শেষবারের মত একটা টান দিয়ে সিগারেটটা বিছানার পাশে রাখা অ্যাসট্রেতে রেখে দিল সায়ন্তন। তারপর খুব সুন্দরভাবে ধোঁয়ার ‘রিং’টা ছাড়ল। এই নিয়ে শেষ এক ঘন্টায় চার টে সিগারেট এর সলিল সমাধি ঘটল ওই অ্যাসট্রে তে। ওপরে সিলিং ফ্যানটা  ঘুরেও ঘুরছে না। ঘরটা সিগারেটের গন্ধে ম ম করছে। খোলা জানলার কাছেই কোথাও একটা ব্যাঙ ডাকছে। মোদ্দা কথাটা হল অনেক কিছুই হচ্ছে কিন্তু যেটার জন্য সায়ন্তনের হাতে চারটে সিগারেট একঘন্টার মধ্যে মৃত্যুবরন করল সেটাই হচ্ছে না।

“কিরে? এখনো শুরু করতে পারিস নি?”

হঠাৎ ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠতেই হালকা যন্ত্রনায় চোখটা কুঁচকে গেল ওর।
বিরক্তিতে পাশ ফিরে দেখল রূপসা ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে ওর সাদা ক্যানভাসটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলল না ও।

“ইস্‌। ঘরটা পুরো বিড়ির গন্ধে ভরে আছে। ক’টা খেলি রে?”
এই হচ্ছে রূপসার দোষ। সিগারেটকে বলে বিড়ি। জানেনা যে তা নয়। ইচ্ছে করে বলে। সায়ন্তন কতবার বলেছে ‘আমি বিড়ি খাইনা। আমার স্ট্যান্ডার্ড অতটা খারাপ নয়।” রুপসা তখন বলে, ‘একটু আন্ডারএস্টিমেট করতে ভাল লাগে। এই জিনিসটা এখন আমার গুরুত্বটা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে তো তোর কাছে। সেই জন্যে।’

“কিরে? কথা কানে যাচ্ছে না? ক’টা খেলি ওই বিড়ি?”

চমক ভাঙল সায়ন্তনের। একটু রাগ দেখিয়ে বলল, “তুই আবার আমায় ডিস্টার্ব করছিস। মাকে বলব?”
“আহা! নেকু পুষু” মুখ ঝামটে উঠল রূপসা, “তুই কে রে শান্তিগোপাল? যে তোকে আমি ডিস্টার্ব করব?”
সায়ন্তন এবার চেঁচিয়ে উঠল, “মা আ আ…! বোন আমায় ডিস্টার্ব করছে।”

কোনো উত্তর এল না ঘরের বাইরে থেকে।

–       “এই শোন। আমি তোকে ডিস্টার্ব করতে আসিনি। মা বলে পাঠাল যে সাড়ে দশটা বাজে। এবার খাবি চল। সবাই বসে আছি তোর জন্য।”

খেতে হবে? এখুনি? তাহলে আজ আর ছবিটা আঁকা হবে না সায়ন্তনের। খেলেই ওর বড্ড ঘুম পায়। আর তাছাড়া এখনো কনসেপ্টটাই ভাবা হল না ওর। চার দিন মাত্র আছে আর ওর হাতে। তারপরেই ‘অল বেঙ্গল আর্টিস্ট ফোরাম’এর ‘Painting Exhibition’। এই সময়ের মধ্যে না জমা দিলে ওরা আর ছবি নেবে না। এই কম্পিটিশনটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ফ্যামিলির অবস্থা খুব একটা ভাল নয় ওর। বাবা নেই। মা সরকারী হাসপাতালের একজন নার্স। ওর বয়স এখন পঁচিশ। এখনো সংসারের দায়িত্বটাই নিতে পারল না ও। মাঝে মাঝে মা’কে দেখে বড্ড কষ্ট হয় ওর। কি অক্লান্ত পরিশ্রমটাই না করে চলেছে সংসাটার জন্য। আর ও একটা টাকাও দিতে পাচ্ছেনা। তার জন্য অবশ্য কোনোদিন একটা অভিযোগ করেনি মা। সারাজীবনই ওকে ছবি আঁকাতে উৎসাহ দিয়ে এসেছে। কিন্তু এভাবে…

“ওই। আমি আর কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকব?” রূপসা এবার রেগে যাচ্ছে।
সায়ন্তন এক মুহুর্ত কিছু ভাবল। তারপর খুব মিষ্টি করে গলা নামিয়ে বল, “দেখ বোন…”
“ব্যাস! শুরু হল মাখন মারা। এই শোন ন্যাকামি না করে যেটা বলবি বল।”
একটু থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিল সায়ন্তন। তারপর বলল, “না মানে তুই তো জানিস এই কম্পিটিশনটা আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ন। এখানে যদি আমার ছবি ফার্স্ট হয় তাহলে ছবিটা নিলাম হবে। তারপর যে টাকাটা আসবে সেটা দিয়ে আমি একটা নূতন ব্যবসা শুরু করতে পারব। মাকে তাহলে আর ওই চাকরিটা করতে হবে না। সেই জন্যেই…”

–       “শোন”

হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল রূপসা, “আমি খাবারটা এই ঘরে দিয়ে যাচ্ছি সেটাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমার মনে হয় এই সব ব্যবসার চক্করে না পড়ে চাকরির ইন্টারভিউটা ভাল করে দে। তাতে কাজ এর কাজ কিছু হবে।”

এক মুহুর্ত ভাবল সায়ন্তন। চাকরির ইন্টারভিউ? কিসের ? তারপরেই মনে পড়ল সামনের শুক্রবারই একটা কোম্পানীতে ওর একটা ইন্টারভিউ আছে! BGM না কি একটা নাম যেন কোম্পানীটার। মা এর একজন পরিচিত ইন্টারভিউটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মা ভেবেই রেখেছে যে সায়ন্তন ওই ইন্টারভিউ টা দেবে। কিন্তু সায়ন্তনের ওতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ওর শখ তো ছবি।

সবাই কেমন যেন মাথা নীচু করে বসে আছে। আর একজন একটা জি.কে. বই জাতীয় কিছু খুলে কি যেন পড়ছে। ভেতরে কি জেনারেল নলেজ ধরছে নাকি? কে জানে! ও কাল রাত্রে ওর আঁকাটা শেষ করেছে। প্যাকিং টা করা হয় নি। আজ বাড়ি ফিরে প্যাক করবে। তারপর কাল দিয়ে আসবে রবীন্দ্র সদন গিয়ে। বেঙ্গল আর্টিস্ট ফোরাম এর অফিসে। কে জানে ওদের পছন্দ হবে কিনা। বুঝবে কিনা আদৌ সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে ওর।

ওর কনসেপ্ট হল প্যারালাল ইউনিভার্স। অনেক বিজ্ঞানীর ধারনা আমাদের পৃথিবীর পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে আরও অনেক পৃথিবী রয়েছে। কিন্তু দুটো পৃথিবীতে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা হওয়ার জন্যে আমরা সেগুলিকে দেখতে পাই না। ওর ছবিটি ছিল ২ টো আলাদা পৃথিবীতে একটা চরিত্রের ২ টো আলাদা রূপ নিয়ে। ছবিটা ও এমন ভাবে এঁকেছিল তাতে আর একটা কনসেপ্ট পরোক্ষভাবে ফুটে উঠেছিল। সেটা হল একটা পৃথিবীতেই একটা মানুষের দুটো আলাদা রূপ। একটা মুখোশ পরে এবং আর একটা মুখোশ ছাড়া। কিন্তু ও বোঝাতে চাইলো যে এই একই মানুষের ২ টো আলাদা ইউনিভার্সে কীভাবে একেবারে ২ টো আলাদা রূপ থাকতে পারে। একজন হয়তো আমাদের ইউনিভার্সে পুলিশ। আবার সেই মানুষটাই অন্য ইউনিভার্সে হয়তো হবে ক্রিমিনাল।

“অনন্যা গাঙ্গুলি?”

ভেতর থেকে একটা মেয়ে এসে ডাকল নাম টা। মেয়েটার হাতে একটা বোর্ড রয়েছে। ওখানেই সম্ভবত সব বেকার গুলোর নাম রয়েছে। মেয়েটা একজন একজন করে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর তার ইন্টারভিউ হয়ে গেলে পরের জন কে ডাকছে। মেয়েটির সেক্রেটারি বা অ্যাসিস্ট্যন্ট জাতীয় কিছু একটা।

মেয়েটা আবার ডাকল, “অনন্যা গাঙ্গুলি?”

তারপর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে একটু থেমেই বলল, “সায়ন্তন মিত্র?”

সায়ন্তন উঠে দাঁড়ালো। সৃজা নামের মেয়েটি বলল, “আসুন!”

ওরা ইন্টারভিউ এর ঘরে ঢুকতে যাবে হঠাৎই একটা চিৎকার শোনা গেল দূর থেকে।

“Present! Present!”

বলতে বলতেই দৌড়ে এল একটি মেয়ে। পরনে একটা মেরুন রং এর কুর্তি আর জিন্স্‌। সবাই এর চোখ তখন ওই  মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বলল, “সরি! আমি আসলে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। তাই দেরী হয়ে গেল!”

সেক্রেটারি মেয়েটি এবার বলল, “সরি! আমার কিছু করার নেই। আপনি অপেক্ষা করুন। শেষে সময় থাকলে আপনাকে ডাকা হবে!”

তারপর সায়ন্তনের দিকে ঘুরে বলল, “আপনি চলুন ভেতরে।”

সেই মেয়েটি আর একবার বলার চেষ্টা করল কিছু একটা, “আমার কথাটা শুনুন…” বলে। কিন্তু শেষ করতে পারে নি।

সায়ন্তন ভেতরে ঢুকে দেখল ২ জন বসে আছে টেবিলে। মাঝে একজন আর বাঁদিকে একটা চেয়ার একজন। মাঝের জন সম্ভবত বস। চেয়ারে বসার পরেই বাঁদিকের লোকটি চাইল ওর সিভি টা। তারপর একবার চোখ বুলিয়ে এগিয়ে দিল বসের দিকে। বস ভদ্রলোক একবার সিভি টা দেখেই বললেন, “তুমিই সুনয়নার ছেলে?”

ও বলল, “হ্যাঁ।”

–       কী করো?

–       ছবি আঁকতে ভালো লাগে। আর এমনি আপাতত চাকরি-বাকরি কিছু করি না।

–       ছবি আঁকো। বাহ! তা ডিজিটাল পেন্টিং পারো?

–       হ্যাঁ। পারি মোটামুটি।

–       আর কম্পিউটার? কম্পিউটার এর হাত কীরকম?

–       ভালোই। মানে…

আরও হয়তো কিছু বলতো সায়ন্তন তার আগেই ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ। একজন গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “May I come in sir?”

গলাটা শুনেই খুব চেনা লাগল সায়ন্তন এর। মুখ ঘুরিয়ে দেখল বাইরের সেই মেয়েটি ভেতরে আসার পারমিশন চাইছে। এর আবার কী হল? ধুস! ওকে আবার তাড়াতাড়ি গিয়ে প্যাকিং করতে হবে। ইন্টারভিউ টা শেষ হলে ও বাঁচে!

বিরিয়ানি ব্যাপারটা বড্ড লোভনীয়। মূলত ক্ষিদে পেটে নাকে বিরিয়ানির গন্ধ এলে বড্ড চাপ হয় সায়ন্তনের। আজও তাই হল। কিন্তু বাড়ি গিয়েই ওই প্যাকিং। কিছু চার্ট পেপারও কিনতে হবে। কিন্তু সেন্ট্রাল এ চার্ট পেপার পাবে বলে মনে হয় না। মনে হয় কলেজ স্ট্রীট যেতেই হবে। আগে কলেজ স্ট্রীট না আগে বিরিয়ানি সেটা নিয়ে একটু দোটানায় পড়েছিল। তারপর ঠিক করল আগে কাজ টা সেরে নিয়ে তারপর বিরিয়ানি খাওয়া যাবে।

উফফ! কি সিন টাই না হল অফিসে। ওই মেয়েটা ঘরে ঢুকবে কিনা জিজ্ঞেস করার পর বসের পাশের লোক টা বলে ওঠে “এখানে একটা ইন্টারভিউ চলছে।”

মেয়েটা এবার পারমিশনের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে এল ভেতরে। তারপর বলল, “জানি আসলে… একটা কথা না বলা অবধি ঠিক…

বস ভদ্রলোক বললেন, “বলুন।”

–       আসলে আমার নাম ডাকা হয়েছিল এর আগে… কিন্তু…

সেক্রেটারি মহিলা বলল, “কিন্তু আপনাকে পাওয়া যায় নি। আপনি লেট করেছেন।”

মেয়েটি এবার চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি লেট করি নি। আমার আজ পিরিয়ড হয়েছে হঠাৎই। তাই আমাকে বাথরুমে যেতে হয়েছিল। কিন্তু ফেরার পর কয়েক সেকেন্ড লেট হওয়ায় আমায় বলা হল, শেষে টাইম থাকলে তবেই আমায় ডাকা হবে। আর… আমার শরীর টাও খারাপ লাগছে। কাজেই শেষে সময় থাকবে কিনা সেটা যদি একটু বলেন তাহলে অপেক্ষা না করে বাড়ি চলে যাবো।”

কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ। তারপর বস লোকটি বললেন, “আপনি অপেক্ষা করুন বাইরে। আমরা ডেকে নিচ্ছি এর পরে।”

তারপর মেয়েটা আর কিছু বলে নি। বেরোবার সময় দেখল বাইরে অপেক্ষা করছে।

চার্ট পেপার কিনে ওকে আবার ফিরতে হল সেন্ট্রাল এর দিকে। মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে দিয়ে এলেই একটু তাড়াতাড়ি হয়। তাই ওটা দিয়েই আসে ও সাধারনত।

“কেমন হল ইন্টারভিউ?”

বিরিয়ানির দোকানে গিয়ে সবে টেবিল এ বসতে যাবে হঠাৎ ই গলার আওয়াজ টা পেয়েই পাশে তাকাল ও। অফিসের সেই মেয়েটা। ইন্টারভিউ এর টেনশনে তখন ভালো করে দেখেনি ও। এখন দেখল। একটা অন্যরকম ব্যক্তিত্ব রয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। সেক্রেটারি মেয়েটাকে তখন পুরো চুপ করিয়ে দিয়েছিল।

সায়ন্তন বলল, “ওই আর কি। হল একরকম! আপনার কেমন হল?”

মেয়েটি বলল, “আমারও ওই আর কি। যা সিন ক্রিয়েট করলাম। তারপর এমনিও মনে হয় না আর কিছু হবে। Anyway, কিছু মনে করবেন না। আপনার ইন্টারভিউ এর মাঝখানে ওরকম একটা…”

–       আরে না না। ঠিক আছে। ওই সময় আপনার জায়গায় আমি থাকলেও টেনশন হত।

–       হুম। তা ঠিক। বিরিয়ানি নেবেন?

–       নেবো মানে… ওই আর কি… বসেই খাবো হয়তো।

মেয়েটি এবার চোখ কুঁচকে বলল, “আপনিও?”

সায়ন্তন বলল, “আপনিও মানে?”

–       আসলে আমিও বিরিয়ানি খেতেই ঢুকেছি। তবে একা একা রেস্টুরেন্টে বসে খেলে লোকজন একটু অবাক হয়।

সায়ন্তন বলল, “ধুর! বিরিয়ানি থাকলে আবার আপনি একা কী করে হলেন?”

মেয়েটি এবার হেসে ফেলল। বলল, “ভালো বললেন তো বেশ! ওহ! বলা হয় নি… আমার নাম…”

বলতে গিয়েই থেমে গেল। তারপর বলল, “কী হল? কিছু বললেন না?”

সায়ন্তন অবাক হয়ে বলল, “কী বলব?”

–       সেটা বলছি। তার আগে চলুন একটা টেবিল এ গিয়ে বসি। অনেকক্ষন থেকেই ওয়েটার গুলো কটমট করে তাকাচ্ছে।

টেবিলে বসার পর সায়ন্তন বলল, “কী বলতে বলছিলেন?”

মেয়েটি বলল, “আপনি তো আমার নাম জানেন। শুনলেন তো অফিসে। আমি ভাবলাম আমাকে মাঝপথে থামিয়ে সিনেমা হিরোর মত বলবেন, ‘হ্যাঁ আমি জানি।”

“ওহ আচ্ছা” সায়ন্তন হেসে বলল, “আর একবার শুরু করুন।”

মেয়েটি বলল, “Okay. Hi… আমার নাম…”

–       অনন্যা। জানি। শুনলাম তো অফিসে। নমস্কার… আমি…

–       সমন্তক।

–       What?

মেয়েটি এবার মুখে হাত দিয়ে বলল, “সমন্তক নয়?”

সায়ন্তন বলল, “একেবারেই না।”

–       তাহলে?

–       সেটা আপনি Guess করুন।

–       সন্তর্পন?

–       ইস! এরকম কারুর নাম হয়?

–       কেন হয়না? সন্তর্পন চক্রবর্তী। কি সুন্দর নাম।

–       নাহ। বাজে নাম।

–       আচ্ছা সে ঠিক আছে। আপনি আপনার নাম বলুন।

–       নাহ! আপনি আর একটু ভাবুন। ততক্ষন বিরিয়ানি টা অর্ডার দিই।

অনন্যা এবার বলল, “মনে পড়েছে! মনে পড়েছে!”

–       বলুন শুনি।

–       It’s সন্দীপন। তাই না? এবার ঠিক বলেছি?

সায়ন্তন এবার পেছন ঘুরে ওয়েটার কে ডাকল, “দাদা একটু আসুন তো এদিকে। অর্ডার টা নিয়ে যান।”

অনন্যা বলল, “কী হল? বলুন ঠিক বলেছি কিনা!

সায়ন্তন বলল, “নাহ। আপনার দ্বারা হবেনা বুঝতেই পারছি।”

ঘড়ির দিকে একবার দেখল সায়ন্তন। ১ টা ৩০ বাজে। আর তো কাজ নেই এখানে। এবার বেরিয়ে গেলেই হয়। কিন্তু ইচ্ছে করছে না ওর। ইন ফ্যাক্ট কাল থেকে ওর কিছু করতেই ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন অফ হয়ে আছে মুড টা। ও আজ এসেছিল বেঙ্গল আর্টিস্ট ফোরাম এর অফিসে ছবি টা জমা দিতে। সেটা হয়ে গেছে আগেই। কিন্তু এবার? এবার কী করবে? এবার কি ফিরে যাবে?

তাছাড়া আর উপায় কী? কাল বহুদিন পর হঠাৎ Socialize করতে পেরে যেন একটা অদ্ভুত ভালো লাগছিলো। কি যে হল তারপর কে জানে! বিরিয়ানি পর্বের পর ও অনন্যা কে বলল, “আপনার সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল।”

অনন্যা বলল, “আমার খুব একটা ভালো লাগে নি।”

সায়ন্তন বলল, “ওহ। আচ্ছা। এর কি কারন রয়েছে কোনো?”

অনন্যা বলল, “হ্যাঁ কারন তো রয়েইছে। তখন থেকে আপনি আজ্ঞে করে যাচ্ছেন এমন ভাবে। যেন আমি আপনার শাশুড়ি।”

সায়ন্তন এবার হেসে ফেলল, “আচ্ছা আর করব না। তা তুমি ফেসবুকে বা হোয়াটস্‌অ্যাপ এ আছো নিশ্চয়।”

এখানেই বোধহয় কিছুটা ঘেঁটে ফেলল সায়ন্তন। অন্তত সায়ন্তনের তাই ধারনা। নাম্বার চাওয়াটা বোধহয় উচিত হয় নি। তারপর একটা খুব অতি পরিচিত এক্সকিউজ দিল অনন্যা।

বলল, “আমার আসলে ফোন টা একটু প্রবলেম হয়েছে। সার্ভিস সেন্টারে দিয়েছি। আজ নেওয়ার কথা। তোমার নাম্বার টা দাও। আমি ফোন পেলে টেক্সট করে দেবো।”

এর পরে স্বাভাবিক ভাবেই আর কিছু বলা যায় না। নিজের নাম্বার টা দিয়েছিল সায়ন্তন। তবে মেসেজ বা ফোন কোনোটাই আসে নি এই ২৪ ঘন্টায়।

একটা কিছু আসবে এক্সপেক্ট করেছিল ও। মেয়েটার সাথে কথা বলে শুধু যে ওর ভালো লেগেছে তা নয়। ওর মনে হল অনন্যারও ভালো লেগেছে। কে জানে। নারী চরিত্র বেজায় জটিল! রবীন্দ্র সদনের কাজ সেরে মেট্রো স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগেই একটা ফোন বেজে উঠল ওর। অচেনা নাম্বার। বুঝতেই পারল কে ফোন করেছে। যাক। তাহলে মিথ্যে বলেনি মেয়েটা।

“হ্যালো” ও প্রান্ত থেকে একটা মেয়ের গলা শোনা গেল।

সায়ন্তন বলল, “হ্যালো! অনন্যা?”

ও পাশ থেকে উত্তর এল, “অনন্যা? না আমি সন্দীপ্তা বলছি। BGM থেকে।”

BGM বলতেই ওর মনে পড়ল যে কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়ে এল সেটার নামই BGM.

“হ্যাঁ বলুন।” সায়ন্তন বলল

–       আপনি অনন্যা বললেন…

–       নাহ নাহ। ওহ কিছু না। বলুন আপনি।

মেয়েটি এবার বলল, “আপনাকে আগামী সোমবার একবার আসতে হবে আমাদের অফিসে।”

সায়ন্তন বলল, “কেন? কিছু দরকার?”

–       হ্যাঁ। আপনার সাথে ফাইনাল কথা বার্তা বলা হবে। স্টাইপেন্ড, কাজের ধরন এবং জয়েনিং নিয়ে।”

–       আচ্ছা ঠিক আছে। Thanks.

কি বালের চাকরি তার আবার কাজের ধরন, জয়েনিং! লাইফের প্রত্যেকটা স্টেপ প্ল্যান করে চলতে হয়। স্বপ্ন দেখতে হয়। তবেই একটা জায়গায় পৌঁছানো হয়। ওই যে শাহরুখ খান বলেছে না “Agar Kisi Cheez ko Sacche Dil se Chaho to puri kaynaat use tumse milane ki kosis me lag jati haan” কাজেই ওই যে পেন্টিং কম্পিটিশন ওখান থেকে টাকা পেলে ব্যবসাটা শুরু করতেই হবে।

ওর চিন্তার তার কাটলো ফোনের আওয়াজে। ফোন বের করে করে দেখল রূপসা ফোন করছে।

–       বল?

–       কখন ফিরবি?

–       এই তো মেট্রোয় উঠবো এবার। কেন?

–       তাড়াতাড়ি আয়। আমার ক্ষিদে পেয়েছে।

–       তো তুই খেয়ে নে না।

কথাটা বলেই ওর মনে পড়ল রূপসা কখনও একা খায় না দুপুরে। ও বাড়িতে খেলে ওর সাথেই খায়। যাক কারুর তো ওকে মনে আছে।

“কি হল জানাস আমায়!।” রূপসা বলল।

মেয়েটা আজকে বেশ একটু টেনশনে আছে বলেই মনে হচ্ছে। আজ বেঙ্গল আর্টিস্ট ফোরামের পেন্টিং exhibition। রবীন্দ্র সদনেই গগনেন্দ্র প্রদর্শনশালা তে হবে। সব কটা ছবি থাকবে ডিসপ্লে তে। প্রচুর লোক আসবে বাইরে থেকে।

সায়ন্তন জানে রূপসা মুখে যাই বলুক ও চায় যে সায়ন্তনের এই স্বপ্নটা সত্যি হোক। ওই বিচ্ছিরি চাকরি ও করুক এটা রূপসাও চায় না। সব কিছুর ফয়শালা হয়ে যাবে আজ। দেখা যাক কী হয়!

ও হ্যাঁ। সায়ন্তন কয়েক দিন হল ও জয়েন করেছে BGM এ। ওকে কিছু অ্যাড ডিজাইন করতে হয় কম্পিউটার এ। মূলত ফটোশপেরই কাজ। খুব একটা চাপ হয় না। তবে টাকাও খুব বেশী দিচ্ছে না। আজ যাবেনা সেটা আগে থেকে বলেনি ও অফিসে। ভেবেছে যদি আগে শেষ হয়ে যায় তাহলে চলে যাবে। তাহলে ছুটি টা ক্যানসেল হবেনা। আর যদি প্রাইজ পায় তাহলে তো আজকেই গিয়ে রেজিগনেশন লেটার টা দিয়ে আসবে।

ও গিয়ে দেখল সব পেন্টার রা অলরেডি চলে এসেছে। নিজেদের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনও খুব বেশী লোক আসেনি।

ওর পেন্টিং টা দেখলো রাখা রয়েছে ওই হলঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। ও গিয়ে দাঁড়ালো নিজের ছবির কাছে। কিছু লোকজন চলে এসেছে। ঘুরে ঘুরে দেখছে পেন্টিং গুলো। দু’একটা প্রশ্ন করছে পেন্টার কে। ওর কাছেও এলো কয়েকজন। ও যতটা সহজ ভাবে পারলো সেভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করল ওর ছবির বিষয়।

কিন্তু সব কিছু তো প্ল্যান করে হয় না। সব স্বপ্নও সত্যি হয় না। অগত্যা বিকেলে হল থেকে বেরোবার সময় স্বপ্ন আর রেজিগনেশন লেটার টা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ও চলল অফিসের উদ্দেশ্যে।

রূপসা ফোন করল তারপরেই।

–       বল।

–       কী হল?

–       কিচ্ছু না।

“কিচ্ছু না?” ওর গলাটা একটু হতাশ শোনাচ্ছে কী? হবে হয়তো।

সায়ন্তন বলল, “নারে কিচ্ছু না।”

হঠাৎই একটা বিপ বিপ আওয়াজ শুনে সায়ন্তন কান থেকে ফোন টা নামিয়ে দেখল ফোন এসেছে আর একটা। ওয়েটিং। নাম্বার টা সেভ নেই যদিও। তবে ওর চেনা। সন্দীপ্তা ফোন করছে। নিশ্চয় অফিস যেতে লেট হয়েছে বলে।

রূপসা কে রাখতে বলে ওই ফোন টা ধরেই সায়ন্তন বলল, “হ্যাঁ সন্দীপ্তা। আমি আসছি।”

ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, “ডেট নাকি?”

মুহুর্তের জন্য ঘড়িগুলো থেমে গেল কী? পৃথিবীটা থেমে গেল, চারপাশের গাড়ি ঘোড়া গুলো স্লো মোশনে চলতে শুরু করল এটা ও হলফ করে বলতে পারে।

ঠিক শুনেছে কিনা সেটা আর একবার বোঝার চেষ্টা করে বলল, “হ্যালো? কে?”

ও প্রান্ত থেকে বলল, “আমি সন্দীপনের সাথে কথা বলছি তো?”

সায়ন্তন হেসে বলল, “হ্যাঁ। একদম। ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছো। কিন্তু তোমার এই নাম্বার টা দেখে অন্য একজনের নাম্বার মনে হল।”

–       সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারন নাম্বার টা পুরোটাই এক। শুধু আমার ফোন নাম্বারের শেষের নাম্বার টা ৭ আর তুমি যার কথা বললে তার ৮।

সায়ন্তন এবার অবাক হল, “তুমি সন্দীপ্তার নাম্বার জানলে কীভাবে? অফিস থেকে কী ফোন করেছিল তোমাকেও?”

অনন্যা বলল, “আমার এক্স এর নাম্বার আমি জানবো না তা কী করে হয়?”

সায়ন্তন এবার যেন আকাশ থেকে পড়ল, “মানে? তোমার এক্স মানে? বুঝলাম না… তুমি… লেসবিয়ান?”

–       বাইসেক্সুয়াল। মানে…

–       জানি। বাইসেক্সুয়াল মানে আমি জানি।

“বাহ! এই তো হিরোর মত কথা।” অনন্যা বলল, “ফোন না করার জন্য সরি। আসলে সন্দীপ্তার সাথে শেষ টা খুব একটা ভালো হয় নি। দেখলে তো অফিসে কী হল সেদিন। সেই জন্যেই আরও ফোন করিনি। কারন…”

“বলছিলাম যে” সায়ন্তন থামালো ওকে, “বিরিয়ানি খাবেন?”

অনন্যা বোধহয় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। বলল, “হ্যাঁ খেতেই পারি। কোথায়?

–       পার্ক সার্কাস আর্সেলান এ, কতক্ষনে আসতে পারবে ?।”

অনন্যা একটু ভেবে বলল, “ঐ… আধঘন্টা!”

–       চলে এসো। বাকি কথা বিরিয়ানির সাথেই হোক না হয়।

–       ঠিক আছে। আসছি।

ফোন টা রেখে একবার গগনেন্দ্র প্রদর্শনশালার দিকে ফিরে গেল সায়ন্তন। স্বপ্নটা ডাস্টবিনে ফেলা ঠিক হয় নি। কখন কোন টা সত্যি হয়ে যায় বলা যায় না!

একটি অদ্ভুত গল্প

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি