বোধন – পর্ব ৬ঃ https://secularweirdo.com/2018/01/14/বোধন-পর্ব-৬ঃ


অষ্টমী, সন্ধ্যে

রাজর্ষি

মাথায় এখনো হালকা ব্যাথা রাজর্ষির। একটু মাথা নাড়ালেই ব্যাথাটা অনুভব করতে পারছে ও। তবে মাথার ব্যাথাটা ওর এখনের মাথাব্যাথা নয়। ওর এই মুহুর্তের মাথাব্যাথার নাম রঞ্জনা। যে এখন নার্সিং হোমে ঠিক ওর সামনের চেয়ারেই বসে রয়েছে! রঞ্জনা যখন আসে তখন ওর মা ছিল ওর সাথে। ওকে দেখে মা স্বাভাবিকভাবেই একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রঞ্জনার দিকে।

রাজর্ষির তখনই পেটের মধ্যে হাতুড়ি পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। রঞ্জনা তক্ষুনি ওর মা কে প্রনাম করে বলল, “কাকিমা, আমি রঞ্জনা। রাজর্ষির বন্ধু।”

রাজর্ষি তখন ভাবছে, রঞ্জনা সাধারনত যখন ওর মা বা বাবা কে নিয়ে কিছু কথা বলে তখন Uncle-Aunty বলেই সম্বোধন করে। ওর মুখে হঠাৎ কাকিমা ডাক শুনে ও খুব অবাক হয়েছিল। যাই হোক সৌভাগ্যের বিষয় রাজর্ষির মা কিছুই রিয়্যাক্ট করেনি। শুধু, “ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে তোমরা গল্প করো আমি একটু বাইরে থেকে আসছি!” বলে চলে গিয়েছিল রুমের বাইরে।

সেটাও প্রায় মিনিট পাঁচেক হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে রঞ্জনা আর রাজর্ষি চুপ করে দেখছে একে অপর কে। নীরবতা ভাঙল রঞ্জনা নিজেই, “ব্যাথার কি অবস্থা?”

রাজর্ষি বলল, “মাথাটায় ব্যাথা রয়েছে। হাতে সেরকম নেই।”

– কবে ছাড়বে নার্সিং হোম থেকে কিছু বলল?

– নাহ। জানিনা।

রঞ্জনা আরও কিছু বলত হয়ত এমন সময় হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যেতেই রাজর্ষি দেখল অয়ন যাচ্ছে। চেঁচিয়ে ডাকল ও। ডেকেই বুঝতে পারল ঠিক করেনি। মাথাটায় আবার ব্যাথা করছে।

রাজর্ষির ডাকে ওর ঘরে এসেই একটু চমকে গিয়েছিল অয়ন। রঞ্জনা কে দেখে। ও তখন আর রঞ্জনার মেসেজের রিপ্লাই করে নি। তাহলে রঞ্জনা নিশ্চয় অন্য কোথাও থেকে জেনেছে রাজর্ষির কোন নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে সেটা!

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অয়ন বলল, “বল রে!”

রঞ্জনাও তাকিয়েছে এবার ওর দিকে। রাজর্ষি বলল, “তুই কী করছিস এখানে?”

অয়ন একটু থতমত খেয়ে গেল প্রশ্নটা শুনে, “আমি তো! কিছু না… এই একটা কাজে এসেছিলাম!”

– একটা কাজে এসেছিলি? তাও আবার নার্সিং হোমে? কী কাজ?

– ওই একজন ভর্তি হল…

রাজর্ষি বুঝতে পারছে অয়ন কিছু একটা লুকোতে চাইছে। ও বলল, “তুই কি রঞ্জনা রয়েছে বলে সব খুলে বলতে ভয় পাচ্ছিস?”

রঞ্জনা এবার উঠে বেরোতে যেতেই অয়ন রঞ্জনাকে বলল, “আরে না না। তুই বোস!” তারপর রাজর্ষির দিকে ফিরে বলল, “আসলে আমরা চাইছিলাম না তুই জানিস এই ব্যাপার টা!”

“কোন ব্যাপারটা” বলেই উঠে বসতে গেল রাজর্ষি। তারপরেই হাতের যন্ত্রনায় কুঁচকে গেল ওর মুখ।

অয়ন বলল, “তুই শুয়ে থাক। বলছি আমি”

রঞ্জনা এবার বলল, “আমি কি বাইরে অপেক্ষা করবো?”

“না না। কাউকে বাইরে যেতে হবেনা। আমি বলছি সব টা!” বলল অয়ন।

– হ্যাঁ বল। আমরা মানে কারা ঠিক করেছিলি যে আমায় বলবি না?

– আমরা মানে আমি, মৈনাক, জয় আর অনিন্দিতা! তোর সাথে শানুর ওই ব্যাপারটা হওয়ার পর আমরা ঠিক করেছিলাম শানুকে উপযুক্ত শাস্তি দেবো!

– কি শাস্তি?

– জয় ভেবেছিল ওকে confront করবে। এবং সুযোগ বুঝে ওর গায়ে কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেবে!

– কাঁকড়া বিছে? সেটা কোত্থেকে পাবি?

কথাটা জিজ্ঞেস করেই রাজর্ষির চোখে গেল রঞ্জনার দিকে। রঞ্জনা সম্পর্কে প্রায় সবই ওর জানা। “তুই দিয়েছিস?” ও জিজ্ঞেস করল রঞ্জনা কে!

– হ্যাঁ। দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর কি হয়েছে আমায় আর অয়ন জানায় নি!

রাজর্ষি বলল, “হুম! বল তারপর কী হল?”

– ওর কাছ থেকে কাঁকড়াবিছে নিয়ে আমি সাপ্লাই করলাম জয় কে। জয় সেটা নিয়ে গিয়েছিল শানুর সাথে কথা বলতে! আর তারপরেই…

– তারপরে? তারপরে কী?

– তারপরে আমার মাথায় আর একটা প্ল্যান আসে। যেটা আরও কার্যকরী হবে বলে আমার মনে হয়েছিল!

– কী প্ল্যান?

অয়ন একবার রঞ্জনার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “দেখ এই ব্যাপারটা এখনো অবধি আমি মৈনাক ছাড়া কেউ জানেনা। জানলে কিন্তু চাপ হয়ে যাবে। এমনকি অনিন্দিতাকেও বলা হয়নি এটা!”

“কেউ জানবেনা তুই বল।” রঞ্জনা বলল।

অয়ন বলতে শুরু করল, “আমার মনে হয়েছিল এভাবে কাঁকড়াবিছের কামড় খেয়ে শানুর শিক্ষা হবেনা। তার চেয়ে বরং আরও খারাপ কিছু করা যায়! এটা মনে হওয়ার পরেই প্ল্যানটা ছকে নিয়ে জানিয়ে দিই মৈনাক কে। তারপর বাবার রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি!”

“রিভলবার নিয়ে মানে? মাথা খারাপ নাকি??” আঁতকে উঠল রাজর্ষি!

– আরে আমি কি পাগল? আসল রিভলবার নিয়ে বেরোলে আমার বাপ একটা মারও মাটিতে ফেলত না। আমার বাবার কাছে ২ টো রিভলবার থাকে। সব সময় আসল টা নিয়ে বেরোয় না। জিজ্ঞেস করলে বলে সবসময় Arms Carry করতে ভালো লাগে না! লোকজন রিভলবার দেখলেই ভয় পায়! যা হোক একটা সাথে থাকলেই হল!

– যাক তবু ভাল সুবুদ্ধি রয়েছে তোর মাথায়!

– আর সুবুদ্ধি! কেসটা তো পুরো ঘেঁটে গেল!

– কেন?

– কারন আমি ভুল করে, আসল রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম!

কথাটা বলার পরেই মৈনাক ঢুকল ঐ ঘরে। তারপর অয়ন কে বলল, “জয় এর… মানে… তুই কি আসবি একবার?”

রাজর্ষি এবার একটু জোরেই বলল, “এই কী হয়েছে খুলে বল তো আমায়! জয় এর কী হয়েছে? কোথায় ও?”

অয়ন বলল, “জয় এই নার্সিং হোমেই এ ভর্তি!”

“মানে? কেন? কী হয়েছে ওর?” চিৎকার করে প্রশ্নটা করার সাথে সাথে রাজর্ষি আবার বুঝতে পারল ওর ব্যাথা লাগল মাথায়! যন্ত্রনায় চোখটা বন্ধ করে ফেলল ও!

অষ্টমী, সন্ধ্যে

জয়

বেশ অনেকক্ষন থেকেই আশে পাশে কিছু মানুষের কলকাকলি হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিল জয়। কিন্তু চোখটা খুলতে ইচ্ছে করছিল না ওর। কেমন যেন একটা ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। ও যখন চোখ খুলল তখন সামনে মৈনাক আর অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিছানায় রাখা বালিশটা সোজা করে ঠেস দিয়ে বসে ও জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে, আমার বাড়িতে এই কেসটা জানেনা তো?”

মৈনাক বলল, “না জানেনা। তোর বাড়িতে জানে তুই ক্লাবের পূজো তে মাঠে রয়েছিস!”

মৈনাক কথা শেষ করা মাত্র একটা খুব জোর থাপ্পড় খেলো জয়! থাপ্পড়টা মেরেছে অনিন্দিতা এটার জন্যে একেবারেই তৈরী ছিল না জয়!

মৈনাক অবস্থা বেগতিক দেখে বলে উঠল, “আমি আসছি এক্ষুনি। দেখি অয়ন কোথায় গেল!”

জয় গালে হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী হল? আমার সারা শরীরে ব্যাথা তুই জানিস না?”

অনিন্দিতা বলল, “এটাকে থাপ্পড় মারা বলে। বহুদিন খাস নি তো আমার হাতে। তাই খুব ভুলভাল কাজকর্ম শুরু করেছিলি!”

– রাজর্ষিদার সাথে যেটা হল সেটার পর আমি চুপ করে বসে থাকব না সেটা তুই জানিস!

– চুপ করে বসে থাকতে তো কেউ বলেনি! কিন্তু এভাবে প্রান হাতে করে এইসব কাজ কর্ম করতেও তো কেউ বলে নি!

– আরে আমি জানতামই না অয়ন রিভলবার আনবে। ইন ফ্যাক্ট আমি এখনও জানিনা কেন ও এসব করতে গেল!

– আমি জানি। মৈনাক এর দয়াতে জানতে পারলাম ওদের প্ল্যান টা!

– কী প্ল্যান?

– অয়ন ভেবেছিল নকল রিভলবার নিয়ে যাবে! তারপর বন্দুকের আওয়াজ করতেই মৈনাক লাল রঙ নিয়ে নিজের গায়ে লাগিয়ে Pretend করবে যে ওর গুলি লেগেছে। তারপর অয়ন ওর বাবাকে দিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে মার খাওয়াবে শানু কে।

– What? এটা কি ধরনের প্ল্যান? এর থেকে আমার কাঁকড়াবিছের প্ল্যানটাই ভালো ছিল!

– হ্যাঁ About that, তুই কী করে জানলি রঞ্জনার বাড়িতে কাঁকড়া বিছে রয়েছে?

– ও নিজেই বলেছিল একবার চ্যাটে!

– ওর সাথে কথা হয় তোর? বলিস নি তো!

– সে ভুলে গেছি হয়তো! আগে তুই আমায় ওদের প্ল্যানটা কেন ভেস্তে গেল বল!

– আরে অয়ন ভুল করে আসল রিভলবার নিয়ে চলে গিয়েছিল।

– হ্যাঁ সে তো আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম!

– হুম। কারুর দিকে তাক করেনি ভাগ্যিস! নাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত!

– তারপর কী হল?

– মৈনাক বলল, রিভলবার এর আওয়াজ শুনে ও যথারীতি লাল রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিল এখানে সেখানে। তারপরেই তোর হাত থেকে কাঁকড়া বিছের শিসির ঢাকনা খুলে যায় এবং…

– এবং আমাকে কাঁকড়াবিছেটি আলতো করে চুমু খায়! বুঝেছি। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম নারে?

– হ্যাঁ। আমি যখন ফোন করলাম মৈনাক ইচ্ছে করে বলল, তোর নাকি গুলি লেগেছে! প্রথমে নাকি তাই ভেবেছিল ওরা! আমার তো শুনেই অবস্থা শেষ!

– শানুর কী হল?

– জানিনা।

বহুদিন পর একটানা এতক্ষন জয় কথা বলল অনিন্দিতার সাথে। কাঁকড়াবিছের কামড় খাওয়ার আগে অনিন্দিতা কে সব জানিয়ে দেওয়ার যে ইচ্ছেটা হচ্ছিল সেটা আবার হচ্ছে এখন! তাহলে কি জানিয়ে দেবে ও অনিন্দিতা কে সব? কিন্তু শুভদ্বীপ? অনিন্দিতা তো ওরই! জানালেও কি জয় কোনোদিন পাবে অনিন্দিতা কে?

শুভদ্বীপ এর কথা মনে পড়তেই জয় বলল, “আচ্ছা তোর আজ…

ঠিক একই সময়ে অনিন্দিতার প্রশ্ন, “তুই আজ আমায়…

হেসে উঠল দু’জনেই। হাসতেই জয় এর কোমরের কাছ টা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠল!

জয় বলল, “আচ্ছা বল কি বলবি!”

অনিন্দিতা হেসে বলল, “না তুই আগে বল। তারপর বলছি আমি!”

– আরে তোর আজ শুভদ্বীপের সাথে বেরোনোর কথা ছিল না? বেরোস নি?

– বেরিয়েছিলাম তো। তুই ফোন করেছিলি। তারপর তোকে ফোনে না পেয়ে মৈনাক কে ফোন করলাম। তারপর জানলাম এইসব ব্যাপার! কাজেই ওকে সরি বলে চলে এলাম নার্সিং হোম এ।

– ও রাগ করেনি?

– জানিনা। হয়তো করেছে!

– হুম। এবার তুই!

– ও হ্যাঁ! তুই ফোন করেছিলি কেন আমায় তখন? মানে এত কিছু হওয়ার আগে?

এই প্রশ্নটার উত্তর রয়েছে জয় এর কাছে। কিন্তু দেওয়াটা কি ঠিক হবে? এটা নিয়ে এখনো দোটানার মধ্যে আছে ও! সব যদি শেষ হয়ে যায় এক মুহুর্তে! বহুদিন পর আবার কত কথা বলছে অনিন্দিতার সাথে! সেটা আবার ভেস্তে যাবেনা তো?

যা হবে দেখে যাবে ভেবে জয় বলতে শুরু করল, “আমি আসলে তোকে একটা কথা বলতে ফোন করেছিলাম। অনেকদিন থেকেই তোকে বলতে চাইছিলাম কথাটা আমি।”

– কী কথা রে? সিরিয়াস কিছু?

– আমি…আমি… মানে…আমি… তোকে……

হঠাৎই একটা ফোনের রিংটোন মুহুর্তটাকে ঘেঁটে দিয়ে বেজে উঠল কর্কশ স্বরে। অনিন্দিতার ফোন। ও বলল, “এক মিনিট দাঁড়া তো! তমালিকা কী বলছে দেখি!”

জয় কিছু বলল না। অনিন্দিতা ফোনটা ধরে বলল, “হ্যাঁরে বল!”

“আমার তোকে কিছু কথা বলার আছে!” ওপ্রান্ত থেকে বলল তমালিকা!

অনিন্দিতা জয় এর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “বাবাহ! সবারই দেখছি আমাকে কথা বলার আছে! বল কী বলবি?

– যেটা বলব সেটা আমার আরও আগে বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলতে পারিনি ভয়ে, লজ্জায়!

– কী হয়েছে রে? কীসের ভয়?

– কথাটা শুনে আমায় বিশ্বাস করা বা না করা তোর ব্যাপার! তবে প্রমান করার মত জিনিস আমার কাছে রয়েছে। আমি আর থাকতে পারছিনা এভাবে।

– আরে বল না কী বলবি। এত ভূমিকা করছিস কেন?

কথা বলতে বলতে বিছানা থেকে একটু সরে গিয়েছিল অনিন্দিতা। জয় এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওর দিকে। আর ভাবছিল আর কয়েক মুহুর্ত পরেই এত দিনের চাপা কথাটা বলতে পারবে ও অনিন্দিতা কে! তারপর যা হবে তাই মেনে নেবে ও। অনিন্দিতা যদি চায় ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখবে, না চাইলে রাখবে না!

(চলবে)

বোধন – পর্ব ৭

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


One thought on “বোধন – পর্ব ৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি