নিজের ছোট্টো গুমটির মত ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল লাবন্য।  বিকেল থেকেই আজ ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। অবশ্য বৃষ্টি পড়া বা না পড়ার সাথে ওর  কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। ওকে সবদিনই এই সন্ধ্যের সময় বড় রাস্তাটার ধারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। এই সময়টা অনেকেই অফিস থেকে ফেরে। তাদের এক-আধজনকে যদি বিক্রি করতে পারে। তাহলেই ওর প্রায় ২-৩ দিনের খাওয়া-দাওয়ার আর কোনো চিন্তা নেই। হ্যাঁ, বিক্রিই বটে। টাকার বিনিময়ে নিজের শরীর বিক্রি। মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে ওর কোন বাড়ির মেয়ে ছিল ও। আর আজ ও কোথায় নেমে এসেছে কিংবা বলা ভাল জীবন ওকে কোথায় নামিয়েছে।
“কিরে মাগী? আর কতদিন মাসির পয়সা মেরে খাবি? খদ্দের জোটা কিছু।” পেছনে চেনা গলার আওয়াজ শুনে ফিরে তাকাল লাবন্য।  কথাটা বলেছে কুসুম। ও কিছু জবাব দিল না। এ মেয়েটাকে ওর সহ্য হয়না। সব সময় কেমন যেন ঠেস দিয়ে কথা বলা স্বভাব। আসলে ও আসার আগে সম্ভবত মাসির সবচেয়ে প্রিয়পাত্রী ছিল কুসুম। কিন্তু যেদিন থেকে ও এখানে এসেছে তারপর থেকে মাসি ওর প্রতি আর অতটা নজর দেয়না। তাই ওর সমস্ত রাগ লাবন্যর ওপর।
আস্তে আস্তে রাস্তার ধারে রেলিং ঘেরা ফুটপাথে এসে দাঁড়াল ও। লোকজন খুব কম আজ। বৃষ্টির জন্যেই বোধহয়।  নাহ! আজকেও বোধহয় ওর ভাগ্যে নেই। ৬ দিন হয়ে গেল একটা খদ্দেরও জোটাতে পারেনি ও।         নেহাৎ রানু মাসি আছে তাই খেয়ে পরে বাঁচতে পারছে। রানুমাসিই এখানকার সর্বেসর্বা। কেন যে মাসি এতটা ভালবাসে তার কারন ও আজ অবধি জানেনা। শিলিগুড়ি থেকে চলে আসার পর হাওড়া স্টেশনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল ও। ৩ দিন পেটে জল ছাড়া আর কিছু পড়েনি। আর ও খুব ভাল করে জানত ভিক্ষাবৃত্তি ওর দ্বারা হবেনা। সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। স্টেশনে রাখা একটা ঠেলাগাড়ির ওপর বসে বসে মানুষদের আসা যাওয়া দেখছিল ও। হঠাৎই ওর কানে যায় ফোন কানে একজন মহিলা কাউকে যেন বলছেন, “মেয়ে দিতে পারবি না মানে? অতগুলো টাকা নিয়ে এখন চুকলিবাজি করা হচ্ছে! কালকের মধ্যে আমার মেয়ে চাই।” তারপর যে কিভাবে সব হয়ে গেল ও নিজেরও ভাবতে অবাক লাগে। ও হঠাৎই যেন এক ঘোরের মধ্যে ওই মহিলার পায়ে গিয়ে পড়ে যায়। পাগলের মত বলতে থাকে, “আপনার মেয়ে লাগবে তো কাজের? আমি কাজ করব। আমায় নিয়ে চলুন। আমি সব কাজ পারব।”
ওই মহিলা প্রথমে একটু ঘাবড়ে যান তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, “না না। আমার কাজের মেয়ে লাগবেনা চল যা! ঝামেলা করিস না।” ও তাও ওই মহিলার পা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে। স্টেশনের সমস্ত লোক অবাক হয়ে দেখছিল সেই দৃশ্য। তারপর হঠাৎ ওই মহিলা ওর চুলের মুঠি ধরে ওর মাথাটা পা থেকে সরিয়ে দেন। ও আর পারেনা। ওইখানেই শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে ওর।
যখন চোখ খুলল তখন দেখে একটা ছোট্টো গুমটির মত ঘরের তেল চিটচিটে তক্তপোষে শুয়ে আছে। পাশে বসে রয়েছে স্টেশনের সেই মহিলা। পরে ও জানতে পারে উনি এখানে রানুমাসি নামে পরিচিত। সেদিন রানুমাসির সাথে আর একটা মেয়েকে দেখেছিল ও। কুসুম। রানুমাসি চলে যাওয়ার পর ওকে লাবন্য জিজ্ঞেস করেছিল “এই জায়গাটা কোথায়?” মেয়েটি ফিক করে হেসে বলেছিল, “আমরা বলি স্বর্গ। তবে লোকে এই জায়গাটাকে বলে সোনাগাছি।” তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল কুসুম নামের মেয়েটি। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে উঠেছিল ওর। কি? সোনাগাছি? শেষ অবধি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এখানে বেশ্যাবৃত্তি করতে হবে? ক্ষনিকের জন্য ওর ভাবনা-চিন্তাগুলো যেন মরে গিয়েছিল। তারপর… তারপর বাকিটা ইতিহাস। দু’মাস হয়ে গেল ওর এই স্বর্গে। ২-৩ বার পালাবার চেষ্টা করেছে, ধরা পড়েছে। মার খেয়েছে এখানকার লোকেদের হাতে। রানু মাসির কাছে কাজ করে লোকগুলো। ওদের কাজ হচ্ছে দালালি করা মানে দালালি করে ছেলে জুটিয়ে আনা। শেষবার যেবার ও ধরা পড়েছিল পালাতে গিয়ে সেবার ওকে প্রচন্ড মেরেছিল ওদেরই একজন। রানু মাসি কিছু বলেনি তাকে।  তারপর বুঝে গেছে ও এটাই ওর ঘর। এই স্বর্গেই কাটবে ওর বাকি জীবন।
“কি রে? কি ভাবছিস?” কুসুমের ডাকে সংবিৎ ফিরল ওর।
দেখল ওর ঠিক পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুসুম। পরনে একটা টাইট গোলাপী রঙ এর গেঞ্জি। আর নীল শর্ট স্কার্ট।
ও একটু ম্লান হেসে উত্তর দিল, “না। কিছু না”
“বাড়ির কথা মনে পড়ছে নারে?”
অবাক হল লাবন্য। কুসুম ওর সাথে এভাবে কখনও কথা বলে না। ওকে তো পছন্দই করেনা ও। সবসময়ই অপমান করে। আজ কি হল ওর?
কুসুম বোধহয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, “তোকে আমি ঘেন্না করি না রে। তোকে আমার শ্ত্রুও ভাবিনা। মাঝে মাঝে তোকে দেখে খুব হিংসে হয়।”
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল লাবন্য। ওর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। কেমন যেন যন্ত্রচালিত হয়ে যাচ্ছে ও দিনকে দিন।
“হ্যাঁরে সত্যি হিংসে হয়। তুই আমাদের অনেকের থেকেই খুব ভাল দেখতে। তোকে আমাদের মত টাইট টাইট জামা তোকে পরতে হয়না, আমাদের মত মুখে রঙ মাখতে হয়না। আমাদের মত লোকের পেছনে কুকুরের মত তোকে ঘুরতে হয়না। রানু মাসিও তোকে এত ভালবাসে। সেই জন্যেই মাঝে মাঝে তোকে উল্টোপাল্টা বলে ফেলি রাগে। কিন্তু আমি তোর ক্ষতি চাই না রে।”
“কিন্তু তাও তো আমার কাছে লোকে।” হতাশ গলায় বলল লাবন্য।
কুসুম এবার ওর পিঠে হাত রাখল। বলল, “তুই কি ভাবছিস আমরা এগুলো মনের আনন্দে করি। আমরা কেউ করিনা। কেউ নয়। সম্মান তো অনেক আগেই চলে গেছে। খেতে পাব বলে এখানে এসেছি। আচ্ছা, তুই তো ভদ্রবাড়ির মেয়ে। এখানে কেন এলি তুই ? আর কোথাও জায়গা পেলিনা মরতে?”
কেন এল এখানে ও? কি বলবে ও? বলবে মা-বাবা মারা যাওয়ার পর কিছুদিন আমানুষিক অত্যাচারের পর ওর কাকু ওকে মেয়ে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিতে গিয়েছিল? একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। বলল, “ তুই কিভাবে এলি এখানে?”
কুসুম কোমর থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে একটা টান মেরে বলল, “আমি…” তারপর কিছুক্ষন চুপ। তারপর দীর্ঘশ্বাসের সাথে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে
বলল, “যখন স্কুলে পড়তাম আমাকে তো শালা রেপ করেছিল ৪ টে জানোয়ার। তারপর অজ্ঞান করে এখানে বিক্রি করে দিয়ে গেছিল।  এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করেছি কয়েকবার। ধরা পড়েছি। ক্যালানি খেয়েছি। তারপর বুঝে গিয়েছি শালা এখানেই পচতে হবে বাকি জীবন।”
লাবন্যর চোখে জল চলে এল। কুসুমের হাতের সিগারেটটা কিছুটা পুড়ে গিয়েছে। বাকি সিগারেটটা ফেলে ও লাবন্যর চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর বলল, “কাঁদিসনা রে বোন। আমার প্রথম প্রথম খুব কান্না পেত। এখন চোখের জল শুকিয়ে গেছে।”
এখানে যখন ও প্রথম আসে তখন লাবন্যর মনে হত ওর মত জীবন হয়ত কারুর নয়। ও ভাবত ওর মত কষ্টকে এত কাছ থেকে কেউ দেখেনি। কিন্তু আজ ওর এই ভুল ধারনাটা কিছুটা হলেও ভাঙল।
“তোর জুতোটা খুব সুন্দর” কুসুম হঠাৎ বলল, হয়ত পরিবেশটা হালকা করার জন্য। একটু হেসে নিজের পায়ের দিকে তাকাল ও। এই লালজুতোটা ওর ভীষন প্রিয়। বাবা-মার স্মৃতি বলতে ওর কাছে এখন এটাই শেষ সম্বল। মাথা তুলে এবার রাস্তার দিকে তাকাল লাবন্য। কত লোক হেঁটে যাচ্ছে। কেউ কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে আড়চোখে। কেউ বা কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎই ওর চোখ গেল। মায়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে যাওয়া একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে বলছে “তুমি কেন কিছু আনোনি আমার জন্যে। তুমি তো আনবে বলেছিলে?”
আর বাচ্চাটার মা তাকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। চুপ করতে বলছে।  ওর মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা। সেটা ছিল মার্চ মাসের কোনো একটা দিন। মা-বাবার গ্যাংটক যাওয়ার কথা ছিল। বাবার কি একটা অফিসের কাজ পড়েছিল গ্যাংটকে। ৫ দিনের জন্য যাচ্ছিল। মাকেও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল ওকে কাকু-কাকিমার কাছে রেখে। ওর স্কুলের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা থাকায় ও যেতে পারেনি। মা যাবার আগে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল “তোর জন্য কি আনব বল?”
ও গম্ভীরভাবে বলেছিল , “কিছু আনতে হবেনা। ফিরে এসে আমায় টাকা দিও। আমি নতুন কয়েকটা গল্পের বই কিনব।”
মা অবাক হয়নি অবশ্য। এটা ওর চিরকালের নেশা। গল্পের বই পেলে পুরো দুনিয়াকে ভুলে থাকতে পারে ও। মা হেসে তক্ষুনি ব্যাগ থেকে বের করে টাকা দিতে গিয়েছিল। ও মাকে থামিয়ে বলেছিল, “এখন চাইনি আমি। ফিরে এসে দিও আমায়।”
ফিরে অবশ্য আর বাবা-মা আসেনি।  গ্যাংটকে এ একটা খুব বড় ভূমিকম্প হয়েছিল সেবার। পেলিং বলে একটা ছোট্টো শহর মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। খোঁজ পাওয়া যায়নি আর বাবা-মার।
“এই রে? মেয়ে কেস।” কুসুমের কথায় আবার বাস্তবে ফিরে এল ও।
“ মেয়ে কেস মানে?”
“আরে ওই যে ছেলেটা আসছে এদিকে। শালা নিশ্চয় কোনো মেয়ে ছেড়ে পালিয়েছে। তাই ব্যাটা এখানে মরতে এসেছে। ও আমি দেখেই বুঝে গেছি। অনেক কেস দেখেছি এরকম আমি।”
লাবন্য তাকাল ছেলেটার দিকে। লম্বা চেহারা। চোখে চশমা। পা’টা একটু একটু টলছে মনে হয়। এদিকেই আসছে।
“শোন। অনেক দিন তোর জোটেনি। যদি এখানে আসে ওটাকে তুই সামলাস। আমার আজ ভাল লাগছেনা। কালকেই একটা মোটা লোক অবস্থা খারাপ করে দিয়ে চলে গেছে।”
লাবন্য কিছু না বলে খুব আস্তে আস্তে একবার ঘাড়টা নাড়াল। কুসুমের অনুমানই ঠিক হল। ছেলেটা আস্তে আস্তে এসে দাঁড়াল কুসুমের সামনে।

এই রাস্তার সিগন্যাল গুলো কী লাল হবেনা। ওহ! গাড়ি আসছে তো আসছেই। মাথা গরম হয়ে যায় শালা। রাস্তা পেরোবে বলে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে ও। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল অরন্যর। আচ্ছা এই গাড়িগুলোর একটার নিচে চলে গেলে হয় না? তাহলেই তো ওর কাজ সম্পূর্ন হয়ে যাবে। পরক্ষনেই ওর মনে পড়ল, কি ভাবছে কি ও? মরার আগে আরও একটা কাজ তো ও করবে ঠিক করেছে। ওটা না করে মরা যাবেনা। কোনোভাবেই না। অন্যমনস্কভাবে দু’দিকে মাথা নাড়ল অরন্য।
ঢুলুঢুলু চোখে একবার ট্র্যাফিক লাইটের দিকে তাকাল ও। নাহ! আজ শালাদের মেশিনে গোলমাল হয়েছে মনে হয়। সবুজ আর লাল হবেনা। পেছনে একটা পেট্রোল পাম্প। রাস্তার পাশেই একটা হলুদ ট্যাক্সি রাখা আছে। ড্রাইভারটাও নেই দেখে ট্যাক্সিটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ও। সোজা হয়ে ও আজ বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারছেনা। প্রথমবার ড্রিঙ্ক করার সাইড এফেক্ট বোধহয়। একটু দূরের সেই দোকানটার দিকে তাকাল অরন্য। ওই দোকানটা থেকে ও একটু আগেই বেরিয়ে এসেছে। কত লোক ঢুকছে কত লোক বেরোচ্ছে এখনও। হঠাৎ ওর মনের মধ্যে একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন ভীড় করে এল। এই যে লোকগুলো ওই দোকনে মদ খেতে ঢুকছে ওদের সবারই কি জীবনটা শেষ হয়ে গেছে ওর মত, সবাই কি ওর মত থার্ড ইয়ারের পরীক্ষায় ফেল করেছে নাকি সবারই বাবা ওদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।
“ক্যায়া ভাইসাব কাঁহা জায়েঙ্গে?” অরন্য দেখল প্রশ্নটা করেছে ট্যাক্সির ড্রাইভার। সে ইতিমধ্যেই ফিরে এসেছে। হাতে কাগজে মোড়া ওটা কি? মদের বোতল হবে হয়ত। আজকাল সবাই মদ খাচ্ছে। ড্রাইভার সাহেবের কোঁচকানো ভুরু দেখে অরন্য বুঝতে পারল লোকটার ওর এই ট্যাক্সিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। অরন্য ভাবল আজ ওর জীবনের শেষ দিনে একটা শেষবারের মত একটা মজা ও করবে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আড়চোখে দেখল সিগন্যাল লাল। ও গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে  বলল, “ড্রাইভারসাব ধর্মতলা যাওগে?”
ড্রাইভার হঠাৎ “হাঁ জরুর যায়েঙ্গে” বলে  তাড়াহুড়ো করে নিজের ট্যাক্সিতে উঠে বসল। অরন্য মুচকি হেসে বলল, “তো যাও না। ইঁয়াহাপর ক্যায়া কর রহে হো?”
তারপর আর একমুহুর্ত না দাঁড়িয়ে রাস্তা ক্রস করল। শুনতে পেল ড্রাইভার তখন পেছন থেকে ওর বাবা-মা উদ্ধার করে দিচ্ছে গালাগালিতে।
রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাথ এর পাশ দিয়ে ও এগিয়ে যাচ্ছিল গিরিশ-পার্ক মেট্রোর দিকে। ও জানে এখানেই আছে ওর শেষ ইচ্ছে পূরনের জিনিস। একটু হাঁটার পরেই ও দেখতে পেল ডানদিকে পর পর যেন লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মুখে রঙ মেখে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক মেখে, টাইট টাইট জামা পরে সবাই তাকিয়ে আছে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা মানুষদের দিকে ও ভেবে পেলনা, এরা কি করে একজন মানুষকে শারীরিক সুখ দিতে পারে? এখানে আসেও বা কারা? তারপরেই নিজের মনে মাথা নেড়ে চিন্তা করল আজ ওর এসব ভাবলে চলবে না। আজ ও নিজেও এখানে এসেছে যৌন ক্ষিদে মেটানোর জন্য। আজ ওকে এদেরই মধ্যে কাউকে একটা পছন্দ করতে হবে। ও দেখল একটু দূরেই দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। একজন পরে আছে গোলাপী রঙ এর একটা টপ আর নীল স্কার্ট। আর পাশের জন একটা ময়লা-সাদা টপ আর কালো স্কার্ট। ও এগিয়ে গেল গোলাপীর দিকে।
সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পর কি বলবে আর বুঝতে পারছিলনা ও। কীভাবে বলবে ও? মেয়েটিই প্রথম কথা বলল, “কতক্ষন?”
“অ্যাঁ? কি?”
মেয়েটির এবার ভুরুটা কুঁচকে গেল। “কতক্ষনের জন্য” আবার জিজ্ঞেস করল সে।
“ও আচ্ছা! আজ রাতের জন্য।”
“সারা রাত?”
এবার একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল ও। এই রে! এর কি উত্তর হয়?
বলল, “না মানে হয়ে গেলেই চলে যাব।”
“ঠিক আছে। ৫০০ টাকা লাগবে। ও যাবে।” বলে পাশের মেয়েটিকে দেখাল গোলাপী জামা পরা মেয়েটি। ওহ! যেন টালিগঞ্জ এর অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর ভাল করে ও দেখল পাশের মেয়েটিকে। মনে হয় চার্লি চ্যাপলিনের কোনো একটা সিনেমায় ঠিক এরকম একজন নায়িকা দেখেছিল ও। নামটা সেই মুহুর্তে মনে পড়ল না। তারপরেই ওর খেয়াল হল ওর কাছে তো ৩০০ টাকার বেশি নেই। এই সেরেছে। ঠোঁট কামড়ে একবার ভাবল এখানে কি ‘বারগেনিং’ হয়? একটু ভেবে মনে মনে ‘জয় মা’ অন্য মেয়েটির দিকে ফিরে বলল,
“আমার কাছে ৩০০ টাকার বেশী নেই”।
মেয়েটি ঝাঁঝিয়ে উঠল এবার, “তাহলে ফোটো তো চাঁদু। অন্য জায়গা দেখো।”
“না মানে আমি-”
“ঠিক আছে আমার অসুবিধে নেই। ও ৩০০ ই দিক” অরন্য কথা শেষ করার আগেই পাশের মেয়েটি বলে উঠল।
গোলাপী জামা পরা মেয়েটি এবার ভুরু কুঁচকে পাশের মেয়েটির দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বললনা। তারপর অরন্যর দিকে ফিরে বলল, “ঠিক আছে ওর সাথে যান।”
পাশের মেয়েটি এবার হাটতে শুরু করল গিরিশ পার্ক মেট্রোর দিকে। অরন্য যাচ্ছিল ওর পেছন পেছন। দেখতে পেল রাস্তায় কত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তাদের দিকে তাকাতে ভক্তি হচ্ছে না অরন্যর। সবাই ওর দিকে লোভী চোখে তাকাচ্ছে। কিছুটা হাটার পর মেয়েটি একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। গলিটা খুব অন্ধকার। রাস্তায় কয়েকবার হোঁচট খেল অরন্য। সেটা মানুষের সাথে না পাথরের সাথে সেটা অবশ্য ও বুঝতে পারেনি। মেয়েটি আস্তে আস্তে এসে থামল একটা ছোটো ঘরের সামনে। এখানটায় কিছুটা আলো আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে অরন্য দেখত পেল ঠিক এই ঘরটার মত অনেক ঘর রয়েছে আশে পাশে। মেয়েটি এতক্ষন একটা কথাও বলেনি ওর সাথে। ছোট্টো ঘরের চাবিটা খুলে একবার সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “আসুন।”
অরন্যর তুলনায় দরজাটা খুব ছোটো। ও মাথা নিচু করে ঘরটায় ঢুকল। ঘরটায় কোনো আসবাব নেই। শুধু একট খাট, দেয়ালের সাথে একটা তাক আর একটা দড়ি ঘরের মাঝবরাবর চলে গেছে তাতে কিছু জামাকাপড় রয়েছে। সম্ভবত মেয়েটিরই হবে ওগুলো। মেয়েটি দরজাটা বন্ধ করে দিল। ও কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। সত্যি বলতে কি ওর এবার একটু ভয় ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল কাজটা কি ঠিক করল ও। ঝোঁকের মাথায় মদ খেয়ে এখানে আসাটা বোধহয় উচিত হয়নি ওর। গা টা খুব গুলোচ্ছে? বমি হবে নাকি? রঞ্জা থাকলে কি এই কাজটা ও করতে পারত ? নাহ। কখনই পারত না। কিন্তু রঞ্জা তো থাকল না। চলে গেল। সেই যে সিকিম গেল বেড়াতে। আর তো ফিরল না। ফিরল না বলা উচিত হচ্ছেনা বোধহয়। আসল কথাটা ভগবান ফিরতে দিল না। ভুমিকম্পের আগের দিন অবধি রাত্রে ওর সাথে কথা বলে ঘুমিয়েছিল রঞ্জা। পরের দিন সকালে আর…
“আপনি বসুন এখানে।” মেয়েটির কথায় চিন্তার তার কাটল অরন্যর। বিছানায় বসল ও। মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। এরপর কথা কীভাবে শুরু করবে সেটা বুঝতে পারছিল না ও। আর কথা তো এখানে বলতে আসেনি ও। যেটা করতে এসেছে সেটাই বা কিভাবে শুরু হবে? মেয়েটাই বা এখনো কিছু বলছেনা কেন?
একটু গলাটা ঝেড়েই অরন্যই প্রথম শুরু করল কথা, “নাম কি তোমার… ইয়ে মানে আপনার?”
“এখানে আমাদের কেউ আপনি বলেনা। আপনি তুমি/তুই যা ইচ্ছে হয় বলতে পারেন। আমার নাম লাবন্য। কীভাবে করতে চান আপনি?”
শেষ কথাটা মনে হয় কানে গেল না ওর। কারন ও তখন অন্য একটা জিনিস আবিস্কার করে ফেলেছে। আরে একে তো পুরো ‘সিটি লাইটস’এর নায়িকাটার মত দেখতে। নামটা মনে হয় লীটা গ্রে। সোনাগাছির বেশ্যাপাড়ায় চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার নায়িকা। নিজের অজান্তেই মুখটা হাসিটে ভরে গেল ওর। মেয়েটি এবার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি হাসির কোনো কথা বললাম?”
“না আসলে একটা মজার কথা মাথায় চলে এল তাই…”
“কীভাবে করতে চান আপনি?”
অরন্য তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। যেটা ও আবিস্কার করেছে এইমাত্র সেটা আর চেপে রাখতে না পেরেই বলে ফেলল, “জানো চার্লি চ্যাপলিনের একটা সিনেমা আছে ‘সিটি লাইটস’। সে সিনেমার নায়িকার নাম লীটা গ্রে। তোমার মুখটা অনেকটা তার মত।”
কথাটা বলেই ওর নিজের লজ্জা পেল। কি সব বলছে ও। উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে লাভ কি লাভ? নিজের বোকামিতে নিজের আবার হাসি পেল। আর একটা জিনিস বুঝতে পারল ও। পেটের ভেতরের জিনিসগুলো একসাথে যেন গলায় উঠে আসতে চাইছে। এই রে সত্যি বমি হবে নাকি?
“না।”
লাবন্যর কথায় মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল অরন্য। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ও তাকাল তার দিকে।
“আমাকে কার মত দেখতে আমি জানিনা তবে ‘সিটি লাইটস’ এর নায়িকা ভার্জিনিয়া চেরিল। লীটা গ্রে নয়।”
মানে? কি হল কেসটা? কি বলছে কি এই মেয়েটা? এরকম জায়গায় বসে কেউ চার্লির সিনেমার ভুল ওকে ধরিয়ে দিচ্ছে? এর বেশি অবশ্য আর ভাবতে পারল না অরন্য। কারন পেটে জমে থাকা সমস্ত জঞ্জাল ওর  মুখ দিয়ে উঠে এল। চেপে রাখত পারল না আর।

প্রশ্ন

Arnab Mondal


হিজিবিজি লেখা আর বিরিয়ানি নিয়ে Phd করছি আর আকাশবাণী কলকাতায় নিজের কন্ঠস্বর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।


Post navigation


One thought on “প্রশ্ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করবেন না দাদা/দিদি