাক হল শুভংকর। আসলে মধুরিমা যে কখনও আর ওর সাথে যোগাযোগ করবে ও সেটা স্বপ্নেও ভাবে নি। প্রায় সাত মাস মত হয়ে গিয়েছে ওদের সব শেষ হয়েছে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড দোষী মনে হয় শুভংকরের। ওরকম টা না করলেই হয়তো পারত ও। কিন্তু ওই বা কী করবে। মধুরিমার তো ওই সময় বাইরে যাওয়ার কথা ছিল।

আবার ফোন টা বেজে উঠল। কয়েক সেকেন্ড একটু ভেবে নিয়ে ফোন টা ধরল শুভংকর।

–       হ্যালো

–       আমি বলছি।

–       হ্যাঁ নাম্বার সেভ আছে। বল।

–       কেমন আছিস?

–       ভালো রে। তুই?

–       সত্যি বলব না মিথ্যে?

মধুরিমার এই কথাটা শোনার পর একটু চুপ করে গেল শুভংকর। এর কি উত্তর হয়। ও জানে যদি মধুরিমা সত্যি বলে তাহলে ওর নিজেকে আরও বড় অপরাধী মনে হবে।

মধুরিমা আবার নিজেই বলল, “ঠিক আছে ছাড়। তোকে awkward পরিস্থিতিতে ফেলতে আমি ফোন করিনি।”

শুভংকর  বলল, “কী খবর তোর? কী করছিস এখন?”

মধুরিমা বলল, “ওই তো যা করছিলাম। চাকরি।”

–       IBM এ?

–       হ্যাঁ। তবে আমার সম্প্রতি প্রোমোশন হয়েছে। আমার অফিস এখন পার্ক স্ট্রীটে।

–       ওহ সল্টলেক এ আর যেতে হয় না তাহলে?

–       নাহ!

–       হুম।

কিছুক্ষন আবার দু’জনেই চুপ। আসলে শুভংকর বুঝতে পারছে না মধুরিমা আজ হঠাৎ কেন ফোন করেছে। ও তো শেষ বার বলেছিল শুভংকরের মুখও দেখতে চায় না। দোষ টা অবশ্য শুভংকরেরই। সেদিন রাত্রে…

“বলছিলাম যে, Avengers: Infinity War দেখলি?” জিজ্ঞেস করল মধুরিমা।

শুভংকর বলল, “হ্যাঁ। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। তুই?”

মধুরিমা বলল, “না রে। দেখা হয় নি।”

–       মানে? কেন? তুই মার্ভেল এর সিনেমা মিস করেছিস! ভাবতেই পারছি না যে!

–       আসলে পার্টনার পাইনি রে। তুই কার সাথে গিয়েছিলি?

এই প্রশ্ন টার উত্তর দেওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবছে শুভংকর। নতুন গার্লফ্রেন্ডের কথা বলা কী ঠিক হবে?

শুভংকর বলল, “আমি ওই… ইয়ে… আসলে…

মধুরিমা বলল, “ওহ আচ্ছা বুঝেছি। ওই মেয়েটার সাথে? যার সাথে দেখা হল আমার ফ্ল্যাটে?”

ধুর! বড্ড ঝামেলার পুরো বিষয়টা। কেন বার বার ওই টপিক টা টেনে আনছে মধুরিমা। ঠিক আছে। ভুল তো হতেই পারে। তাই বলে কী move on করা যায় না?

শুভংকর বলল, “তুই একা গেলি না কেন? Infinity War দেখার জন্য কোন পার্টনার লাগে নাকি?”

–       জানিনা। আসলে বহুদিন থেকে তোর সাথে প্ল্যান করেছিলাম যাবো বলে। কিন্তু যাওয়ার কথা মাথায় এলেই ওই ঘটনা টা মনে পড়ত। তাই আর ইচ্ছে করত না।

–       হুম। তোর আপত্তি না থাকলে আমি যেতে পারি তোর সাথে।

–       আমার সাথে?

–       হুম। যদি তোর চাপ না হয় এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে সিনেমা দেখতে যেতে!

–       আমার কীসের চাপ? কিন্তু তোর গার্লফ্রেন্ড? মানে এখনকার গার্লফ্রেন্ড রাগ করবে না।

শুভংকর বলল, “দেখ, আমি সব কথা যেচে যেচে বলতে যাই না ওকে। আর ও জানতে চায় না। কাজেই… আমি যেতেই পারি। আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধে নেই।”

মধুরিমা একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। কাল যাবি?”

–       কাল?

–       হ্যাঁ? কেন? চাপ আছে?

–       নাহ। চাপ নেই। যেতেই পারি।

–       তাহলে কিন্তু সন্ধ্যের শো তে যেতে হবে। আমার অফিসের পর।

–       তাতে আমার অসুবিধে নেই। আমি দেখে নিচ্ছি ক’টায় শো।

“ঠিক আছে তাই দেখ। আর – ” পরের কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মধুরিমা।

শুভংকর জিজ্ঞেস করল, “আর?”

মধুরিমা একটু থেমে বলল, “আর তোর ইচ্ছে হলে আমার দমদমের ফ্ল্যাটে থেকে যেতে পারিস। রাত্রে যদি ফিরতে না ইচ্ছে করে।”

শুভংকরের খুব ভালো লাগল কথাটা শুনে। তার সাথে সাথে নিজের ওপর রাগ টাও আর একটু বাড়ল। কী করে এই মেয়েটাকে ছেড়ে ও অন্য মেয়ের দিকে ছুটতে গেল? কেনই বা গেল?

ও বলল, “আচ্ছা বেশ। তাই হবে।”

সন্ধ্যে ৭ টায় New Empire এ একটা শো ছিল। ওটা দেখে শুভংকর আর মধুরিমা যখন বেরোলো। তখন বাজে প্রায় সাড়ে ৯ টা। টিকিট টা শুভংকরই কেটেছিল। ও ঠিক করেছে আজ মধুরিমা কে ডিনার ট্রীট টা ওই দেবে। ও যা করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ব হিসেবে এই টুকু টাকা খরচা কিছুই না।

সিনেমা দেখে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মধুরিমা জিজ্ঞেস করল, “কিছু ঠিক করলি?”

শুভংকর বলল, “কী ব্যাপারে?”

–       ওই যে? রাত্রে থাকার ব্যাপারে?

–       সে তো কালকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম।

–       কী ঠিক করলি? থাকবি আমার ফ্ল্যাটে?

–       হ্যাঁ। থাকবো। তবে একটা শর্তে।

–       কি শর্ত?

–       আজ আমি ট্রীট দেবো।

–       কেন?

–       এমনি। আমার ইচ্ছে।

–       প্রায়শ্চিত্ব করছিস?

কথাটা শুনেই থতমত খেল শুভংকর। মধুরিমা সব সময় ওর মনের কথাটা বুঝে যায়। আগেও তাই হত।

শুভংকর বলল, “আরে না না… আমি আসলে… এমনি ভাবলাম তোকে খাওয়াই…”

কথাটা বলতে বলতেই মধুরিমার জন্মদিনের কথা ভাবছিল শুভংকর। মে মাসেই ওর জন্মদিন। কিন্তু তারিখ টা শুভংকরের মনে পড়ছে না। নাহলে বলা যেত ‘এই তো তোর জন্মদিন সামনে। তাই আমি খাওয়াচ্ছি।’

মধুরিমা আর কিছু বলল না। হাসল শুধু।

শুভংকর ফোন বের করে বলল, “দাঁড়া একটা Ola book করি?”

মধুরিমা বলল, “কেন ভাই? যাবি তো এইটুকু দমদম। আবার Ola কেন?”

–       আরে ধুর! এই গরমে মেট্রোতে যাবো নাকি?

–       ঠিক আছে। Ola কর। কিন্তু আমি টাকা দেবো।

–       বাজে বকিস না। আজ তুই একটা টাকাও দিবি না।

মধুরিমা এবার একটু রেগে গেল, বলল, “নাহ হবে না। আমিও চাকরি করি শুভ। আমিও টাকা দিতে পারি। বয়ফ্রেন্ডের টাকা মেরে খাওয়া আমার স্বভাব না সেটা তুই খুব ভালো করে জানিস।”

শুভ, বয়ফ্রেন্ড এসব কী বলছে মধুরিমা। আচ্ছা সব কি আগের মত হয়ে যাবে আবার? আগে তো মধুরিমা এই নামেই ডাকতো ওকে।

মধুরিমা আবার বলল, “সরি। মাথা গরম করে ফেললাম। কিছু মনে করিস না।”

শুভংকর বলল, “না না ঠিক আছে। চাপ নেই। আমরা মেট্রোতেই যাবো চল।”

মধুরিমা বলল, “অমনি না? যেই দেখলি আমার খরচা হবে সঙ্গে সঙ্গে মেট্রো তে যাবি? হারামি একটা।”

শুভংকর হাসল। কিন্তু কিছু বলল না। মধুরিমা ওকে সত্যিই খুব ভালো চেনে।

* * *

তখন বোধহয় নভেম্বর মাস। অফিসের একটা Trip এ যাওয়ার কথা ছিল মধুরিমার। ওর দমদমের ফ্ল্যাটের একটা চাবি ও দিয়ে রেখেছিল শুভংকর কে। ওদের সম্পর্কের তখন প্রায় ২ বছর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার পাশাপাশি শুভংকরের একটা Affair শুরু হয়েছিল ওর Wipro র অফিসের এক কলিগের সাথে। ও ভেবেও ছিল যে মধুরিমার সাথে সব শেষ করে এই মেয়েটির সাথে নতুন সম্পর্কে যাবে! কিন্তু ওই Affair চলাকালীন খুব বাজে একটা ঘটনা ঘটে!

মধুরিমা সাধারনত খুব লেট করে সব ক্ষেত্রেই। সেদিন দমদমের ওর ফ্ল্যাট থেকে যখন ও বেরোয় তখন অলরেডি বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। ট্রেন সাড়ে ছ’টায় হাওড়া থেকে। এবং as usual কলকাতার জ্যাম ঠেলে মধুরিমা যখন হাওড়া পৌঁছোয় তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।

এদিকে শুভংকর দমদমের ফ্ল্যাট ফাঁকা দেখে ডেকে নিয়েছে ওর প্রনয়ীকে। ফ্ল্যাটের দরজায় গোদরেজ লক লাগানো ছিল। ভেতর থেকে লক না করলে চাবি থাকলে অনায়াসেই বাইরে থেকে খোলা যায় এই ফ্ল্যাটের দরজা। সুতরাং যা ঘটার তাই ঘটল। মধুরিমা চাবি খুলে ফ্ল্যাটে ঢোকার পরে ওই অবস্থায় দু’জন কে দেখে জাস্ট নিতে পারে নি। তারপর –

“কীরে কী ভাবছিস?” মধুরিমার কথায় চিন্তার তার কাটল শুভংকরের।

ধর্মতলা থেকে মেট্রোয় উঠে থেকে শুভংকরের বার বার পুরোনো কথা গুলো মনে পড়ছিল। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছিল। কেন সেদিন ট্রেন টা মিস করল মধুরিমা? কেন তাড়াতাড়ি গেল না?

শুভংকর বলল, “কিছু না।”

একটুক্ষন মধুরিমা জিজ্ঞেস করল, “পুরোনো কথা ভাবছিস?”

সত্যি এই মেয়েটার থেকে কিছু লুকোনোর উপায় নেই। শুভংকর আস্তে আস্তে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

মধুরিমা বলল, “আমিও মাঝে মাঝে ভাবি জানিস। আমারও মনে পড়ে আমার নিজের ঘরে ঢোকার পরের ওই দৃশ্য টা।”

শুভংকর বলল, “I’m sorry”

–       I know you are. কিন্তু আমাকে মাঝে মাঝে ওই দিন টা বড্ড Haunt করে জানিস। কেন করলি এরকম? কেন?

শুভংকর বলল, “আমি জানি না রে। আমি জানি না।”

মধুরিমা বলল, “কত ভালো ছিলাম আমরা দু’জনে! সব শেষ করে দিলি তুই!”

শুভংকর কিছু বলতে পারল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেট্রোয় আজ এত রাতেও বেশ ভীড়। কয়েকদিন আগেই যা সব ঘটল এখানে। ভাবতেই অবাক লাগে ওর। এটা নাকি কলকাতা!

শুভংকর বলল, “আজ রাত্রে কোথায় ডিনার করবি?”

–       তুই বল। বাইরে খেতে ইচ্ছে করছে না আমার!

–       তাহলে বাড়িতে অর্ডার করে নিই? মানে তোর ফ্ল্যাটে।

–       হ্যাঁ। করতেই পারিস।

–       তাহলে এখনই ডমিনোজ এ পিজ্জা অর্ডার করে দিচ্ছি। আধ ঘন্টার মধ্যে তো পৌঁছেই যাবো।

–       হুম। ঠিক আছে।

কথাটা বলেই শুভংকর পিৎজা অর্ডার করে দিল। পে করে দিল অনলাইনেও। নাহলে আবার টাকা দেওয়ার সময় ঝামেলা করবে। মধুরিমা।

বেলগাছিয়া স্টেশন পেরোনোর পর ভীড় টা একটু হালকা হল ট্রেনে।

শুভংকর বলল, “এই তোর Infinity War কেমন লাগল বললি না।”

মধুরিমা বলল, “খুব ভালো লেগেছে রে। আজ তো প্রথম বার না?”

“মানে?” এবার একটু অবাক হল শুভংকর, “তুই আগে দেখেছিস?”

মধুরিমা হেসে বলল, “Yes। একাই দেখেতে গিয়েছিলাম।”

–       তাহলে আমার সাথে আবার গেলি কেন?

–       কেন তুই সেটা বুঝে নে। সব আমাকে বলে দিতে হবে নাকি?

শুভংকরের খুব ভালো লাগল কথাটা শুনে। মেয়েটা সত্যিই ওকে খুব ভালোবাসে।

মধুরিমা এবার ওর কাছে সরে এসে বলল, “By the way, আজ আমার জন্মদিন। ভুলে গেছিস তো?”

শুভংকরের সাথে সাথে মনে পড়ে গেল। তাই তো। আজ তো ৭ই মে। সোমবার। আজকেই তো ওর জন্মদিন। ইসস! কী করে ভুলে গেল ও?

শুভংকর জিভ কেটে বলল, “এই রে। আমি তো গিফট কিনতে ভুলে গিয়েছি তোর জন্য।”

ট্রেন টা তখন দমদম ঢুকছে। মধুরিমা এবার আরও কাছে এসে বলল, “এই তো আমার গিফট্‌।”

কথাটা বলেই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মধুরিমা। তারপর মেট্রোর মধ্যেই ওর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেল সে। তারপর ট্রেন টা থামার সাথে সাথে মেট্রো থেকে নেমে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল মধুরিমা।

শুভংকর ততক্ষনে বুঝতে পেরেছে কি গিফট্‌ এর কথা বলছিল মধুরিমা। কারন ও ততক্ষনে দেখতে পেয়েছে একদল উন্মত্ত জনতা মারমুখী হয়ে আসছে ওর দিকে। সাথে কানে আসছে কিছু গালাগাল! বানচোদ্‌। মেট্রোর মধ্যে অসভ্যতা। মার শালাকে। চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শুভংকর দেখল সাদা চুলওয়ালা পঞ্চাশোর্ধ পাঁচজন বৃদ্ধর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা ‘মব’ টা চড়,থাপ্পড়, কিল মারছে ওকে। তার মাঝখানেও ঝাপসা চোখে ও দেখল মধুরিমা হাসছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে।

সত্যিই প্রতিশোধের থেকে বড় গিফট্‌ আর হয় নাকি?

উপহার

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


2 thoughts on “উপহার

  1. Vbe6ilm ending ta happy hbe…tbe onno type er lglo…R vlobasle keo protisodh nay na…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি