আজ কলেজ থেকে বেরোতে খুব দেরী হয়ে গেল অবিনাশবাবুর। এখন আবার ওকে দমদম গিয়ে কল্যানী সীমান্ত লোকাল ধরে বাড়ি ফিরতে হবে। আজ যে ঠিক কী কারনে এত দেরী হয়ে গেল অবিনাশ বাবুর সেটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না তিনি। কিছু খাতা দেখা বাকি ছিল বটে কিন্তু সে তো হাতে গোনা ৬ টা খাতা। তার জন্য এত দেরী হওয়ার তো কথা নয়। সবাই বলে বয়স হলে নাকি স্মৃতিশক্তি কমে যায়। কিন্তু ৪১ এমন কি বেশি বয়স যার জন্য স্মৃতিশক্তি লোপ পাবে!

মনীন্দ্র কলেজ থেকে শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনটা একেবারে কাছে। স্টেশনে ঢোকার সাথে সাথেই মেট্রো পেয়ে যাওয়ার সময় সবে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন অবিনাশ চ্যাটার্জী। এমন সময় বুকের বাঁ দিকে একটা হালকা ব্যাথা টের পেলেন তিনি। রোগ জ্বালার বালাই খুব একটা নেই ওঁর। কলেজে আজ চিকেন কাটলেট খেয়েছিলেন তার থেকেই কী কিছু সমস্যা হল? এর সাথে তিনি আরও একটা বাজে ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তার শার্টের পকেটের কাছে একটা লাল দাগ। সম্ভবত কাটলেট খাওয়ার সময় টমেটো সস পড়েছে। এবার একটু বিরক্ত লাগল ওঁর।

একে তো আজ ৯ টা বেজে গেছে কলেজ থেকে বেরোতে বেরোতে। তার মানে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটা বাজবে। তার ওপর সদ্য কাচা জামায় দাগ দেখলে ওনার স্ত্রী আবার একটা গোলমাল বাধাবেন।

এসব ভাবতে ভাবতেই ওনার খেয়াল হল মেট্রো বেলগাছিয়া পেরিয়ে মাটির ওপর উঠতে শুরু করেছে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। নেমেই দৌড়তে হবে। নাহলে ৯ টা ৫ এর ট্রেনটা পাওয়া যাবে না। এই সময় ডানদিকে চোখ পড়তেই মেয়েটাকে দেখতে পেলেন অবিনাশবাবু। আরে! এই মেয়েটা ওরই ডিপার্টমেন্টের না! নামটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। তবে ওনার যতদূর মনে আছে মেয়েটা থাকে টালিগঞ্জে। একদিন লেট করে আসার জন্য বকুনি খাওয়ার পর এই অজুহাতটাই দিয়েছিল।

রাত ৯ টার সময় এ মেয়ে দমদম এ কি করছে?       

***

–      Come On! Let’s Do This. এত ভাবিস না। কিচ্ছু হবে না।

–      কিন্তু…

–      দেখ সব কিছুই তো প্রথমবার হয়। আর এখন Sex is not a big deal.

–      I can’t. I’m Sorry!

–      Okay Then you leave me no choice. You can go.

–      না না। Please Don’t do This.

–      শোন সুদীপ্তা একটা কথা বলি। This is the only way. সময় নেই আমার হাতে বেশী।

       ২

অবিনাশবাবু ক্লাসে সব সময় ঠিক টাইমে ঢোকেন। উনি বোঝেন এতে ক্লাসের ছেলে মেয়েরা বিরক্ত হয়। কিন্তু উনি পাত্তা দেন না। আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। ক্লাসের টাইমের ঠিক ২ মিনিটের মধ্যেই অবিনাশবাবু ক্লাসে ঢুকলেন। যথারীতি ছাত্র ছাত্রীরা বিরক্ত।

ক্লাসে ঢুকেই অবিনাশবাবু জানিয়ে দিলেন আর ৬ টা খাতা দেখতে বাকি আছে। আজ রাতেই সেগুলো দেখে উনি কাল ক্লাসে দিয়ে দেবেন খাতা গুলো। তখনই সবাই জানতে পেরে যাবে যে কারা কারা ইউনিভার্সিটি পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাচ্ছেনা এবার।

আগের দিন করানো অঙ্ক থেকে ২ টো অঙ্ক করতে দিলেন অবিনাশবাবু। সামনের বেঞ্চে বসে থাকা ২ জন ছাত্র ছাত্রী অবিরাম গল্প করে যাচ্ছিল দেখে অবিনাশ বাবুর বেশ রাগ হল। এদের কি নূন্যতম সম্মান দেওয়ার ক্ষমতা নেই একজন অধ্যাপক কে? ছেলে মেয়ে দুজনেরই নাম জানেন তিনি। অনুব্রত আর সুদীপ্তা।

কিছু কথা টুকরো টুকরো ভাবে কানে আসছিল ওনার।

অনুব্রত।। কী রে? আজ আসছিস রাতে?

সুদীপ্তা।। কালকের পর আবার আজ? একদিন করেই খুব শখ না?

অনুব্রত।। আরে হ্যাঁ। মারাত্মক ভাল লেগেছে বিশ্বাস কর।

অবিনাশ বাবুর বুঝতে অসুবিধা হল না ওরা কী নিয়ে কথা বলছে। আর থাকতে পারলেন না তিনি। চেঁচিয়ে বললেন, ‘অনুব্রত Get Out!’

অনুব্রত একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “কেন স্যার? আমি কী করলাম?”

“তুই কি করলি? বলব আমি ক্লাস ভর্ত্তি লোকের মাঝখানে? Just Get the hell out of my class.” তারপর একটু থেমে বললেন, “And Sudipta, meet me after college. দেখা না করে বাড়ি যাবি না আজ তুই।”

এতক্ষনে নামটা মনে পড়ল অবিনাশ বাবুর। সুদীপ্তা চক্রবর্তী। আজ বিকেলে ক্লাসের পর ওকে দেখা করতে বলেছিলেন। কিন্তু কেন বলেছিলেন সেটা আবার মনে পড়ছিল না ওর। নাহ্‌ এবার ডাক্তার দেখাতেই হবে। এই রোগটা না সারালে উনি আর ছাত্র পড়িয়ে খেতে পারবেন না।

মেয়েটা কোন একটা কারনে খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিল। তাই প্ল্যাটফর্মের ভীড়টা হালকা হতেই সুদীপ্তাকে আবার দেখতে পেলেন তিনি। এবার একটু দ্রুত পা চালালেন অবিনাশবাবু।

ডাকতে যাচ্ছিলেন পেছন থেকে এমন সময় একটা ফোন আসতে উনি একটু দাঁড়িয়ে গেলেন। পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখলেন স্ত্রী ফোন করছে। বুঝতে পারলেন আজ ভাগ্যে দুঃখ রয়েছে।

“বল”

“কোথায় আছো?”

“এই তো দমদম এ। ট্রেনে উঠে গেছি। আসছি আমি।”

আর কিছু না বলে ও প্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হল। ইচ্ছে করেই মিথ্যে বললেন অবিনাশবাবু। মাঝে মাঝে মিথ্যে টা খুব জরুরী।

পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে দেখলেন এর মধ্যেই মেয়েটি অনেকটা এগিয়ে গেছে। ও এখন প্রায় সিঁড়ির কাছে। এবার দ্রুত পা চালালেন অবিনাশ বাবু।

“এই যে… সুদীপ্তা?”

পেছন থেকেই ডাকলেন অবিনাশবাবু। ডাকার পরেই বুঝতে পারলেন বুকের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে। এবার ব্যাপারটা আর ব্যাথায় থেমে নেই। একটা চিনচিনে যন্ত্রনায় পরিনত হয়েছে সেটা। শার্টের দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল হল লাল সসের দাগটাও বেশ ছড়িয়েছে অনেকটা।

***

–      May I Come In Sir?

–      ও সুদীপ্তা? হ্যাঁ আয় আয়। দরজাটা ভেজিয়ে দে।

–      বলুন কী বলবেন?

–      Listen তোর খাতার অবস্থা খুব খারাপ। এবার মনে হয় তোর পরীক্ষায় বসা হবে না।

–      Why Sir?

–      Because You have written nothing in your paper. কিচ্ছু নেই। পড়াশুনো করেছিস আদৌ? নাকি সারাদিন…?

যাই হোক শোন। পরের বার পরীক্ষা দিস।

–      Please এরকম করবেন না স্যার। আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি আর একবার পরীক্ষা দেব। ভালভাবে পড়ে।

–      Nare. Sorry. আমার হাতে কিছু নেই। আমায় marks জমা দিতে হবে। তারপর কলেজের দায়িত্ব।

তবে…

–      তবে?

–      আমি সব কিছু direct বলতেই ভালবাসি। তাই বলছি। তুই যদি আমায় কিছু দিস এর বদলে। তাহলে হয়ত তোর পরীক্ষায় বসাটা আটকাবে না।

–      What do you mean by আমি যদি কিছু দিই?

–      তুই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিস আমি কিসের কথা বলছি।

[সুদীপ্তা চুপ করে থাকে]

–      Come On! Let’s Do This. এত ভাবিস না। কিচ্ছু হবে না।

–      কিন্তু…

–      দেখ সব কিছুই তো প্রথমবার হয়। আর এখন Sex is not a big deal.

–      I can’t. I’m Sorry!

–      Okay Then you leave me no choice. You can go.

–      না না। Please Don’t do This.

–      শোন সুদীপ্তা একটা কথা বলি। This is the only way. সময় নেই আমার হাতে বেশী।

“এই সুদীপ্তা”

অবিনাশবাবু এবার পেছন থেকে কাঁধে হাত দিলেন মেয়েটির। মেয়েটা হাঁটা থামিয়ে পেছন দিকে তাকাল।

“কীরে? এত রাতে এখানে কী করছিস?”

মেয়েটি অদ্ভুত এবং করুন একটা চোখে তাকিয়ে রইল অবিনাশবাবুর দিকে। এমন সময় হঠাৎ মেয়েটির হাতের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলেন তিনি। এই জুন মাসের গরমেও মেরুদন্ড বেয়ে বরফ শীতল ঠান্ডা একটা হাওয়া বয়ে গেল। মেয়েটির হাতে একটা মাঝারি সাইজের কাঁচি। এই কাঁচিটাই কলেজের Math ডিপার্টমেন্টের ঘরে থাকে যেখানে আজ বিকেলে উনি দেখা করতে বলেছিলেন সুদীপ্তা কে। আস্তে আস্তে সবটা মনে পড়ে গেল অবিনাশ বাবুর।

                                      ***

মৃত্যুর আগে এক মুহুর্তের জন্য জ্ঞান ফিরেছিল অবিনাশবাবুর। খুব জোর একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার পরেই সব নিস্তব্ধ হয়ে যায় আবার। ফুলহাতা শার্টের প্রায় পুরোটাই রক্তে ভিজে গিয়েছিল। এবং ওনার কলেজের ঘরেই ওনার দেহের পাশে একটি কাঁচি পাওয়া যায়। জানলা দিয়ে ঘরে ঢোকা জোৎস্নার আলোতেও তাতে রক্তের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।

মৃত্যু-ভ্রম

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


One thought on “মৃত্যু-ভ্রম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি