কলকাতার রাস্তায় গাড়ি দিন দিন যেভাবে বাড়ছে তাতে আর বছর খানেকের মধ্যেই যে গাড়ির সংখ্যা মানুষের থেকে বেশী হয়ে উঠবে সে কথা বলাই বাহুল্য। কলকাতার আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল রাস্তা ঘাটে কেউ কারুর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। কে মরল, কে বাঁচল, কে চিৎকার করল তাতে কারুর কিস্যু যায় আসে না, যদি না আপনি কোনো সেলেব্রিটি হন।
একজন বৃদ্ধা কে দেখা গেল গ্র্যান্ড হোটেলের নীচের ফুটপাথ দিয়ে ধর্মতলার ভিড় ঠেলে যাচ্ছেন মেট্রোর দিকে। কিন্তু ওই ফুটপাথে এতটাই ভীড় যে প্রতি দু’ সেকেন্ড ছাড়া কারুর না কারুর সাথে ধাক্কা লাগবেই। বৃদ্ধার হাতে অনেক গুলো প্যাকেট। প্রচুর মার্কেটিং করেছেন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অত প্যাকেট নিয়ে ওই ভীড় ফুটপাথ দিয়ে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল দেখে উনি নেমে এলেন রাস্তার ওপর। সেখানেও বিপত্তি। গাড়িগুলো এমন ভাবে চালাচ্ছে যেন ওই রাস্তায় হাঁটার কোনো অধিকার নেই সাধারন মানুষদের। হঠাৎ একটা হলুদ ট্যাক্সি এমন ভাবে গা ঘেঁষে চলে গেল বৃদ্ধার সে উনি আর টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন মাটিতে। হাতের প্যাকেট গুলো ছিটকে গেল এদিক ওদিক।
আগেই বলেছি এটা কলকাতা। কাজেই সাধারন মানুষের সাহায্য করা দূরে থাক সেদিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত নেই। কারুর যদি সময় থেকেও থাকে তাহলে তার ইচ্ছের অভাব তাকে সাহায্য করতে দিচ্ছে না বলতেই হয়। এমন সময় একটি মাঝবয়সী ছেলেকে হঠাৎ এগিয়ে আসতে দেখা গেল ওই বৃদ্ধার দিকে। ছেলেটি বেশ খানিকক্ষন ধরে বৃদ্ধা কে লক্ষ্য করছিল কী? তা হতে পারে। তবে ছেলেটি এগিয়ে আসে হাত ধরে বৃদ্ধা কে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। তারপর তাঁর হাত থেকে পড়ে যাওয়া প্যাকেট গুলো তুলে দিল তাঁর হাতেই।
বৃদ্ধা বোধহয় খুব খুশি হলেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন ছেলেটিকে। তারপর দু’জন অচেনা মানুষ চলে গেল নিজেদের নিজেদের পথে।

ব্যারিস্টার অদ্বৈত মল্লিক নিজের নাকের ডগায় থাকা চশমাটা ঠিক করলেন। তারপর ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন অভিযুক্ত কে। যেকোনো কেস হাতে নেওয়ার আগেই উনি বুঝে নিতে চান, সেই মানুষ টা দোষী না নির্দোষ। তাহলে কেস লড়তে সুবিধে হয়। অবশ্য দোষী হলেই যে উনি যে কেস ছেড়ে দেন তা নয়। কারন এখানে একটা অর্থনৈতিক লেনদেনের ব্যাপার রয়েছে কাজেই নৈতিকতার ধার ধারলে চলে না।
ব্যারিস্টার মল্লিক গলা ঝেড়ে বললেন, “দেখুন মিস্টার-
“বর্মন… রাজ বর্মন” ভাঙা গলায় বলল ছেলেটি।
“হ্যাঁ… দেখুন মিস্টার বর্মন” বললেন ব্যারিস্টার মল্লিক, “আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আপনার অবস্থাটা এখন ঠিক কীরকম? এই বিপদের হাত থেকে যদি আপনি বাঁচতে চান তাহলে কিচ্ছু চেপে রাখবেন না। সব কথা খুলে বলতে হবে আমাকে।”
রাজ ছেলেটি অনেকক্ষন ধরেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল উকিল বাবুর দিকে। এবার একটু নড়ে চড়ে বসল। তারপর বলল, “আমি জানি। আমি জানি আমার অবস্থা কতটা শোচনীয়। কিন্ত বিশ্বাস করুন আমি একটাও মিথ্যে কথা বলছি না। পুলিশ কে আমি বার বার বলেছি আমি খুন করিনি। কিন্তু ওরা আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইছে না।”
অদ্বৈত মল্লিক বাস্তববাদী মানুষ। সেন্টিমেন্ট কে কোনো কালেই আমল দেন না। কারন উনি জানেন এই সময় যেকোনো খুনের মামলায় অভিযুক্ত অপরাধীই একই কথা বলবে। “আমি খুন করিনি।” কিন্তু এই তিনটে শব্দের ভেতরের অর্থ টা বের করাই উকিলের আসল কাজ।
ব্যারিস্টার মল্লিক বললেন, “বিশ্বাস তো কেউই করবে না মিস্টার বর্মন। আসলে তথ্য প্রমান গুলো তো আপনার বিপক্ষেই কথা বলছে কাজেই… তবে একটা কথা আমি আপনাকে দিচ্ছি, আপনি যদি সত্যি নির্দোষ হন, তাহলে আপনার শাস্তি আমি হতে দেবো না। তবে তার জন্য আমাকে যে সব জানতে হবে। কিচ্ছু গোপন করবেন না আমার কাছে।”
রাজ কিছু বলল না। আগের মত একই ভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ব্যারিস্টার মল্লিক এর দিকে। রাজ বর্মন এর কেস টা এর আগে অবধি অদ্ভুত রকমের ধোঁয়াশা পাকিয়ে রয়েছে। একটা কথা সবাই ধরেই নিয়েছে যে খুন টা রাজই করেছে। ব্যারিস্টার মল্লিক ও তাই বিশ্বাস করছিলেন এতক্ষন। কিন্তু এই প্রথমবার হঠাৎ ওঁর মনে খটকা লাগল।
“আপনি ভাবছেন আমি খুনী।” খুব ধরা গলায় বলল রাজ, “কিন্তু প্লিজ আমায় বিশ্বাস করুন। আমি খুন করিনি। আমি জানি সমস্ত তথ্য প্রমান আমার বিরুদ্ধে কথা বলছে। আসলে… আসলে একটা অদ্ভুত জালে জড়িয়ে গেছি আমি। এখন প্রানপন চেষ্টা করলেও হয়তো এটা থেকে আর বেরোতে পারবো না। কিন্তু আমি… আমি এ কাজ করিনি।”
এরকম বিপাকে পড়লে যেকোনো মানুষ দাবী করবে যে তার কোনো দোষ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার মল্লিক এর মনে হল, ছেলেটি হয়তো সত্যি বললেও বলতে পারে। হয়তো ও সত্যি নির্দোষ।
তিনি বললেন, “ঠিক আছে। আমি আপনার কথা সত্যি বলেই ধরে নিচ্ছি। এবার বরং আমরা কেস টার দিকে নজর দিই। আপনি ঠিক কীভাবে মিস ইন্দিরা রায়চৌধুরী কে চিনলেন একটু খুলে বলুন তো।”
রাজ বলতে শুরু করল, “আমার সাথে ওঁর প্রথম আলাপ হয় ধর্মতলায়। গ্র্যান্ডের নীচে যেখানে হকারগুলো বসে সেখানে খুব ভীড় ছিল। এক বৃদ্ধা কে দেখলাম অনেক জিনিস হাতে করে নিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এমন ভাবে ওর পাশ দিয়ে গেল যে উনি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন রাস্তায়।
“এক সেকেন্ড একটু থামাচ্ছি” ব্যারিস্টার মল্লিক বললেন, “গ্র্যান্ডের নীচে যেখানে হকার রা বসে সেখানে গাড়ি কোত্থেকে এল? মানে ওটা তো ফুটপাথ…
– না আসলে খুব ভীড় ছিল সেদিন ফুটপাথে। সেই জন্যেই উনি সরে গিয়ে রাস্তে দিয়ে হাঁটছিলেন।
– ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে। আপনি ডিটেল গুলো বাদ দেবেন না। বলে যান।
রাজ সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলতে শুরু করল আবার, “তো উনি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরে আমি এগিয়ে যাই। একজন বয়স্ক মহিলা রাস্তায় পড়ে গিয়েছেন কেউ একবার এগিয়ে এল না। ভাবুন!”
ব্যারিস্টার মল্লিক কিছু উত্তর দিলেন না। রাজ একটু থেমে আবার বলল “যাই হোক ওঁর হাত ধরে ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম আমি। তারপর মাটিতে পড়ে থাকা প্যাকেট গুলো তুলে দিলাম ওঁর হাতে। উনি আমাকে আজকালকার জেনারেশনের অপদার্থতা নিয়ে দু’একটা কথা বললেন। আর বললেন যে আমি ওরকম নই এটা দেখে উনি খুব খুশি হয়েছেন। তারপর উনি চলে গেলেন মেট্রোর দিকে আর আমি গেলাম আমার কাজে।”
– আচ্ছা ওই সময় কী কাজ ছিল আপনার ধর্মতলায়?
– আমার ওইদিন রাত্রেই একটা বিয়ে বাড়ি ছিল। এক বন্ধুর বিয়ে। তাই ওর জন্য একটা ভালো গিফট্‌ কিনতে গিয়েছিলাম।
– তা কী কিনলেন?
– ঘড়ি।
– হুম। আচ্ছা তার মানে কী বলা যায় আপনি ওই বৃদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছেন?
– আরে ধুর! কী বলছেন কি আপনি? উনি পড়ে গিয়েছিলেন আর আমি তুলে দিয়েছি। ব্যাস! এটুকুই। এতে আবার জীবন বাঁচানোর কী আছে? আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও হয়তো তাই করতো।
– Okay. Carry on please.
– হ্যাঁ। যাই হোক ওই ঘটনার পর যে যার নিজের কাজে চলে যাই। ওই ভদ্রমহিলার সাথে আর কখনও দেখা হবে ভাবিনি। কিন্তু অদ্ভুত ভাগ্য মশাই আমার। ঠিক সেদিনই বন্ধুর বিয়েতে গিয়েই দেখা পেলাম ওই বৃদ্ধার। আমার বন্ধুর যার সাথে বিয়ে ছিল, সেই মেয়েটির দূর সম্পর্কের পিসি হন উনি। ওঁর নাম টাও তার আগে জানতাম না। ওখানেই জানলাম। ইন্দিরা রায় চৌধুরী।
– আপনি নিজে গিয়ে ওঁর সাথে কথা বললেন?
– না। আমি প্রথমে ওঁকে দেখিনি। উনিই নিজে আমাকে দেখতে পেয়ে এসে কথা বললেন। আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। তারপর সকালের ব্যাপারটার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানালেন আবার। তারপর বললেন একদিন ওঁর বাড়ি যেতে। আমি প্রথমে ভাবলাম এমনি ভদ্রতার খাতিরে বলছেন হয়তো মহিলা। তাই আমি বললাম যাবো। কিন্তু উনি তক্ষুনি আমার কাছে জানতে চাইলেন কবে যাবো। আমার যে ইচ্ছে নেই যাওয়ার সেটাও মুখের ওপর বলতে পারছিলাম না।
– কেন পারছিলেন না? আপনার কি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাহলে?
রাজ মাথা নীচু করে বলল, “আসলে কি জানেন… আমি আসলে সেই সব মানুষদের দলে পড়ি যারা কখনও কোনো কিছুতে না বলতে পারে না। নিজের হাজার অসুবিধে থাকলেও মুখ ফুটে না বলতে পারি না আমি।”
ব্যারিস্টার মল্লিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন, “বলে যান।”
রাজ আবার বলতে শুরু করল, “তো উনি কবে যাবো বলায় আমি একটু চেষ্টা করছিলাম কথা ঘোরানোর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না পেরে বললাম আমি সামনের শনিবার যাবো ওঁর বাড়ি। উনি চলে যাওয়ার পর ওঁর সম্পর্কে কিছু কথা আমি শুনেছিলাম। যে উনি বিয়ে থা করেন নি, একা থাকেন নিজের মতন আর ভীষন বড়লোক।”
ব্যারিস্টার মল্লিক নিজের চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, “উনি একা থাকেন আর বড়লোক এই দু’টো ব্যাপার আপনাকে কে বলল?”
– ওই তো আমার ওই বন্ধু। দেবাঙ্গন।
– উনি নিজেই আপনাকে এসব বললেন? নাকি আপনি জিজ্ঞেস করেছেন?
– আমার সেটা ঠিক খেয়াল পড়ছে না এই মুহুর্তে।
– খেয়াল করুন মিস্টার বর্মন। খেয়াল করুন। এই বিষয় টা খুব জরুরী। আপনার বন্ধু আপনাকে কী নিজে থেকে বলেছিলেন কথাটা। নাকি আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ওই মহিলা সম্পর্কে।
– আমার সত্যি মনে পড়ছে না।
– আচ্ছা আপনার বন্ধু মানে যার বিয়েতে আপনি গিয়েছিলেন, তিনি কি মনে করতে পারবেন তিনি আপনাকে এই কথাটা বলেছিলেন কিনা?
– আমি… আমি ঠিক জানিনা… মনে থাকার তো কথা। তবে এটা তো বেশ কয়েক মাস আগের কথা। জানিনা মনে থাকবে কিনা।
“দেখুন মিস্টার বর্মন”, বললেন ব্যারিস্টার মল্লিক, “সরকার পক্ষের উকিল প্রথম এই ব্যাপার টা কোর্টে highlight করবে, যে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা ইদানীং কালে ঠিক ভালো যাচ্ছে না। আর সেই কারনেই আপনি ইন্দিরা দেবীর মত ধনী একজন কাউকে পেয়ে বড়লোক হওয়ার ফন্দি এঁটেছেন। তারপর তাকে খুন করেছেন টাকার লোভে। কেউ বিশ্বাস করবেনা আপনি শুধুমাত্র একজন বয়স্ক মহিলার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ওঁর বাড়ি গিয়েছিলেন…”
– হ্যাঁ। একদমই তাই… আমার সত্যি মায়া হচ্ছিল ওঁর ওপরে। উনি আসলে এমন ভাবে বললেন।
– আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি মিস্টার বর্মন। কিন্তু কোর্ট চায় সাক্ষ্যপ্রমান। কাজেই…
রাজ একটু ভেবে নিয়ে বলল, “নাহ। আমার মনে হয় না দেবাঙ্গনের মনে থাকবে ওই কথাটা। ওখানে আরও অনেকেই উপস্থিত ছিল। দু’একজন বন্ধু আমার পিঠ চাপড়ে বলেছে ‘ভালোই তো দাঁও মারলে বাবা।’ আর তাছাড়া দেবাঙ্গন কথাটা আমার আকার উদ্দেশ্যে বলেনি। ওই মহিলা কে নিয়ে গসিপ করে সবাই। এত টাকা ওঁর। তার ওপর নিজের কেউ নেই।”

ব্যারিস্টার মল্লিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেস টা ক্রমশ জিলিপির মত প্যাঁচালো হয়ে যাচ্ছে।

(চলবে)

রাজসাক্ষী – প্রথম পর্ব

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি